শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণতা পর্ব-০৭+০৮

0
291

#শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণতা
#পর্বঃ০৭+০৮
#ফারজানা_আক্তার

সিয়াম বিরক্তি নিয়ে বসে আছে রাইসাদের ড্রয়িংরুমে। ঘরটা টিনের হলেও বড় বড় দালানকোঠাকেও হার মানাবে, খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ঘরটা। সিয়াম বসে আছে আর সিয়ামের একমাত্র শালা ফাহিম ওকে জ্বালিয়ে পুরিয়ে শেষ করতেছে। রাইসা ওর রুমে কাপড় চেঞ্জ করতেছিলো, শাড়ি পরিধান করে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব না তাই জামা পরিধান করে নেয়। রাইসা কখনো থ্রি পিচ পরিধান করে না, সে সবসময়ই গোল কাটিংয়ের জামা পরে ফ্রক এর মতো। রাইসা জামা চেঞ্জ করে এসেই সিয়ামকে ডেকে ওয়াশরুমে নিয়ে যায় ফ্রেশ হওয়ার জন্য। তারপর খাবার টেবিলে নিয়ে আসে। রোকসানা আমিন মেয়ে জামাইয়ের জন্য অনেক পদের রান্না করেছেন। বড় ঘরের ছেলেকে তো তাদের মতোই আপ্যায়ন করতে হবে এটা ভেবেই উনি এতোকিছু আয়োজন করলেন কিন্তু সব পদ খাওয়া সম্ভব হয়নি সিয়ামের। সিয়াম খুব চিমচাম, একসাথে বেশি খাবার খেতে পারেনা তবুও আজকে শ্বাশুড়ি মায়ের আবদারে যথেষ্ট খেয়েছে। খাওয়া দাওয়া শেষে ফারুক আহমেদ বলেন সিয়ামকে আর রাইসাকে রুমে যেয়ে আরাম করার জন্য।
রাইসা রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে আছে, সিয়াম এক হাত মাথার নিচে রেখে আরেক হাত বুকের উপর রেখে চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে সিয়াম বলে “তোমার রুমে ওয়াশরুম নেই?”

রাইসা মনটাকে কিছুটা ছোট করে বলে “না, কেনো?”

সিয়াম শুয়া থেকে উঠে বসে উত্তেজিত হয়ে বলে “কেনো মানে কি সকালে গোসল করবো কি ওই বাহিরের ওয়াশরুম যেয়ে?”

মাথা নিচু করে ফেলে রাইসা। সিয়াম শক্ত কণ্ঠে বলে “আমরা আগামীকালই চলে যাবো। এতোদিন থাকতে হয়না, পরে অন্যসময় না হয় তুমি একা এসে থেকো।”
কথাগুলো বলে পাশ ফিরে শুয়ে পরে সিয়াম। সে যে উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছে সেটা সফল না হওয়া পর্যন্ত শান্তি হবেনা ওর। সিয়ামের মেজাজ বিগ্রে যাচ্ছে বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলে কি বলবে সেটা ভেবে।
রাইসার লজ্জা করছে সিয়ামের পাশে শুতে তাই সে বসে আছে। সিয়াম খেয়াল করছে রাইসা হুদাই বসে আছে তাই সে উঠে যেয়ে লাইট বন্ধ করে দিয়ে রাইসাকে বকাবকি করে শুইয়ে দেয়। রাইসা সিয়ামের বকা শুনে চুপচাপ শুয়ে গেলেও মনে মনে খুব অভিমান হয় ওর।

সকালে আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভাংগে রাইসার। রাইসা ঘুম থেকে জেগেই দেখতে পাই সিয়ামের ঘুমন্ত মুখ। সিয়াম যে একজন বখাটে ছেলে সেটা কেউই বিশ্বাস করবেনা এই ঘুমন্ত চোহারটা দেখলে। ঘুমন্ত অবস্থায় একদম নিষ্পাপ লাগছে ওকে। রাইসা অনেকক্ষণ উপভোগ করে এই ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটাকে। তারপর রাইসা ফ্রেশ হয়ে ওজু করে এসে নামাযে দাঁড়াতে যায়, নামাযে দাঁড়ানোর আগে সে একবার সিয়ামকে ডাকতে আবার বিছানার কাছে যায়। প্রায়ই অনেকক্ষণ ডাকলেও সিয়াম উঠেনা, পরে রাইসা হালকা পানি ছিঁটিয়ে দেয় ওর মুখে, সকাল সকাল ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেয়ে লাফিয়ে উঠে সিয়াম।

