শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-১০

0
368

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_১০
#সামিয়া_মেহেরিন

সময় তার আপন গতিতে বহমান। দেখতে দেখতে একটা মাস কেটে গেল। আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর।
গত একমাসে আদিত্য আর বন্যার দেখা হয়েছে মাত্র দুবার। আদিত্য এসেছিল দেখা করতে।

আজ আদিত্য ভীষণ খুশি। প্রায় দশদিন পর সে যাচ্ছে তার বৃষ্টিকন্যার কাছে। সে ভেবে রেখেছে আজ সে বন্যাকে নিজের বাসায় নিয়ে যাবে।
বাইক রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে বন্যাদের বাসার কলিংবেল চাপে আদিত্য। মহিমা বেগম দরজা খুলে দেন। আদিত্যকে বাসার ভেতর নিয়ে এসে কুশলাদি বিনিময় শেষে আদিত্য বন্যার কথা জিজ্ঞেস করলে মহিমা বেগম জানান বন্যা আরো এক ঘণ্টা আগেই আদিত্যর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে।

মহিমা বেগমে এমন কথায় আদিত্য কপাল কুচকে তাকায়। সে তো বন্যাকে আগেই বলেছিল যে নিতে আসবে। তাহলে বন্যা একা কেন চলে গেল?
আদিত্য মহিমা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে বন্যাকে কল দেয়। দুইবার রিং হতেই বন্যা কল রিসিভ করে। আদিত্য বেশ চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে।
-বন্যা তুমি কোথায় বলো তো।

বন্যার ভাবলেশহীন জবাব।
-আপনার বাসায়।
বন্যার জবাবে আদিত্যর কপালের ভাঁজ আরো প্রগাঢ় হয়।
-আমার বাসায় মানে? তুমি আমার বাসায় কীভাবে গেলে? বাসার একটাই চাবি যেটা এই মুহূর্তে আমার কাছে।

বন্যা সোজাসাপটা জবাব দেয়।
-আমি আপনার বাসা মানে আমার শশুড়বাড়িতে।

বন্যার কথা বুঝতে আদিত্যর আর সময় নষ্ট করতে হয় না। আদিত্য চোয়াল শক্ত করে আদেশের সুরে বলে
-এক্ষুনি ওই বাসা থেকে বেরিয়ে এসো বন্যা।

-আপনি এসে নিয়ে যান।
বন্যা কথাটুকু বলেই কল কেটে দেয়। বন্যা ঘুরে ঘুরে বাসাটা দেখতে থাকে। চাররুমের একটা ফ্লাট। আদিত্যর ঘরটা সবথেকে বড়। ঘরটা সুন্দর করে সাজানো। বন্যার ভাবতেই অবাক লাগে মানুষটা গত দুই বছর এই ঘরে আসে নি। বন্যার তো মনে হচ্ছে আদিত্যর গায়ের ঘ্রাণ এগখনো এই ঘরে আছে। আসলে দিশারী বেগম ছেলের ঘরটা আগের মতো করেই রেখেছেন যেমনটা আদিত্য রাখতো।
বন্যার সবথেকে পছন্দ হয়েছে বারান্দাটা। ঘরের সাথে ঝুলন্ত বারান্দা। ঘর আর বারান্দার মাঝখানে থাইগ্লাস দেয়া।

হঠাৎ দিশারী বেগমের ডাকে বন্যা উদ্যত হয় রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ঘরের দরজার কাছে আসতেই ঘটলো এক অঘটন।
বন্যা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল আর বন্যার ওপর পড়লো আদিত্য। পড়ে যাওয়াতে আদিত্যর চোখের চশমা খুলে পড়লো বন্যার কপালে। বন্যা চোখমুখ কুঁচকে তাকালো। আদিত্য ঝাড়ি মেরে বললো
-চোখে দেখো না? নিজেও পড়লে আমাকেও ফেললে।

বন্যা কপট রাগ দেখিয়ে বলল
-আমি চোখে দেখি না? আপনি তো আপনার চার চোখ দিয়েও দেখেন না। আর নিজের দোষ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া কি আপনার স্বভাব নাকি?

আদিত্য দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বলে
-কি? আমি অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দেই?
বন্যা গলার জোর বারিয়ে বলে
-তা নয়তো কি? মদ গিলে বাড়ি ফিরবেন আর বাবা শাসন করলেই দোষ না?

আদিত্য চোখ গোল গোল করে তাকায়। বন্যা কীভাবে জানলো এই কথা? বন্যা চোখমুখ খিঁচে বলে
-কি ভারি বাবাহ! উঠুনতো আমার ওপর থেকে।

আদিত্য উঠে দাঁড়ায়। নিজের চশমাটা তুলে নিয়ে চোখে পড়ে। বন্যাও উঠে দাঁড়ায়। আদিত্য থমথমে গলায় বলে
-চলো এখান থেকে।

বন্যা নিজের ওড়না ঠিক করতে করতে প্রশ্ন করে।
-কোথায় যাবো?
আদিত্য সোজাসাপটা উত্তর দেয়।
-আমাদের বাসায়।

বন্যা ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দেয়।
-এটাই আমাদের বাসা। আজ থেকে এখানেই থাকা হবে আপনার।
আদিত্যর প্রতিউত্তরের আশায় না থেকে বন্যা হাঁটা ধরে দিশারী বেগমের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

