শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-০১

0
1051

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(১)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

ফয়জান এসেছে তার সহকর্মী সিনিয়র শিক্ষিকা আইরিন সুলতানার জানাযায় শরীক হতে! সেখানে তার কলেজের সবচেয়ে মেধাবী এবং পর্দাশীল ছাত্রী আলো কে প্রথমবারের মতো দেখে!স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল ফয়জান।

মেয়েটা সবসময় নিজেকে পূর্ণ পর্দায় আবৃত করে কলেজে আসে তাই গত এক বছর যাবত কেউই মেয়েটা কে দেখতে পায়না। সেখানে কয়েক মাস হলো ফয়জান কলেজে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছে।তাই তার ও দেখার কথা নয়।ফয়জান কে তাকিয়ে থাকতে দেখে একজন শিক্ষক বললেন, মেয়েটার শেষ আশ্রয় টুকুও চলে গেল! কথাটা শুনে অবাক চোখে তাকায় ফয়জান। এদিকে লাসের খাটিয়া ধরে অজস্র কেঁদে চলেছে আলো। ফয়জান ভাবছে নিঝুম কে গিয়ে শান্তনা দিবে কিনা।

কেউ কেউ বলছে খাটিয়া নেওয়ার সময় হয়ে গেছে, মেয়েটা কে কেউ ঘরে নিয়ে যান। কয়েকজন মহিলা এসে আলো কে নিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু আলো কিছুতেই যাবে না,সে কান্না করেই চলেছে।তার কান্নার কোন শব্দ নেই।শব্দবিহীন কান্না কিভাবে করতে হয় তা আলো’র থেকে শিখে নেওয়া যায়। তবে মেয়েটার চোখের পানি অজস্র ধারায় ঝরছে যার ফলে চোখ গুলো লাল রঙা ধারন করেছে। ফর্সা মুখশ্রী মলিন হয়ে গেছে, শরীরের কিছু অংশ মাটি লেগে আছে।মুখ আর হাত গুলো শুধু অনাবৃত তাছাড়া পা পর্যন্ত পর্দায় আবৃত।

ফয়জান প্রথমে চিনতে পারেনি আলো কে, কলেজের আয়া এসে যখন বললো,আলো ইসলাম তোমার কলেজের শিক্ষকরা এসেছেন ম্যাডামের জানাযায় শরিক হতে। তখন ফয়জান চিনতে পারে আলো’কে।

আলো ঘরে যাচ্ছে না দেখে ফয়জান হাঁটু ভাঁজ করে আলো’র কাছে গিয়ে বসে বললো,আলো?
প্রথম ডাকে সাড়া দিলো না আলো তাই আবার ডাকলো আলো বলে। দ্বিতীয় বার মাথা তুলে তাকায় আলো। ফয়জান নরম গলায় বললো, কেঁদো না প্লিজ। আমাদের সকলকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তুমি তো ধার্মিক একটা মেয়ে,জানো তো কান্না করা ঠিক নয়। এরচেয়ে তুমি কোরআন তেলাওয়াত করো, জিকির করো,দুরুদ শরীফ পাঠ করো এতে তোমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবেন।
আলো থেমে থেমে বললো,স্যার আম্মু আমাকে সাথে কেন নিয়ে গেল না? আমি কি করে থাকবো আম্মু কে ছাড়া।

ফয়জান বললো, এরকম কথা বলে না আলো। আমি তো জানি তুমি হাদীস সম্পর্কে অনেক জ্ঞান রাখো। তাহলে তোমার এরকম কথায় আল্লাহ তা’আলা নারাজ হবেন সেকি জানো না? তাহলে এরকম কথা আর বলো না। এবার উঠে এসো।

আলো বসেই রইলো!তা দেখে ফয়জান বললো, তুমি আমার কথা শুনছো না? তোমার শিক্ষকের কথা,, আরো কিছু বলার আগেই আলো উঠে দাঁড়ালো, তারপর কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে ঘরের দিকে যায়। দরজা দিয়ে যখন ডুকে যাবে তখন আবার শেষ বারের মতো মায়ের খাটিয়ার দিকে ফিরে তাকায়।
এদিকে লোকজন খাটিয়া নিয়ে যেতে তৈরি হয়,ফয়জান নিঝুমের দিকে একপলক তাকিয়ে খাটিয়া ধরতে শরিক হয়।
.
.
দুই মাস পূর্বে,
ক্লাসে একজন হ্যান্ডসাম সুপুরুষ কে দেখে ছাত্রীরা বেশ অবাক হয়। সাথে কেউ কেউ প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করে।

সুদর্শন যুবকটি বললো, হ্যালো এভরিওয়ান। আমি তোমাদের নতুন টিচার। আমি ফয়জান মাহমুদ চৌধুরী।

এর মধ্যে একজন ছাত্রী দাঁড়িয়ে বললো,স্যার কোন সাবজেক্ট নিবেন আপনি?

