শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-১২

0
399

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_১২
#সামিয়া_মেহেরিন।

শীতকাল নীরবে তার আগমনের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটা মোটা কাঁথা মুরি দিয়ে বন্যা বিছানায় শুয়ে এদিক ওদিক করছে।
সেদিনের ঘটনার পর প্রায় একমাস কেটে গেছে। দীপ্তর বাবা দিদার সাহেব সেদিনই দীপ্তকে ত্যায্য পুত্র করেছেন। এরপর দীপ্তর কি হয়েছে বন্যার ঠিক জানা নেই। শুনেছিল সে নাকি দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছে।
বন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই একমাসে কিছু না বদলালেও বদলেছে আদিত্য। লোকটা বড্ড বেশি অভিমানি। বন্যা স্বীকার করে তার ভুল ছিল। দীপ্ত আদিত্যর মামাতো ভাই। অবশ্যই সে তার ভাইয়ের চরিত্র সম্পর্কে জানে তাই তো বন্যাকে নিজে থেকে ঘটনাটা বলতে বলেছিল। বন্যার উচিত ছিল আদিত্যকে আগেই বলে দেয়া। কিন্তু তাই বলে আদিত্য তার সামনে মৌনব্রত পালন করবে?
গত একমাসে আদিত্য রোজ বন্যাকে তার ভার্সিটি থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গিছে ঠিকই কিন্তু মুখে কোনো কথা বলেনি। বন্যা নিজে থেকে কথা বললেও হু হা ছাড়া আর কোনো জবাব পায়নি আদিত্যর থেকে।
অদিতির বিয়ের শপিংয়ের দিন অদিতি বন্যাকে সাথে নিয়ে গিয়েছিল। পুরোটা সময়েও আদিত্য বন্যার জন্য একটা রা শব্দ পর্যন্ত করেনি।
এইজন্যই হয়তো মানুষ বলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিতে হয়। বিয়ের পর থেকে সে আদিত্যকে এড়িয়ে চলে এসেছে। আদিত্য তার জীবনে কতটা জায়গা দখল করে নিয়েছে তা সে বুঝতে পারেনি। আর আজ যখন আদিত্য তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে তখন ঠিকই সে বুঝেছে আদিত্যর গুরুত্ব তার জীবনে ঠিক কতটা। এসব ভাবতে ভাবতে বন্যা একসময় পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।

দুপুরের ভাতঘুমটা বন্যার বেশ ভালো হয়েছে। ঘুমের রেশ তখনো পুরোপুরি কাটেনি। বন্যা পিটপিট করে চোখ খুলে নিজের পাশে আদিত্যকে বসে থাকতে দেখে।
আদিত্য তখন ফোনে কি যেন করছে। বন্যা আদিত্যর এক হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে নিজের ওপর ফেলায়। হঠাৎ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না আদিত্য বিধায় হুমড়ি খেয়ে বন্যার ওপর পরতে নেয়। বন্যার বালিশের পাশে নিজের একহাত রেখে বন্যার ওপর সম্পূর্ণ পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে আটকায়।
বন্যা নিজের দুই হাত দিয়ে আদিত্যর গলা জড়িয়ে ধরে। ঠোঁট উল্টে অভিমানি গলায় বলে
-আপনি আমার সাথে কথা বলেন না কেন বলুনতো। জানেন না আপনি কথা না বললে আমার ভালো লাগে না।

আদিত্য কপাল কুচকে বন্যার দিকে তাকায়। বন্যা নিজের ডান হাত দিয়ে আদিত্র ঠোঁটে স্লাইড করতে করতে বলে
-ঠোঁট এতো কালো হয়েছে কেন? সিগারেট খান?

আদিত্য থমথমে গলায় জবাব দেয়।
-আগে খেতাম।
একটু থেমে আবার বলে
-অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছো। ওঠো এবার।
বন্যা ঠোঁট উল্টে বলে
-না উঠবো না। উঠলেই আপনি গায়েব হয়ে যাবেন।

আদিত্য কপট রাগ দেখিয়ে বলে
-জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছো তুমি মেয়ে?