“পাগল হয়েছো নাকি সকাল সকাল? পানি ছিঁটাও কেনো?”
রাগান্বিত কণ্ঠে বলে সিয়াম।

“আসলে নামাজ পড়ার জন্য ডাকছিলাম আপনাকে, কিন্তু অনেকক্ষণ ডাকলেও যখন আপনি উঠলেননা তখন বাধ্য হয়েই পানি ছিঁটালাম।”

রাইসার কথা শুনে কিছুক্ষণ রাগান্বিত নজরে তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে সিয়াম তারপর বলে “পড়বোনা আমি নামায। কখনোই পড়িনি আমি। তুমি পড়ো যাও আর আমার জন্যও দোয়া করে দিও।”

সিয়ামের কথা শুনে অবাক হয় রাইসা। এটা কেমন মানুষ। রাইসা সবসময়ই একজন দ্বীনদার জীবনসঙ্গী চেয়েছে অথচ আল্লাহ তার ভাগ্যে এমন বাজে চরিত্রের একজন মানুষ মিলিয়ে দিবেন কখনো চিন্তাও করেনি সে। রাইসা আবারো ডাকে সিয়ামকে তখন রেগে যেয়ে ঝাঁজালো গলায় সিয়াম বলে “এতো নামায নামায করছো কেনো তুমি? কি হবে নামাজ পড়ে? পড়বোনা আমি নামায।”

রাইসা বলে “ধৈর্য আছে শোনার?”

বিরক্তি ভাব নিয়ে সিয়াম বলে “কি শোনার?”

“এই যে বললেন নামায পড়ে কি হবে সেটা?”

“শোনার ইচ্ছে নেই৷ ঘুমাতে দাও।”

“তবুও তো শুনতে হবে জনাব।”

“বাড়াবাড়ি করতেছো কিন্তু?।”

“হুম করতেছি আগে আমার কথা শুনুন তারপর নামায পড়ুন, নামায পড়লে আর কোনো বাড়াবাড়ি করবোনা প্রমিজ।”

সিয়াম কিছু বলেনা, শুধু লাল লাল চোখ করে রাইসার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। রাইসা ভয় পেয়ে যায় সিয়ামের এমন দৃষ্টি দেখে তবুও সে সাহস করে বলে আচ্ছা শুনুন নামাজ কেনো পড়তে হবে –

যে কারণে নামাজ আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল

ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নামাজ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে বার বার নামাজের তাগিদ পেয়েছেন। কুরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন জায়গায় সরাসরি ৮২ বার সালাত শব্দ উল্লেখ করে নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

তাই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজকে ঈমানের পর স্থান দিয়েছেন। নামাজের গুরুত্ব ও ফায়েদা সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের সামনে অসংখ্য হাদিস বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে একটি হলো-
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম- (হে আল্লাহর রাসুল!) আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় আমল কোনটি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘নামাজ’। (বুখারি ও মুসলিম)

উল্লেখিত হাদিস বর্ণনা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইসলামি স্কলার আল্লামা মোল্লা আলি ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘এ হাদিসের মাধ্যমেই আলেমগণ ঈমানের পর নামাজকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করেন।

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা মনোনীত সর্বোত্তম আমল হলো নামাজ। অতএব যে বেশি বেশি নামাজ পড়তে সক্ষম, সে যেন বেশি বেশি নামাজ পড়ে। (তাবারানি)

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজের গুরুত্ব বুঝাতে হাদিসের মাধ্যমে একটি উপমা প্রদান করেছেন।

হজরত আবু যর গিফারি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সময় শীতকালে বাইরে (কোথা্র) তাশরিফ আনলেন। তখন গাছের পাতা ঝরার মওসুম ছিল। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গাছের একটি ডাল হাত দিয়ে ধরলেন। ফলে তার পাতা আরও বেশি ঝরতে লাগল।

অতঃপর তিনি বললেন, হে আবু যর! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি উপস্থিত। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন-

