শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-০৪

0
485

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(৪)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

বোনের এমন দূর্ঘটনার কথা শুনে হতাশ হয়ে পড়ে ফয়জান।সে যে কলেজে অধ্যাপনা করে সেটা বাসা থেকে বেশ দূরে হওয়ায় সেখানে রামিশা কে ভর্তি করায় নি ফয়জান। এখন বাসার কাছাকাছি কলেজ হ‌ওয়া সত্তেও একি মুছিবত! আজকাল মেয়েদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড্ড অভাব রয়েছে।

কায়েস সবকিছু শুনে বললো,
-” তায়েস তো ঐ রোড দিয়ে অফিসে যাতায়াত করে রামিশা কে না হয় তায়েস নিয়ে যাবে। কিন্তু আসার সময় কি হবে?

তায়েস বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়। কেননা রামিশা কে সে কোন ভাবেই সহ্য করতে পারে না। কেমন দর্শিপনা মেয়ে একটা। ফয়জান আর ফাইজার বোন এরকম অগোছালো এলোমেলো টাইপের বোন কি করে হয়?তা মাথায় আসে না তায়েস এর।তায়েস বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বললো,
-“তোমরা অজ্ঞতা দুশ্চিন্তা করছো। আমার মনে হয় ছেলে গুলো এখন পর্যন্ত সুস্থ সবল আছে কিনা সন্দেহ!যদি ঠিকানা জানা থাকতো তাহলে আমি একবার ফলমূল নিয়ে দেখে আসতাম ছেলে গুলো কে।

এ কথা শুনে রামিশা তেতে উঠল। বললো,
-” বড় মা তোমার ছেলে কি বলে শুনছো? তোমার ছোট ছেলে রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্য এছাড়া ঘরের শত্রু বিভীষণ!

আয়েশা ও কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বললেন,
-“তোর বোন কে ছেলে গুলো ইফ’টিজিং করেছে আর তুই সেই ছেলে গুলোর হয়ে কথা বলছিস?

রামিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
-” তোমার ছোট ছেলেকে আমি ভাই হিসেবে মানি না বড় মা।একটা রাজাকার কখনো আমার ভাই হতে পারে না!

তায়েস শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-” আমার যেন বয়েই গেছে তোমার ভাই হতে?
-” আমি কি বলেছি আমার ভাই হবেন?ভাই হবেন?যত্তসব ফাউল মার্কা লোক!
-“বেয়াদব মেয়ে বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানে না কিছু না। আচ্ছা ফাইজা আপু তোমরা একে লন্ডন থেকে কুড়িয়ে এ দেশে কেন নিয়ে এসেছো?

তায়েসের শেষার্ধ কথায় ফয়জান আর ফাইজা হাসে। এদিকে আরো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো রামিশা। তায়েস কে আরো কিছু কথা শুনাতে মুখ খুলবে তার আগেই ধমকে উঠে শফিক মাহমুদ বললেন,
-“চুপ!একদম চুপ। একটা বিপদের মধ্যে অহেতুক ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। কোথায় সমস্যা সমাধান করবে তা নয়। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তায়েস প্রতিদিন তোমার বাইকে করে রামিশা কে কলেজ পৌঁছে দিবে আর আমি না হয় ছুটি হলে গিয়ে নিয়ে আসবো।

তায়েস এ কথা শুনে রেগে উঠে চলে গেল। বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই তার।যদিও শফিক মাহমুদ সহ সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারলো কিন্তু কিছু বললো না।
ফয়জান বললো,
-“বড় বাবা আপনি কষ্ট করে কেন যাবেন?ফাইজা নিয়ে আসলেই তো হবে।

ফাইজা চিন্তিত মুখে বললো,
-“ভাইয়া আমি তো ঐ সময় আমার কর্মক্ষেত্রে থাকবো।

শফিক মাহমুদ বললেন,
-” হুম তাই তো ফাইজা তো বাসায় থাকে না তখন।আর কোন কথা না। আমার ছোট মেয়েকে আমি ই গিয়ে আনবো।

রামিসা খুশিতে আপ্লুত হয়ে শফিক মাহমুদ এর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
-“তুমি ছাড়া আমাকে আর কেউ ভালোবাসে না বুঝছো? লাভ ইউ বড় বাবা।
-“লাভ ইউ টু ছোট আম্মা।

জেঠা-বাসতির এমন নিবিড় সম্পর্ক দেখে সবাই মুচকি হাসে।
.
তাদের সম্পর্কটা বেশ মধুর।
শফিক মাহমুদ এর ছোট ভাইয়ের সন্তান ফয়জান,ফাইজা আর রামিসা।

