শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-১৭

0
376

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(১৭)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

কায়েস দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে ফোন বের করে কলে ডায়াল করলো।
তারপর অপরপাশে কল রিসিভ হতে বললো, সেন্টারে ফিরে আস।

ওপাশ থেকে কেউ হয়তো বলছেন যে ফাইজা কে পাওয়া গেছে কিনা?
তখন কায়েস বলে, আসলেই দেখতে পাবে।
.
.
তারপর,
ফয়জান সহ যারা যারা খুঁজতে বের হয়েছিল সবাই কমিউনিটি সেন্টারে ফিরে আসে।
রুহুল আমিন ঢুকেই বললেন,
-“কোথায় আমার ফাইজা মা?

সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে কায়েসের দিকে। কায়েস ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত।
ফয়জান আর ধৈর্য ধরতে পারে না এগিয়ে এসে কায়েসের কাদ ঝাঁকিয়ে বললো,
-“কিছু বলো? চুপ করে আছো কেন?

কায়েস এবার মুখ খুললো। নিজেকে শক্ত করে বললো,
-“যে নিজ থেকে নিজ ইচ্ছায় হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয় ভাই!

ফয়জান বিষ্মিত চোখে তাকায়! অতঃপর কিছু বুঝতে না পেরে বললো,
-“হেঁয়ালি না করে সোজা ভাষায় বলো না?

কায়েস নিজের হাতে মুঠো করে রাখা কাগজটা ফয়জান এর হাতে দিল।

ফয়জান সাথে সাথে কাগজের বাজ খুলে পড়া শুরু করল।পড়া শেষে নিজের চুল টেনে ধরে।

শফিক মাহমুদ এগিয়ে এসে বললেন,
-“কি এটা?

ফয়জান তার দিকে কাগজ টা এগিয়ে দিল। শফিক মাহমুদ ও পড়লেন।
এরকম একে একে সবাই পড়া শুরু করলো। সবার চোখ মুখে বিষ্ময়ের অন্ত নেই।কেন ফাইজা এরকম করলো?
তাছাড়া রামিসা কেই বা কায়েস বিয়ে করবে কেন?রামিসা কি মেনে নিবে এই বিয়ে?

পরিবেশটা কেমন শান্ত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও এখানে চিৎকার, চেঁচামেচি ছিল। কিন্তু এখন আর নেই। সবাই নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে, বসে আছে।

এই নিস্তব্ধতা বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না!রামিসা এসে বললো,
-“বিয়ে শুরু করা হচ্ছে না কেন?

এ কে?
বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে আছে!
শান্ত,স্নিগ্ধ,শোভন একজন পাথরের ন্যায় মানব দাঁড়িয়ে আছে সবার সামনে।

আরেক দফায় সবাই বিষ্মিত হলো। মেয়েটা নিজ থেকে বলছে বিয়ের কার্যক্রম শুরু করার কথা? হচ্ছে টা কি আজকে?
এই দিনটা কি এক কালো অধ্যায়ের স্বপ্ন?যা কিছুক্ষণ পর ঘুম ভাঙ্গলেই চলে যাবে।

কিন্তু তা আর হ‌ওয়ার নয়।
সবাই স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে রামিসার দিকে।
এদিকে রামিসা আষাঢ় শরীরটা ভয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। আজকে দুপুরে খাওয়া ও হয়নি এখনো। খুব পানি তৃষ্ণা পেল কিন্তু কাউকে বলতে পারলো না আমাকে একটু পানি দাও?

নিরবতা ভেঙ্গে কায়েস বললো,
-“বাবা আর ছোট বাবা কাজী সাহেব কে বলো বিয়ের কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার জন্য!

শফিক মাহমুদ বললেন,
-“সত্যি রামিসা কে বিয়ে..

কথা শেষ হ‌ওয়ার আগেই কায়েস বললো,
-“তোমার বড় মেয়ে তো তাই চাইছে বাবা!তার এই শেষ আবদার কি করে না রাখি?
প্লিজ আর কিছু ভালো লাগছে না, বিয়ে শুরু করতে বলো?

সবাই আর কিছুই বললো না। বলার মতো আছেই বা কি?থাকলে তো বলবে?
নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো সবাই।
.
.
আঁখিপল্লব জোড়া মেলে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে ফাইজার। আজকে তার সব থেকেও নিঃস্ব সে।ভিশন নিঃস্ব।

ফাইজার কলিগ রাইমা এবং অনন্যার বাসায় পালিয়ে চলে আসে ফাইজা। পূর্ব পরিকল্পনা ছিল যার কারণে সহজেই আসতে পারে এখানে। তাছাড়া রাইমা আর অনন্যা গাড়ি নিয়ে আগে থেকে কমিউনিটি সেন্টারের ওখানে তৈরি থাকে।

তারা অবশ্য ফাইজাকে অনেক বুঝিয়েছে।ফাইজা যেন অতিত ভুলে জীবনটা নতুন করে শুরু করে। কিন্তু ফাইজা কিছুতেই কায়েস এর জীবন নষ্ট করতে চায় না।তার থেকে রামিসা কে বিয়ে করলে সুখী হতে পারবে।