‘মুসলমান বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নামাজ আদায় করে, তখন তার থেকে পাপসমূহ ঝরে পড়ে; যেমন এ গাছের পাতা ঝরে পড়ছে। (মুসনাদে আহমদ)

নামাজই একমাত্র ইবাদত; যার মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার সব কাজ ছেড়ে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত হয়ে যায়। এ নামাজই মানুষকে দুনিয়ার সব পাপ-পংকিলতা থেকে ধুয়ে মুছে পাক-সাফ করে দেয়। দুনিয়ার সব অন্যায়-অনাচার থেকে হেফাজত করে।

পরিশেষে…
নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া মুমিন মুসলমানের ঈমানের দাবি ও ফরজ ইবাদত। নামাজি ব্যক্তিই হলো সফল। যার সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন প্রিয়নবি। তিনি বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি নামাজের প্রতি যত্নবান থাকে; কেয়ামতের দিন ওই নামাজ তার জন্য নূর হবে এবং হিসেবের সময় নামাজ তার জন্য দলিল হবে এবং নামাজ তার জন্য নাজাতের কারণ হবে।

পক্ষান্তরে
যে ব্যক্তি নামাজের প্রতি যত্নবান হবে না- কেয়ামতের দিন নামাজ তার জন্য নূর ও দলিল হবে না। তার জন্য নাজাতের কোনো সনদও থাকবে না। বরং ফেরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফের সাথে তার হাশর হবে।’

এবার বুঝেছেন নামাজ কেনো পড়তে হবে নাকি আরো বুঝাতে হবে?”

“থামো বলছি, আর একটা কথাও বলবেনা তুমি আমার সামনে। ওয়াশরুমে ওজু করা যাবে?”

“হুম যাবে। কিন্তু আপনি কি সত্যি সত্যি নামাজ পড়বেন?”
মুচকি হাঁসি দিয়ে চাপা কন্ঠে বলে রাইসা।

“তো কি? এখানে বসে তোমার লেকচার শোনার চেয়ে নামাজটা পড়ে চুপচাপ কানে তুলো দিয়ে ঘুমানো অনেক ভালো।”
দাঁত গিজগিজ করে কথাটি বলে সিয়াম বিছানা থেকে নেমে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়।
রাইসা মুচকি হেঁসে নামাযে দাঁড়িয়ে যায়।

দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যায় রাইসা, তার পাশেই বসে ফোন ঘাঁটছে সিয়াম। হঠাৎ রাইসা ঘুমের মধ্যেই এদিক থেকে ওদিক হতে ওর একটা হাত সিয়ামের হাতের সাথে স্পর্শ হয়, হঠাৎ রাইসার স্পর্শ পেয়ে ফোন পরে যায় সিয়ামের হাত ফসকে। রাইসা ঘুমে বিভোর, সিয়াম ভাবছে সে এতো মেয়ের স্পর্শ পেয়েছে কিন্তু কখনো এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়নি। রাইসার স্পর্শে অন্যরকম একটা মিষ্টি অনুভূতি অনুভব করেছে সিয়াম। বসে থাকতে থাকতে একসময় সিয়ামও ঘুমিয়ে যায়।

আছরের আজান দিলে রাইসা উঠে ওজু করে আসে। রাইসা নামাযে দাঁড়ানোর আগে সিয়ামকে ডেকে দিলে সে রাইসার হাত ধরে টান দিয়ে রাইসাকেও তার পাশে শুয়ে দেয় আর বলে “চুপচাপ ঘুমাও, সকালেও ঘুমাতে দাওনি, একবার বাসায় গেলে কিন্তু সব উচল করে নিবে দেখে নিও।”
রাইসা সিয়ামের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পরনের কাপড় ঠিক করে নেয় তারপর আবার সিয়ামকে ডাকে আর বলে “এবার না উঠলে কিন্তু সকালের মতো আবার শুরু করবো।” কথাটি বলেই মুখ টিপে হাঁসে রাইসা। সিয়াম আর একমুহূর্তও শুয়ে না থেকে উঠে ওজু করতে চলে যায়, যাওয়ার পথে বিড়বিড় করে বলে “একবার বাসায় নিয়ে যায় তোমায় তারপর বুঝাবো এই সিয়াম কি জিনিস”।
সিয়াম কথাগুলো বিড়বিড় করে বললেও রাইসা কিছুটা শুনে ফেলে, এবার রাইসা ভয় পেয়ে যায় আর নিজে নিজে বলে ” না জানি বাসায় গেলে কি অবস্থা হয় আমার।”

