শৈবলিনী পর্ব-০৭

0
537

#শৈবলিনী—৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো দ্য গ্রেট “আবির”। (আমার সব গল্প যারা পড়েছে তারা ভালো চিনতে পারবে) শাহরুখ খানের মতো দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে মাথাটা আলতো দুলিয়ে বলল,
-সাহেবান,মেহেরবান,কদরদান,পানদান,থুকদান। লাখো মেয়ের জানের জান,প্রাণের প্রাণ দ্য ওয়ান এন্ড ওনলি ক্রাশ বয় অফ দ্য কান্ট্রি ইজ হিয়ার। আবির রায়হান। নামতো সুনা হি হোগা।

আদিত্য বলে উঠলো।
–হ্যাঁ শুনেছি তো অবশ্যই। আজকাল গালির বদলে লোকজন তোর নামই ইউজ করে। এটা নাকি অনেক বেশি কার্যকর। তা বেঁচে আছিস এখনো?

আবির এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
— লাহোল বিল্লালের পুত, কি কস এইসব! মরে আমার গার্লফ্রেন্ডের বাপ ভাই। এখনো তো বিশ্ব রেকর্ডই করলামই না।

–কিসের? থাপ্পড় খাওয়ার?

–আরে না,ওটাতো আগেই করে ফেলছি। আমিতো বিশ্ব প্রেমিক হওয়ার ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করবো। পৃথিবীর সব দেশে আমার গার্লফ্রেন্ড থাকবে। এটাই আমার জীবনের একমাত্র অ্যাম্বিশন। জানি এই মহৎ কাজ করা এতো সহজ না। তবে সব বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে আমি সফলতার শীর্ষে পৌঁছাবোই। দেখবি আমার দেশের নাম কেমন উজ্জ্বল করি আমি। বাংলাদেশ এই আবিরের নামে বিখ্যাত হবে। লোকে বলবে আরে এইটা তো দ্য গ্রেট আবিরের দেশ না? এই দেশ কতো মহান হবে, যে দেশে এমন মহাপুরুষের জন্ম হয়েছে। এই দেশকে তো সেরা দেশ ঘোষণা করা উচিত। সরকার আমাকে জাতির বয়ফ্রেন্ড হিসেবে ভূষিত করে দিবে।

–তোর এই মহান উদ্যোগের জন্য আমার পক্ষ থেকে তোর জন্য থাকছে কেয়া কসমেটিকসের সৌজন্যে একটি মহা মূল্যবান ই,য়া,বা মেশিন,পরিবেশ বান্ধব গা,ঞ্জা,র গাছ , আরও থাকছে আমার বাথরুম পরিষ্কার করা ব্রাশ আর কোমটের ভেতর থাকা পদার্থ টাও। তোর জন্য এক বদনা ভরপুর শুভকামনা। এই মহৎ কাজ করতে গিয়ে তুই মরে টরে গেলে তোর নামে বিশাল একটা ডাস্টবিন বানায় দিবো স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে।

আবির আবেগে আপ্লূত হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
–বাস কার পাগলে,আব রুলায়েগা কেয়া। তুই আমাকে এতো ভালোবাসিস আমার জানাই ছিলোনা। চোখে পানি চলে এলো দোস্ত। আয় আমার বুকে আয়, বুকাবুকি(কোলাকুলি) করি।

আবির এগিয়ে এসে আদিত্যকে হাগ করলো। আদিত্যও মুচকি হেসে হাগ করলো আবিরকে। মুখে যাই বলুক তবে দুজন দুজনার জিগরী দোস্ত। যাকে বলে একেবারে ল্যাংটা কালের বন্ধু। ছোটবেলা থেকে এই একটাই বন্ধু আদিত্যের। বিদেশেও ওরা একসাথেই পড়াশোনা করেছে। আবির এখন একজন নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার। আদিত্যর সব কস্টিউমের ডিজাইন আবিরই করে। আদিত্য ভাবলো,ভালোই হয়েছে আবির এসেছে। এখন আমার মনের অস্থিরতার সমাধান ওই দিতে পারে। এসবে আবার ও খুব পারদর্শী।আদিত্য আবিরকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
–তা কেমন আছিস? অনেক পর দর্শন দিলি যে।