ফাইজা জানে ফাইজা চলে আসার পর কায়েস কখনোই বিয়ে করবে না।আর তাই রামিসার সাথে বিয়ের কথা বলে।
অপরদিকে রামিসা ও একজন ভালো মানুষ পাবে জীবনসঙ্গী হিসেবে। কখনো অসুখী হবে না ইনশা আল্লাহ।
.
রাইমা এসে বললো,
-“বোন চল কিছু মুখে দিবি? সারাটা দিন দাঁতের কুটাও দেসনি।

ফাইজা ভাঙ্গা গলায় বললো,
-“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না আপু। তোমরা খেয়ে নাও।

রাইমা সামনে এসে দাড়িয়ে ফাইজার দুই কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“এখনো কাঁদছিলি?আর কতো কাঁদবি?গলা যে ভেঙ্গে গেছে। এভাবে চলতে দিলে, দূর্বল শরীর নিয়ে প্রতি’শোধ নিতে পারবি? প্রতি’শোধ নিতে হলেও তো শক্তির প্রয়োজন।
দূর্বল কে তো শ’ত্রুরা সহজেই দূর্বল করে দিতে পারে। কিন্তু..

ফাইজা থেমে থেমে বললো,
-“বাঁচতে হলে তো খেতে হবেই। না খেয়ে তো বাঁচা সম্ভব নয়। কিন্তু আজকের দিনটা না হয় শোক দিবস হিসেবে না খেলাম। একদিন না খেলে কিছুই হবে না।

অনন্যা আসলো ছাদে।এসেই বললো,
-“তোরা এখনো এখানে বসে আছিস? আমি ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করে শেষে না পেরে এখানে আসলাম।চল খেতে চল?

রাইমা তখন বললো,
-“দেখ না আপা ও খাবে না বলছে। কতোবার বলছি শুনছেই না। তুই একটু বুঝিয়ে বল তো?

অনন্যা ও ফাইজার পাশে বসে বললেন,
-“দুঃখ কষ্ট নিয়েই তো আমাদের জীবন বোন।তাই বলে কি না খেয়ে বসে থাকলে চলবে? চলবে না। জীবন যুদ্ধে জয়ী হ‌ওয়ার জন্য হলেও খাওয়া অতিব জরুরি। তাছাড়া
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“রাতের আহার ত্যাগ করো না
যদিও তা এক মুঠো খেজুরও হয়। কারণ রাতের আহার ত্যাগ মানুষকে বৃদ্ধ করে দেয়”

(ইবনে মাজাহ,হাদিস:৩৩৫৫,তিরমিজি, হাদিস:১৮৫৬)
.
.
মাথাটা ভিশন দরেছে রামিসার।নিয়ম অনুযায়ী স্বামীর জন্য বসে অপেক্ষা করছে বাসর ঘরে।
একসময় বসে থাকতে না পেরে পিছনে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে থাকে।রাত বেড়েই চলেছে। এখন আর মানুষের গতানুগতি নেই। সবাই সবার মতো আছে। মেহমানরা নিজেদের বাসায় ফিরে গিয়েছে।এই পরিস্থিতিতে তারা আর শফিক মাহমুদ এবং রুহুল আমিন সাহেবদের বাসায় আসার প্রয়োজন মনে করেনি। তবে সবার মনে প্রশ্ন ফাইজা এরকম কেন করলো? সারাজীবন এই কৌতূহল গেঁথে থাকবে সবার মনে।

কিছুক্ষণ আগে আয়েশা জোর করে রামিসা কে কয়েক লোকমান ভাত খাইয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কায়েস খায়নি। কোথাও একটা বেরিয়ে চলে গিয়েছে।

আলো ফয়জান তারা নিজেদের বাসায় ফিরে গিয়েছে। ফয়জান যেন এখনো অবধি একটা ঘোরের মধ্যে আছে। আজকে তার বোনটাকে যেন চিনতে পারছে না। পড়াশোনা কাজের ব্যস্ততায় কখনো মিশা হয়নি বোনদের সাথে। তবুও বোন,জন্মের পর থেকে দেখে আসছে। এরকম করার কথা ভাবনার বাহিরে ছিল।

আলো পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“ঘুমাবেন না?

ফয়জান ঐ দূর আকাশে দৃষ্টি রেখেই বললো,
-“ঘুম যে কিছুতেই আসছে না আলো। কিন্তু ঘুমের বড্ড প্রয়োজন। ঘুম ও আল্লাহ তা’আলার একটা নেয়ামত। সেই নিয়ামত থেকে আজকে হয়তো আমি বঞ্চিত।
-“এরকম বলতে হয় না। চলুন আমি আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব?

আলো আধশোয়া হয়ে বসে ফয়জান এর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে কিছু কথা বলি?