*
হুসনা টিউশনে গিয়েও ছাত্রী কে পড়াতে পারছেনা, মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে হুসনার। আজ রিয়া কলেজ গিয়েছিলো কিন্তু হুসনার মন খারাপের জন্য একটু রিয়ার সাথে আড্ডা দিতে পারেনি। রিয়া অনেক জিজ্ঞেস করেছে হুসনার থেকে মন খারাপের কারণ কিন্তু হুসনা কিছুই বলেনি তাকে। এতো চাপা স্বভাবের মানুষ এর আগে আর কখনোই দেখেনি রিয়া। রিয়া একা একা শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে আর ভাবছে “ছেলেটা এমন কেনো? আজ একবারও আমার দিকে তাকায়নি ক্লাসে। আমি কি একটু বেশিই ভাব নিয়ে ফেলেছি, না না আমি ভাব নিতে যাবো কেনো? ভাবী বলেছে স্বামী ব্যাতিত কোনো পরপুরুষই একজন নারীর বন্ধু হতে পারেনা।”

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ০৮
#ফারজানা_আক্তার

রোদের তাপ অনেকটা কমে এসেছে কিন্তু গরম কাটছেনা কিছুতেই। বাহিরে বইছে মৃদু বাতাস যা কিছুটা গরম কাটানোর চেষ্টা করছে। আছরের নামাজ শেষে নাস্তা সেরে দ্রুত তৈরি হয়ে যায় রাইসা কারণ দেরি হলে যদি মাগরিবের সময় গাড়িতে থাকে তখন নামায কাযা হয়ে যাবে আর রাইসা কখনো নামায কাযা করতে ইচ্ছুক না। রোকসানা আমিন আর ফারুক আহমেদ অনেক জোরাজোরি করেন আরেকটা রাত থাকার জন্য কিন্তু সিয়াম কিছুতেই রাজি হয়নি। যাওয়ার সময় রাইসার মনটা বেশ খারাপ হয়ে যায়। রাইসা খুব করে চেয়েছে আরেকটা রাত থাকতে কিন্তু সিয়ামের কথার উপরে কথা বলার সাহস সে পাইনি। সিয়াম এক কথার মানুষ, ও যা বলবে তা করবেই যেমন এই বিয়েটা। সেইদিনের রিক্তার কড়া কথায় জিদ করেই রাইসাকে সে বিয়ে করেছে যা রাইসার এখনো অজানা। রাইসা চুপচাপ গাড়িতে বসে প্রকৃতি উপভোগ করছে, রাস্তার দুই পাশে আম গাছ আর ফুল গাছ রয়েছে সারিসারি। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর রাইসা সিয়ামের কাছে একটা অনুরোধ করে যা সিয়াম ইচ্ছে করেই রাখেনি। রাইসা সিয়ামকে বলে গাড়ির এসি বন্ধ করে জানালার গ্লাস খুলে দিতে সে প্রকৃতির মৃদু হাওয়ায় নিজেকে শীতল করতে চাই আর এই এসির বাতাসে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে কেননা তেমন একটা অভ্যস নেই রাইসার। সিয়াম রাইসাকে কিছু বলেনা কিন্তু মনে মনে বলে “তোমার এই ছোট ছোট কষ্ট গুলোও বেশ আনন্দ দেয় আমায়”। এসব ভাবে আর বাঁকা হাঁসে সিয়াম।