–আবির অলওয়েজ বিন্দাস। আসলে কয়দিন হলো ভালো কোনো বিউটির দর্শন হচ্ছে না বুঝেছিস। আমার তো বদহজম হয়ে যাচ্ছে। বাথরুমে প্রেসার আসছে না। তাই ভাবলাম তোর সেটে আসি। তোর এখানে তো বিউটিতে ঘেরা থাকে। সাথে একটা কাজও ছিলো। আমার ফ্যাশন হাউজের নতুন কালেকশন বের করেছি। পরশুদিন নতুন কালেকশনের একটা র্র্যাম্প শো রেখেছি । তো তুই যদি একটু শো স্টপার হয়ে বিড়াল হাঁটা (ক্যাট ওয়াক) করে দিতিস তাহলে এই অধমের ওপর মেহেরবানি হতো।

–হুমম তো, কাজের জন্য বন্ধুকে মনে পড়েছে।

–তুই এটা বলতে পারলি? দিলে চোট পাইলাম।

ওদের কথার মাঝে জিদান এলো। জিদানকে দেখে আবির উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠলো।
–আরে জিদান মিঞা যে। তুমি তো মিঞা দিন দিন সার্ফ এক্সেল দিয়ে ধোয়া শার্টের মতো ফকফকা চুন্দর হইয়া যাইতাছ। এতো রুপ কই রাখবা মিঞা? তোমার রুপে তো জাতি ঝলসে যাবে। নিজেকে ঘরে আঁটকে রাখো। নাহলে আমাদের কী হবে?

আবিরের কথায় জিদান বেচারা লজ্জায় গদগদ হয়ে গেল। আবিরকে তার ভীষণ ভালো লাগে। লোকটা খুবই রসিক প্রিয় লোক। আর জিদানের খুব প্রশংসা করে। জিদান লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
–কিযে বলেন না স্যার। সুন্দর তো আপনি। এইজন্যই তো আপনার এতো এতো গার্লফ্রেন্ড।

আবির আপসোসের সুরে বলল,
–কই জিদান মিঞা। গত দুই দিন হলো আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। ভাবতে পারছ কত কষ্টে আছি আমি। আটচল্লিশ ঘন্টা ধরে উপোস আছি। আহ, কী যে বেদনা।

–সো স্যাড স্যার।

–চিন্তা করোনা জিদান। স্যাডনেস দুর করার পদ্ধতি পেয়ে গেছি। ভাবছি আমি একটা সয়াবিন তেলের দোকান দিবো। দোকানের অফার হবে, এক চুমুতে এক কেজি, দুই চুমুতে দুই কেজি, লিপকিস করলে পাঁচ কেজি আর রুমডেটে গেলে সারাবছরের তেল ফ্রী। একদম ঝাকানাকা দেহ দোলানা ওয়ালা প্ল্যান না? প্ল্যান পছন্দ হলে লাইক করুন, কমেন্ট করুন, শেয়ার করুন, হৃদপিন্ডের বেল আইকনে চাপ দিয়ে সাবস্ক্রাইব করুন।

আদিত্য বলে উঠলো।
–এখুনি তোর বেল আইকন দুটো চাপ দিয়ে ধরছি। একেবারে ফটাস করে ফুটে না যাওয়া পর্যন্ত সাবস্ক্রাইব করবো।

জিদান অতি উৎসুকভাবে বলল,
–সত্যি স্যার এমন হয় নাকি? মেয়েরা এসব অফারে আসে?

