শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-০৯

0
371

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(৯)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

প্রতিদিন এর মতো রাতের শেষ তৃতীয়াংশে ঘুম ভাঙ্গলো আলোর। পিটপিট করে তাকাতেই চোখ আটকে গেল এক নিমেষে।

কোলবালিশের মতো করে ফয়জান কে ঝাপটে ধরে আছে আলো। লজ্জায় নাক কা’টার যোগার।
আলোর মাথার সাথে ফয়জান এর থুতনি রাখা।আর আলো সম্পূর্ণ মিশে আছে ফয়জান এর সাথে।

ফয়জান এর ঘুম কোন ভাবেই ভাঙ্গতে দেওয়া যাবে না,এই আলো’র পণ। না হয় লজ্জায় ফয়জান এর সামনে দ্বিতীয় বার মাথা তুলা দায় হয়ে দাঁড়াবে।তাই খুব সন্তর্পণে ফয়জান কে ছাড়িয়ে উঠে বসলো আলো।
ধীরে ধীরে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
ফয়জান নড়ে চড়ে পুনরায় ঘুমালো।

রাত গভীর থেকে গভীরতর। সবাই ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। কোথায় কোন সাড়া শব্দ নেই। হালকা হাওয়ার তানে তানে মৃদু দুলছে গাছের পাতা গুলো।
এ রুমের বেলকনিতে কয়েকটি ফুলের টব আছে পর্তুলিকা,পাতা বাহার,বেলি আর মরিচ ফুল। আয়েশা রেখেছেন এগুলো।তার এগুলো শখের গাছ।

আলো প্রকৃতির কাজ শেষ করে অযু করে এসে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করার জন্য সাজসজ্জা করে নেয়।
কিন্তু জায়নামাজ কোথায় আছে? খুঁজে পায় না। তারপর ফয়জান কে খেয়াল করে জিভে কামড় দেয় আলো।

তার একটা সুন্দর ইচ্ছে কে সে নিজেই মাটি চাপা দিয়ে দিচ্ছিল!
“তোমার কাছে হাজারো শুকরিয়া ইয়া আল্লাহ আমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য”।
এই বলে আলো ফয়জান কে ডেকে তুলতে যায়। কিন্তু কি বলে ডাক দিবে?স্যার বলে? কিন্তু ফয়জান যে স্যার ডাকতে নিষেধ করেছে তবে?যদি স্যার বললে রাগ করে?

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললো,
-“এই যে শুনছেন?

কোন সাড়া নেই।তাই পুনরায় আবার বললো,
-“স্যার উঠুন না?সময় যে গড়িয়ে যাচ্ছে।আযান হয়ে যাবে প্লিজ উঠুন?

ফয়জান ঘুম ঘুম চোখে তাকায়, সেকেন্ড কয়েক তাকিয়ে থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে ফয়জান।হাই তুলে বললো,
-“আলো তুমি এভাবে দাড়িয়ে আছো কেন? তোমার কি মাথা ব্যথা কমেনি? বেশি খারাপ লাগছে?

আলো আদুরে গলায় অনুরোধ করে বললো,
-“আমার সাথে তাহাজ্জুদ নামায পড়বেন প্লিজ? আমার খুব ইচ্ছে ছিল আজকের প্রথম রাতে আমি আমার স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করবো।

একদমে কথা গুলো বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো আলো। ফয়জান সবটা শুনে মুচকি হেসে আলো’র গাল টি’পে দিয়ে বললো,
-“এতো সুন্দর ইচ্ছে পূরণ না করি কি করে বলো? তাছাড়া আমি কখনো তাহাজ্জুদ নামায আদায় করিনি! তোমার উসিলায় আজকে পড়া হবে “আলহামদুলিল্লাহ”।

আমি তৈরি হয়ে আসছি তুমি অপেক্ষা করো।
আলো মাথা কাত করে সম্মতি দিলে ফয়জান বাথরুমে ঢুকে।
তারপর,সাত মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে আসে। এখন রুমে একটা জায়নামাজ আছে, সেটা আলো’র হাতে দিয়ে বললো,
-“আমি বাহিরে থেকে আরেকটি নিয়ে আসছি।