ফয়জান বললো, আমি তোমাদের হিসাববিজ্ঞান বিষয়টি নিব।

এর মাঝে প্রিন্সিপাল স্যার এলেন ক্লাসে। সবাই সালাম দিলে,প্রিন্সিপাল স্যার সকলকে আরেক বার পরিচয় করিয়ে দিলেন ফয়জান এর সাথে।ছাত্রীরা বেশ উতফোল্ল, নতুন টিচার কে পেয়ে।তাই ধন্যবাদ জানাতে ভুললো না প্রিন্সিপাল স্যার কে।

প্রিন্সিপাল স্যার চলে যাওয়ার পর। ফয়জান বললো, আমার ক্লাসের সার্থে তোমাদের পরিচয়টা জানা অতি প্রয়োজনীয়।একে একে সবাই পরিচয় দেও।

সবাই স্যারের কথা মতো পরিচয় দিতে খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে।প্রথম বেঞ্চ থেকে শুরু হলে বোরকা পরিহিত একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বললো, আসসালামু আলাইকুম। আমি আলো ইসলাম।

মেয়েটাকে মাত্র ই খেয়াল করলো ফয়জান।সে খুবই আশ্চর্য হলো মেয়েটাকে বোরকা পরিহিত অবস্থায় দেখে। যেখানে কলেজের নিয়ম অনুযায়ী সবাই সাদা এফ্রনের সাথে সাদা স্কার্ফ পরেছে সেখানে মেয়েটা বোরকা পরিহিত।
ফয়জান ভাবনা বাদ দিয়ে বললো,নেক্সট?

তারপর একে একে সবাই সবার পরিচয় দিল। পরিচয় পর্ব শেষে ফয়জান পড়ায় মনোনিবেশ করে জিজ্ঞাসা করলো, কোন চ্যাপ্টার থেকে শুরু করলে তোমাদের জন্য ভালো হবে বলো? আমি সেখান থেকেই শুরু করবো।

কয়েকজনের মতামত নিয়ে আর্থিক বিবরণী চ্যাপ্টার থেকে শুরু করে ফয়জান।ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ছাত্রীদের বোঝায়,আর্থিক বিবরণী অধ্যায় থেকে বাধ্যতামূলকভাবে যেহেতু দুটি প্রশ্নের উত্তর করতে হবে, তাই এই অধ্যায়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে করতে হবে। এই অধ্যায়ে তিন ধরনের আর্থিক বিবরণী রয়েছে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের, ক্রয় বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের এবং উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী। তোমরা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নীট লাভ নির্ণয়, মালিকানা সত্ত্ব বিবরণী, উদ্বৃত্তপত্র প্রণয়ন করা শিখবে। এবং ক্রয় বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মোট লাভ নির্ণয়, নীট লাভ নির্ণয়, মালিকানা সত্ত্ব বিবরণী, মোট সম্পদ নির্ণয় এবং মোট দায় নির্ণয় করা শিখবে। তবে প্রথমে আর্থিক বিবরণীর ছক শিখতে হবে।এই ছক টা শিখতে পারলে অংঙ্ক করা পানির মতো সহজ লাগবে।

এবার বলো তোমরা সবাই কি আর্থিক বিবরণীর দুইটা ছক বিষদ আয় বিবরণী এবং মালিকানা স্বত্ব বিবরণী পারো?

সবার মধ্যে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। তখন আলো বললো,জ্বি স্যার পারি।

ফয়জান সবার দিকে লক্ষ্য করে আহত স্বরে বললো, মাত্র একজন?আর বাকিরা?

