শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-১৮

0
354

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(১৮)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

শুভ্র নীলাভ আকাশে যেমন মেঘ জমে তেমনি দুইটা পরিবারে মেঘ জমেছে।কারো মনে শান্তি নেই শুধু আছে কষ্টের দীর্ঘশ্বাস।

প্রকৃতির নিয়মে মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। তারপর সূর্য মামার আগমনে এক নতুন ঝলমলে দিন শুরু হয়। প্রকৃতি তখন পুনরায় সচল হয়ে উঠে। তাদের পানে তাকালে অনুভব হয় তারা হাসছে হেসে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে “আলহামদুলিল্লাহ” বলছে।

মানুষের জীবনটাও এরকম হাসি আর কান্না,কান্না আর হাসি। এইতো জীবন বড়ই ভালোবাসি। মানুষের জীবনে যদি দুঃখ কষ্ট না থাকতো তাহলে সুখের আনন্দ’টা কেউ উপলব্ধি করতে পারতো না কখনোই না।

তেমনি সুন্দর অসুন্দর দুটোই আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করেছেন।যদি সবকিছু সুন্দর’হীন হতো তাহলে আমরা কখনো সুন্দর অসুন্দর এর পার্থক্য বুঝতাম না। আল্লাহ মহাজ্ঞানী তাই তো সবকিছু বিবেচনা করেই সৃষ্টি করেছেন।তাই বিপদের সময় আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা রাখতে হবে। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে,
জেনে রেখো,আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে [১]
.
.
রামিসা উঠে বসে বললো,
-“সকাল হয়ে গেছে ভাইয়া?

কায়েস একটু চুপ থেকে বললো,
-“না এখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ। তাহাজ্জুদ নামায পড়ার সময়।ফ্রেশ হয়ে অযু করে আসো। একসাথে নামায আদায় করবো।

রামিসা এ কথা শুনে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কায়েসের দিকে।রামিসা বুঝতে পারছে না এই লোকটা এতো ভালো কেন? এতো কিছুর পরেও কেমন আল্লাহ তা’আলার ইবাদত পালন করবে বলছে! আমি তো গতকাল আল্লাহ কে অনেক কিছু বললাম যে তিনি চাইলে তো এরকম কিছুই হতো না! তিনি চাইলে সেদিন আপুই কে ঐ নিকৃ’ষ্ট জানো’য়ার দের হাত থেকে রক্ষা করতে পারতেন! কিন্তু তিনি বাচাননি আপুই কে! কেন এতো নি’ষ্ঠুর হলো আল্লাহ?

রামিসা বসে বসে এসব ভাবছে তখন কায়েস নামাযের জন্য তৈরি হয়ে এসে বললো,
-“এখনো বসে আছো কেন? কিছুক্ষণ পর ফযরের ওয়াক্ত হয়ে যাবে।যাও তাড়াতাড়ি?
-“আল্লাহ তা’আলার প্রতি আমার অনেক রাগ! তিনি ইচ্ছে করলেই সেদিন আপুই কে বাঁচাতে পারতেন কিন্তু কেন বাঁচালেন না? আমি তার ইবাদত পালন করবো না!

রামিসার এমন কথায় বিষ্মিত হলো কায়েস সাথে সাথে বললো,
-” নাউযুবিল্লাহ!
এসব কি কথা বলছো? তাড়াতাড়ি ত‌ওবা করে আল্লাহ তা’আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। আল্লাহ তা’আলা কোরআন এর আয়াতে বলেছেন,
হে ঈমানদারগণ,তোমরা ধৈর্য্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।[২]

এবং তিনি আরও বলেছেন,যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের (নিয়ামত) বাড়িয়ে দিবো।[৩]

তাই আমাদের সবকিছুর জন্য শুকরিয়া আদায় করতে হবে।আমরা তো এই দুনিয়া ক্ষণিকের জন্য এসেছি অতিথি হিসেবে। আবার তার কাছেই ফিরে যেতে হবে।ক্ষনিকের মোহ মায়ার জান্য জাররা পরিমাণ ও আল্লাহ তা’আলার বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না। আল্লাহ তা’আলা আমাদের হেদায়েত এবং হেফাজত দান করুন আমীন,সুম্মা আমীন!