–আবার জিগায়, আরে অফারের জন্য তো মেয়েরা মঙ্গলগ্রহের এলিয়েনের কাছেও চলে যাবে। মানুষ আর কী জিনিস। তবে এগুলো দিয়ে শুধু স্টাটারের কাজ হবে। এরমাঝেই একটা মেইন কোর্সের ব্যবস্থা করতে হবে।

–মানে বুঝলাম না স্যার।

–আরে জিদান মিঞা এটাই বুঝলা না? তাহলে শোন,খাবারের যেমন তিনটা ধরন থাকে তেমন মেয়েরাও হলো তিন ধরনের। তিন নাম্বারে হলো সব আনাড়ি মেয়েগুলো। যাদের যা একটু আধটু চেহারা আছে সেটাতে সিমেন্ট বালি মেরে আরেকটু পাকাপোক্ত করে। এদের ব্রেইন বলতে কোনো পদার্থ নেই। যে বলে আয় তার সাথেই যায়। এরা হলো স্টাটার, হালকা ক্ষিদে মেটায়। আর দ্বিতীয় নাম্বারে হলো বিউটিফুল হট গার্লস। এদের যেমন চেহারা তেমন হাইক্লাস ফ্যাশানেবল। এরা বেশির ভাগ উচ্চবিত্ত পরিবারের হয়ে থাকে। এদের ব্রেইন মোটামুটি থাকে। এরা হলো মেইন কোর্স। পুরো ক্ষিদে মেটায়। এখন আসি নাম্বার একে। এরা হলো সবার ওপরে। এগুলো সংখ্যায় কম থাকে। তবে এরা খুব সাংঘাতিক। বলতে গেলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এদের পাওয়া খুব কঠিন।

আবিরের কথায় তেমন আগ্রহ না দেখালেও এবারে কেমন আগ্রহ জাগছে আদিত্যর। সে হালকা গলা ঝেড়ে বলল,
–যেমন? মানে এই ধরনের মেয়েরা কেমন হয়?

আদিত্যর কথায় একটু খটকা লাগলো আবিরের। আদিত্য তো কখনো এসব বিষয়ে কোনো কৌতুহল দেখায় না। তো আজ হঠাৎ কী হলো? তবে আপাতত সে বিষয়ে কিছু বললোনা আবির।যে প্রসঙ্গে ছিলো সেটাই বলতে লাগলো।
–এরা ভাই মারাত্বক লেভেলের হয়। এদের চেহারা যেমনই হোক, বুদ্ধি,জ্ঞান, প্রতিভা,সাহসীকতা, দায়িত্বশীল আর প্রচুর প্রচুর একেবারে ড্রাম ভর্তি আত্মসম্মানে ভরপুর থাকে। এই টাইপের মেয়েরা সহজে কোনো ছেলেকে পাত্তা দেয়না। তবে একবার যদি এদের পটিয়ে ফেলা যায় তবে লাইফ সেট হয়ে যাবে। এরা হলো খাবারের পরের সেই মিষ্টি ডেজার্ট, যা খেলে খাবারের পরিপূর্ণ তৃপ্তি আসে। যদিও এক নাম্বার টা আমার টাইপের না।

জিদান কৌতুহলী হয়ে বলল,
–কেন স্যার?

–কারণ এগুলো সব প্রেমে সাড়া দেয়না। এদের পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এরা কেবল হৃদপিণ্ড কাঁপানো, ১০৪ ডিগ্রি জ্বর আসা, কলিজা পোড়ানো ভালোবাসাতেই সাড়া দেয়। ওই কেয়ামত থেকে কেয়ামত পর্যন্ত ভালোবাসা টাইপ। আর আমার ওইরকম প্রেম হবেনা কখনো।

আদিত্য বলল,
–তুই বুঝবি কীভাবে এমন প্রেমে পড়েছিস কি পড়িসনি?

–ওমা, আমি না বুঝলে কী পাশের বাড়ির ছকিনা আন্টি বুঝবে? অবশ্যই বুঝবো, কারণ যখন এই ধরনের প্রেম যখন হয় তখন মানুষের মন মস্তিষ্ক মুলা তুলতে যায়। দিন দুনিয়ার কোনো খেয়াল থাকেনা। ভেতর থেকে কেউ খালি ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে বলে এই চলনা ওকে দেখি। সেই ব্যাক্তির দিকে খাওয়া-দাওয়া, হাগা-মুতা সব বাদ দিয়ে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। মনে হয় তার শরীরের একটা পশম নড়াটাও যেন মিস না যায়। সে গালি দিলেও মনে হয় রুনা লায়লার গান গাইছে। তার সবকিছুই তখন অসাধারণ লাগে, হাসি থেকে শুরু করে নাকের সর্দিটাও। মনে হয় যেন কোনো বিখ্যাত শিল্পীর কারুকাজ। মোট কথা যখন নিজের অস্তিত্বই নিজের দুশমন হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে ওই কেয়ামত থেকে কেয়ামত টাইপের প্রেম, ভালোবাসা হয়ে গেছে।

