শৈবলিনী পর্ব-০৮

0
504

#শৈবলিনী—৮
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★আদিত্যর অবস্থা মারাত্মক শোচনীয় ।যাকে বলে একেবারে আইসিইউ লেভেলের মুমূর্ষু অবস্থায় সে।প্রথমত, রাতে ঘুম নামক বস্তুর দেখা পায়নি। ভোর রাতের দিকে যা একটু চোখ দুটো লাগাতে পেরেছিল, সেই ঘুমের মাঝেও এক ভয়ানক স্বপ্ন এসে হানা দেয়। স্বপ্নটা খুবই অদ্ভুত আর উদ্ভট বলা চলে। আদিত্য স্বপ্নে দেখতে পায় ওর বুকের মাঝে হৃদপিণ্ডের জায়গা শূন্য। হৃদপিণ্ড হারিয়ে গেছে ওর। কী অদ্ভুত ব্যাপার, হৃদপিণ্ড আবার কোথায় গেল? আদিত্য হন্যে হয়ে খুঁজছে তার হৃদপিণ্ডকে। “হৃদপিণ্ড…ও হৃদপিণ্ড… বাবু…. কোথায় গেলে তুমি? এসো এসো পাপার কাছে এসো।” এভাবেই ডেকে ডেকে খুঁজছে আদিত্য। হৃদপিণ্ড ছাড়া সে বাঁচবে কী করে। কেউ কী চুরি করে নিয়ে গেল তার শখের হৃদপিণ্ডকে? কার এতবড় স্পর্ধা যে সাদমান শাহরিয়ার আদিত্যর হৃদপিণ্ড চুরি করে! চোরকে পেলে হয় একবার। তারপর বুঝবে এই আদিত্য কী জিনিস। আমার হৃদপিণ্ড চুরি করা তাইনা?

হঠাৎ হা হা করে মেয়েলী কন্ঠে কারোর অট্টহাসির শব্দ ভেসে উঠলো চারপাশে। আদিত্য হকচকিয়ে চারপাশে দেখতে লাগলো। হাসির শব্দ আসছে তবে মানুষ দেখা যাচ্ছে না। আদিত্য সামনের অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুদুর যেতেই সেই উচ্চস্বরে হাসতে থাকা মানবীকে দেখতে পেল। চমকে গেল আদিত্য। কারণ সেই মানবী আর কেউ নয় স্বয়ং নূর। আর সবচেয়ে চমকালো নূরের হাতে আদিত্যের হৃদপিণ্ডটা দেখে। নূর ওর হৃদপিণ্ড টাকে হাতে নিয়ে বলের মতো হাতের ওপর ড্রপ করে খেলছে। মুখে তার অট্টহাসি। আদিত্য তার হৃদপিণ্ড টা নিতে এগিয়ে গেল নূরের দিকে। কিন্তু একি! সেতো এগুতেই পারছেনা। জানেপ্রাণে চেষ্টা করেও এগুতে পারছেনা সে। পেছন থেকে যেন কিছু টেনে ধরেছে তাকে। নূর আদিত্যর হৃদপিণ্ড টা নিয়ে ধীরে ধীরে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে লাগলো। আদিত্য শত চেষ্টা করেও এগুতে পারলোনা। নূর একসময় তার হৃদপিণ্ড টা নিয়ে চলে গেল। আদিত্য চিল্লিয়ে ডাকতে গিয়ে দেখলো তার গলার স্বরও বের হচ্ছে না। কী আশ্চর্য! তবে কী সে মরে যাচ্ছে? হ্যাঁ নূরতো ওর হৃদপিণ্ড নিয়ে গেল, তাহলে তো এখন মৃ,ত্যু অবধারিত।

ঠাস করে চোখ খুলে তাকালো আদিত্য। চোখ মেলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেই জোরে জোরে হাঁপাতে লাগলো সে। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। কী মনে করে আদিত্য হঠাৎ বুকের বামপাশে হাত রাখলো। হৃদপিণ্ড ঠিক ঠাক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। এটা কেমন অদ্ভুত স্বপ্ন ছিল? মেয়েটা স্বপেও এসে ওকে হয়রানি করা শুরু করে দিয়েছে। কত্তো বড়ো বদ! আমার হৃদপিন্ড নিয়ে খেলছিলো।

