শৈবলিনী পর্ব-০১

0
1259

#শৈবলিনী
সূচনা পর্ব
লেখিকা-মেহরুমা নূর

★একা একা কী মজা পাবেন ম্যাডাম! আমাদের সাথে নেন তবেই না আসল মজা পাবেন।আমাদের আপনার পেছনে বসান, আমরা অনেক ভালো কোম্পানি দিতে পারি। আমাদের একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন, তারপর দেখেন আপনার রাইড কেমন স্মরণীয় করে দেই।
ঢাকার শাহবাগ মোড়ে সিগনালের সামনে বাইক নিয়ে সিগনাল ছাড়ার অপেক্ষায় বসে ছিল নূর। তখনই পাশের বাইক থেকে নিজেদের পুরুষ দাবি করা সমাজের কিছু ভাইরাস গুলো উপরোক্ত কটুক্তি ছুঁড়ল। দশ বারোটা বাইকের মাঝে নূরই একমাত্র মেয়ে বাইকার। আর যথারীতি এতগুলো পুরুষের মাঝে বিপরীত লিঙ্গের কাউকে দেখে স্বভাবগতভাবেই তাঁর বিষয় টাকে বিনোদনের উদ্দেশ্যে বানিয়ে ফেললো। নানান রকম অরুচিকর কথা বলে নির্লজ্জের মতো হাসছে। নূর ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। সবাই শুধু চেয়ে চেয়ে তামাশা দেখছে। কেউ কোনো রকম প্রতিবাদ করছেনা এই অশালীন কাজের।

বাইকের হ্যান্ডেল ছেড়ে মাথার হেলমেট টা খুলে নিচে নামালো নূর।মাথা ঝাকিয়ে খোলা চুলগুলো পেছনে সরিয়ে ফেললো। বাইকের ওপর বসে থাকা কটুক্তি করা ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে সম্মতি স্বরূপ হাসলো। এতে করে ছেলেগুলো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাওয়ার ন্যায় আমোদিত হয়ে গেল। তাদের খুশিকে আরও দ্বিগুণ করে দিয়ে নূর তর্জনী আঙুলের ইশারায় ছেলেগুলোকে নিজের কাছে ডাকলো। কাল বিলম্ব না করে বাইক থেকে একটা ছেলে নেমে এলো। নূরের সম্মুখে এসে দাঁড়াল।মুখে তার কুরুচিপূর্ণ হাসি। পঙ্খি তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো।
–আপনি বসবেন আমার কাছে?

–ইয়া শিওর। ইট ওয়াজ মাই প্লেজার।

–হাউ সুইট অফ ইউ।

হাতের হেলমেট টা বাইকের হ্যান্ডেলের সাথে ঝুলিয়ে রেখে বাইক থেকে উঠে দাঁড়াল নূর। ঠোঁটের নাটকীয় হাসি বজায় রেখে বলল,
–তা এমন অফার কী আপনার মা বোনকেও দেন?

ছেলেটা রাগান্বিত হয়ে বলল,
–হোয়াট??

–আই টেল ইউ হোয়াট।
মুহূর্তের ব্যবধানে নূরের মুখশ্রী কঠিন হয়ে উঠল। তীক্ষ্ণ ক্ষোভপূর্ণ দৃষ্টির অগ্নি ছুঁড়ল লোকটির পানে। লোকটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই নূর লোকটির পেট বরাবর সজোরে ঘুষি মেরে দিলো। পেটে হাত দিয়ে ব্যাথায় যখন ঝুঁকে পড়লো লোকটা, তখন নূর লোকটার মাথা ঠেসে ধরে বাইকের সাথে বারি মেরে দিলো। চোখের সামনে হাজার তারার মেলা দেখতে পেল লোকটি। মারছে আর ক্ষিপ্ত স্বরে বলছে,
–মেয়ে মানুষ দেখলেই শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় তোদের তাইনা? সালা কাপুরুষের দল। খুব মজা করার ইচ্ছে তাইনা? দিচ্ছি তোদের মজা আমি। এমন মজা দেব জীবনে মজা নাম শুনলেও কলিজা কাঁপবে।