আদিত্যর গলা শুঁকিয়ে আসছে। পানির বোতল টা হাতে নিয়ে এক ঢোকে ঢকঢক করে পুরো পানি খেয়ে ফেললো সে।আবিরের বিশ্লেষণ মতে ওর সাথেও তো এমনই হচ্ছে। তারমানে ওরও ওই ধরনের প্রেম হয়ে গেছে? দ্যাট মিনস সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য ইজ ফিনিশড! এখন তোর কী হবে রে আদি?

অপরদিকে আবিরের চার পৃষ্ঠা সমান বয়ান শুনে জিদান বলে উঠলো।
–তাহলে আমার টাইপ কোনটা স্যার? একটু বলেন না?

আবির বিড়বিড় করে বলল,
–তোমার টাইপ গুলো বাজারের সব ফ্লেবারের বিষ একসাথে ব্লেন্ডারে মিশিয়ে জুস বানিয়ে খেয়ে নিয়ে, গলায় দ,ড়ি দিয়ে, নদীতে ঝাপ দিয়েছে।

–জি স্যার কী বললেন? একটু ভালো করে বলুন। আসলে আমি না, মেয়েদের বুঝতে পারিনা। আমার কাছে মেয়েদের মতিগতি বোঝা কেজিএফ মুভির কাহিনি বোঝার চেয়েও বেশি কঠিন মনে হয়।

–আরে জিদান মিঞা তুমি এইসব টাইপ টুইপ ছাড়ো। মেয়ে পাইলেই বড়ো কথা।এতো ভাবাভাবি না করে চাঞ্চ নিয়ে দেখ। “যেখানে পাইবে মাইয়া, চাঞ্চ মেরে যাইবা। পাইলেও পাইতে পারো নিজের ছাইয়া।”

–জি স্যার মনে থাকবে।

–আচ্ছা তাহলে এই খুশিতে আমার স্পেশাল কফিটা খাওয়াও।

–জি স্যার এখুনি আনছি।

জিদান চলে যেতেই আবির আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–হ্যাঁ তো বল কী হয়েছে?

আদিত্য একটু নড়েচড়ে বসলো। অপ্রস্তুত স্বরে বলল,
–কী আবার হবে?

–সেটাতো তুই বলবি। বল কী হয়েছে? আর কোনরকম বাহানা করবিনা। তুই জানিস আমাকে তুই মিথ্যে বলতে পারবিনা।

আদিত্য ফোৎ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। সত্যিই আবির ওর সবকিছু বুঝে ফেলে। তাই আর হেয়ালি না করে আবিরকে নূরের ব্যাপারে সব খুলে বলল। সব শুনে আবির অবাক সুরে বলল,
–হেয়াট? তুই ওর বু* দেখে ফেললি?

–শাট আপ ইডিয়ট, শুধু পিঠ দেখেছিলাম। তাও এক্সিডেন্টলী।

–হুম, তো এইজন্য আজ আমার কথায় আগ্রহ জাগছিল তাইনা? তায়লে কী শেষমেশ তুইও গেলি? সিদ্দত ওয়ালা প্রেমে পইড়া গেলি। এখন তোকে উপরওয়ালাই বাঁচাক। বাইদা ওয়ে,তুই তো এখন ঐশির ওই গানটা গাইতে পারবি ♬ বন্ধু আমার গাড়ির মেকানিক। না তোর বেলায় বান্ধবী হবে।♬ বান্ধবী আমার গাড়ির মেকানিক।

আদিত্য শরীরের ভর ছেড়ে পেছনে হেলে চোখ বুজে নিলো। ওর সর্বনাশ তবে হয়েই গেল। এখন কী হবে?
__