ফয়জান ছোট করে বললো,
-“বলো।

আলো বলতে শুরু করে,
-“সংসারে কতইনা ঝামেলা হয়, তাই না?
স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াঝাঁটি, শাশুড়ী ননদদের প্যারা, কাজের প্রেসার, বাচ্চার দুষ্টুমি ইত্যাদি…
নিজের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। অসহায়ত্ব চেপে বসে, হতাশ লাগে। কান্না পায়, কিছুই ভালো লাগে না, মনে হয় জীবনটা শেষ হয়ে গেলো বুঝি!

যারা এমন সমস্যাগ্রস্ত তাদের জন্য আমি কিছু পরামর্শ দিচ্ছি নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে। ট্রাস্ট মি, সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্।

১) সার্বক্ষণিক জিকির ,💚
সবসময়ই জিকিরে রত থাকবেন। ছোটো ছোটো জিকির, সবচাইতে উত্তম হল “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”! টয়লেট ছাড়া সব স্থানে জিকির করা যাবে। বাচ্চা ঘুম পাড়াবেন সুরে সুরে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” জিকির করে। বাসন ধুতে, রান্না করতে, ঘর গুছাতে সবসময়
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” চলতে থাকবে।
এছাড়া দুরুদ, ইস্তেগফারও জারি রাখবেন। মুখস্ত তিলাওয়াতগুলো করতে চেষ্টা করবেন। অন্তত বাচ্চাকে নিয়ে মোবাইলের এ্যাপ থেকে কুরআন তিলাওয়াতটা করার চেষ্টা করবেন রোজ ৫ মিনিট হলেও। আর রোজ ঘরে তিলাওয়াত অবশ্যই বাজাবেন। বাচ্চাকে বাদ্যবিহীন নাশীদ ও তিলাওয়াত শোনাবেন।

২) আল্লাহর সাথে গল্প 💚
আপনার খারাপ লাগছে? আল্লাহর সাথে গল্প করুন। কাজ করছেন? নাপাক আছেন? কোনো সমস্যা নাই। বাসন ধুতে ধুতে, রান্না করতে করতে বলুনঃ আল্লাহ দেখছো আমার কত কষ্ট হচ্ছে, তুমিতো সব পারো, দাওনা আমার কষ্টটা দূর করে….
কেউ কষ্ট দিয়েছে? আল্লাহকে বলুনঃ আল্লাহ দেখছো আমি কত কষ্ট পাচ্ছি? আমার মনটা ভালো করে দাওনা…
মনে মনেই বলুন। সারা দিন গল্প করতে থাকুন। আল্লাহকেই কথা বলার সাথী বানিয়ে নিন, বন্ধু বানিয়ে নিন। তিনি আপনার সব কথা শুনবেন। তিনি কখনো বিরক্ত হবেন না।

৩) সালাত ও দু’আ 💚
সালাতে আপনার স্পেশাল দু’আ গুলো করুন। আপনার টাকার সমস্যা, বাজার নাই, কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, বুয়া লাগবে, বাচ্চা জ্বালায় বেশি, জামাইর সাথে ঝগড়া, এটা চাই, ওটা চাই না ইত্যাদি সব আল্লাহ তা’আলাকেই বলুন। তিনিই সব ঠিক করে দেবেন ইনশাআল্লাহ্। বাচ্চা নিয়ে সালাতে সমস্যা? সালাম ফিরিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে বাচ্চার হাত নিজ হাতের উপর রেখে মুনাজাত করুন। দেখেন কি সুন্দর জান্নাতি অনুভূতি হয় সুবহানাল্লাহ্!

৪) রিযা বিল কাযা 💚
যদি দু’আ কবুলে দেরী হয় তবে ভাববেন তিনি আরো কিছুদিন আপনার ডাক শুনতে চান। কারণ আপনার ডাক আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বেশি পছন্দ। তাই সর্বাবস্থায় আল্লাহ পাক রব্বুল আলামিনের উপর তাওয়াক্কুল রাখবেন। এমনকি আপনি অসুস্থ হলেও খুশি হবেন। সবসময় ভাববেন আল্লাহ আপনাকে ভালো রেখেছেন, আল্লাহ আপনাকে উনার বিশেষ রহমত দিয়ে ঘিরে রেখেছেন, তিনি আপনাকে অনেক ভালোবাসেন। এই ভাবনার মাঝেই সকল সুখের চাবি আছে। সবসময় ভাববেন আপনি অত্যন্ত ভালো আছেন। আপনার চাইতে যারা খারাপ হালাতে আছে, যাদের হাত নাই,
পা নাই, যারা দিন মজুর, তাদের কথা ভাববেন। (এগুলো নারীদের জন্য আমল লিখা হলেও আপনিও আপনার কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই আমল গুলো করতে পারেন)
✍️mumtaz mily

বলা শেষে দেখলো ফয়জান ঘুমিয়ে পড়েছে।তাই আলোও ঠিক হয়ে শুয়ে পড়ল।
.
.
কায়েস রুমে ঢুকে দেখলো রামিসা আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে আছে। সেকেন্ড কয়েক তাকিয়ে থেকে ডাকলো,
-“রামিসা?রামিসা?

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।