বন্যা চোখ গোল গোল করে তাকায়। তারমানে সে আদিত্যকে কল্পনা করছে না বরং আদিত্যই তার সামনে।
আদিত্যর বুক বরাবর ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বন্যা উঠে বসে। জোরে জোরে শ্বাস নেয়। ইশ্, কি কাণ্ডটাই সে ঘটিয়ে ফেলেছে।
———-
আদিত্যর কর্মকাণ্ডে অবাক হয়ে যাচ্ছে বন্যা। লোকটা হুট করে চলে এসেছে। এমন তো কখনো করে না। তারউপর উদ্ভট সব কাণ্ড করছে।
বিকেলবেলা বন্যা ছাদ থেকে শুকনো কাপড়গুলো নামিয়ে নিয়ে আছে। নিজের ঘরে বিছানার ওপর কাপড়গুলো রেখে একটা একটা করে ভাঁজ করতে শুরু করে। আদিত্য তখন বারান্দায়।
বারান্দা থেকে গটগট করে হেঁটে এসে একদমে বলে
-শোনো মেয়ে তুমি শুধুই আমার। গল্পের শুরুটা যেভাবেই হয়ে থাক। শেষটায় আমি তোমাকেই চাই। অন্যকেউ তোমার ওপর ভাগ বসাতে আসলে ফল খুব খারাপ হবে।
কথাটুকু বলেই আদিত্য আবার বারান্দায় চলে যায়। বন্যা কাপড় ভাঁজ করা শেষে সেগুলো আলমারিতে তুলে রাখছিল। তখনই উদ্ভট লোকটা বারান্দা থেকে আবার এসে হাজির। বন্যার সামনে দাঁড়িয়ে গরগর করে বলে ওঠে।
-মা আমাকে পাঠিয়েছে তোমাকে নিয়ে যেতে। পরশু অদিতির বিয়ে। কিন্তু বিয়েতে তুমি যাবে না, আমিও যাবো না।
আদিত্যর এমন কথায় অবাক হয় বন্যা। লোকটা নিজের বোনের বিয়েতে থাকবে না বলছে।
———-
সূর্য পশ্চিম আকাশে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আদিত্য ঠোঁট উল্টে বিছানায় পা তুলে বসে আছে। তার দৃষ্টি ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হতে থাকা বন্যার দিকে।
আদিত্য আমতা আমতা করে বলে
-বলছিলাম যে জুঁই তো জায়ানের বোন। তারমানে অবশ্যই বিয়েতে জুঁই তার পরিবারকে নিয়ে আসবে তাই না?

বন্যা কপার কুচকে আদিত্যর দিকে তাকায়। তাহলে এই কারণেই লোকটা এমন উদ্ভট ব্যবহার করছে? আদিত্য কি বিয়েতে শাবাব আসতে পারে বলে এমন করছে।
———
আদিত্য বন্যাকে তাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে কোন এক কাজে বেরিয়ে যায়। রাত ১০টা পেরিয়ে যায় অথচ আদিত্যর আসার নাম নেই। দিশারী বেগম জোর করে বন্যাকে খাইয়ে দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেন।
১০.৩০টার পর আদিত্য বাড়ি ফেরে। দিশারী বেগম আদিত্যকে দেখে খেতে বসতে বলেন।
ডাইনিং টেবিলে তখন শুধু আদিত্যর বাবা আনোয়ার সাহেব ছিলেন।
আদিত্য চেয়ারে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে হাক ছাড়ে।
-মা, সবাই খেয়েছে?