এই বলে চলে যায়।
.
দুজন নর-নারী রাব্বুল আলামীনের ইবাদতে মশগুল।মা শা আল্লাহ, কতো সুন্দর দৃশ্য দেখলেও জুড়াবে প্রাণ।
বরাবর জানালার থাই গ্লাস গলিয়ে দেখা যাচ্ছে, অন্ধকারের আচ্ছন্ন হয়ে আছে পৃথিবী এর উপর সাদা আলো হয়ে ফুটে আছে আকাশ।ডান দিকে চাঁদ মামা মিটি মিটি হাসছে হয়ত এতো সুন্দর দৃশ্য দেখে।
ডান কাঁধের ফেরেস্তা বসে বসে নেকি লিখছে আর হাসছে খুশিতে হয়তো।

আবূ হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-আল্লাহ তা‘আলা রাতের শেষ তৃতীয়াংশে প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। তারপর তিনি বলেন, কে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব? কে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব? কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব? অর্থাৎ রাতের এ সময়ে আল্লাহ তার বান্দাদের থেকে এ কামনা করেন যে, তারা যেন তাকে ডাকে এবং তার প্রতি তিনি তাদের উৎসাহ প্রদান করেন। যে তাকে ডাকে তিনি তার ডাকে সাড়া দেন। তিনি তাদের থেকে চান যে, তারা যেন তাদের চাওয়া-পাওয়া তার কাছেই চায়। যে তার কাছে চায়, তিনি তাকে দেন। আর তিনি তাদের কাছে চান যে, তারা যেন তাদের গুনাহসমূহ হতে তার কাছে ক্ষমা চায়, তিনি তার মু’মিন বান্দাদের ক্ষমা করে দেবেন। আর চাওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তাদের উৎসাহ প্রদান ও আহ্বান করা। [১]
সহীহ – মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)।
.
.
তায়েস কক্সবাজার এসে পৌঁছায় সকালের দিকে। সে প্রথমে সমুদ্র সৈকতে যায় যেখানে সূর্যোদয় এর অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
যদি কক্সবাজার এসে থাকে তাহলে অবশ্যই এখানে আসার কথা মেয়েটার।কারণ এতো সুন্দর মোহনীয় দৃশ্য দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবে না নিশ্চয়ই।

পকেট থেকে ফোন বের করে আরেক বার রাকিব হাওলাদার এর মেয়ের ছবিটা পরখ করে নিল তায়েস।
তারপর প্রথম থেকে মেয়েদের কে দেখতে দেখতে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। মাঝে মাঝে খুব অস্বস্তি বোধ হচ্ছে কারণ এখানে অনেক কাঁপল রয়েছে। তারা একে অপরের সাথে রোমান্টিক মূহূর্ত কাটাচ্ছে।
কখনো কেউ স্বামী স্ত্রীকে জড়িয়ে ছবি তুলছে আবার কেউ কোলে তুলে নিয়ে।

কিন্তু তায়েসের এই মুহূর্তে এসব ভাবলে চলবে না। সে তার ডিউটি পালন করতে এসেছে তাই এসব পাত্তা দেওয়া যাবে না।

অনেক খুঁজেও মেলেনি মেয়েটার দেখা।তাই হোটেলে চলে যায় তায়েস। সকালের খাওয়া দাওয়া শেষ করে তারপর আবার বের হবে।
.
.
খাবার টেবিলে সবাই নাস্তা করছে। ফয়জান রিনু কে বললো,
-“আলো কে বলুন নাস্তা সেরে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে।

ফাহমিদা খাতুন কথা টেনে নিয়ে বললেন,
-“তৈরি হয়ে কি করবে?

ফয়জান চামুচে খাবার মুখে দিতে দিতে বললো,
-“কলেজে যাবে তাই।

ফাহমিদা খাতুন খানিকটা কাঠিন্য স্বরে বললেন,
-“বাহ্ চমৎকার! গতকাল বিয়ে করে এসেছে আর আজকে কলেজে যাবে।

ফয়জান বললো,
-“প্লিজ মা এভাবে বলো না।ও কতটা মেধাবী ছাত্রী তুমি ভাবতেও পারবে না।
“মা শা আল্লাহ”।
ওর মা মা’রা যাওয়ার পর থেকে এমনিতেই পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছে, এখন তুমি কিছু বললে মোটেও আর পড়াশোনা করতে পারবে না।
মেয়েটার মা মারা গেছে, এখন থেকে তুমিই তো ওর মা বলো? তুমি যদি আশ্রয় না দাও তাহলে আর কার কাছে যাবে বলো?
-“মেয়েটার মা মা’রা গেছে?
-“দুই মাস আগে।