নূর পাশে তাকিয়ে দেখলো অন্য একটা ছেলে ফোন বের করে এসব ভিডিও করতে ব্যাস্ত। নূর সেই ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ ভিডিও কর। ভিডিও করে সোস্যাল মিডিয়ায় ছাড়বি। আর ক্যাপশনে লিখবি, হ্যাশট্যাগ যখন আমাদের দেশের পুরুষ রা নিম্নমানের কাপুরষ। চুড়ি পড়ার কথাটা বললাম না। কারণ তোদের মতো পুরুষদের চুড়ি পড়তে বলাটাও মেয়েদের জন্য অপমান। চুড়ির পড়া নারীরও অনেক শক্তি আছে, যা তোদের মতো কাপুরুষের নেই।

ছেলেটি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। বাকিরাও লজ্জায় নতমুখ হয়ে গেল নূরের বক্তব্যে। হট্টগোল দেখে ট্রাফিক পুলিশ ওখানে এগিয়ে এলো। নূরের কাছে এসে জিজ্ঞেস কী হয়েছে এখানে? মার খাওয়া ছেলেটা পুলিশের কাছে নূরের নালিশ দিতে লাগলো। পুলিশ নূরকে কিছু বলতে যাবে তখনই একটা হোয়াইট বিএমডব্লিউর ড্রাইভার গাড়ির ভেতর থেকে পুলিশ কে ডাক দিলো। পুলিশ ওখানে গিয়ে ড্রাইভারের সাথে কথা বলা শেষে আবার ফিরে এলো। নূরকে কিছু না বলে মার খাওয়া ছেলেটার কলার ধরে নিয়ে চলে গেল। সাথে ওর বাইকের বাকি লোকগুলোকেউ। ব্যাপার টাতে নূর খানিকটা অবাক হলো বৈকি। সিগনাল ছেড়ে দেওয়ায় আর সেই বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো সে।

এতক্ষণ ধরে এখানকার সব কর্মকাণ্ড গাড়িতে বসে দেখছিলো আদিত্য। মেয়েটির সাহসীকতায় সে অবাকের সাথে অনেক টা প্রভাবিতও হলো। এমন মেয়ে সে খুব কমই দেখেছে। সিগনালে বসে থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো সে। গাড়ির জানালার ওপর ব্লাক গ্লাসের পারদ থাকায় বাইরে থেকে তাকে কেউ দেখতে পায়না। তবে সে বাইরের সবকিছু দেখছিলো। তখনই দেখতে পাই বাইকের কিছু ছেলে ওই মেয়েটিকে টিচ করছে। বিষয় টা নজরে আসতেই মেজাজ বিগড়ে যায় তার। গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হলে পাশ থেকে সেক্রেটারি জিদান ওকে থামিয়ে দিয়ে উদ্বেগি হয়ে বলল,
–স্যার, কোথায় যাচ্ছেন? এভাবে পাবলিক প্লেসে নামা আপনার জন্য ঠিক না।

–আই ডোন্ট কেয়ার। বাইরে ওই ছেলেগুলো একটা মেয়েকে হ্যারেস করছে। আর চোখের সামনে অন্যায় দেখেও চুপচাপ বসে থাকা ব্যাক্তি আমি না সেটা তুমি ভালো করেই জানো।
আদিত্য হাত ছাড়িয়ে নামতে নিয়েও থেমে গেল। ততক্ষণে যে ভুক্তভোগী নিজেই তার প্রতিবাদ দেখানো আরম্ভ করে দিয়েছে। বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো আদিত্য। মেয়েটার এমন বীরাঙ্গনা রুপান্তর দেখে রিতীমত থমকে গেল সে। বাংলা সিনেমার সুপারস্টার “সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য”। সিনেমায় অভিনয়ের সুবাদে অনেক হিরোইনকে যোদ্ধার অভিনয় করতে দেখেছে। তবে সেসব শুধুই ক্যামেরার সামনে। রিয়েল লাইফে এমন কাউকে আজ প্রথম দেখলো সে। যে নিজের লড়াই নিজেই করতে জানে। অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তিও দিতে জানে। মেয়েটার ওই প্রতিবাদী রক্তিম মুখটায় অজান্তেই দৃষ্টি জোড়া আকৃষ্ট হয়ে গিয়েছিল তার। মেয়েটির মারের স্কিলটাও ভালো পারদর্শী ছিল। আদিত্য সবই উপভোগ করছিল। থ্রিডি সিনেমার মতোই জীবন্ত সবকিছু।