তবে আদিত্য কী জানতো তার এই দূর্দশা তো মাত্র শুরু। ধীরে ধীরে হাল আরও বেহাল হতে চলেছে তার। ঘুম থেকে জাগতেই আরেক পেরেশানি শুরু হলো আদিত্যর। যেদিকে তাকাচ্ছে শুধু নূরকেই দেখতে পাচ্ছে। চারিদিকে শুধু নূর আর নূর,ঘর জুড়ে নূরের ছড়াছড়ি। একেক জায়গায় একেক ভঙ্গিতে বিরাজমান হচ্ছে সে। আদিত্যর মাথা ঘুরে উঠার উপক্রম।সে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। কিন্তু এখানেও শান্তি নেই। বাথরুমের আয়নায় তাকাতেই নিজের প্রতিবিম্বের জায়গায়ও নূর দাঁড়িয়ে আছে। একি অশান্তি? এখন আদিত্য শেভ করবে কীভাবে? রেজার টা হাতে নিয়ে গালে লাগাতেই আয়নায় থাকা নূরও গালে রেজার লাগালো। সাথে সাথে আদিত্য হাতের রেজারটা ছিটকে ফেলে দিলো। কী ভয়াবহ দৃশ্য! নাহ আজ আর শেভ করা হলোনা আদিত্যর। শাওয়ার নিতে গিয়েও দ্বিধায় পড়ে গেল। আয়নায় নূর এখনো ওর দিকে চোখ গেড়ে তাকিয়ে আছে। ওর সামনে কাপড়চোপড় খুলবে কীভাবে? মেয়েটাও কেমন নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে আছে। আদিত্য আর উপায় না পেয়ে পুরো কাপড় পরেই শাওয়ার নিলো। কোনরকমে শাওয়ার শেষ বাইরে বেড়িয়ে এলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে আসলে সেখানেও একই অবস্থা। বেচারা আদিত্য মহা মুশকিলে পড়ে গেল। নিজের প্রতিবিম্ব না দেখতে পারলে রেডি হবে কীভাবে এখন? কী অশান্তি?

অশান্তির শেষ এখানেই হয়না। সময়ের সাথে আরও বাড়তে থাকে। সকালের কফি দিতে যখন ছবি আদিত্যের রুমে আসে তখন তার মাঝেও নূরকেই দেখতে পায় আদিত্য। কী সুন্দর নূর ওর দিকে কফি এগিয়ে দিচ্ছে। যেমনটা স্ত্রী তার স্বামীকে কফি দেয়। আদিত্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নূরের দিকে। রোজ সকালে নূর ওর সামনে এভাবে এলে জীবন কতোই না মধুর হবে। নূর কফির মগ এগিয়ে মিষ্টি গলায় বলল,
–ভাইজান কী দেহেন? কফি নেন। জুড়ায় গলো তো।

নূরের কন্ঠে ভাইজান শুনে মধুর মুহুর্ত টা একেবারে বেসুরো কর্কশ হয়ে গেল। ধ্যান ভাঙলো আদিত্যর। কফি হাতে বাস্তব মানুষটাকে এবার দেখতে পেল সে। অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,
–নিয়ে যা,কফি খাবোনা আজ।

ছবি চলে গেল। আদিত্য বিছানায় বসে লম্বা লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিলো। মাথা কয়েকবার ঝাকিয়ে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করলো। যদিও তা এক পার্সেন্টও কার্যকর হলো বলে মনে হলোনা।কারণ নিচে ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসেও সেই একই দশা হলো। এখানকার দৃশ্য আরও ভয়াবহ। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের স্থানে নূরকে দেখতে পাচ্ছে আদিত্য। সবগুলো চেয়ারে শুধু নূর বসা। এমনকি আবিরের মাঝেও নূরই দেখা যাচ্ছে। কেমন দাঁত কেলিয়ে পরোটা চিবোচ্ছে আর মায়ের প্রশংসা করছে। লিমিট তো তখন হয়ে গেল যখন বাবলুর বেশেও নূরকেই দেখতে পেল। টাওয়াজ আর ফতুয়া পরে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আর বরাবরের মতোই বাবার কাছে বকা খাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বকা দেওয়া বাবার জায়গায়ও নূরকেই দেখা যাচ্ছে। লুঙ্গি আর সাদা গেঞ্জিতে বাবার বেশে থাকা নূর বাবলুর বেশে থাকা নূরকে বকা দিচ্ছে। কী ভুতুরে ব্যাপার স্যাপার। আর কিছুক্ষণ থাকলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে আদিত্য ।