*
আছরের নামায পড়ে উঠে হুসনা একটা ছোট্ট মেয়ে স্টুডেন্ট কে পড়াতে বসেছে। হুসনা পড়ার টেবিলে বসে বসে ভাবছে ও একটা পার্ট টাইম জব নিবে কারণ এসব টিউশনি করে ওর খরচ পোষায় না, মাসের শেষে খুব হিসেব করে চলতে হয় ওকে, হিমসিম খেতে হয় খুব। একটা পার্ট-টাইম জব হলে মন্দ হতো না কিন্তু কে দিবে জব, হুট করে জব পাবেই বা কোথায় মাত্র ইন্টার প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সে। এসএসসির সার্টিফিকেট দিয়ে ভালো জব আশা করা মানেই হাঁটু সমান পানিতে ডুব দেওয়ার চেষ্টা করার মতোন। অনেক ভেবে চিন্তে হুসনা রিয়াকে কল দেয় তার আগেই সে মেয়েটাকে ছুটি দিয়ে দেয়, আজ সময়ের আগে ছুটি পেয়ে মেয়েটা নাচতে নাচতে বাসায় চলে যায়।
রিয়া কল রিসিভ করে বলে “কিরে হঠাৎ এই সময়ে কল করলি যে, সব ঠিক আছে তো?”
হুসনা চুপ হয়ে আছে কারণ সে রিয়াকে কি বলবে আর কিভাবে বলবে তা বুঝতে পারছেনা। হুসনার নিরবতা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় রিয়া। রিয়া অনেক কথা বলতেছে কিন্তু হুসনার কোনো সাড়াশব্দ নেয় শুধু নিঃশ্বাসের ভারি শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রায়ই ৮মিনিট পর হুসনা ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পান করে নিরবতা ভেঙে রিয়াকে বলে “একটা সাহায্য করতে পারবি?”
হুসনার কথা রিয়ার কর্ণকুহর হতেই যেন রিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। রিয়া খুব দ্রুত গতিতে বলে “কি সাহায্য বল, আমার সাধ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই করবো।”

“একটা ছোটখাটো পার্ট-টাইম জব খুঁজে দিতে পারবি প্লিজ”?
কিছুটা থেমে থেমে বলে হুসনা। রিয়া কি বলবে বুঝতে পারছেনা। রিয়াকে চুপ দেখে হুসনা আবারো বলে “প্লিজ বোন সাহায্য টা কর, চির কৃতজ্ঞ থাকবো আমি”।

“আরে কি বলছিস এসব আর এতো প্লিজ প্লিজ করছিস কেনো? তুই আমাকে বলছিস এবার নিশ্চিন্তে থাক, মনে কর তোর জব কনফার্ম। ”

তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দেয় ওরা। রিয়া চিন্তায় পরে গেছে কারণ হুসনাকে তো ভরসা দিয়ে দিয়েছে এবার কি জব দিবে তাকে সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা। তাদের কলেজ ২ঃ৩০ এ ছুটি হয় বাসায় আসতে আসতে তিনটা বাজে আর তিনটা থেকে কাজে জয়েন করলে ৩টা থেকে ৭টা চার ঘন্টার মতো করতে হবে কাজ এর চেয়ে কম সময় পার্ট-টাইম হয়না। রিয়া ভাবছে এই বিষয়ে আগে রাইসার সাথে বলবে তারপর ওর মা বাবার সাথে বলবে। রিয়া জানে হুসনা সাধারণ ঘরের নয়, হুসনার বাবার টাকার অভাব নাই কিন্তু হুসনা এমন সাধারণ ভাবে কেনো চলে কেনোই বা নিজেই উপার্জন করে নিজের খরচের জন্য তা অজানা রিয়ার কাছে এবং সবার কাছেই। হুসনা এক মগ কফি নিয়ে বেলকনিতে হাঁটাহাঁটি করছে আর ভাবছে শেষ ভরসা রিয়া, রিয়া যদি একটা জব জোগার করতে না পারে তবে আর কেউ নেই যে তাকে সাহায্য করবে। চিন্তার ভাজ কপালে নিয়ে আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছে অন্তরিক্ষের দিকে। হুসনার বড় বোন ফাইজার বিয়ে হয়েছে মাসখানেক আগে, সে তার বরকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে কিছুদিনের জন্য কিন্তু হুসনা এখনো তার দুলাভাইকে দেখা দেয়নি। ফাইজা এসে দাঁড়িয়ে আছে হুসনার পেঁছনে কিন্তু হুসনা খেয়াল করেনি, একটু পর ফাইজা হালকা কেঁশে উঠলে হুসনা পেঁছনে ফিরে দেখে বড় বোনকে।

“এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? প্লিজ ক্ষমা করে দে বাবাকে, উনি যা করেছেন ভুল করেছেন কিন্তু পরে আবার অনুতপ্তও তো হয়েছিলেন। যত যা-ই হয়ে যাক উনি তো আমাদের জন্মদাতা পিতা এটা তো আর চেঞ্জ হবেনা কখনো। তুই প্লিজ স্বাভাবিক হ একটু। ছোট নয় এখন তুই আর, ১৭বছর পেরিয়ে ১৮বছরে পা দিয়েছিস। একটু বোঝার চেষ্টা কর বোন, সিয়া আর মিম তো আমাদের-ই ছোট বোন ওদের সাথে হলেও একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা কট প্লিজ। এভাবে জীবন চলেনা। তুই কি শুনছিস কি বলছি আমি? এমন অদ্ভুত ভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”

শেষের কথাটা একটু বেশিই রেগে বলেছে ফাইজা কারণ হুসনা এমন ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে যেনো সে ফাইজার কোনো কথায়-ই শুনছেনা। ফাইজার রাগ হওয়াটাও স্বাভাবিক, এতো করে বুঝাই সে হুসনাকে কিন্তু হুসনা যেনো কানেই শুনেনা কোনো কথা।

“তোর লেখচার দেওয়া শেষ হলে এবার যেতে পারিস, আমাকে একটু একা থাকতে দে। নতুন বিয়ে হয়েছে তুই দুলাভাইকে সময় দে যা।”
খুব শান্তভাবেই কথাগুলো বলে হুসনা। হুসনাকে এভাবে শান্তভাবে এমন কথা বলতে দেখে ফাইজার খুব বেশি রাগ উঠে যায় তাই সে গজগজ করে বলল “সারাক্ষণই তো একাই থাকিস বাসায় তো কারো সাথেই কথা বলিসনা, আবার আলাদা ভাবে কিসের সময় দিতে হবে তোকে?” এটা বলেই হনহন করে হেঁটে সেই স্থান ত্যাগ করে ফাইজা। ফাইজা চলে গেলে হুসনা নিজে নিজে বলে “তুই বুঝবিনারে আপু, আজকের এই দিনের জন্য কি কি করতে হয়েছে আমায়। নয়তো আমাদের মা মেয়ে তিনজনকে ফুটপাতে দিনের পর দিন কাটাতে হতো।” কথাগুলো বলে বুক চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে হুসনা।

*
রাইসা রাগে ফাঁস ফাঁস করছে কিন্তু এসব গাড়িতে কিভাবে কি করতে হয় সেটা জানেনা বলে কিছুই করতে পারছেনা। রাইসার রাগের কারণ হলো সিয়াম গাড়িতে খুব লাউডে মিউজিক বাজাচ্ছে যা রাইসার সহ্য হচ্ছে না। সিয়ামকে মিউজিক বন্ধ করতে বললে সে লাউড আরো বাড়িয়ে দেয় এবার রাইসা উলটাপালটা চেপে বন্ধ করে দেয় মিউজিক, সিয়াম ঠাস করে থামিয়ে দেয় গাড়ি মাঝ রাস্তায় তারপর রাইসার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত খিঁচে বলে “আর ইউ ম্যাড?”

“কেনো?”
স্বাভাবিক ভাবেই বলে রাইসা।

“উল্টাপাল্টা চাপলে কেনো? যদি নষ্ট হয়ে যেতো।”

“নষ্ট হলে কি আর হতো। ভালোই হতো।”
মৃদু হেঁসে বলে রাইসা।

“ভালো হতো মানে কি?”
কপাল ভাজ করে বলে সিয়াম।

“আপনি কি জানেন ইসলামে গান-বাজনা হারাম?”

“জানার দরকার নাই তো আমার।”
বিরক্তি ভাব নিয়ে বলে সিয়াম।

“তবুও শুনুন একটু।”
এটা বলেই শুরু করে রাইসা “আল-কোরআনে গান-বাজনা হারাম

● মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا ۚ أُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ

একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি। [1]

আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা:) বলেন, “এ আয়াতে ‘অবান্তর কথাবার্তা (لَهُمْ عَذَابٌ) বলে গান-বাজনা ও অন্যান্য মন্দকে বোঝানো হয়েছে। [2] এমনিভাবে জাবির, ইকরিমা, সাঈদ ইবনু জুবাইর, মুজাহিদ, মাকহূল, আমর ইবনু শুআইব এবং আলী ইবনু নাদীমা (রহ:) থেকেও এই একই ব্যাখ্যা বর্ণিত আছে। বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরি (রহ:) বলেন, ‘গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে এই আয়াত নাযিল হয়েছে। [3] আব্দুর রহমান সা’দি (রহ:) উল্লেখিত শব্দের ব্যাখ্যায় যাবতীয় অশ্লীল কাজকর্ম, অনর্থক কথাবার্তা, গীবত, চোগখুরী, গালি-গালাজ, মিথ্যা, কুফর, ফিসক, পাপাচার, অবৈধ খেলাধুলা, গান-বাজনা ও সব রকমের বাদ্যযন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। [4]

ইবনুল কাইয়্যিম (রহ:) বলেন, সাহাবী ও তাবিয়িদের ব্যাখ্যা থেকে জানা ও সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়, এই আয়াতে ‘অবান্তর কথাবার্তা’ বলে গান-বাজনা ও বাদ্যযন্ত্রকে বোঝানো হয়েছে। আবুস সাহাবা (রহ:) বলেন, ‘আমি এই আয়াত সম্পর্কে ইবনু মাসউদ (রা:)-এর কাছে জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম করে বলছি, এর মাধ্যমে কেবলমাত্র গান-বাজনাকেই বোঝানো হয়েছে। “এই কথাটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন। [5] আল্লাহ তায়ালা সূরা লুকমানে বলেন, এদের জন্য রয়েছে অবমানকর শাস্তি। অর্থাৎ যারা গান-বাজনা শুনে তাদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ কঠিন শাস্তি রয়েছে।

গান-বাজনা শয়তানের সুর

● মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

قَالَ اذْهَبْ فَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ فَإِنَّ جَهَنَّمَ جَزَاؤُكُمْ جَزَاءً مَوْفُورًاوَاسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ وَأَجْلِبْ عَلَيْهِمْ بِخَيْلِكَ وَرَجِلِكَ وَشَارِكْهُمْ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ وَعِدْهُمْ ۚ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا

আল্লাহ (শয়তানকে) বলেন: ঠিক আছে, তুমি যাও, এদের মধ্য থেকে যারাই তোমার অনুসরণ করবে, তুমি-সহ তাদের সবার জন্য জাহান্নামই হবে পূর্ণ প্রতিদান। তুমি যাকে-যাকে পারো তোমার আওয়াজের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করো। তাদের ওপর অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ চালাও। ধন-সম্পদে ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যাও। এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতির জালে আটকে ফেলো। আর শয়তানের প্রতিশ্রুতি ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়।[6]

ইবনুল কাইয়্যিম (রহ:) বলেন, ‘যারা আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতাপূর্ণ কথা বলে এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে, যেমন: বাঁশি, নিষিদ্ধ জাতের দফ, ঢোল-তবলা ইত্যাদি এগুলো হলো শয়তানের আওয়াজ। [7]

● মহান আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

أَفَمِنْ هَٰذَا الْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ. وَتَضْحَكُونَ. وَأَنْتُمْ سَامِدُونَ

তোমরা কি এই বিষয়ে আশ্চর্যবোধ করছ? এবং হাসছ-ক্রন্দন করছ না? ররং তোমরা খেল-তামাশায় লিপ্ত রয়েছ! [8]

ইবনু কাসীর (রহ:) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, “সুফ্ইয়ান সাওরি (রহ:)-এর পিতা ইবনু আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘(সূরা নাজমের ৬১ নম্বর) আয়াতে ব্যবহৃত ‘খেলা-তামাশা’ (سَامِدُونَ) শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গান-বাজনা। এটি ইয়ামানি শব্দ। যেমন ‘ইসমিদ লানা (اِسْمِدْ لَنَا)-এর অর্থ হলো, আমাদের জন্য গান গাও৷” ইকরিমা (রহ:) অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। [9] কুরআন অনুযায়ী গান-বাজনা স্পষ্টভাবে হারাম নিষিদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা গান-বাজনাকে হারাম করেছেন। যারা গান-বাজনা শুনবে তারা এর জন্য কঠোর শাস্তি ভোগ করবে। ”

#চলবে_ইনশাআল্লাহ