পুলিশ যখন মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল তখন আদিত্যই ড্রাইভার কে বলে পুলিশকে ডেকে আনে। পুলিশ তো সুপারস্টার আদিত্যকে দেখেই আনন্দে আপ্লুত হয়ে যায়। আদিত্য তখন পুলিশকে সব টা খুলে বলে আর ছেলেগুলোকে অ্যারেস্ট করতে বলে। সেই মোতাবেক পুলিশ মেয়েটিকে আর কিছু বলে না। সিগনাল ছাড়লে মেয়েটি যখন বাইক নিয়ে চলে যাচ্ছিল আদিত্য তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিল। এই প্রথম মনে হলো সিগনাল এতো তাড়াতাড়ি কেন ছাড়ল। পাশ থেকে জিদানের কথায় ধ্যান পরিবর্তন হলো তার। জিদান কপাল টান টান করে চোখ দুটো বিশাল করে বলল,
–বাপরে, কী একটা মেয়েরে বাবা! কী মারটাই না দিলো।ছেলেটা বাপের জন্মেও ভুলবেনা। আজকের পর নিশ্চয় ওই ছেলেটা নিজের বউকেও আপা বলে ডাকবে। তখন আবার বউয়েরও উদম ক্যালানি খাবে।

প্রতিক্রিয়া বয়ান করে হাসতে লাগলো জিদান। আদিত্যর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়তেই সুইচ বাটনের মতো পরমুহূর্তেই তা বন্ধও হয়ে গেল। গলা ঝেড়ে রোবটের মতো সটান হয়ে বসে রইলো সে। যেন হাসি কোন ক্ষেতের মুলা সেই ব্যাপারে তার কোন ধারণাই নেই। তার চৌদ্দ গুষ্ঠিও হাসি নামক বস্তুর সাথে পরিচিত না। আদিত্য নজর সরিয়ে বাইরের দিকে ফেরালো। জানালার ওপর কনুই ঠেকিয়ে ঠোঁটের ওপর দুই আঙুল চেপে ধরে আনমনে হাসলো সে। হাসিটার কারণ যদিও তার কাছে এখন অজানা।
___

শুটিং শেষ করে বাড়ি ফিরছিলো আদিত্য। রাস্তায় বাইক দেখলেই তার শুধু সেই মেয়েটার চেহারা মনে পড়ছে। আজ শুটিংয়ের সময়ও বারবার কেন যেন মেয়েটের কথাই মনে পড়ছিলো। মেয়েটাকে কী আর কখনো দেখতে পাব? দেখলেই বা কী হবে? কী বলব তাকে? প্রয়োজন বা প্রিয়জন কোন কিছুই তো নয় সে। তবে কেন এই অহেতুক ভাবনায় ব্যাকুল মন?
মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেমে গেলে ভাবনা মোড় নেয় আদিত্যর। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,
–কি হয়েছে গাড়ি থামালে কেন?

–স্যার মনে হয় কোনো সমস্যা হয়েছে। গাড়ি চালু হচ্ছে না। নেমে দেখতে হবে।

–হোয়াট? ওকে ফাইন, দেখ তাড়াতাড়ি।

জিদান আরও তোরজোর দিয়ে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ জলদি দেখেন ভাই।এই ফাঁকা জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা স্যারের জন্য মোটেও সেফ না। স্যারের রাইভেল রা এমনিতেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

–আহ জিদান, সবকিছুতে এতো ওভার রিয়্যাক্ট করার দরকার নেই। বাইরে গিয়ে দেখ গাড়ির কী সমস্যা হলো?