আদিত্য দ্রুত উঠে বেড়িয়ে পড়লো। বাড়ি থেকে বের হতে পারলে এসব থেকে মুক্তি পাবে। এমনটাই ধারণা আদিত্যর। তবে বাইরে আসতেই সেই ধারণা মাটির নিচে চাপা পড়ে গেল। বাইরে আসতেই প্রথমে সিকিউরিটির পোশাকে নূরকে দেখলো। আদিত্যকে দেখেই সে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা সালাম দিলো। সেটার জের যেতে না যেতেই আরেক ঝটকা খেল গাড়ির কাছে এসে। ড্রাইভারের পোশাকে নূর আদিত্যর জন্য গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। আরেক ঝটকা খেল জিদানের জায়গায় নূরকে দেখে। শার্ট প্যান্ট পড়ে হাতে ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্যকে দেখেই বলে উঠলো।
–গুড মর্নিং স্যার।

কিসের মর্নিং? কীসের কী? আদিত্যর তো ব্রেইনের হালুয়া হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পা চালিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো আদিত্য। সামনে নূর গাড়ি চালাচ্ছে আর পাশে জিদান নামক নূর বসে আছে। আদিত্য তাকিয়ে আছে পাশের নূরের দিকে। জিদান সেটা খেয়াল করে লাজুক হেঁসে বলল,
–স্যার, আজকে কী আমাকে বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে?

আদিত্য হকচকিয়ে উঠে বাইরের দিকে ফিরে তাকালো। সেখানেও আরেক জালা। সিগনালে গাড়ি থামলে দেখতে পেল, বাঁশি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক পুলিশের জায়গায়ও নূর দাঁড়িয়ে আছে। বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে গাড়িগুলোকে সিগনাল দিচ্ছে। পুলিশের বেশে নূরকে ভালোই লাগছে দেখতে। ওর পার্সোনালিটির সাথে ভালোই মানিয়েছে। হঠাৎ গাড়ির জানালায় টোকা পড়লে সেদিকে তাকালো আদিত্য। আর তাকাতেই আজকের দিনের সবচেয়ে বড়ো ঝটকা খেল। যখন শেষমেশ ভিখারিনীর বেশেও নূরকে দেখতে পেল। ছেঁড়া,ময়লা একটা কাপড় পড়ে হাতে স্টিলের একটা পুরান থালা পেতে বলছে,
–সাব, আল্লার ওয়াস্তে কয়ডা টেহা দেন। আপনে এক টেহা দিলে আল্লাহ আপনেরে দশ টেহা দিবো। ও সাব দেন না?

এতবড় ট্রাজেডি নিতে পারছেনা আদিত্য।এবার বুঝি অজ্ঞান হওয়া কনফার্ম। নূরকে এই অবস্থায় দেখে কলিজা শুঁকিয়ে খড়খড়া হয়ে যাচ্ছে ওর। চোখের মনি ফটাস করে ফেটে যাওয়ার উপক্রম। কী দূর্বিষহ দৃশ্য! নূর ভিক্ষা চাইছে? কী দিবে সে নূরকে? হৃদপিণ্ড তো আগেই নিয়ে চলে গেছে সে। এখন আর কী দিবো? জানটা বের করে তার হাতে দিয়ে দিবো? সিগনাল ছাড়ায় গাড়ি সামনে এগিয়ে গেল। আদিত্যও এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রেহায় পেল। আজ বোধহয় সত্যিই সে পাগল হয়ে যাবে। এবার এর একটা বিহিত করতেই হবে। নাহলে যে বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে।
__

–একটা টেনশনে আছি বুঝছস? একটু হেল্প করনা তোরা?

