শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-১১

0
381

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_১১
#সামিয়া_মেহেরিন

রমজানের ছুটির শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-অফিস আদালত সব আগের মতো চলতে শুরু করেছে। আদিত্য-বন্যা যে যার কর্মব্যস্ত জীবনে মত্ত। তবে বদলায়নি তাদের একে অপরের প্রতি অনুভূতিগুলো।

রোজকার মতো আজও আদিত্য তার বাইক নিয়ে হাজির বন্যার ভার্সিটির সামনে। তবে আজ বন্যাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসবে না। নিজের সাথে নিজের বাড়ি নিয়ে যাবে।
দিশারী বেগমের বড় ভাই-ভাবী আজ দেশে ফিরেছেন। আদিত্যদের বাসাতেই তারা উঠেছেন। দিশারী বেগম বন্যাকে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চান বিধায় খুব করে বন্যাকে অনুরোধ করেছেন যাতে আজ সে তাদের বাসায় যায়। বন্যা তার শাশুড়ি মায়ের কথা ফেলতে পারে নি।

আদিত্য প্রায় এক ঘণ্টা ধরে নিজের ঘরের এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করে চলেছে। বন্যা এতক্ষণ হলো তাদের বাসায় এসেছে অথচ নিজের বউটাকে দুই মিনিটের জন্যও কাছে পায়নি। রাগে নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে তার। মনে মনে নিজের বাসার মানুষদের ঘরশত্রু বিভীষণ বলে আখ্যায়িত করছে। একে তো বন্যা সব সময় তার থেকে পালিয়ে বেরায়, তারওপর বাড়ির মানুষগুলো বন্যাকে তার কাছে আসতেও দেয় না।

আদিত্য এখন তার মা-বাবার সাথে এই বাড়িতেই থাকে। বন্যার জেদের কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে। বা অন্যভাবেও বলা যায়, নিজের বৃষ্টিকন্যার কোনো আবদার সে অপূর্ণ রাখতে চায়নি।

বেশ অনেকক্ষণ হলো বন্যা ড্রইংরুমের সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে। আদিত্যর মা বাবা দিশারী বেগম ও আনোয়ার সাহেব আর আদিত্যর মামা-মামির গল্পে মজেছেন। এদিকে বন্যা অসহায়ের মতো বসে আছে। না সে এখানে বসে থাকতে চাইছে আর না উঠে যেতে পারছে। তারওপর বন্যার অস্বস্তির আরেকটি কারণ হলো দীপ্তর উপস্থিতি।
বন্যা হাতে থাকা ফোন ভাইব্রেট করে ওঠে। মেসেজ এসেছে। বন্যা ফোনের দিকে দৃষ্টি দেয়।

আদিত্যর মেসেজ-জলদি ছাদে এসো।
বন্যা কা করবে ভেবে পায় না। সবার সামনে থেকে উঠে গিয়ে ছাদে গেলে বিষয়টা কেমন দেখাবে। তারওপর কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে কোথায় যাচ্ছো। তখন কি বলবে বরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি?

বন্যা ছাদে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে আদিত্যকে খোঁজে। কিন্তু আদিত্য তো ছাদে নেই।
বন্যার ছাদে আসতে পারার ক্রেডিট যায় অদিতিকে। সেই এটা ওটা বলে বন্যাকে ছাদে পাঠিয়ে দিয়েছে।

হঠাৎ কেউ পেছন থেকে বন্যাকে জড়িয়ে ধরে। বন্যা ভয়ে কেঁপে ওঠে। প্রথমে ভাবে হয়তো আদিত্য হবে কারণ আদিত্য ছাড়া কারো অধিকার নেই তাকে এতো নিবিড়ভাবে স্পর্শ করার। কিন্তু আদিত্যর গায়ের ঘ্রাণ তার চেনা। শরীরের ঘ্রাণ জানান দিচ্ছে এটা আদিত্য নয়।
বন্যা সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে দূরে সরে যায়। দীপ্তকে হাসি হাসি চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগে তার শরীর রি রি করে ওঠে।