আলো’র মা নেই শুনে ভিতরটা আর্তনাদ করে উঠলো ফাহমিদার।প্লেটে করে খাবার নিয়ে এগিয়ে গেল।

সবাই বুঝতে পারলো ফাহমিদা খাতুন কোথায় যাচ্ছেন। মহিলার রাগ থাকলেও মায়া আছে। কথায় বলে না?”যার রাগ বেশি তার মায়াও বেশি”। ঠিক সেরকম ফাহমিদা খাতুন।

আয়েশা ও কষ্ট পেয়েছে এ কথা শুনে। আয়েশা আগেই ভেবেছিলো, সবার খাওয়া শেষ হলে আলোকে নিয়ে সে খাবে। এখন জা নিজেই যখন গেল তখন আর কিছু বললো না।

ডাইনিং রুমে কায়েস আছে বলে আলো এখানে আসেনি। ফাহমিদা রুমে গিয়ে দেখে আলো গ্রিল ধরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।
তাই ডেকে বললেন,
-“ব‌উ এদিকে আস?

আলো শ্বাশুড়ি মাকে দেখে চমকালো।দ্রত পায়ে এগিয়ে এসে সুধালো কিছু লাগবে কিনা? ফাহমিদা আলোকে পাশে বসিয়ে হাঁ করতে বলে মুখের সামনে খাবার ধরে।
এই দৃশ্য দেখে আলোর নেত্রজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে ঝাঁপসা হয়ে এলো। হাঁ করার শক্তি পাচ্ছে না যেন।
ফাহমিদা খাতুন তারা দিয়ে বললো,
-“কি হলো হাঁ করো?

এ কথা শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে আলোর চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে। ফাহমিদা হকচকায়!বললো,
-“সেকি তুমি কাঁদছো কেন?

আলো আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, ঝাঁপিয়ে পড়লো ফাহমিদার বুকে। ফাহমিদা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“আমরা সবাই একদিন চলে যাবো বুঝলে?কেউ থাকবো না।মন টাকে শক্ত করো।
আজ থেকে আমি তোমার মা।

ফাইজা আসে এখানে আলো কে কাঁদতে দেখে তার খুব কষ্ট হয়। কাছে গিয়ে বললো,
-“ভাবী মনি কেঁদ না, তোমার আরেক মা’কে তো আল্লাহ তা’আলা পাঠিয়ে দিয়েছেন তাই না?

আলো মাথা নাড়িয়ে চোখের পানি মুছে। ফাহমিদা খাবার খাইয়ে দেয়।
দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে দেখে ফয়জান।তার খুব শান্তি লাগছে এই ভেবে যে তার মা আজ থেকে আলোর ও মা। মেয়েটার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

ফাইজা তৈরি হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়।পিছু পিছু কায়েস ও যায়।ফাইজা কে বলে,চলো আজকে তোমাকে অফিসে নিয়ে যাই?
ফাইজা অবাক হয়ে বললো,
-“তার দরকার নেই আপনি উল্টো পথে কেন যাবেন আপনার অফিসের লেইট হয়ে যাবে।
-“হলে হবে, তোমাকে ভাবতে হবে না।

অঘর্তা কায়েসের সাথে যেতে হলো ফাইজা কে।
.
.
ফয়জান কলেজের জন্য তৈরি হয়ে নিয়ে। আলো জানিয়েছে আজকে কলেজে যাবে না।তাই ফয়জান একাই যাবে।যাওয়ার আগে আলোর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে,আলোর ডান গালে হাত রেখে বললো,
-“বিয়ে করেছো বলে আজকে কিছু বললাম না। তুমি কিন্তু জান পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া আমি একদম পছন্দ করি না।
আর হ্যাঁ একদম কাঁদবে না,কিছুর প্রয়োজন হলে মা আর বড় মা’কে বলবে।

তারপর ফয়জান বেড়িয়ে গেলে আলো গালে হাত দিয়ে ফয়জান এর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।
.
.
তায়েস তার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছে মেয়েটা কে খুঁজে বের করার। এখানে অনেক গুলো হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলেছে সবার নাম ঠিকানা চেক করেছে কিন্তু কোন খুঁজ মিলেনি এই পর্যন্ত।….

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।