ক্যাম্পাসের মাঠের একপাশে বসেছিলো নূর, শিখা আর গিয়াস। ক্লাস শুরু হতে এখনো কিছুসময় আছে। তাই একটু বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আড্ডার মাঝেই গিয়াস এই কথা বলে উঠলো। শিখা যথারীতি গিয়াসকে ব্যাঙ্গ করে বলল,
–তুই তো নিজেই জন্মগত টেনশন। জন্মের পর নার্স তোরে তোর বাপের কোলে তুলে দিয়ে বলেছিল, অভিনন্দন! আপনাদের ঘর আলো করে টেনশন জন্ম নিয়েছে।

–মজা করিসনা শিখাইয়া, আমি সিরিয়াস।

–সিরিয়াস হলে আইসিইউতে ভর্তি হ। এখানে কী করছিস? বায়দা চিপাগলি, তোর মতো জাতীয় আবালরে আবার কে টেনশন দিলো? জাতি ওয়ান্টস টু নো।

–আরে কয়দিন হলো ফাস্ট ইয়ারের পপির সাথে একটু ট্রাই মারছি।আর ওর ভাব তাল দেখে মনে হয় ওর দিক থেকেও গ্রীন সিগনাল আছে। কাল কথায় কথায় বলল, ওকে কেউ যদি একদম অন্যরকম, ভিন্নভাবে প্রপোজ করে তাহলে ও রাজি হয়ে যাবে। এখন ভাবছি কী এমন অন্যরকম করবো?

–আরে ওই পপি? বাহ্ কী চয়েস তোর? শেষমেশ ওই ভবের আনাড়ি? গরীবের সানি লিওনি। যাই বলিস, জুটি তো একেবারে হিট হবে। গরীবের সানি লিওনি আর লায়ক ফনন্ত জলিল। দুইজন মিইল্লা নতুন ছবি করবি রাত দ্য নাইট। এক্কেরে অস্কারের চৌদ্দ গুষ্ঠি তোগো ফিইক্কা মারবো।

–হইছে, অফ যা এখন। আর কোনো আইডিয়া থাকলে দে।

–হুম, আমার কাছে একটা ফাটাফাটি আইডিয়া আছে। একদম ইউনিক। আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড।
–কী আইডিয়া ক না?

–শোন তুই ওরে কবি, ওই শ,য়তা,নী, হা,রা,ম,জা,দী, শেওড়া গাছের পে,ত্নী, মফিজের আম্মা, আবালের নানী ,কু,,ত্তি, ক,ল,ঙ্কি,নী আই লাভ ইউ চোওও মাচ। আমারে বিয়া কইরা আমার জীবন ধ্বংস কইরা দে ডা,ই,নী।

শিখার অভিনব প্রপোজ করার আইডিয়া শুনে বেচারা গিয়াস বসে বসেই হালকার উপর কোমায় চলে গেল। প্রচন্ড রকমের ঝটকা খেয়ে সে অনুভূতি শূন্য হয়ে গেল। মুখ হা করে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো শিখার দিকে। শিখার আইডিয়া শুনে যে বেচারার হার্টখানা ফটাস করে ফেটে যাইনি এইতো হাজার শুকুর। শিখা আত্মগর্বে বলে উঠলো।
–কিরে কেমন লাগলো আইডিয়া? এক্কেরে ফাটাফাটি না? আজপর্যন্ত কেউ কাউরে এমন কইরা প্রপোজ করে নায়। তুই মিঞা হিস্ট্রি করতে যাচ্ছিস। তাও আমার জন্য। ধন্যবাদ দেওয়ার দরকার নেই।

গিয়াস একটু ধাতস্থ হয়ে ফিচেল গলায় বলল,
–ইয়ার তোর মতো মাইয়া মানুষ তো ইউক্রেনে দরকার। তুই থাকলে আর ওদের বো,মা,র দরকার হবেনা। খালি তোরে ছুঁড়ে মারলেই রাশিয়া ফিনিশ।

এদের দুইজনের কথার মাঝে নূরের তেমন খেয়াল নেই।ফ্যান নষ্ট হওয়ায় সারারাত ঘুমোতে পারেনি ও। তাই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। শিখা সেটা খেয়াল করে বলল,
–কীরে নূর তোর কী হলো? শরীর খারাপ করছে নাকি?

