শুভ্র নীলাভ আকাশে মেঘের আনাগোনা পর্ব-০২

0
643

#শুভ্র_নীলাভ_আকাশে_মেঘের_আনাগোনা(২)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

ঘর্মাক্ত শরীরে ঘরে ঢুকে তায়েশ। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব ক্লান্ত। আয়েশা দ্রুত পায়ে লেবুর শরবত এনে দেয় ছেলেকে।ড্রয়িং রুমে বসে থাকা সবার নজর এখন তায়েশের উপর নিবদ্ধ। আয়েশা স্নেহের স্বরে বললো,
— আজ‌ও বস রাগারাগী করেছেন?

তায়েশ প্যান্টের পকেট থেকে রি’ভ’ল’বার টা বের করে ছোট ট্রি টেবিলে রেখে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
— আম্মা এই কয়েক মাসে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। আমি কিছুতেই খু’নি’কে শনাক্ত করতে পাচ্ছি না।খু’নি খুব নিখুঁতভাবে খু’ন গুলো করে চলেছে। সবচেয়ে বড় কথা সব গুলো খু’ন এক‌ই ভাবে করা হচ্ছে যা থেকে বুঝা যায় খু’নি একজন বা এক‌ই চক্রের।

ফয়জান বললো,
— এই মাত্র খবরে দেখলাম আজ‌ও একটা ছেলের লা’শ উদ্ধার করেছে পুলিশ! অন্যান্য হ’ত্যা’র মতো আজকেও ছেলেটার পুরুষাঙ্গে আ’ঘা’ত করে হ’ত্যা করা হয়েছে! আশ্চর্য বিষয় ছেলেটার শরীরে অন্য কোন ক্ষত স্থান নেই।

তায়েশ মাথার চুল টেনে ধরে বললো,
— হুম ভাইয়া,সব গুলো খু’ন এক‌ই ভাবে করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়,যে ছেলে গুলো কে হ’ত্যা করা হচ্ছে সেই ছেলে গুলোর সমস্ত ইনফরমেশন থেকে জানা গেছে,কেউ নারী প্রা’চারের সাথে জড়িত,কারো বা নারী নির্যা’তনের মা’মলা রয়েছে! আবার কেউ বা নারীদের ইভ’টিজিং করে বেড়াতো!

কায়েস মাথা নিচু করে বসে আছে, সবার কথা গুলো শুনেও জেন শুনছে না!

তখন রামিশা বললো,
— এসব জঞ্জাল সমাজে না থাকাই ভালো। যারা বা যে এই খু’ন গুলো করছে আমি তাদের সেলুট জানাচ্ছি। এদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তায়েশ ভাইয়া আপনি বরং হ’ত্যা’কারী কে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করুন, কারণ আপনারা পুলিশ’রা ত এই কাজগুলো করতে অক্ষম।

তায়েশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রামিশার দিকে।রামিশা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ড্রয়িং রুম থেকে চলে যায়।
.
.
তায়েশ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একজন উপ-পরিদর্শক (SI)গত কয়েক মাসে একেরপর পর এক খু’ন করা হচ্ছে আর খু’নি’কে শনাক্ত করার দায়িত্ব পরেছে তায়েশের উপর। শুধু তাই নয় ইন্সপেক্টর তুহিন হাওলাদারের মেয়ে,
এক সপ্তাহ যাবত নিখোঁজ!তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব পরেছে তায়েশের উপর।
যার দরুন তুহিন হাওলাদার রীতিমতো কথা শুনিয়ে যাচ্ছে তায়েশ কে।
সামান্য একটা মেয়েকে খুজে বের করতে পারছেন না, সেখানে এরকম নিখুঁত খু’নি’কে শনাক্ত করা আপনার দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়,যদি না ই পারেন দায়িত্ব নিতে গেলেন কেন?ছেরে দিন পুলিশের পোশাক।
এরকম নানা কথা বার্তা শুনিয়ে চলেছেন ইন্সপেক্টর রাকিব হাওলাদার।