সবাই মাথা নিচু করে বসে আছে।এর মধ্যে কয়েকজন বললো, স্যার পারি তবে মাঝে মধ্যে গন্ডগোল লেগে যায়।

ফয়জান বললো, এটাকে পারি বলে না।ছক গুলো এমন ভাবে মুখস্থ করতে হবে যেই কোন স্থান থেকে প্রশ্ন আসলে যেন আন্সার করা যায়।
অধিকাংশ স্টুডেন্ট যেহেতু ছক গুলো পারো না সেহেতু আগামীকালের পড়া দুইটা ছক। আমি সবার থেকে পড়া পাই। মনে থাকবে?

সবাই একসাথে বলে,জ্বি স্যার।
.
.
দ্বিতীয় দিন ক্লাসে পড়া ধরে ফয়জান।
প্রথম দুটো মেয়ে ঠিক মতো বলে। তিন নাম্বার জন একটু বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।তার মানে সে পারে না। তারপর আলো কে জিজ্ঞাসা করে,পরিচালন মুনাফা বের করে কিভাবে?

— মোট মুনাফার সাথে যোগ পরোক্ষ পরিচালন আয় এবং পরিচালন ব্যয় বিয়োগ করলে পরিচালন মুনাফা পাওয়া যায়।
— মালিকানা স্বত্ব থেকে কোন গুলো প্লাস মাইনাস করতে হয়?
— মূলধন যোগ অতিরিক্ত মূলধন বিয়োগ উত্তোলন যোগ নিট লাভ।

সব গুলোই সঠিক উত্তর দেয় আলো। ফয়জান লক্ষ্য করে মেয়েটা প্রথম থেকে মাথা নিচু করে উত্তর গুলো দিচ্ছে।তারপর আলো কে বসতে বলে আলো’র বান্ধবী ইসমত আরা কে দাড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,মোট সম্পদ বের করে কিভাবে?

ইসমত আরা বললো,
— স্যার মোট চলতি সম্পদ,যোগ বিনিয়োগ তারপর, তারপর..
— তারপর?

ইসমত হাতের আঙ্গুলে স্কার্ফ পেচাতে পেচাতে বললো,
–স্যার ভুলে গেছি। একটু দেখলেই মনে পড়ে যাবে।

ফয়জান রগচটা নয়নে তাকিয়ে বললো,
— দাঁড়িয়ে থাকো।
নেক্সট তুমি বলো?নিট লাভ বের করার ধাপ গুলো কি কি?

এরকম ভাবে পুরো ক্লাসের ছাত্রীদের মধ্য থেকে ঠিক ভাবে পড়া দিতে পারে মোটা পাঁচজন!আর বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে। ফয়জান রেগে বললো, বেঞ্চের উপর দাঁড়াও সবাই!

সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে ফয়জান আবার বললো,
— যারা দাঁড়িয়ে আছো তারা বেঞ্চের উপর কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো।নাও ফার্স্ট!

সবাই ভয়ে হুড়মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে যায় বেঞ্চের উপর।

তারপর ফয়জান তার ক্লাসের কিছু রুলস দেয়। এবং এটাও বলে যে, রুলস না মানলে আজকের মতো শা’স্তি দেওয়া হবে। এবং পড়াশোনার ব্যাপারে কোন ছাড় দেয়া হবে না।
.
ঘন্টা পরলে ফয়জান চলে যায়।আর হ্যা যাওয়ার আগে বলে যায় আগামীকাল যেন ছক গুলো ভালো করে পড়ে আসে। আগামীকাল অঙ্ক করাবে সে।

ফয়জান যাওয়ার পর সবাই ক্লান্ত হয়ে যার যার সিটে বসে। ইসমত আরা রাগে দুঃখে আলোকে বলে,
— দোস্ত এটা দেখি আস্ত একটা খারুস!

আলো হেসে বললো,
— খারুস মানে কি?
— খারুস মানে রস,কসহীন একটা বস্ত্র(সিরিজ পেপার) কোথায় ভেবেছিলাম একটা ইয়াং স্যার এসেছে ক্রাস খেতে খেতে জীবন পার করবো,তা নয় এখন জীবন তেজপাতা বানিয়ে ছাড়বে ঐ খারুস স্যার।

আলো বললো,
— তুই যাই বলিস না কেন স্যার কিন্তু অনেক ভালো বোঝায়।দেখবি এবার হিসাববিজ্ঞান এ সবাই ভালো করবে ইনশা আল্লাহ।….

#চলবে??