রামিসা নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো।ক্ষমা প্রার্থনা করে “আস্তাগফিরুল্ল” বললো। তারপর একটা থ্রিপিস নিয়ে বাথরুমে গেল।শাড়ি চেঞ্জ করে থ্রিপিস পরবে বলে।
.
.
এদিকে কায়েস জায়নামাজে বসে কষ্টে মাথা চেপে ধরে। মুখে যাই বলুক না কেন মন থেকে তো আর ফাইজা কে ভুলতে পারবে না। কিন্তু তারপরও আল্লাহ তা’আলার বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না কিছুতেই। আল্লাহ যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা উত্তম পরিকল্পনাকারী।

রামিসা তৈরি হয়ে আসলে দুজনে একসাথে নামাযে দাঁড়ায়।
.
আলো একাই তাহাজ্জুদ নামায পড়ছে।
ফয়জান কে কয়েকবার ডাকার পরও উঠেনি। হয়তো সারাদিন এতো ঝামেলা পোহাতে হয়েছে বলে উঠতে পারছে না।তাই আলো আর জোর করেনি।
.
ফাইজা’র নামাজরত অবস্থায় চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে।সে যে বড্ড পা’পি!তার পা’পের খোরাক পূর্ণ হয়ে আসছে আর বেশি দেরি নেই! এই পৃথিবীর আনন্দ তার জন্য নয়, তবুও শুকরিয়া আদায় করে নিতে হবে।পরকালে যদি একটু ঠাঁই মিলে।
.
.
পাঁচ মাস পর,
সবাই সবার কর্মক্ষেত্র নিয়ে ব্যস্ত জীবন যাপন করছে।ব্যস্ততার মাঝেও দীর্ঘশ্বাস রয়েই গেছে।
আলো’র এইস‌এসসি পরীক্ষা নিকটবর্তী। দিন, রাত এক করে মেয়েটা পড়াশোনা করছে।তার গাইড লাইন হিসেবে আছে ফয়জান। যেকোনো সমস্যা সমাধান করে দিচ্ছে সে। আলোকে নিয়ে ফয়জান এর অনেক স্বপ্ন। ফয়জান এর বিশ্বাস আলো একদিন খুব বড় হবে, সবার মুখ উজ্জ্বল করবে।

এদিকে ফাহমিদা খাতুন এসবে মোটেও খুশি নন।তার ইচ্ছা ঘরে একজন ফুটফুটে নবজাতক শিশুর আগমন ঘটুক। এতো পড়াশোনা করে কি হবে? তাদের যা আছে এগুলো দিয়েই তো জীবন চলে যাবে।এর চেয়ে বেশি কি প্রয়োজন?
ফাহমিদা খাতুন শুধু অপেক্ষা করছেন পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষা হয়ে গেলেই এ নিয়ে আলোর সাথে কথা বলবেন তিনি।

অপরদিকে ছোট মেয়ের ঘরেও নাতি নাতনির সম্ভাবনা দেখছেন না। জানেন না আদৌও তার মেয়েটা স্বামী ঘর নিয়ে সুখে আছে কিনা। এমনিতে সবার সাথে হাসিখুশি কথা বলে, চলাফেরা করে। ফাহমিদা খাতুন বাচ্চার কথা বললে, কিছুক্ষণ চুপ থেকে অন্য কথা বলে কাটিয়ে নেয়।