–জী স্যার এখুনি দেখছি।

কিছুক্ষণ পর জিদান এসে বলল,
–স্যার, অঘটন তো একটা ঘটে গেছে।

–অঘটন মানে? কী হয়েছে?

–স্যার গাড়ির ইঞ্জিনে সমস্যা হয়েছে। গাড়ি তো এখন চলবেনা।

–তো এতে অঘটনের কী হলো? তুমিতো এমনভাবে বলছ যেন গাড়ির নিচে কেউ চাপা পড়ে গেছে।

–কী বলেন স্যার? এরচেয়ে বড়ো অঘটন আর কী হতে পারে? এমন ফাঁকা জায়গায় এভাবে থাকাটা আপনার জন্য কতো রিস্কের তা একমাত্র আমি জানি। বাড়ি থেকে বেড়োনোর সময় ম্যাম আমাকে রোজ বলে দেয়, আমার ছেলেকে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি জিদান। ছেলেকে সহিসালামত বাড়ি ফিরিয়ে আনা তোমার দায়িত্ব। ভাবেন,কতবড় গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে। আপনার গায়ের একটা পশম খোয়া গেলেও আমি সেই দায়িত্বহীনতার নিচে চাপা পড়ে মরে যাবো।

মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তিতে নাক মুখ শক্ত হয়ে এলো আদিত্যের। জিদানের এই অপ্রয়োজনীয় অতিভক্তি দেখে চরম পরিমাণ বিরক্ত হয়ে যায় সে। সে সিনেমার নায়ক হলেও দুনিয়ার যতো ড্রামা তো এরাই বেশি করে। এক এই জিদান আর এক আছে ওর মা জননী। চোয়াল চিবিয়ে আদিত্য বলল,
–ড্রামা বন্ধ করে দেখ আশেপাশে কোথাও গ্যারেজ আছে কিনা।

–জি স্যার এখুনি দেখছি।

দুই মিনিটের মাঝেই জিদান আবার ফিরে এসে বলল,
–স্যার, সুখবর গ্যারেজ পাওয়া গেছে। এই একটু সামনেই একটা গ্যারেজ আছে।

–আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে গিয়ে তাদের কাউকে ডেকে আনো। আমি ততক্ষণে অন্য গাড়ি আসতে বলছি।

–স্যার,বলেছিলাম। কিন্তু ওরা নাকি এখন আসতে পারবেনা বলছে।

–আচ্ছা ঠিক আছে আমি গিয়ে দেখছি চলো।

আদিত্য গাড়ি থেকে নেমে গ্যারেজের দিকে এগুলো।জিদানও তাঁর পিছু পিছু চললো। এদিকে ফাঁকা থাকায় লোকজন তেমন নেই। তাই আদিত্য আর মাস্ক পড়লোনা। কিছুদূর এগুতেই গ্যারেজ টা দেখতে পেল। সাইনবোর্ডে লেখা নুরুজ্জামান মেকানিকাল গ্যারেজ। গ্যারেজ টা পুরান হলেও সাইনবোর্ড টা এখনো যেন চকচক করছে। কেউ যেন সাইনবোর্ডটাকে অতি যত্নে রেখেছে। গ্যারেজের সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলো একজন মেকানিক চিত হয়ে গাড়ির নিচে অর্ধেক ঢুকে আছে। ভেতর থেকে হয়তো গাড়ি মেরামতের কাজ করছে। তার পায়ের কাছে হ্যাংলা করে একটা ছেলে বসে আছে। দরকারী যন্ত্রপাতি যা বলছে সেগুলো এগিয়ে দিচ্ছে ছেলেটা। আদিত্য ছেলেটার সামনে গিয়ে বলল,
–এক্সকিউজ মি!