তবে ভবিষ্যতে এই সম্পর্কটা ভিন্ন রুপে রুপান্তরিত হবে! শফিক মাহমুদ এর বড় ছেলে কায়েস মাহমুদ এর সাথে তার ছোট ভাই রুহুল আমিন এর বড় মেয়ে ফাইজা চৌধুরীর কে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করা হবে ইনশা আল্লাহ।

বর্তমানে রুহুল আমিন এবং তার স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে আছেন। ফয়জান, ফাইজা আর রামিসা তাদের কর্মক্ষেত্র এবং পড়াশোনার জন্য শফিক মাহমুদ এর বাসায় থাকে। তবে তাদের এপার্টমেন্ট এর কাজ চলছে খুব শীঘ্রই কমপ্লিট হলে তারা নিজেদের বাসায় শিফ্ট হবে। তখন কায়েস আর ফাইজার বিয়ের তারিখ ধার্য করা হবে।
.
.
রাতের খাবার খেয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ফাইজা। আকাশের দিকে তাকালেই কোরআন এর আয়াতের অংশা মনে পরে, শরীর শিউরে উঠে।
“আকাশের দিকে তোমার বার বার তাকানো আমি অবশ্যই লক্ষ্য করি”।
[সূরা আল বাকারাহ-১৪৪]

“সুবহান আল্লাহ” বলে ফাইজা খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষন করার চেষ্টা করছে। গোলাকার আকৃতির চাঁদ জ্বলজ্বল করছে ঐ দূর আকাশে।তার আশে পাশেই কয়েকটি তাঁরা মিটিমিটি জ্বলছে।
ঢাকা শহর বলে গাছপালা খুব কম। না হয় গাছের শাখা প্রশাখার ফাঁকফোকরে স্নিগ্ধ শোভন চাঁদ কে আরো মোহনীয় লাগে দেখতে। যখন গাছের পাতা হাওয়ায় দোলে তখন আরো সুন্দর লাগে সেই দৃশ্য।

এর মাঝে গুন গুন করে ফাইজা গজল গায়,
“তোমার দুনিয়াতে আমি যেদিকে তাকাই,
অথ‌ই নেয়ামতে,ডুবে আছি সবাই।
পাখপাখালির গানে যেন তাসবিহ…

এতটুকু বলতেই রুম থেকে রামিসার বিচলিত কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে থেমে যায় ফাইজা। রুমে চলে আসে দেখার জন্য কি হয়েছে?
.
রামিসা পড়তে বসেছে তখন তার বান্ধবী নিদ্রার নাম্বার থেকে কল আসে।রামিসা কল রিসিভ করেই বললো,
-“নিহোনিয়ান এর পাগলী হঠাৎ আমাকে স্মরণ করার কারণ কি?

কলের ওপাশ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,
-“তারমানে তুমিও ঐ ছেলের কথা জানো রামিসা? আমি ঠিক ধরেছি আমার মেয়ে একদম বকে গেছে।হারাম সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে! ইয়া আল্লাহ এমন মেয়ে পেটে নিয়েছি আমি যে তোমার আদেশ অমান্য করে হারাম সম্পর্কে জড়িয়েছে!

রামিসার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো বুঝতে যে নিদ্রার মা ফোন ধরেছেন। কিন্তু রামিসা বুঝতে পারছে না তিনি এসব কি বলছেন?তাই বিচলিত হয়ে ঝটপট বললো,
-“আন্টি আপনি শান্ত হোন প্লিজ। আমাকে একটু খুলে বলুন কি হয়েছে?

কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল।ফাইজা চোখে ইশারা করে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে?রামিসা প্রথম থেকে সবটা খুলে বললো। সবটা শুনে দুই বোনের মধ্যে নিরবতা পালন চলছে। হঠাৎ রামিসা চিৎকার করে বললো,
-“হায় আল্লাহ! এখন কি হবে?

ফাইজা কিছু বলবে তার আগেই রামিসা দৌড়ে বেড়িয়ে গেল। গিয়ে কায়েসের রুমের দরজায় কড়াঘাত করলো। কায়েস হাদীসের ব‌ই পড়ছে দরজায় কড়াঘাত শুনে বললো,
-“দরজা খোলা আছে ভেতরে আস।

রামিসা গিয়ে বললো,
-“ভাইয়া আমার সাথে একটু বাহিরে যেতে পারবেন?