আনোয়ার সাহেহ টিটকারি করে বলেন
-তুমি যার কথা বলছো সে খেয়েছে।
আদিত্য আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে খাওয়ায় মন দেয়। দিশারী বেগম রান্নাঘর থেকে রুটি এনে টেবিলে রাখতে রাখতে বলেন
-সবাই খেয়েছে শুধু তুই আর তোর বাবা বাদে।

আনোয়ার সাহেব আবার টিটকারি মেরে বলেন
-দিশা, তোমার ছেলে বউ পাগল হয়েছে।

আদিত্য আনোয়ার সাহেবের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে টিটকারির সুরে বলে ওঠে
-বাপ কা বেটা, সিপাহি কা ঘোড়া।
আনোয়ার সাহেব সবে খাওয়া শেষ করে পানির গ্লাসে মুখ দিয়েছিলেন। আদিত্যর এহেন কথায় বেশ বাজেভাবেই বিষম খেলেন তিনি।

বন্যা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজছে। তার সাজা মানে হলো হালকা লিপস্টিক আর কাজল দেয়া। তার পরনে লাল শাড়ি। বন্যা তেমন একটা শাড়ি পরে না কারণ শাড়ি সামলাতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। তবে দিশারী বেগম শাড়িটা তাকে দিয়েছেন অদিতির বিয়েতে পড়ার জন্য। তাই আজ শাড়িটা তাকে পড়তে হলো।
লাল শাড়ি, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখে মোটা কাজল রেখা ব্যাস এটুকুই তার সাজ। শ্যামাঙ্গীর চোখে কাজলের ছোঁয়া তাকে আরো মোহময়ী করে তুলেছে।
আদিত্য ঘরে এসে ঢোকে। বোনের বিয়ে বিধায় অনেক দিক তাকে সামাল দিতে হচ্ছে।
আদিত্যর উপস্থিতি টের পেয়ে বন্যা উঠে তার দিকে ফিরে তাকায়। আদিত্য একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলে-আজ আপনাকে আমার বউ বউ লাগছে বৃষ্টিকন্যা।

আদিত্য বন্যার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আলমারি থেকে নিজের পাঞ্জাবি বের করে বন্যার উদ্দেশ্যে বলে
-একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি।

আদিত্য বাথরুমে ঢুকে যায়। ওদিকে বন্যার ডাক পড়ে। দিশারী বেগম তাকে ডাকছে। বন্যা ঘরের দরজা পর্যন্ত গিয়ে আদিত্যর কণ্ঠস্বর শুনে পেছন ফিরে তাকায়। এতদ্রুত সে পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এসেছে।
পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে বন্যার দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। তাদের মাঝে দূরত্ব মাত্র একহাত।
আদিত্য থমথমে গলায় বলে
-বলেছিলাম না অপেক্ষা করতে?

বন্যা একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে
-ভালো যখন বেসেছেন, একটু বিশ্বাস করেই দেখুন না আমাকে।

আদিত্য কৌশলে বন্যার কোমর জড়িয়ে ধরে হেচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আছে। বন্যা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। আদিত্য আফসোস জরানো কণ্ঠে বলে
-আমার ভালোবাসা যে তার অতীতেই মত্ত হয়ে আছে।

বন্যা ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকায়। আদিত্যর কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে এসে মিহি সুরে বলে
-আমি আমার বর্তমানেই মত্ত। আমি আমার উন্মাদ প্রেমিক পুরুষতেই আবদ্ধ। শুধু একটাই অনুরোধ, আমার জীবনের শেষ গল্পটা হয়ে থেক। কথা দিলাম আমি তোমাতেই বিলীন হবো।

আদিত্য কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝে উঠতে পারে না। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটি অনাকাঙিক্ষত ভাবে পেয়ে গেলে হয়তো মানুষ এমনই প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে যায়।
———
বিয়ের শেষে বিদায়ের পালা। বন্যা তার অতীতের মুখোমুখি হয়। তার সামনে তার অতীত শাবাব।
শাবাবের মুখোমুখি হওয়াতে বন্যার ওপর তেমন প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। তবে শাবাবের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তারা শুধু মুখোমুখিই হয়। কোনো কথা হয়। হয়তো শাবাব কিছু বলতো। কিন্তু পরিস্থিতির প্রতিকূলতা নাকি তার বোকামির ফল তার গলা পর্যন্ত কথা এসেও মুখ দিয়ে বেরোয় না।