ছেলেটি আদিত্যের দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল। চোয়াল খুলে যেন নিচ পর্যন্ত ঝুলে পড়লো। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না সে চোখের সামনে সুপারস্টার আদিত্যকে দেখতে পাচ্ছে। ছেলেটা ফাটা ফাটা চোখে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। উপরে দাঁড়িয়ে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
–ও মাই বাপ!!! দ্যা সুপারস্টার আদিত্য স্বয়ং আমার সামনে! আমার তো বিচ্ছাচই (বিশ্বাসই) হইতাচেনা। আমি কী জাইগ্গা জাইগ্গা ছপন দেখতাছি নি?

আদিত্য সৌজন্যমূলক কিঞ্চিৎ হাসির রেখা টেনে বলল,
–স্বপ্ন নয়, আমি সত্যিই তোমার সামনে। আসলে আমার গাড়িটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেছে। তোমরা একটু দেখে দিবে?

–হ হ অবচ্ছই। আপনে বছেন না স্যার।

–নো ইটস ওকে, তুমি শুধু গাড়িটা…

আদিত্যের বাক্য পূরণ হওয়ার আগেই গাড়ির নিচ থেকে সেই ব্যাক্তি কর্কশ গলায় বলে উঠলো।
–ওই হালার পল্টু, কই আকাম করতে গেলি? আমারে রেঞ্জ দেসনা কেন?

ছেলেটি এক ছুটে আবারও তার পায়ের কাছে বসে উৎসাহী কন্ঠে বলল,
–ওস্তাদ,বাইরে আহেন। দেহেন কেঠা আইছে আমগো গ্যারেজে!

–কেন? তোর মরা নানির বয়ফ্রেন্ড এসেছে নাকি? খালি কাজে ফাঁকি দেওয়ার বুদ্ধি তাইনা? আজাইরা প্যাঁচাল রেখে কাজ কর।

–আরে ওস্তাদ একবার বারাইয়া তো দেখ। দেহ কতবড় কাস্টোমার আইচে!

–কাস্টোমার? আচ্ছা আসছি।

গাড়ির নিচের ব্যক্তিটি পিঠের নিচের চ্যাপ্টা ট্রলি ঠেলে সুরুত করে বাইরে বেড়িয়ে এলো। আদিত্য ফোনে ব্যাস্ত ছিলো। বাসায় ফোন করে অন্য গাড়ি আনার ব্যবস্থা করছে। তখনই ছেলেটা ওর সামনে এসে বলল,
–স্যার, এইযে আমগো ওস্তাদ। উনারে কন কী ছমছ্যা।

আদিত্যের দৃষ্টি ছিলো ফোনের স্ক্রিনে। ছেলেটির কথায় মাথা তুলে দৃষ্টি মেললো সামনের ব্যক্তির পানে। সামনে একবার তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে আবার চোখ নামিয়ে নিতেই, মুহূর্তের ব্যবধানে আবারও এক ঝটকায় সামনে তাকালো সে। চমক ছেয়ে গেল তার আঁখি যুগলে। অবাক দৃষ্টি স্থির সামনের অনাকাঙ্খিত ব্যক্তির পানে। এইতো সেই মানবী। যার ভাবনা ওর মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে দৌড়ে বেড়িয়েছে আজ। আদিত্যের সম্মুখে স্বয়ং সে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে নেভি ব্লু কালারের ট্রাকার সুট। যার অসংখ্য জায়গায় মবেলের কালো দাগ লেগে আছে। দুই হাতসহ মুখেও এই দাগ লেগে আছে। একটা জীর্ণ কাপড়ের ত্যানা দিয়ে হাত মুছছে সে। মাথার উঁচুই ঝুটি বাঁধা চুলগুলোও জীর্ণতা থেকে রেহাই পায়নি। মেয়েটাকে এভাবে দেখবে সেটা ভাবনাতীত ছিলো আদিত্যের কাছে। আদিত্যের বিস্ময়ের ঘোর কাটে সামনের মানবীর বেসুরো বানিতে ।
–ওই মিয়া এমন উল্লুকের মতো তাকিয়ে আছেন কেন? মনে হচ্ছে জন্মের পর আজই প্রথম মানুষ নামক মেরুদন্ডটি প্রাণীকে স্বচক্ষে দেখছেন? জীবনে জ্যান্ত মানুষ দেখেননি নাকি?