পুরো পরিবার দুপুরের খাবার খেতে বসবে তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে। অদিতি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে দীপ্ত এসেছে। দীপ্তকে সাথে নিয়ে অদিতি ডাইনিং টেবিলে আসে। দীপ্ত সকলের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে।
এদিকে বন্যা দীপ্তর দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ হলো চেনার চেষ্টা করছে। কোথায় যেনো দেখেছে সে লোকটাকে। মাথায় একটু জোর দিতেই বন্যার মনে পড়ে যায়। এই লোকটাই তো সেদিন রাতে তাকে বাজে ইঙ্গিত করেছিল।
দীপ্ত আড়চোখে বন্যার দিকে তাকায়। এমন একটা ভান ধরে যেন সে বন্যাকে চেনেই না। দীপ্তর আগমনে খুশি হয়নি আদিত্য। দীপ্তর চরিত্র কেমন তা সে খুব ভালো করেই জানে। ভাগ্যিস সময় থাকতে সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল। নয়তো সে নিজেও আজ হয়তো দীপ্তদের দলভুক্ত হতো।
———
রাত বোধহয় ৯টা। আদিত্যর ঘরে বিছানার ওপর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন বন্যা। আদিত্য তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে বলেছিল। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে মানুষটা তাকে অপেক্ষা করতে বলে কই যে গেলো এখনো এলো না। অপেক্ষা করতে করতে একসময় বন্যা ঘুমিয়ে যায়।

আদিত্য ঘরে এসে দেখে বন্যা ঘুমে বিভোর। বন্যা ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না। তাই সে বন্যার পাশে আধশোয়া হয়ে ফোন স্ক্রল করতে শুরু করলো।
হঠাৎ ঘুমের মাঝে বন্যা কি যেন বিরবির করতে শুরু করে। ঘেমে-নেয়ে সে একাকার। হুট করে ‘মা’ বলে চেঁচিয়ে সে উঠে বসলো।
আদিত্য তার পাশেই ছিল। বন্যার এমন কাণ্ডে সে ঘাবড়ে যায়। বন্যার কাছে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয় হয়তো খারাষ স্বপ্ন দেখেছে। ঘরে পানি ছিল না। আদিত্য এক মুহূর্তের জন্য বন্যাকে রেখে দ্রুত যায় পানি আনতে। বন্যা আদিত্যকে আটকাতে চায় কিন্তু পারে না তাকে বুঝাতে এযে নতুন কিছু নয়।

পানি নিয়ে এসে ঘরে আদিত্য বন্যাকে পায় না। এদিক ওদিক তাকাতেই তাকে বারান্দায় আবিষ্কার করে। আদিত্য তার কাছে যায়। আদিত্যর উপস্থিতি টের পেয়ে বন্যা বলে
-ঘাবড়াবেন না এ আর নতুন কিছু নয়।
আদিত্য পানির গ্লাসটা বারান্দায় থাকা চেয়ারের ওপর রাখে।

সুদূর অন্তরীক্ষে মিটিমিটি তারাদের খেলা। একপাশে চাঁদমামা বসে বসে হাসছে। রুপালি আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে দিগ্বিদিক। বন্যা সেদিকেই তাকিয়ে আছে। আর তার পাশে আদিত্য। আদিত্যর দৃষ্টি তার বৃষ্টিকন্যাতে আবদ্ধ। আর বন্যার সুদূর অন্তরীক্ষে।
বন্যা ধীর গলায় বলে
-আমার মায়ের অগোচরে আমার বাবা জামিনী আন্টির সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। অবশ্য তাদের সম্পর্ক বাবা-মার বিয়ের আগেই ছিল। এমন কি একটা ছেলেও ছিল তাদের। পরিবারের কেউই জানতো না তাদের সম্পর্কের কথা। মাও জানতো না। একদিন জামিনী আন্টি জায়ান ভাই আর নয় মাসের ছোট্ট জুঁইকে নিয়ে বাড়ির চৌকাঠে এসে দাঁড়ায় অধিকার চাইতে। আমার তখন কতই বা বয়স হবে, হয়তো দুই বা আড়াই।

বন্যা একটু থামে। গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করে
-মা বাবাকে খুব ভালোবাসতো। বাবার করা প্রতারণা মা সহ্য করতে পারে নি। সেদিনই মা আত্মহত্যা করে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে। গায়ে আগুন লাগানোর পর মা যেভাবে ছটফট করছিল, যেভাবে চিৎকার করছিল সবটাই নিজ চোখে দেখেছিলাম। সেদিনের ঘটনা আজও স্বপ্ন হয়ে আমাকে তাড়া করে।

বন্যা চুপ করে। আদিত্য এতক্ষণ তার সব কথা শুনছিল। কি বলবে বুঝতে পারে না সে। তখন অদিতির কণ্ঠস্বর কানে আসে।
বন্যা আদিত্য দুজনই পেছন ফিরে অদিতির দিকে তাকায়।

-মা তোমাদের খেতে ডাকছে। জলদি এসো।
কথাটুকু শেষ করে অদিতি বেরিয়ে যায়।
——-
নিশুতি রাত। নিশাচর প্রাণী বাদে সকলেই গভীর ঘুমে। ঘুম নেই শুধু অদিতির চোখে।
বন্যা-আদিত্যর সব কথাই তখন সে শুনেছিল। এতদিন সে ভাবতো বন্যা জায়ানের আপন বোন। ভেবে খুশিও হয়েছিল সে। কিন্তু এখন! বন্যা আর জায়ানের সম্পর্কের তিক্ততা কোনোভাবে তার আর জায়ানের অথবা বন্যা আর আদিত্যর সম্পর্কে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না তো?

চলবে!