মাহমুদ সাহেব বিস্মিত, হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, তার জাপান থেকে কেনা শার্ট টার এই দশা কপালে লেখা ছিলো। অতিরিক্ত শক পেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন তিনি। সামনে রোবটের মতো নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকা বাবলুকে তার কী করতে ইচ্ছে করছে রাগের মাথায় সেটাও ভেবে পাচ্ছেন না। মাহমুদ বাবলুর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সারা বাড়ি কাঁপানো চিৎকার দিয়ে স্ত্রী রেহনুমাকে ডাকলেন। মাহমুদের ডাকে রেহনুমাসহ বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে গেল। রেহনুমা মাহমুদের উদ্দেশ্যে বললেন।
–কী হয়েছে? এমন আনকালচারড পিপলদের মতো গলা ফাটিয়ে চিল্লাচ্ছ কেন?

মাহমুদ রাগী কন্ঠে বললেন।
–আমি আনকালচারড? আর তোমার এই মায়ের বাড়ি থেকে যে এলিয়েন টা এনেছ এটাকে কী বলবে হ্যাঁ? দেখ দেখ আমার ইম্পোর্টেট শার্টটার কী অবস্থা করেছে সে।

মাহমুদ হাতে থাকা শার্টটাকে দুই হাতে উঁচু করে মেলে ধরলো। রেহনুমা খেয়াল করে দেখলো শার্ট টা কেমন ব্লাউজের মতো লাগছে। সে কপাল কুঁচকে বলল,
–তোমার মগজের মতো চোখেরও গবর পড়েছে নাকি? এটা কোথাথেকে শার্ট মনে হচ্ছে তোমার? এটাতো ব্লাউজ।

মাহমুদ করুন অসহায় কন্ঠে বলল,
–হ্যাঁ ব্লাউজ, তোমার এই এলিয়েন আমার শার্টটাকে রিমেক করে ব্লাউজ ভার্সনে পরিবর্তন করেছে। আমি ওকে বলেছিলাম আমার শার্ট স্ত্রী করে দিতে। আর ও আমার শার্ট টার এই হাল করে দিয়েছে।

বাবলু পাশ থেকে নির্বিকারচিত্তে বলে উঠলো।
–আমার কী দোষ? আপনিই তো বললেন আমার শার্টটাকে স্ত্রী করে দে। তো আমিতো তাই করলাম। আপনার শার্ট তো পুরুষ ছিলো, এখন স্ত্রী হইছে। ভালো কাজের কোনো দামই দেন না আপনে।

আহানা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার আর পারলোনা। পেট ফাটা হাসিতে ভেঙে পড়লো সে। হাসতে হাসতেই বলল,
–বাবা, ভালোই হয়েছে। তুমি এটা আমাকে দিয়ে দাও। আমাদের কলেজের কালচারাল প্রোগ্রামে আমার নতুন শাড়ির সাথে ভালো ম্যাচ হবে। জাপানের ব্লাউজ বলে কথা।

রেহনুমা মেয়েকে ধমক দিয়ে বলল,
–এই চুপ কর।
তারপর মাহমুদের উদ্দেশ্যে বলল,
–আচ্ছা তুমি জানোই ও এমন তাহলে ওকে কোনো কাজে বলোই কেন?

–তো কাকে বলবো তোমাকে? শুধু স্নো পাউডার মাখা ছাড়া আর কোনো কাজে ধ্যান দাও তুমি? দেখ আজ এর একটা ফয়সালা হয়েই ছাড়বে। হয় এপার নাহয় ওপার।

রেহনুমা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–যাও যাও আগে গিয়ে নিজের মাথায় থাকা গোবর সাফ করো,তারপর ফয়সালা করতে এসো। এখনো পর্যন্ত নিজের ঘুমের ফয়সালা করতে পারলেনা। শোবার সময় ভারত হলে উঠার সময় পাকিস্তানে পাওয়া যায় তাকে,আবার আইসে ফয়সালা করতে।

–কীহ! আমার শোয়া খারাপ? ঠিক আছে এতদিন যে গোপন সত্যিটা নিজের বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম সেটা আজ বলতেই হচ্ছে।

–কিসের সত্যি হ্যাঁ?