রগচটা তায়েশ মাহমুদ মাঝে মাঝে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিবে, কিন্তু এতো কষ্টের পর নিজের স্বপ্নের ধাপে পা রেখে পিছিয়ে যাওয়াটা কাপুরুষের কাজ।তাই আবার নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নেয় তায়েশ, আরো করা ভাবে পুলিশ ফোর্স কে নিয়ে পরিকল্পনা করে।
.
.
এদিকে রামিশা নিজের রুমে এসে প্রান ভরে দম নেয়। এতক্ষণ ধরে কি দুঃসাহসী কাজটাই না সে করলো। রাগী বদমেজাজী সাব-ইন্সপেক্টর তায়েশ মাহমুদের মুখের উপর এত গুলো কথা শুনিয়ে দিল, ভাবা যায়। নিজের প্রতি নিজের খুব প্রাউড ফিল হচ্ছে রামিশার।

লন্ডন থেকে আসার পর থেকে তায়েশের সাথে শুধু ঝগড়াই হয়েছে রামিশার।তাই আজকে যেন সুদে আসলে ফেরত দিতে পেরেছে, এরকম ফিল হচ্ছে রামিশার।

লন্ডন থেকে আসার তৃতীয় দিন, একটা অগোছালো রুম চোখে পরে রামিশার তাই দিকপাশ না ভেবে কৌতুহল বশত রুমটায় ঢুকে রামিশা।
কি ভাবছেন রুমটা সুন্দর করে গোছানোর জন্য ঢুকেছে?
আরে না না, এই কাজ রামিশার দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়।এই অগোছালো রুমটাকে আরো অগোছালো করার জন্যই তার প্রবেশ!
কারণ এর থেকেও বড় অগোছালো মেয়ে রামিশা যার কারণে মায়ের থেকে কম বকা শুনতে হয় না তাকে।

তো যা বলছি, রুমটায় ঢুকে প্রথমে একটা বড় ফুটবল পায়ের কাছে পায় রামিশা, নিজের ডান পা দিয়ে মেসির মতো করে বলটা মেরে দিল।বলটা গিয়ে পড়ল দেয়ালে থাকা পেপার ফ্লাওয়ারের উপর!যার কারণে পেপার ফ্লাওয়ার টা দেয়ালেই চ্যাপ্টা হয়ে গেল! তারপর খাটের কাছে গিয়ে দেখে অনেক ব‌ই এলোমেলো করে রাখা।ব‌ই গুলো একটা একটা করে হাতে নিয়ে দেখে, দেখার পর একটা ব‌ই রাখে খাটের এক কোনায় তো আরেকটা রাখে আরেক কোনায়।

তারপর আসে বুক সেল্ফের কাছে, একটা একটা করে ব‌ই গেটে গেটে দেখছে মনে হয় যেন কত পরিচিত তার এই বুক সেল্ফ। পাশে একটা রকিং চেয়ার, যেটাতে পুলিশের পোশাক ছড়িয়ে রাখা।যা দেখে ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচু করে রামিশা।
কিন্তু বেশি পাত্তা না দিয়ে, কম্পিউটার রাখা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। কিবোর্ডের উপর একটা কি যেন দেখতে পেয়ে হাতে তুলে নেয় রামিশা,
হাতে তুলে নেওয়ার পর দেখলো এটা ছেলেদের জাংগিয়া। সাথে সাথে ছুরে ফেলে, নিজের মুখের আকৃতি করে ওয়াক, কি যাতা একটা অবস্থা!নিজে নিজেই বকবক করে বলে,
এখানে কি কোন এলিয়েন থাকে নাকি? আমার রুম তো এতোটাও খারাপ না বাবা।
তারপর একটা খুব সুন্দর সপিশ দেখতে পায়,সপিশটা একটা কাঁচের গাছ উপরের দিকটা গাঢ় সবুজ রঙের পাতা গুলো নিচে শিখর গুলো সচ্চ পানির মতো।সপিশটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে রামিশা তখন পিছন থেকে কেউ বলে, আমার জাংগিয়া টা কফির কাপে ফেললো কে?

