শেষ পাতায় তুমি পর্ব-০৮

0
3481

#শেষ_পাতায়_তুমি (Revenge Story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৮|

মেহের ফায়াজের আনা সাদা লং টপস, কালো জিন্স সাথে কালো হিজাব পড়েছে। হিজাবে সাদা পাথরের বড় হিজাব পিন লাগাচ্ছে। চোখে কাজল পড়েছে ঠোঁটে হালকা পিংক কালার চ্যাপস্টিক। বিয়ের পর এই প্রথম বাইরে যাচ্ছে। নতুন বউয়ের একটা চিহ্ন থাকা জরুরী মনে হচ্ছে মেহেরের। তাই একটা সাদা নাক ফুল আর দু’হাতে চুড়ি পড়ে নিল। মেহের নিজেকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। বিয়ের আগের সেই মেহের আর নেই। বিয়ে নামক শব্দটা কতটা বদলে দিয়েছে। নাক ফুল পড়ায় পুরো ফেসই যেন বদলে গেছে। নিজেকে দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। তারপর মনে পড়ল ফায়াজ নিচে অপেক্ষা করছে। মেহের তাই দ্রুত জুতার ফিতে লাগিয়ে ব্যাগ নিয়ে নিচে দৌড় মারল।

মেহের নিচে গিয়ে ফায়াজকে খোজছে কিন্তু ফায়াজ কোথাও নেই। ফায়াজকে খোজে না পেয়ে একজন সার্ভেন্টকে জিজ্ঞেস করল,
“ফায়াজ মানে আপনাদের স্যার কোথায়?”

সার্ভেন্ট উত্তরে বলল,
“স্যার তো কখন চলে গেছে। অনেকক্ষণ হবে।”

মেহের অবাক হয়ে গেল সার্ভেন্টের কথা শুনে। ফায়াজ ওকে রেডি হতে বলে রেখেই চলে গেল। মেহেরের মনটা খারাপ হয়ে গেল।

মেহের মন খারাপ করে বলল,
“চলে গেছে? তাহলে আমি যাব কিভাবে? ”

“মেম, ড্রাইভার আপনাকে নিয়ে যাবে। বাইরে আপনার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে।”

মেহের জোরপূর্বক হেসে বলল,
“জ্বি ধন্যবাদ।”
মেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল যা সার্ভেন্ট মহিলার চোখ এড়াইনি। তিনিও বুঝতে পারছে মেহেরের মন খারাপ। স্বামীর এভাবে চলে যাওয়ায় কষ্ট পেয়েছে। পাওয়াটাই স্বাভাবিক।

মেহের ভার্সিটিতে ঢুকে চারদিকে চোখ বুলাচ্ছে। মনে হচ্ছে সামান্য কয়দিনে সব বদলে গেছে। আসলে নিজের বদলে যাওয়া জীবনটা, বদলে যাওয়া দৃষ্টির জন্য সব অদলবদল লাগছে।
মেহের ক্লাস রুমের সামনে যেতেই অনু ওকে দেখে দৌড়ে এল।
অনু মেহেরকে ঝাপটে ধরল। মেহের পড়ে যেতে নিয়েও ব্যালেন্স রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অনু মেহেরকে ধরে কেঁদে দিল।

মেহেরকে ছেড়ে বলল,
“কেমন আছিস তুই? শুনলাম ফায়াজকে বিয়ে করেছিস। তারপর কতবার ফোন করেছি কিন্তু অফ পাচ্ছি। তোদের বাড়িতে গিয়েও কিছুই জানতে পারি নি। পাড়ার লোক নানান কথা বলাবলি করছে। কি এমন হয়েছিল যে ফায়াজকে বিয়ে করলি? সব বল। সবটা জানতে চাই। দাঁড়া ওলিদ আর আলিফকে ডেকে আনি। ওদের কাছ থেকেই জেনেছি তোর বিয়ের কথা। ওরাও তোর জন্য টেনশন করছে।”

মেহেরকে কোনো কথা বলতেই দিচ্ছে না। মেহেরের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ক্যাম্পাসের দিকে।

ফায়াজ এডিটিউট নিয়ে বন্ধুদের সাথে ডিপার্ট্মেন্টের হেডের সাথে মিট করতে যাচ্ছে। ডিপার্ট্মেন্টের হেডের রুমে গিয়ে ফায়াজ স্যারের সঙ্গে টুকিটাকি কথা বলে বলল,
“মেহের,, মেহের নওয়াজ খান। ফার্স্ট ইয়ার। আমার ওয়াইফ। হুট করে আমাদের বিয়ে হওয়ার কারণে পরীক্ষাটা কন্টিনিউ করতে পারে নি। নতুন বিয়ে, ফ্যামিলি ব্লা ব্লা বুঝেনই তো এ-সব কারণে ও পরীক্ষা কন্টিনিউ করতে পারে নি। আজ থেকে আবারও ক্লাস করছে। সো এখন কি করতে হবে? যদি পরীক্ষার জন্য জরিমানা নেন তো ইটস ফাইন। বাট পরীক্ষা না দেওয়ার জন্য ভবিষ্যতে কোনোরুপ প্রব্লেম যেন না হয় দেখবেন।”