–এই যে,রাতে তোমার ঘুমাবার পর যে মুখে লালার নায়াগ্রা ফল (ঝর্ণার নাম) নামে তাকি আমি কাউকে বলেছি?

–এই এই একদম ফালতু কথা বলবেনা। এসব আনকালচারড কাজ শুধু তোমার দ্বারাই সম্ভব। তুমি যে বগল চুলকিয়ে সেই আঙুল আবার নিজের নাকে ধরে সেটার ঘ্রাণ নেওয়ার মতো ডিসকাস্টিং কাজ করো সেটাওতো আমি কাউকে বলিনি। আগে জানলে তোমার মতো এমন ডিসকাস্টিং লোককে কখনো বিয়ে করতাম না। আমার মতো একটা ক্লাসি, সোফিস্টিকেটেড বউ যে তোমার কপাল জুটেছে তারজন্য তো তোমার উপরওয়ালার কাছে শুকরিয়া জানাতে জানাতে মুখে ফেনা তুলে ফেলা উচিত।

–একদম কারেক্ট বলেছ রানী ভিক্টোরিয়া।

স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার মাঝে হঠাৎ কারোর কথা শুনে পাশে ফিরে তাকালো ওরা। আদিত্য আর আবির এসেছে। আবির এগিয়ে আসতে আসতে রেহনুমাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করে বলল,
–আন্টি একদম ঠিক বলেছে। উনার মতো বউ পেয়ে তো আপনার রোজ একটা করে কাঙালি ভোজ দেওয়া উচিত। লুক এট হার। সি ইজ সো পারফেক্ট। জাস্ট লাইক রানী ভিক্টোরিয়া।

আবিরের প্রশংসায় রেহনুমা গর্বে গদগদ হয়ে গেলেন। এইজন্যই ছেলেটাকে তার ভালো লাগে। রেহনুমার সঠিক অ্যাপ্রিশিয়েশন শুধু এই ছেলেটাই দিতে পারে। বিপরীতে মাহমুদ মেকি হেসে বলল,
–হ্যাঁ সেই, এতো খুশিতে আমার তিন বেলা আ,ত্ম,হ,ত্যা করতে মন চায়।

এসব কথোপকথনের মাঝে যে আবির আহানার পানে তাকিয়ে সন্তর্পণে কখন চোখ মেরে দিয়েছে তা কেউই টের পেলোনা। তবে আহানা ঠিকই দেখলো সেটা। আর তার অগ্নি দৃষ্টিও নিক্ষেপ করতে সময় নিলো না। নিঃশব্দে অন্তরালে গালিও দিলো ইচ্ছেমতো। যা আবিরের কানে না গেলেও চোখ ঠিকই বুঝতে পারলো। বুঝতে পেরেই নিঃশব্দে স্মিথ বাঁকা হাসলো সে।
__

আজ আদিত্যর বাড়িতেই থেকে গেছে আবির। রেহনুমা আন্টির জোরাজোরিতে আর মানা করতে পারেনি সে। ডিনার শেষে অভ্যাস অনুযায়ী সিগারেটের নেশা হলো আবিরের। তাই ছাঁদে আসলো একটু নিকোটিন টানতে। ছাঁদে আসতেই দেখলো আহানা ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে। আদিত্য পেছন থেকে বলে উঠলো। –বাহ,লুকিয়ে লুকিয়ে এখানে ফোনে প্রেমালাপ হচ্ছে।

আহানা পেছনে ফিরে তাকালো। ফোনের ব্যাক্তিকে পরে কথা বলবে জানিয়ে ফোন কেটে দিয়ে আবিরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–সবাইকে কী নিজের মতো ক্যারেক্টরলেস ভেবেছেন?