নূরের কথায় আদিত্য একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কৌতুহল দমাতে না পেরে আগ্রহী কন্ঠে বলে উঠলো।
–তুমি?? এখানে?

নূরের সোজাসাপ্টা জবাব।
–হ্যাঁ আমি। আমার গ্যারেজ এটা। আমার গ্যারেজে আমি থাকবো না তো কী ডোনাল ট্রাম্প থাকবে? কেন আপনার কোনো সমস্যা?

আদিত্যের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জিদানও নূরকে চিনতে পেরেছে। এখন তো তার স্যারের জন্য ভয় লাগছে। তখনকার ওই ছেলেটার মতো যদি স্যারকেও পচা সাবান দিয়ে ধুয়ে দেয় তখন? এই মেয়ে তো সাংঘাতিক। না না আমার জান থাকতে স্যারকে কিছু হতে দেবোনা। স্যারকে কিছু করার আগে এই মেয়েকে আমার লাশের ওপর দিয়ে যেতে হবে। এই পণ করে জিদান আদিত্যের পাশে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
–স্যার, আপনি কোনো চিন্তা করেন না। এই জিদানের শরীরকে এক ফোটানো র,ক্ত থাকতে আপনাকে কেউ ছুঁতে পারবেনা।

আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় আওয়াজে বলল,
–ইউ জাস্ট কিপ কোয়াইট। লেট মি টক।

আদিত্য নূরের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আগেই পল্টু বলে উঠলো।
–আরে ওস্তাদ, ওনার গাড়ি নষ্ট হইয়া গেছে। হেইডাই কইতে আইছে।

–ও আচ্ছা। তা কোথায় আপনার গাড়ি?

–এইতো একটু সামনেই। আসুন দেখাচ্ছি।

আদিত্যের পেছনে গেল নূর। গাড়ির কাছে এসে ডিকি খুলে চেক করতে লাগলো। আদিত্যর বিস্ময় যেন কাটছেই না। মেয়েটাকে দুইবার দেখলো। আর দুইবারই অবাক করলো মেয়েটা ওকে। মেয়ে হয়ে গ্যারেজে গাড়ি মেরামতের কাজ করতে এই প্রথম কাউকে দেখলো। মেয়েটা সত্যিই ইউনিক। সবথেকে আলাদা। না চাইতেও অবাধ্য চোখের দৃষ্টি বারংবার তার পানেই ছুটছে। অদৃশ্য কোনো মধ্যাকর্ষণের সৃষ্টি হচ্ছে যেন। গাড়ি চেক করা শেষে নূর বলে উঠলো।
–হুম, ইঞ্জিনে সমস্যা হয়েছে। সময় লাগবে। গাড়ি রেখে যেতে হবে। ঠিক হলে কাল নিতে পারবেন। পল্টু খাতাটা নিয়ে আয়।

পল্টু এক দৌড়ে খাতা নিয়ে এলো। নূর এক হাতে খাতা আরেক হাতে কলম নিয়ে খাতার দিকে তাকিয়ে থেকে আদিত্যের উদ্দেশ্যে বলল,
–হ্যাঁ বলুন,নাম কী?

আদিত্য বুঝতে পারলো না। সে জিজ্ঞাসু চোখে বলল,
–নাম? কার নাম?