নূর মাথা নেড়ে বলল,
–আরে না তেমন কিছু না। এই এমনি একটু মাথা ধরছিলো।

–ধরবেই তো। তুই তো মানুষ, কোনো মেশিন না। একা মানুষ এতসব ঝামেলা কাঁধে বয়ে বেড়াস। একটুও তো রেস্ট নিস না। তোরও তো একটু আরামের দরকার হয়। দেখবি কোনদিন গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাবি তুই।

–আরে ধুরর কিছুই হবে না। এতো চাপ নিস না। তোকে মানায় না।

–হুম নাহলেই ভালো। আচ্ছা বায়দা ওয়ে, আদিত্যর সাথে তোর কাজ কেমন চলছে? তুই কতো লাকি। রোজ আদিত্যর সাথে দেখা করতে পারছিস।

গিয়াস শিখার কথা বুঝতে না পেরে বলল,
–এই এক মিনিট! আদিত্যর সাথে রোজ দেখা করতে পারবে মানে কী?

শিখা গিয়াসকে সবটা খুলে বললো। সব শুনে গিয়াস বলে উঠলো।
–বাহ্, তাহলে তুইও বাকি মেয়েদের মতো আদিত্যের ফ্যান হয়ে গেলি?

–ফ্যান মাই ফুট! কক্ষনো না। এইসব ন্যাকামি করার টাইম নাই। আমি শুধু কাজের জন্য যাই। তাও প্রিন্সিপাল স্যার বলেছে তাই। এখন চল ক্লাসে যাই। ওই লায়কের ফায়কের প্যাঁচালে মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল।
__

আদিত্যর মেজাজ বিগড়ে গেল আজকের স্ক্রিপ্ট পড়ে। সে জিদানকে দিয়ে ডিরেক্টরকে ডেকে পাঠালো। ডিরেক্টর আসতেই আদিত্য ডিরেক্টরের দিকে স্ক্রিপ্ট টা ছুঁড়ে মেরে চোয়াল শক্ত করে বলল,
–হোয়াট ইজ দিস? হোয়াট ইজ দিস শিট?

ডিরেক্টর ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
–কেন আদিত্য এনিথিং রং?

–এনিথিং রং? ডিড ইউ আস্ক মি এনিথিং রং? দেয়ার ইজ এভরিথিং রং। আমি কনট্রাক্ট সাইন করার আগে আপনাকে কী বলেছিলাম? আমি আপনাকে ক্লিয়ারলি বলেছিলাম আমি মুভিতে কোনোরকম কিসিং সিন বা কোনোধরনের ই,ন্টিমেট সিন করবোনা। তারপরও আপনি আজকের সিনে এমন ই,ন্টিমেট রোমান্টিক সিন কেন রেখেছেন? এসব করার আগে একবারও জিজ্ঞেস করেছেন আমাকে? আপনি কী জানেন না আমার প্রতিটা মুভি এ্যাকশন আর থ্রিলার জনরার হয়ে থাকে। যেখানে রোমান্স শুধু নামমাত্র থাকে। অতিরিক্ত রোমান্টিক মুভি আমি কখনোই সাইন করিনা। তাহলে আপনি কোন যুক্তিতে আপনি এই সিন এড করলেন?