–না না তা কী করে হয়, সবাইকে নিজের মতো কীভাবে ভাবতে পারি? কোথায় সবাই আর কোথায় আমি। দেয়ার ইজ নো কমপেরিজন। আবির রায়হান শুধু একটাই। তার মতো আর দ্বিতীয়টা কেউ হতে পারবেনা।

–অফকোর্স, আপনার মতো এতো ক্যারেক্টরলেস লোক দুনিয়াতে এখনো পয়দা হয়নি।

আহানার কথাটা অপমান স্বরুপ হলেও আবির সেটাকে নিজের প্রশংসা হিসেবে নিয়ে মাথা হালকা ঝুঁকিয়ে বলল,
–শুকরিয়া জনাবা, ব্যাস কখনো অহংকার করিনি।

আবিরের সাথে পেরে না উঠে আহানা ওখান থেকে ধুপধাপ পা ফেলে চলে যেতে লাগলো। আবিরকে পেরিয়ে যেতে নিলেই আবির পেছন থেকে আহানার হাত ধরে ফেললো। আহানা থেমে গিয়ে একবার নিজের ধরে রাখা হাতের দিকে তাকালো, তারপর আনিরের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল,
–এসব কী ধরনের অসভ্যতামো? নিচেও একবার অসভ্যতামো করেছেন। এখন আবার করছেন। আপনার কী লজ্জা করে না? আমি যদি ভাইয়াকে বলে দেই আপনার এই অসভ্যতামোর কথা? ছাড়ুন আমার হাত।

আবির আহানার কথায় কোনরকম ভ্রুক্ষেপ না করে বলে উঠলো।
–তুই আমাকে ঘৃণা করিস তাইনা আন্নি?

আহানা আবিরের চোখে চোখ দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–অনেক। সবচেয়ে বেশি।

আবির আহানার হাত ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ প্রফুল্লচিত্তে বলে উঠলো।
–এন্ড আই লাভ দ্যাট হেটনেস।

আহানা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো আবিরের পানে। আবির হাসিমুখে বলল,
–ইয়েস ঠিক শুনেছিস তুই। আই জাস্ট লাভ ইউর হেটনেস। জানিস আমি চারপাশে ভালোবাসা পেতে পেতে বোর হয়ে গেছি। সবাই শুধু আমার ওপর ভালোবাসা লুটিয়ে দেয়। এতো এতো ভালোবাসায় আমি দম নিতে পারিনা।আমার জীবনে ঘৃণার বড্ড অভাব। আমি ঘৃণার কাঙ্গালি। তাই তোর এই ঘৃণা আমাকে কতো শান্তি দেয় তা তুই ভাবতেও পারবিনা। তোর এই ঘৃণায় ভরা চোখে যখন আমার দিকে তাকাস, উফফ..কলিজা জুড়িয়ে যায়। তোর ঘৃণা ভরা চোখের সামনে ওই জুলি আর জেনির হট ফিগারও কিছু না।

আহানা চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
–ছিহহ…

–এইতো, এইভাবে যখন ছিহহ বলিস না, কতোযে তৃপ্তি হয় কী করে বলবো তোকে? রিয়ার সাথে বিছানায়ও এতো তৃপ্তি পাইনা। তুই আমাকে প্রমিজ কর, আমাকে সারাজীবন এভাবেই ঘৃণা করে যাবি।বাকিদের মতো আমাকে কখনো ভালোবাসবি না।

আহানা দাঁত কিড়মিড় করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–কখনো না,মরে গেলেও না, দুনিয়াতে আপনি একমাত্র ছেলে থাকলে তাও না। দরকার হলে লে,স,বি,য়া,ন হয়ে যাবো। আরেকটা মেয়েকে ভালোবাসবো তবুও আপনাকে কক্ষনো না।

–লাহোল বিল্লালের পুত, কী কস এইসব? আমার মতো মাছুম বাচ্চার সামনে এমন অশ্লীল ভাষার প্রয়োগ করতে একটুও বাঁধলো না তোর? ছ্যা ছ্যা ছ্যা… এখন আমার বুড়িগঙ্গায় গিয়ে নিজেকে শুদ্ধ করে আসতে হবে। তওবা তওবা।