আর বড় মেয়ের কথা কি বলবেন? এই কয়েক মাসে কয়েকবার এসে শুধু দেখা করে চলে গেছে। মেয়েটার মনের মধ্যে কি এমন যন্ত্র’না তিনি আদৌও এর হিসাব নিকাশ মিলাতে পারেন না।
কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে,
-“মা কোন প্রশ্ন করো না দয়া করে। আমি উত্তর দিতে পারবো না।আর এই যে দেখছো আমি মাঝে মাঝে আসি, তখন তাও আসবো না।

তখন ফাহমিদা কেন? ভয়ে কেউ ই কোন কথা জিজ্ঞাসা করতে পারে না।

রামিসা যথাসম্ভব মানিয়ে নিচ্ছে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে। তাছাড়া মানুষগুলো যে পূর্ব থেকেই তার বড্ড আপন। এদের মতো পরিবার পাওয়া ও ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে বলেই এমন ভালো স্বামী শ্বশুরবাড়ি পেয়েছে।

বিয়ের পর কয়েক মাস রামিসা’র তায়েস এর সাথে বন্ধুত্বের মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্যাপারটা কায়েস এর চোখে পড়লে কায়েস রামিসা কে হাদীসের আলোকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলে,
উকবা ইবন আমের (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ আলাইহিসসালাম ইরশাদ করেন, সাবধান! তোমরা পরনারীর কাছে ঘেঁষা থেকে বিরত থাকবে। তখন জনৈক আনসারী বললেন, দেবর সম্পর্কে বিধান কী? তিনি বললে, দেবর হচ্ছে মৃত্যু।[৪]

হাদীসে দেবরকে মৃত্যুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আসলে কি তাই? সত্যিই কি দেবর মৃত্যুতুল্য? নাকি হাদীসের অন্তর্নিহিত কোনও অর্থ উদ্দেশ্য? মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে আসুন এ ব্যাপারে ইসলামী মনীষীদের বক্তব্য জেনে নিই। পাঠক! ততক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য না হারানোর অনুরোধ করছি।

এর ব্যাখ্যায় আবূ উবায়দ (রহ.) বলেন, ভাবীর মৃত্যু হলেও সে যেন দেবরদের দেখা না দেয়। ইমাম খাত্তাবী (রহ.) বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ মৃত্যুকে যেভাবে ভয় করে, দেবরকেও সেভাবে ভয় করা উচিত।[৫]

আল্লামা উব্বী রহ. বলেন, ‘নারীরা যেন পরপুরুষ ও দেবরদের সঙ্গে নিভৃতে না মেশে। কেননা, এতে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে এমন পাপ হয়ে যেতে পারে, যা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক।’

ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, দেবরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত, মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার মতোই ভয়ানক ও ক্ষতিকর।[৬]

মনীষীগণের এসব বক্তব্যে ফুটে উঠেছে দেবরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষতির কথা।
.
.
হাদীসের এরুপ বানী শুনে রামিসা আর জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তায়েসের সামনে যায় না। কিছুদিন পর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তায়েস ও নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখে। কারণ সে জানে তার ভাই খুবই ধার্মিক মানুষ। ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছে কখনো নামায কালাম বিনা কারণে বাদ দেয় না।তার ব‌উ তো সেরকম ই হ‌ওয়া উচিৎ।
.
আজকে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে কায়েস ব‌ই পড়ছে।রামিসা ফোন নিয়ে বসে আছে বিছানায় তখন কায়েস বললো,
-“একটা কথা অনেক দিন যাবত জিজ্ঞাসা করবো করে করা হচ্ছে না! জিজ্ঞাসা করবো?

রামিসা ফোন রেখে ভাবনার মগ্ন হয় কি জিজ্ঞাসা করতে চাইছে কায়েস?
________
রেফারেন্স:
১)[সূরা বাক্বারাঃ২১৪]
২)[সূরা বাক্বারাঃ১৫৩]
৩)[সূরা ইব্রাহিমঃ৭]
৪)[বুখারী : ৫২৩২]
৫)[আ‘লামুল হাদীস : ৩/২০২৫]
৬)[ফাতহুল বারী : ৯/২৪৩]
_______
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।