–আদিত্য কাম ডাউন। আমি বুঝতে পারিনি তুমি এতো রেগে যাবে। আসলে সামাইরা বলল, মুভিতে এমন রোমান্টিক সিন দিলে দর্শক আরও পছন্দ করবে। তাই সামাইরার কথামতো সিনে একটু চেঞ্জ করেছি।

–সামাইরা বললেই করতে হবে? ডিরেক্টর আপনি না ও? এমন সিন করিনি বলে কী আমার মুভি হিট হয়নি? আপনি জানেন, আমার নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট মুভিই ব্লকবাস্টার হয়। তাহলে এখন আমার ছবি হিট করাতে এসবের দরকার কেন? আর এই সামাইরাকে তো আমি দেখছি। আম শিওর ওর সাথে এটাই আমার শেষ ফিল্ম হতে চলেছে।

আদিত্য হনহন করে বেড়িয়ে গেল এবার সামাইরাকে জব্দ করতে। মেরেটার সাহস দেখে অবাক হচ্ছে ও। আদিত্যকে ওভারটেক করা! ভদ্রতার খাতিরে ভালো ব্যাবহার করাতে বোধহয় মেয়েটা মাথায় উঠে গেছে। আজতো ওকে ওর আসল জায়গা দেখিয়েই ছাড়বে।
__

ক্লাস শেষে নূর আদিত্যর ভ্যানিটির সামনে এলো। আজ আর জিদানকে দেখতে পেল না। তাই সোজা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরে আদিত্যকে না দেখে ভাবলো হয়তো এখনো শুটিংয়ে আছে। টেবিলের পাশে রাখা চেয়ার টা টেনে বসলো। আদিত্য না আসা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করবে সে।গোল টেবিলের ওপর ছড়ানো কিছু কাগজ দেখতে পেল নূর। হয়তো মুভির স্ক্রিপ্ট হবে। স্বাভাবিক ভাবেই একটা কাগজ হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো সে। তবে দুই লাইন পড়েই চোখ মুখ বিকৃত করে ছিটকে ফেলে দিলো কাগজ টা। ছিহ্, কী সব অ,শ্লী,ল সিন। লুইচ্চা ব্যাটা এইগুলা করে তাহলে। ছিহ্, বদ লোক একটা। এইজন্যই এইসব নায়ক ফায়কদের আমার দুইচোখে দেখতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে তো হচ্ছে এখুনি চলে যাই। কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যারকেও অবমাননা করতে পারি না। কী আর করার, কয়টা দিন সহ্য করতে হবে এই লোককে।

টেবিলের ওপর কনুই রেখে গালে হাত ঠেকিয়ে বসে রইলো নূর। কাল রাতে ঘুম না হওয়ায় মাথাটা শুধু ঝিমঝিম করছে। ঘুম পাচ্ছে শুধু। এসির ভেতর বসে থেকে ঘুম আরও যেন জেঁকে বসছে। হাই তুলতে তুলতে একসময় চোখের সাটার বন্ধ হয়ে গেল নূরের। টেবিলের ওপর হাতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো নূর।

সামাইরার সাথে বোঝাপড়া সেরে ফিরে এলো আদিত্য।সামাইরার ইলজিক্যাল কথায় মেজাজটা আরও বিগড়ে গেছে তার।শুটিংই ক্যান্সেল করে দিয়েছে আজকের। প্রযোজক ওর ক্লোজ না হলে আজই ও মুভিটাও ক্যান্সেল করে দিতো। আদিত্যকে কেউ আন্ডারেস্টিমেট করবে এটা তার কখনোই মান্য না। ক্ষিপ্ত মনোভাব নিয়ে নিজের ভ্যানিটিতে প্রবেশ করলো আদিত্য। ভ্যানিটির ভেতর প্রবেশ করতেই থমকে গেল সে। পরমুহূর্তেই ভাবলো, এটা কী সত্যিই নূর? নাকি আবারও ভ্রম হচ্ছে ওর? পরিক্ষার জন্য হাতে একটা চিমটি কাটলো সে। ব্যাথা পেয়ে বুঝতে পারলো এটা সত্যিই নূর। বুঝতে পেরেই নূরের দিকে তাকাতেই শীতল দমকা বাতাস তীব্র বেগে ছুটে এসে হামলে পড়লো আদিত্যের সর্বাঙ্গে।তার ভেতরে থাকা ক্রোধের মনোভাব টা মুহুর্তেই কর্পূরের মতো উড়ে গেল হাওয়ায়। পরিবর্তে মুখমন্ডলে ছেয়ে গেল মোহনীয়তা। সম্মুখের এই ঘুমন্ত নারীকে দেখে দুনিয়ার সব প্রশান্তি বর্ষন হয়ে ঝরে পড়লো তার হৃদকুঞ্জে।এ যেন সুখময় শ্রাবণের ঘনঘটা। হঠাৎ দরজা ঢেলে জিদান বলে উঠলো।
–স্যার বলছি…….