দীপ্ত হেসে বলে
-রিল্যাক্স এটা আমি। আজ আমি তোমাকে একটা অফার দেই কেমন?
দীপ্ত কিছুক্ষণ ভাবার ভঙ্গি করে আবার বলে
-তো কি যেন বলছিলাম? ওও হ্যাঁ, শোনো তোমাকে আমার মনে ধরেছে। সো এক রাতের জন্য হলেও আমার তোমাকে চাই। বাট, প্রবলেম হলো তুমি আমার ভাইয়ের ছেলে এন্ড আমি আমার ভাইয়ের সংসার তো আর নষ্ট করতে পারি না।
দীপ্ত মুখে শয়তানি হাসির রেখা টেনে বলে ওঠে
-তো তুমি নিজ ইচ্ছায় একরাত আমার সাথে কাটাও। আই প্রমিস আদিত্য কিছু জানবে না। তোমার সম্মানেও কোনো আঘাত লাগবে না আর আমারও না। সো বি রেডি।

গড়গড় করে কথা গুলো বলে দীপ্ত ছাদ থেকে নিচে নেমে যায়। বন্যা রাগে আর ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। আদিত্যর আগমন ঘটে ঠিক তখনই। বন্যাকে কাঁপতে দেখে আদিত্য তার দিকে এগিয়ে আসে। চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে।
-কি হয়েছে বন্যা? এমন করছো কেন? আর দীপ্তকে দেখলাম নিচে নামতে। ও কি ছাদে এসেছিল?

বন্যা নিজেকে সামলে নেয়। আমতা আমতা করে আদিত্যকে বলে তার কিছু হয়নি। কিন্তু আদিত্যর মনের শঙ্কা যায় না। বন্যার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম গলায় বলে
-দীপ্তর সঙ্গদোষে মদ গিলে বাড়ি ফিরেছিলাম এটা যেহেতু জানো, তাহলে এটাও তো জানো উচিত যে দীপ্তর ব্যাপারে বাজে কিছু বললে তা আমার বিশ্বাসযোগ্য হবে।

আদিত্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বন্যার দিকে তাকায়। কিন্তু বন্যা সম্পূর্ণ বিষয়টা এড়িয়ে যায়।

রাতের আঁধারে ধরণী আচ্ছাদিত। পূর্ণিমা রাত। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। কেউ গভীর ঘুমে মত্ত, তো কেউ চন্দ্রবিলাসে। তবে বন্যা আপাতত এই দুই শ্রেণীর একটাতেও দলভুক্ত নয়। বিছানায় শুয়ে বারবার এদিক ওদিক করছে। আজকে দুপুরের ঘটনা তার চোখে ভেসে উঠছে। হুট করে মাথায় আসে দীপ্তর জায়গায় যদি আদিত্য তাকে জড়িয়ে ধরতো তাহলে কি খুব ক্ষতি হতো? নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জায় লাল নীল হতে শুরু করে বন্যা। কি ভাবছে সে এসব! আদিত্যর প্রতি তার জড়তাগুলো বোধহয় হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে।
————
লালরঙা কামিজ পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে অদিতি। আজ সে ভীষণ খুশি। জায়ান তার মা-বাবাকে নিয়ে আজ তাকে দেখতে আসছে।
প্রথমে সে ভেবেছিল তার আর জায়ানের সম্পর্ক হয়তো অনিশ্চিত দিকে এগিয়ে যাবে। তবে তা হয়নি। অদিতি তার জায়ানের সম্পর্কের ব্যাপারে বন্যাকে সব জানিয়ে দিয়েছিল। এতে বন্যা বেশ খুশিও হয়েছিল। বন্যা নিজেই আদিত্যকে এ ব্যাপারে বলেছিল। প্রথম প্রথম আদিত্য নাকোচ করে দিলেও পরবর্তীতে বোনের খুশির কথা চিন্তা করে আর বাঁধা দেয় নি।

আজ বন্যা নিজ হাতে অদিতিকে সাজিয়ে দিয়েছে। তবে এসবের ভিতরেও সে অস্বস্তিতে ভুগছে। তার কারণ হলো দীপ্ত। দীপ্ত আর তার বাবা-মা আজ এ বাড়িতেই আছেন।