আবিরের সাথে না পেরে আহানা উল্টো ঘুরে চলে যেতে লাগলো। এখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালে আজ নির্ঘাত ছাঁদ থেকে ফেলে দিয়ে আবিরকে উপরে পাঠিয়ে দিবে।এই লোকটাকে মেরে নিজের হাত নষ্ট করতে চায়না সে। ধুপধাপ পা ফেলে নিচে নেমে এলো আহানা।নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিয়ে, চোখের জমে থাকা পানি মুছে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
–আমি আপনাকে কখনো ভালোবাসবোনা আবির ভাই। কখনে না।

আবির ছাঁদের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালালো। নাক মুখ দিয়ে নিকোটিনের ধুঁয়া ছেড়ে বলল,
–আমি তোকে কখনো আমাকে ভালোবাসতে দিবোনা আন্নি। কখনো না।
__

ঘুমের মাঝে হঠাৎ অসহ্য গরমে ঘুম ভেঙে গেল নূরের। চোখ খুলে দেখলো ফ্যানটা বন্ধ হয়ে গেছে। উঠে গিয়ে সুইচটা কয়েকবার অফ অন করলো। কাজ হলোনা তাতে।ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নূর। নিশ্চয় ফ্যানের কয়েল পুড়ে গেছে। পুরান সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্যান কতোইবা চলবে। তার ঘরের বেশির ভাগ জিনিসই সেকেন্ড হ্যান্ড। মেকানিকের দোকান থেকে যখন যেটা দরকার হয় সেটা নিয়ে আসে ও।কপাল ভালো হলে কতগুলো ভালোই চলে। কতগুলো আবার চলেই না। ফ্যানটা অনেক দিনই চলেছে। এখন তাহলে কী করবে?এই গরমে ফ্যান ছাড়া তো ঘুমও ধরবেনা। মায়ের ঘরে গেলেও সে আবার এটা শুনলে চিন্তা করতে থাকবে। এমনিতেই সবসময় শুধু চিন্তা করে। না না থাক একটা রাতেরই তো ব্যাপার। কাল পল্টুকে দিয়ে সারিয়ে আনবো। নূর বেলকনিতে এগিয়ে গেল। এখানে প্রকৃতির মৃদু বাতাস লাগছে। বেলকনির একপাশে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসলো নূর। আকাশ পানে তাকালো। মিটমিট করা তারার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বলল,
–কেমন আছ বাবা? আমাকে এভাবে দেখে একদম মন খারাপ করোনা। আমি অনেক ভালো আছি বাবা। তোমার নূর এতো সহজে ভেঙে পড়ে না। তোমার নূর সব সামলে নিয়েছে বাবা। মা ভালো আছে,ইভান টাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। মিছরি একটু দুষ্টুমি করে, তবে পড়ালেখা ভালোই করে। লিয়াটা একটু অবুঝ হয়েছে। তবে চিন্তা করোনা সময়ের সাথে ওরও বুদ্ধি হয়ে যাবে। তুমি শুধু দোয়া করো। আমি যেন সামনেও সবটা সামলে নিতে পারি। তোমার দোয়া আমার সাথে থাকলে আমি সব পারবো বাবা। আজ রাত নাহয় আমরা দুজন গল্প করেই কাটাই কেমন।
__

বেলকনির রকিং চেয়ারে বসে আছে আদিত্য। চোখের নজর সীমাবদ্ধ হয়ে আছে হাত ধরে থাকা নূরের দুলের দিকে। দুলটার দিকে তাকিয়ে আদিত্য আনমনে বলতে লাগলো।
–কী যাদু করলে শৈবলিনী? কেন এমনটা করলে আমার সাথে? নিজের অথৈয় পানিতে আমাকে ডুবানোটা কী খুব জরুরি ছিলো? আমার ঘুম কেঁড়ে নিয়ে নিজে নিশ্চয় আরামে ঘুমিয়ে আছো। সব গুনে গুনে রাখছি আমি। একটাও বাদ যাবে না। এইসব অত্যাচারের বদলাতো আমি হারে হারে নিবো মিস নূর।নূর নামক শৈবলিনীকে যে এই আদিত্য নামক মহাসাগরে মিলিত হতেই হবে। যেন রাখো মিস নূর। সর্বত্র ছড়ানো হয়েছে তোমারই অপেক্ষার সুর।

চলবে……