ডিপার্টমেন্ট হেড বলল,
“কোনো সমস্যা হবে না। আর না কোনো জরিমানা দিতে হবে। ওকে বলবেন একটা এপ্লিকেশন জমা দিতে। যত তাড়াতাড়ি দিতে পারবে ততই ভালো।”

“ওকে ধন্যবাদ।” ফায়াজ উঠে দাঁড়াল।
মেহের ভার্সিটিতে এসেছে কিন্তু কোথায় আছে কে জানে।
ফায়াজ ডিপার্টমেন্ট হেডের রুম থেকে বের হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করছে। তারপর হটাৎ করে মনে হলো ওর কাছে মেহেরের নাম্বার নেই।

ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে বিরবির করে বলল,
” উফফ, এখন আবার ওকে খোজে বেড়াও।”

ফায়াজ মেহেরের ক্লাসরুমের সামনে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করল মেহেরের কথা। কিন্তু মেহের ক্লাস রুমে নেই জানিয়ে দিল।

মেহের ভার্সিটিতে এসেছে অনেক আগেই সেই খবরটা ফায়াজের কাছে পৌছেছে। তাহলে মেহের কোথায়? ক্লাস রেখে কোথায় গিয়েছে? কোথায় গল্প করে বেড়াচ্ছে?

.

মেহেরকে দেখে ওলিদ, আলিফ উৎফুল্ল হয়ে এগিয়ে এল।
তারপর এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে। কেন এমন করল, ফায়জকে বিয়ে করার কারণ বারবার জিজ্ঞেস করছে কিন্তু মেহের বারবারই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে।

ফায়াজ মেহেরকে খোজে খোজে ক্লান্ত। খুজতে খুজতে পেয়েও গেল অবশেষে।
মেহের বোনের সাথে বসে গল্প করছে। মেহেরকে মাহির সাথে দেখে ফায়াজের মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে গেল। ফায়াজ সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। মেহের হেসে হেসে মাহির সাথে কথা বলছে। মাহি একমনে মেহেরকে দেখছে। মেহেরকে দেখে তৃপ্তি মেটাচ্ছে। কিছুদিন পরে মাহির বিয়ে। মেহেরের আসার খবর শুনে মাহি হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও চলে এসেছে বোনকে এক নজর দেখবে বলে।

ফায়াজ ধীরে ধীরে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হটাৎ মাহির চোখ পড়ল ফায়াজের দিকে। মেহের তখনও বকবক করে যাচ্ছে। মাহি আলতো করে মেহেরকে ধাক্কা দিয়ে ফায়াজের দিকে ইশারা করল। মেহের ফায়াজকে দেখে চমকে গেল।

মেহের দাঁড়িয়ে গেল। ফায়াজের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলছে।
ফায়াজ ভ্রুতে চুলকে বলল,
“এই তোমার পড়াশোনা? এর জন্য তুমি ভার্সিটিতে আসার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলে?”

মেহের আমতা আমতা করছে। মাহি মেহেরের আগে ফায়াজকে কিছু বলতে গেলে ফায়াজ হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল।

তারপর বলল,
“আমি আমার ওয়াইফের কাছে উত্তর চাই কোনো থার্ড পারসনের কাছে নয়।”

মাহি চুপ করে গেল৷ মেহের বলল,
“আপুর সাথে হটাৎ দেখা হয়ে যায়৷ তাই…

“তাই ক্লাস বাদ দিয়ে গল্পে মেতে উঠেছ?”

মেহের বুঝতে পারছে না ফায়াজের এত রিয়েক্ট করার কি আছে৷ ফায়াজ নিজেও সারাক্ষণ বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে থাকে৷ কোনো দিন একটা ক্লাস করেছে কি না সন্দেহ। তাহলে ওর সাথে এমন করছে কেন?

ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এল। তারপর মেহেরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে রাখল। মেহের ভয় পেয়ে গেল। সাথে ব্যথাও পাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছে না।মাহি রিয়েক্ট করে বসল।
“ফায়াজ মেহেরকে ছাড়ো৷ মেহের ওর বোনের সঙ্গে কথা বলেছে। বোনের সঙ্গে কথা বলার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। ওর লাগছে ওকে ছেড়ে দেও।”

ফায়াজ মাহির কথা শুনে মেহেরের কোমড় জড়িয়ে এক পাশে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“আমি ওকে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে রাখব কেউ ওকে ছাড়ার কথা বলতে পারে না। আমার এক্স তো নয়ই।”

অনু, ওলিদ, আলিফ নির্বাক ওদের কথা শুনছে পাশে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এক্স ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না কেউই তাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। মাহি চুপ করে গেল। ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মেহেরও মাহির দিকে তাকাতে তাকাতে ফায়াজের সাথে চলে যাচ্ছে। মাহি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে৷ ওর কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।
অনু, ওলিদ, আলিফ মেহেরের সাথে ফায়াজের ব্যবহার দেখে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে। ফায়াজ যে মেহেরকে ভালো রাখে নি এবং রাখবেও না সেটা বুঝতে বাকি নেই।

.