দ্রুত গতিতে ঠোঁটের ওপর তর্জনী আঙুল রেখে, হুঁশশ করে জিদানের কথা থামিয়ে দিলো আদিত্য। আঙুলের ইশারায় চুপচাপ বেড়িয়ে যেতে বললো জিদানকে। জিদান বেচারা কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ চলে গেল। আদিত্য ধীর পায়ে এগিয়ে এলো নূরের কাছে। আস্তে করে নূরের পাশের চেয়ারটাতে বসলো। নূরের মুখোমুখি নিজের মুখটা টেবিলের ওপর রেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নূরের পানে। যেন অবিস্মরণীয় কিছু দেখছে সে। খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখছে সে নূরকে। এতো কাছ থেকে নূরকে দেখার সুযোগ এই প্রথম হলো তার। এই সুযোগ টা হাত ছাড়া করতে চায়না সে। জেগে থাকলে তো ঝাঁঝির রানীর মতো সর্বদা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকে। এখন ঘুমন্ত অবস্থায় কতো সুন্দর শান্ত পরীর মতো লাগছে তাকে। যেন বরফ রাজ্যের ফ্রোজেন গার্ল সে। কতো নিষ্পাপ এই চেহারা। আদিত্যর মন চাচ্ছে এই মুহুর্ত টা যেন শেষ না হয়। আদিত্য নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এভাবেই দেখে যেতে চায় নূরকে। সর্বসুখ যেন এই মুখটাতেই লুকিয়ে আছে। আদিত্যর চোখের পারদে নেশা ছেয়ে যাচ্ছে। মরণ নেশা। হারিয়ে যাচ্ছে নূরের মোহে। বুকের বামপাশে খাঁচায় বন্দী পাখিটা আবারও বিদ্রোহ আরম্ভ করে দিয়েছে। আর কোনো মতেই সে থাকতে চাচ্ছে না বুকের মাঝে। তাইতো বুকে ব্যাথা দিচ্ছে সে। তবে এই ব্যাথাও যেন মধুর লাগছে ওর। বাতাসে নূরের কপালে কিছু চুল এসে উড়ো উড়ি করছে। এতে যেন ঘুমের মাঝেই বিরক্ত হচ্ছে নূর। আর নূরের বিরক্তি আদিত্যর সহ্য হলো না। সে আলতো করে আঙুল ছুঁইয়ে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। আদিত্যর খুব ইচ্ছে হচ্ছে নূরের ওই ললাটে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতে। কিন্তু সেই অধিকার তার এখনো হয়নি। নিজের এই ইচ্ছে আপাতত দমিয়ে নিলো আদিত্য। সময়মত তার ইচ্ছের প্রতিফলন করবে সে।

হঠাৎ চোখ মেলে তাকালো নূর। আদিত্যকে তার মুখের কাছাকাছি দেখে ভড়কে গেল নূর। ছিটকে উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–এই এই কী করছিলেন আপনি? আমার ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নিচ্ছিলেন ? দেখুন আপনার এই লুইচ্চাগিরি আমার সাথে দেখাতে আসলে পরিনাম অনেক ভয়াবহ হবে। আমাকে দূর্বল মেয়ে ভাবার ভুল করবেন না মোটেও। আমার সাথে কোনো ধরনের মিসবিহেভ করার চেষ্টা করলে আপনার নায়ক হওয়ার সাধ জীবনের মনে মিটিয়ে দিবো।

নূর নিজের মতো ভেবে নিয়ে বলে যেতে লাগলো। আদিত্যকে বলার সুযোগই দিচ্ছে না। হঠাৎ আদিত্য একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–আই লাভ ইউ……

চলবে…….