হঠাৎ রামিসার আগমনে হকচকায় কায়েস!ব‌ই বন্ধ করে উঠে দাড়ালো। স্বাগতিক করে বললো,
-“রামিসা তুমি? আমি ভাবলাম মা এসেছে।তা এই রাতের বেলা বাহিরে বের হবে কেন?
-“যেতে যেতে বলবো ভাইয়া এখন তাড়াতাড়ি চলুন।

নরম মনের মানুষ কায়েস মাহমুদ।তাই না করতে পারলো না।রামিসা কে নিয়ে বের হলো গন্তব্য নিদ্রার বাসায়। নিদ্রার পরিবারের সদস্যরা খুবই ধার্মিক।নিদ্রার বাবা বিদেশে থাকেন আর মা ভাই বোন দাদু কে নিয়ে নিদ্রা ফ্লাট ভাড়া করে থাকে ঢাকায়। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল।
নিদ্রা পড়ার টেবিলে বসে খাতায় আঁকিবুঁকি করছিল তখন তার মা দেখে,
নিদ্রা খাতার মধ্যে “নিহোনিয়ান” লিখে পুরো খাতা ভরে ফেলছে। শুধু তাই নয় লিখেছে,
আই লাভ ইউ নিহোনিয়ান!
আই মিস ইউ নিহোনিয়ান!
নিহোনিয়ান তুমি জানো আমি তোমার জন্য হাজারো কথা মন’গহীনে জমিয়ে রাখছি একটু একটু করে।

তখন থেকেই শুরু হয় তুমুল ঝড়। নিদ্রা কিছুতেই বোঝাতে পারে না তার মা’কে।তাই শেষে না পেরে বললো,
-“তুমি রামিসা কে কল করে জিজ্ঞাসা করে দেখ।রামিসার কথা নিশ্চ‌ই বিশ্বাস করবে? দেখবে ও বলবে নিহোনিয়ান নামে আদৌও কেউ নেই।

কিন্তু হলো তার উল্টো।রামিসা প্রথমেই নিহোনিয়ান দিয়ে শুরু করে দিয়েছে। এখন রামিসা যাচ্ছে নিদ্রার মাকে সবটা বুঝিয়ে বলতে।
.
.
বাসার কলিং বেল বাজাতে নিদ্রা দরজা খুলে রামিসা দেখে বললো,
-“আমি তোর কোন জন্মের শ’ত্রু রামিসা? তুই এভাবে মা’কে বলতে পারলি?

রামিসা ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-“আন্টি কোথায়?
-“আর কোথায় চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত।

রামিসা নিদ্রার মায়ের কাছে গিয়ে বললো,
-“আন্টি আপনি যা ভাবছেন তা নয়।
নিহোনিয়ান হলো রসায়নের একটা মৌল।আর সেখান থেকেই নিদ্রা নিহোনিয়ান নিয়ে মজা করে। বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই।

নিদ্রার মা চোখ মুখ মুছে বললো,
-“তুমি সত্যি বলছো”?

রামিসা ভদ্রমহিলা কে আশস্ত করে বললো,
-“জ্বি আন্টি পাক্কা সত্যি”।
-“আচ্ছা মেহমান নিয়ে এসেছো বসো আমি তোমাদের নাস্তার ব্যবস্থা করি”।
-“না আন্টি রাত বেড়ে যাচ্ছে এখন বাসায় যেতে হবে অন্য একদিন এসে খাবো।
-“তা কি করে হয় এভাবে খালি মুখে চলে যাবে না না একটু কিছু খেয়ে তবে যাও?

তারপর,রামিসা ভদ্রমহিলা কে বুঝিয়ে কায়েস কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো বাসায় ফিরে আসার জন্য। কায়েস বললো,
-“তোমার বান্ধবী আগে থেকেই হবু বরের নিক নেম ঠিক করে রেখেছে বিষয়টি খুব ইন্টারেস্টিং।

এর উত্তরে রামিসা হাসে।
পথে ফুচকার স্টল দেখে বায়না ধরে ফুচকা খাবে। কায়েস না করে না খেতে নিয়ে যায় আর সে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে।

কায়েস রামিসা কে দেখছে আর ভাবছে,
-“এই মুহূর্তে তুমি থাকলে সময়টা ভিশন সুন্দর কাটতো ফাইজা। জানি না তুমি আমাকে কেন এভোয়েড করে চলেছো। হয়তো নিজের অজান্তে আমি কোন ভুল করেছি। তবে আমার ভুল ধরিয়ে দিতে তাহলে তো আমি নিজেকে শুধরে নিতাম..
.
.
কিছুদিন পর,
রামিসা কে ইফ’টিজিং করা ছেলে গুলোর লা’শ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়না’ত’দন্তের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানায় তাদের পুরুষাঙ্গে আঘাত করে হ’ত্যা করা হয়েছে! কি আশ্চর্য কে করলো এমন কাজ? আবারো মিডিয়ায় এ নিয়ে তোলপাড় চলছে।

বাসায় প্রতিটি মানুষ থমথমে মুখে বসে আছে টেলিভিশন এর সামনে….

#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।

(আসসালামু আলাইকুম।