–কার আবার! গাড়ি আপনার তো আপনার নামই লিখতে হবে তাইনা? ফটাফট নাম আর ডিটেইলস বলুন।

আদিত্য থ বনে গেল। মনে হচ্ছে যেন অবাঞ্ছিত কোন কথা শুনল সে। মেয়েটা ওর নাম জিজ্ঞেস করছে? দ্যা হার্টথ্রব, লাখো হৃদয়ের স্পন্দন, সুপারস্টার আদিত্যর নাম জিজ্ঞেস করছে সে? মেয়েটা কী সত্যিই তাকে চিনে না, নাকি ইচ্ছে করে এমন করছে? আদিত্যকে চুপ দেখে নূর তাড়া দিয়ে বলল,
–কী হলো বলুন নাম। নাকি নিজের নাম ভুলে গেছেন?

জিদান আর সইতে পারলোনা। তার স্যারের এতবড় অপমান? বেদনায় কলিজায় গ্যাস্টিক জমে গেল। স্যারের সম্মান রক্ষার্থে ঢাল হয়ে এগিয়ে গেল সে। যদিও মেয়েটাকে দেখে ভয়ে হাঁটু কাঁপছে তার। তবুও স্যারের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
–এইযে ম্যাডাম, আপনি জানেন কার সাথে কথা বলছেন আপনি?

নূর সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো জিদানের পানে। মাথা থেকে পা অব্দি পর্যবেক্ষণ করে বলল,
— ওই ব্যাটা পাতিহাঁস। আমি কার সাথে কথা বলছি সেটা জানার আপনি কে?

পাতিহাঁস? এতবড় অপমান? আমার মতো এতো সুন্দর হ্যান্ডসাম সুদর্শন ছেলেকে শেষমেশ কিনা পাতিহাঁস উপাধি পেতে হলো? হ্যাঁ ওই একটু নাহয় কুচকুচে কালোই, নাহয় একটু দাঁত গুলো দরজার বাইরে বেড়িয়ে থাকে, সুতার মতো নাহয় একটু পাতলাই, জোরে বাতাস আসলে খাম্বা ধরে থাকতে হয়। ব্যাস এই সামান্য ত্রুটি ছাড়া কোন কমতি আছে তার মাঝে? তাই বলে পাতিহাঁস? একথা শোনার আগে ঠাটা কেন পড়লোনা? ধরণী ফেটে দুই ভাগ কেন হয়ে গেল না? জিদানের দুঃখের নদী এবার সাগরে পরিণত হলো নূরের পরবর্তী কথায়। নূর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আদিত্যদের পানে তাকিয়ে বললো।
–এই এক মিনিট! আপনারা গাড়ি টা চুরি টুরি করে আনেন নি তো? সেইজন্যই নাম বলতে পারছেন না তাইনা? সত্যি করে বলুন কোথাথেকে মেরেছেন এটা?

আদিত্য তব্দা খেয়ে গেল। মাথার ওপর মনে হচ্ছে চার পাঁচ টা কাক একসাথে কা কা করছে। চোর! লাইক রিয়েলি? সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য গাড়ি চোর! ওয়াও!! আদিত্য অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। কেউ শুনলো নাকি তাই দেখছে। নাহলে কালকের সব রকম মিডিয়ার হেডলাইন হয়ে যাবে সে। আদিত্য কোনরকমে কথাটা হজম করলেও, জিদান আর নিতে পারলোনা। ঠাস করে বাজ পড়লো তার মাথায়।তার স্যারের নামে এতবড় অপবাদ! আমি থাকতে স্যারকে এতবড় অপবাদ শুনতে হলো। এই জীবন রেখে আর কী লাভ? এক পৃথিবী সমান দুঃখ নিয়ে সে সরে গেল ওখান থেকে। পল্টু বিষয় টা সামলাতে তড়িঘড়ি করে নূরের কানের কাছে ঝুঁকে বলল,
–ওস্তাদ কী করতাছেন? আপনি উনারে চিনেন না?

–কেন, উনি কী হাসিনার মেয়ের জামাই নাকি যে তারে আমার চিনতে হব?