হঠাৎ কারো উচ্চ কন্ঠ শুনতে পেয়ে কেঁপে ওঠে রামিশা যার দরুন হাত ফসকে সপিশটা ফ্লুরে পরে টুকরো টুকরো হয়ে যায়!
তায়েশ মাথাটা খানিক কাত করে দেখলো তার প্রিয় সপিশটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পরে আছে ফ্লুরে!তাই রেগে গিয়ে ধমকে বলে ইডিয়ট কোথাকার!কে তুমি? আমার জিনিসে হাত দেওয়ার সাহস পেলে কোথা থেকে? শুধু তাই নয় ভেঙ্গে ও ফেললে।

তায়েশ রাগি মুখশ্রী করে এগিয়ে আসে রামিশার দিকে!রামিশা ভয়ে চুপসে যায়,যার কারণে কিছুটা পিছিয়ে যায়। ফলস্বরূপ কাঁচের টুকরো গুলো তে পা দিয়ে দেয়, সাথে সাথে কাঁচ গুলো বিঁধে যায় পায়ে!রামিশার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ইয়া আল্লাহ আর্তনাদ।তায়েশ থমকে দাঁড়ায়,সে এমনটা কখনোই চায়নি। তবে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো, আল্লাহ উচিৎ বিচার করেছে অন্যের ক্ষতি করলে নিজের ক্ষতি হবে এটাই স্বাভাবিক।

সেদিন তায়েশ রামিশার প্রতি একটু সহানুভূতি ও প্রকাশ করেনি।এরপর থেকে রামিশার সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ হয়ে ওঠে তায়েশ মাহমুদ। দুজনে যেন দু’জনের চোখের বালি!
.
.
আজকে ফয়জান ক্লাসে ঢুকে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল, কোথাও আলো নামের বোরকা পরিহিতা মেয়েটি নেই। তাহলে কি আজকে কলেজে আসেনি? হবে হয়তো।

মেয়েটি ক্লাসে উপস্থিত থাকলে ফয়জানের খুব ভালো লাগে। ফয়জান যেখান থেকেই প্রশ্ন করে না কেন খুব ঝটপট উত্তর দিয়ে দেয় আলো।তাই আলো’র প্রতি এক অন্যরকম অনুভুতি কাজ করে ফয়জানের।

প্রতিটি স্কুল কলেজে এরকম কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী থাকে। এবং তাদের প্রতি এক আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে টিচার দের।সে হিসেবে ফয়জান ও ব্যাতিক্রম নয়।

তাছাড়া শুধু ফয়জান নয় হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রত্যেকটা শিক্ষক আলোকে ভালোবাসে। শুধু যে ওর মেধার কারণে তা কিন্তু নয়।আলো কে ভালোবাসার মতো আরো অনেক কারণ বিদ্যমান।

ফয়জান অফিস রুমে বসে সি.টি. পরীক্ষার খাতা দেখছে তখন সমির স্যার আসলেন। ফয়জান কে বললো,
— স্যার ব্যস্ত নাকি?

ফয়জান খাতায় মার্কস দিতে দিতে বললো,
— এই তো সেকেন্ড ইয়ারের খাতা দেখছি।স্যার কিছু বলার ছিল আপনার?
— এখন আমাদের দুজনের ই তো ক্লাস নেই তাই ভাবলাম আপনার সাথে ক্যান্টিনে বসে কফি খেতে খেতে আড্ডা দিব আর কি।
— আচ্ছা তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, শেষের খাতাটা দেখে যাবো।

সমির স্যার পাশের একটা চেয়ারে বসে ফোন স্ক্রলে মনোযোগ দেয়। ততক্ষণে ফয়জান এর খাতা দেখা হয়ে যাবে এই ভেবে।
ফয়জান খাতায় চোখ নিবদ্ধ রেখেই বললো,
— জীবনে প্রথম কোন ছাত্রী কে দেখলাম যে কিনা পঞ্চাশ মার্কসের পরীক্ষায় পঞ্চাশ পেয়েছে! মানতেই হবে মেয়েটা খুবই মেধাবী ছাত্রী। তাছাড়া ওর ধার্মিকতা দেখেও আমি ভেরি ইমপ্রেস। একটা মেয়ে এতোটা নিখুঁত হতে পারে সেটা আলো ইসলাম কে না দেখলে কখনো বিশ্বাস করতাম না।

সমির স্যার ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফয়জান কে বললো,
— সরি খেয়াল করিনি।কার এতো প্রশংসা করছেন?
— সেকেন্ড ইয়ারের আলো ইসলাম এর কথা বলছি।

সমির ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে বললো,
— আলো ইসলাম!ঐ নাচনে ওয়ালীর কথা বলছেন?

ফয়জান অরুনলোচন আঁখি মেলে বললো,
— নাচনে ওয়ালী মানে?

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।