জায়ানরা তখনো এসে পৌঁছায়নি। আজ বন্যা নিজে রান্না করতে চেয়েছে। দিশারী বেগম মানা করেন নি। মেয়েটা প্রথমবার তার কাছে আবদার করেছে কীভাবে মানা করতেন তিনি?
দিশারী বেগম হাতে হাতে বন্যার কাজে সাহায্য করতে লাগলে বন্যা তাকে জোর করে রান্নাঘরের বাইরে পাঠিয়ে দেয়।
রান্না শেষ করতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যায় বন্যার। রান্নাঘরে সব খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে বের হতে নেবে তখনই আগমন ঘটে দীপ্তর।
দীপ্ত সোজা এসে বন্যার কোমর জড়িয়ে ধরে বন্যাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে। বন্যা নিজের সর্ব শক্তি ব্যবহার করেও দীপ্তকে নিজের থেকে দূরে সরাতে পারে না। যেই না চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে যাবে দীপ্ত নিচু গলায় বলে
-ভুলেও চেঁচিও না। সবাই তোমাকেই ভুল বুঝবে। তুমি হলে পরের বাড়ির মেয়ে আর আমি বাড়ির ছেলে। আমার কথাই সবাই বিশ্বাস করবে।

দীপ্তর কথা কানে যেতেই বন্যার হতবুদ্ধি হয়ে যায়। দীপ্তর কথা ভুল নয়। যদি সবাই তাকে ভুল বোঝে? বন্যা মুখে কোনো আওয়াজ না করলেও দীপ্তকে সর্বশক্তি ব্যবহার করে সরাতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার চেষ্টায় সে সফল হয় না। বন্যার দম ফুরিয়ে আসে। তবুও চেষ্টা থামায় না।
দীপ্ত বন্যাকে শক্ত করে ধরে রেখে বাঁকা হেসে বলে
-তো আমার অভার নিয়ে ভেবেছো? একটা রাত কাটাতে রাজী তো তুমি? কবে তোমাকে নিজের করে পাবো বলতো।

-দীপ্ত!

নিজের বাবার গলার হুংকার শুনে দীপ্ত বন্যাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়। বন্যা দীপ্তর কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে।

-বাবা, আমি কিছু করিনি। এই মেয়েই
দীপ্তর বলা কাথা শেষ হয় না তার আগেই দীপ্তর গালে চড় বসে যায়। দিদার সাহেবের হুংকারে ততক্ষণে বাসার সবাই রান্নাঘরে এসে হাজির হয়েছে। রান্নাঘরে দীপ্তেকে দেখে এবং এককোণায় বন্যাকে জড়োসড়ো হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদিত্যর যা বোঝার সে বুঝে গিয়েছে। মেয়েটাকে সে অনেকবার বলেছে তার কাছ থেকে যেন কোনো কথা না লুকায়। আর দীপ্তর ব্যাপারে হলেতো কথাই নেই। তীব্র অভিমানে আদিত্য বন্যার থেকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। আদিত্যর চোখ সরিয়ে নেয়া বন্যার দৃষ্টিগোচর হয়। আদিত্যর চোখ সরিয়ে নেয়াতে তার বুকে স্যাঁত করে ওঠে।
দিদার সাহেবের রাগে কপালের রগ দৃশ্যমান হয়ে গিয়েছে। তিনি দীপ্তর উদ্দেশ্যে হুংকার ছেড়ে বলে ওঠেন
-আমি কি নিজের চোখে ভুল দেখেছি? ছিহ! এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোকে? একটা মেয়ের সম্মানে দাগ লাগাতে গিয়েছিলি।

দিদার সাহেব ছাড়া উপস্থিত সবাই চুপ করে থাকে। দীপ্তর চরিত্র সম্পর্কে তারা জানে। শুধু জানতেন না দিদার সাহেব। ছেলের এতটা অধঃপতন তিনি মেনে নিতে পারছেন না।

চলবে!