–আরে ওস্তাদ, উনি সুপারস্টার আদিত্য। বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেতা “সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য”। হ্যারে চেনে না কেডা? আর তারে আপনে চোর কইতাছেন? আরে বাংলাদেশের সবচেয়ে দামি গাড়ির কালেকশন আছে তার কাছে।

আদিত্য একটু গলা ঝেড়ে কলার টেনে দাঁড়াল। ভাবলো মেয়েটা এবার হয়তো ওকে একটু গুরুত্ব দিবে। কিন্তু আদিত্যের সে গুড়ে বালি পড়লো। নূর ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
–হ্যাঁ তো? সুপারস্টার হোক না ফুপাস্টার হোক তাতে আমার নানীর কী?

অতঃপর আদিত্য আরও একবার বেকুব হয়ে গেল। যদিও আদিত্যর নিজের খ্যাতি নিয়ে কখনো অহংকার করে না বা কখনো এই পরিচয়ের অপব্যবহার করতে চায় না। আর না মানুষের কাছে এই খ্যাতির জন্য বিশেষ মূল্যায়ন চায়। বরং এই খ্যাতির জন্য তার অনেক চাওয়া পাওয়া থেকে দূরে থাকতে হয়। নিজেকে সাধারণ ব্যক্তির কাতারেই রাখতে ভালো লাগে তার। এই প্রথমবার কেউ ওকে এমন কথা বলায় একটু অবাক হলেও বুঝতে পারলো, এই মেয়েটা ইউনিক। বাকি সবার মতো না। সে আদিত্যর সাথে নিতান্তই একজন সাধারণ ব্যক্তির ন্যায় আচরণ করছে। তথাপি আদিত্যও স্মিথ হেঁসে নিজের ভিজিটিং কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
–হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। আসলে ভুলটা আমারই।এই নিন এটা আমার কার্ড। এখানে সব ডিটেইলস আছে।

নূর কার্ডটা হাতে নিয়ে পল্টুকে দিয়ে রেখে দিতে বলল। পল্টু কার্ডটা নিয়ে চলে গেলে আদিত্য নূরের পানে তাকিয়ে বলল,
–আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো। আসলে আজ সকালে আপনাকে আমি শাহবাগ সিগনালের সামনে দেখেছিলাম। যখন আপনি মারপিট করছিলেন। তারপর হঠাৎ এখানে দেখলাম তাই একটু অবাক হয়েছিলাম।

নূর একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আদিত্যকে দেখলো। লোকটা ওখানে ছিলো। তারমানে সেও বাকিদের মতো চুপচাপ বসে তামাশা দেখছিল। হাঁহ্, যতো হিরোগিরি শুধু সিনেমার পর্দায়। বাস্তবে সেও বাকিসব পুরুষের মতোই। কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের হাসি ভাসলো অধরকোনে। যে হাসির মর্মার্থ বুঝতে অক্ষম হলো আদিত্য। সে আরও কিছু বলতে চাইলো মেয়েটিকে। তবে নূর তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করতে করতে বলল,
–কাল বিকেলে গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন।

নূর চলে যাচ্ছে। হঠাৎ ডাক দিলো আদিত্য। নূর দাড়িয়ে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো। আদিত্য বলল,
–আপনার নাম টা তো বললেন না। না মানে নামটা তো জানা দরকার তাইনা?

নূর কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর ছোট্ট করে বলল,
–নূর।

বলেই আবার চলে গেল সে। পেছনে তাকালে হয়তো দেখতে পেত আদিত্যর অপলক দৃষ্টির চাহুনি। বিড়বিড় করে উচ্চারিত তার ধ্বনি।
–নূর!!!!!!
কিছু পরিচয় তার পেছনে রেখে যায় স্মৃতি,
আর কিছু পরিচয় রেখে যায় প্রতিশ্রুতি।
আবার কিছু পরিচয় বয়ে আনে নতুন কোনো গল্পের অনুবৃত্তি।
দেখা যাক আমাদের পরিচয়টা কোন দিকে মোড় নেয়।

চলবে।