বিদায় শেষে মহিমা বেগম আর মাযহার সাহেব নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোনোর আগে বন্যার কাছে গেলেন। মহিমা বেগম স্বাভাবিক গলায় বন্যার উদ্দেশ্যে বলেন
-বন্যা, তোকে একটা কথা বলা হয়নি।
বন্যা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মহিমা বেগমের দিকে তাকায়। মহিমা বেগম জবাব দেন।
-সেদিন তোকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার বিষয়টা জায়ানই আমাদের জানিয়েছিল।

বন্যা ম্লান হাসে। সে জানতো এরকম কিছু সে শুনবে। জায়ান মানুষটা সেই ছোট বেলা থেকেই বন্যাকে নানা ভাবে সাহায্য করে আসছে। তবে সবটাই লুকিয়ে। জায়ানের জন্যই নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পেরেছিল সে। ভার্সিটির ভর্তি যুদ্ধে অংশ নিতে পেরেছিল।
জুঁইয়ের বিয়ের আগের দিন জায়ান বন্যার গায়ে হাত তুলেছিল এটাও ঠিক। কারণ জুঁই সুইসাইড করবে বলে জায়ানকে ভয় দেখিয়েছিল। আর বন্যা বারবার বিয়েতে বাধা দিচ্ছিলো। এক পর্যায়ে জায়ান নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বন্যার গায়ে হাত তুলে ফেলে। যদিও জায়ানের ওপর বন্যার কোনো রাগ নেই।
———–
পূর্ণিমা রাত। হয়তো ১১টা বা ১১.৩০টা বাজে। রাস্তার ধারে সাইড করা বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে বন্যা। তার দুই হাতে দুইটা আইসক্রিম। আইসক্রিম পেলে বন্যার আর দিন দুনিয়ার হুশ থাকে।
অনতিদূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে আদিত্য। ল্যাম্পপোস্টের আলো বন্যার শ্যাম বর্ণ চেহারায় প্রতিফলিত হয়ে ধরা দেয় আদিত্যর চোখে। মোহময়ী লাগে বন্যাকে।
আদিত্য অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলতে চাইছে বন্যাকে। কিন্তু বন্যার সকল মনোযোগ আইসক্রিম দুটোর দিকে।

-বন্যা, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
বন্যা তার মনোযোগ আইসক্রিমের দিকে স্থির রেখে ছোট্ট করে বলে-হুম।
আদিত্য আশাহত হয়। আবার বন্যাকে ডাকে- বন্যা?
তখনো বন্যার মনোযোগ আইসক্রিমের দিকে। আদিত্য সামান্য বিরক্ত হয়। তবুও মুখে কিছু বলে না।

-বন্যা, তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমি কেন তোমাকে বিয়ে করেই নিজের কাছে নিয়ে আসিনি?
বন্যার ছোট্ট জবাব- হুম। এই মুহূর্তে আইসক্রিম থেকে নিজের মনোযোগ সরালে বোধহয় দুনিয়া এদিক ওদিক হয়ে যাবে।

আদিত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে গড়গড় করে বলে দেয়
-বন্যা আমাকে তিন মাসের জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে। আমি আগে থেকেই জানতাম আমাকে যেতে হবে তাই তোমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসিনি। আমরা এতো দিন যদি একসাথে থাকতাম তাহলে আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হতো। তাই আমি এই দূরত্বটা আমাদের মধ্যে রাখতে চেয়েছিলাম।

বন্যার হাত থেকে আইসক্রিম দুটো মাটিতে পড়ে যায়। চুপছে যাওয়া মুখ নিয়ে আদিত্যর পানে তাকিয়ে থাকে সে।

চলবে