মেহের সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই একজন ভদ্রলোককে দেখতে পেল। বাবার বয়সী একজন লোক স্যুট বুট পড়ে ভেতরে ঢুকছে। পেছনে দু’জন ভারী দুটো লাগেজ নিয়ে আসছে। মেহের কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে মেহেরকে দেখে থেমে গেল। ভ্রু কুচকে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেরকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। মেহের ঘাবড়ে যাচ্ছে।

মেহেরকে জিজ্ঞেস করল,
“এই মেয়ে কে তুমি? আমার বাড়িতে কি করছ?”

মেহের প্রশ্ন শুনে ভড়কে গেল। এই ভদ্রলোকের বাড়ি হলে ওরা কার বাড়িতে আছে? এটা ফায়াজের বাড়ি নয়। মেহের ভয় পেয়ে এক দৌড়ে উপরে নিজের রুমে গেল। ফায়াজ শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। মেহের ফায়াজের সামনে গিয়ে বলল,
“শুনুন, কে জানি এসেছে। আর বলছে এটা তার বাড়ি। আমরা কার বাড়িতে আছি?”

ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে টিভি অফ করে কপাল কুচকে বিরক্তি নিয়ে মেহেরের দিকে তাকাল।
“কার বাড়ি মানে? আমি কি অন্যের বাড়িতে থাকব? অদ্ভুৎ। এটা আমারই বাড়ি।”

মেহের প্রশ্ন করল,
“তাহলে ওই আংকেলটা কে?”

ফায়াজ কিছু একটা ভেবে বলল,
“মেবি বাবা এসেছে। মানে তোমার শ্বশুর।”

মেহের ঢোক গিলে বলল,
“শ্বশুর!”

ফায়াজ বেড থেকে নেমে বলল,
“কি করেছ তুমি?”

মেহের ভয়ে ভয়ে বলল,
“কিছু না। শুধু ভয় পেয়ে দৌড় দিয়েছি উত্তর না দিয়ে।”

“কি জিজ্ঞেস করেছিল?”

“আমি কে? এ বাড়িতে কি করছি?”

ফায়াজ বলল,
“চলো। আর হ্যাঁ একদম উল্টো পাল্টা কিছু বলবে না। আমরা যে ঘর ঘর খেলা খেলছি সেটা যেন বাবা না জানে। একদম বউয়ের মতো ব্যবহার করবে। একজন শ্বশুর আর বউমার যেমন সম্পর্ক থাকে ঠিক তেমনই যেন হয়। বুঝেছ?”

মেহের মাথা উঁচু নিচু করে ঝাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ বুঝেছি।”
ফায়াজ মেহেরকে নিয়ে নিচে গেল। ফায়াজের বাবা তখনও নিচে। সার্ভেন্টের সাথে কথা বলছে। মেহেরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে।

মেহের ফায়াজের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ বাবার সামনে গিয়ে দাড়াল। মেহেরকে পেছনে থেকে বের করে সামনে দাঁড় করিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,
“এখানে সোজা হয়ে চুপ করে দাঁড়াও।”

মেহের সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজের বাবা অবাক দৃষ্টিতে মেহেরের বিহেভ দেখছে।

ফায়াজ ভনিতা ছাড়াই বলল,
“আমার ওয়াইফ মেহের। আমরা ১০ দিন হয়েছে বিয়ে করেছি।”

ফায়াজের বাবা ফায়াজের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন। অফিসের কাজে কিছুদিনের জন্য বাইরে গিয়েছে আর এরি মধ্যে ছেলে বিয়ে করে নিয়েছে তাও না জানিয়ে।

“মানে? কি বলছ তুমি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“বিয়ে, বিয়ে করেছি। মানে না বুঝার কি হলো? আমি আর মেহের একে অপরকে ভালোবাসি তাই বিয়ে করেছি।”

ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রুমে যাও।”

মেহের ফায়াজের কথা মতো রুমে চলে গেল। ফায়াজ বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার কিছু বলার আছে? আমার বিয়ে নিয়ে আপত্তি আছে?”

ফায়াজের বাবা বলল,
“না, কোনো আপত্তি নেই। তুমি যদি সুখে থাকো তাতেই আমি সুখী। দোয়া করি তোমাদের বন্ধন অটুট থাকুক।”

ফায়াজ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে।

ফায়াজের বাবা ভাবছে,
“বিয়ের পর নাকি ছেলেরা বদলে যায়। খারাপ মানুষও বউয়ের ভালোবাসায় নিজেকে বদলে নেয়। আমার ছেলেটার যেন সুবুদ্ধি উদয় হয়। যাতে শুধরে যায়। তাহলে আর আমার কিছু চাওয়ার নেই।”

মেহেরকে ফায়াজের বাবা ডেকে পাঠিয়েছে। মেহেরের ভয় লাগছে খুব। কি বলবেন তিনি? বকবে না তো।

চলবে….!