শৈবলিনী পর্ব-২৮

0
428

#শৈবলিনী—২৮
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★নূর গলার ওড়না ঠিক করতে করতে ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো আদিত্য মিছরির সাথে আড্ডায় মেতেছে। মিছরির হাতে চকলেট দেখে বুঝতে পারলো আদিত্যই এনেছে সেটা।মিছরি যেদিন হারিয়ে যায় আর উনি খুঁজে আনে, সেদিনের পর থেকেই মিছরির সাথে তার খুব ভাব হয়েছে। সেই যে বিকালের পর এসেছিল আদিত্য, এখনো যায়নি সে। নূরের সাথে কথা বলা শেষে সে পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথেও কথা বলে তাদের একটু মনোবল দেওয়ার চেষ্টা করে। মায়ের ঘরে গিয়ে তাকেও আশ্বাস দেয়। অমালিয়ার কাছেও কিছুক্ষণ বসে তার মন ভালো করার জন্য নানানরকম প্রয়াস করে সে। এবং তার প্রয়াস কিছুটা হলেও কাজে লেগেছে। পছন্দের সেলিব্রিটিকে দেখে একটু হলেও অমালিয়ার মনোভাব পরিবর্তন হয়েছে। গত দুইদিন হলো শোকের ছায়ায় ডুবে যাওয়া পরিবারটা যেন একটু হলেও আলোকিত হয়েছে। বড়দের এতসব দুর্দশার মাঝে বেচারি ছোট্ট মিছরিটা একেবারে চুপসে গিয়েছিল। ভয়ে ওর চঞ্চলতা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজ ওকে এভাবে হাসতে দেখে অনাবিল শান্তি লাগছে তার। আমার চিনি সোনাটা, হাসলে কতনা ভালো লাগে। নূরের নজর গেল আদিত্যর পানে। লোকটা সত্যিই যাদু জানে। কিছু সময়ের মধ্যেই কেমন সবার মাঝে এক নতুন উদ্যমতা এনে দিয়েছে। এতবড়ো সেলিব্রিটি হয়েও তারমাঝে কোনো অহংকার নেই। কত সুন্দর তার পরিবারের সদস্যদের সাথে মিশে গেছে। যেন অনেক বছরের পূর্ব পরিচিত তারা। এমন মায়ার বাঁধনে কেন বাঁধছে সবাইকে? কোথায় পায় সে এতো মায়া? না চাইতেও যে নিজেও ওই যুবকের মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে নূর।

নূরের একাগ্রতার মাঝেই হঠাৎ ওর মা লতিকা বেগমকে রুম থেকে বের হতে দেখলো। নূর তার মাকে আঁটকে দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
–মা,তুমি এই অসুস্থ অবস্থায় বের হলে কেন? কিছু লাগলে আমাকে বলো। আমি এনে দিচ্ছি।

–না না, আমার কিছু লাগবেনা। কিন্তু বাসায় মেহমান এসে বসে আছে কতক্ষণ ধরে। এখনতো রাতের খাবারেরও সময় হয়ে গেল। তো কিছুতো খেতে দিতে হবে। তাই রান্না ঘরে যাচ্ছি রান্না করতে।

–না না মা,তোমার এই অসুস্থ শরীরে রান্না ঘরে যেতে হবে না। আমিই কিছু করছি।

–তুই কর করবি? তুই কী রান্না করতে পারিস নাকি। এসব মেয়েলি কাজে কী কখনো মনোযোগ দিয়েছিস?

–হ্যাঁ তো কী হয়েছে? কিছু না কিছু করে নিবো। তুমি চিন্তা করোনা। যাওতো, গিয়ে আরাম করো তুমি।
লতিকা বেগমকে এক প্রকার জোর করেই তার রুমে শুইয়ে দিয়ে এলো নূর। নিজে এগিয়ে গেল রান্নাঘরে। খুব জোর গলায় বলেতো এলো কিন্তু নূর সত্যি সত্যিই রান্নার র-ও জানে না। এইদিক থেকে সে দূর্বল বলা চলে। আসলে বাইরের কাজে এতো ব্যস্ত থাকে যে এসব কাজের সময় কই ওর। কিন্তু এখন কী করবে, কিছুতো তৈরি করতেই হবে। এক কাজ করি ডালে-চাইলে খিচুড়ি করে ফেলি।হ্যাঁ এটা সহজ আছে। সাথে ডিম ভাজি করে দিলেই হবে। ভাবনা মোতাবেক একটা পাতিলে চাউল নিলো নূর। ডাউলের বয়াম খুঁজতে লাগলো সে। নিচে কোথাও না পেয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো উপরের তাকে রাখা আছে। নূরের হাত সেখানে পৌঁছাবে না। তাই রান্নাঘরের কোন থেকে একটা টুল টান দিয়ে সেটার ওপর চড়ে হাত উঁচু করে ডাউলের বয়াম নামালো। কিন্তু বয়াম হাতে নিতেই টুল কেমন আনব্যালেন্সড হয়ে নড়তে লাগলো। সাথে নূরও ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললো। নড়তে নড়তে এক সময় সে উল্টে পড়ে যেতে নিলো। কিন্তু নিচে শক্ত জমিনে পড়ার বদলে সে কারোর সুবলিষ্ঠ বাহুদ্বয়ের ওপর এসে পড়লো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো সেই বাহুদ্বয়ের মালিক মোহময় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে তার পানে। বাঁকা হেসে সে বলে উঠলো,
–দেখেছ? ফিল্মি সিচুয়েশন তুমি তৈরি করো আর পরে আমাকে দোষ দাও আমি নাকি ফিল্মিগিরি করি। দিস ইজ নট ফেয়ার না? বাইদা ওয়ে এখানে এসব স্ট্যান্টের প্রদর্শন কোন সুখে করছ? এখন কী আমার মুভির স্ট্যান্ট ম্যানও হওয়ার শখ জেগেছে নাকি?

নূর ঝট করে নেমে দাঁড়াল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
–রান্নার জন্য এসেছি। ডাউলের বয়াম পারতে গিয়েছিলাম।

–আরেকটু হলেতো নিজেই ডাউল হয়ে যাচ্ছিলে। শুকর করো আমার মতো বলিষ্ঠ পুরুষ এখানে ছিলো। নাহলে আজ তোমার কোমড়ের ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যেত। তবে ভয় পেয়না। হয়তো ভয় পেতে পারো কোমড় ভাঙা মেয়েকে আমি কী বিয়ে করবো! তবে সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।মহৎ পুরুষ আমি। সব ভাবেই তোমাকে মেনে নিবো আমি। ♬ বুক ভরা ভালোবাসা রেখেছি তোমারই জন্য।

অন্য সময় হলে হয়তো নূর আদিত্যর এই ডায়লগবাজি দেখে চরম বিরক্ত হয়ে যেত। কিন্তু আজ কেন যেন বিরক্তি হচ্ছে না নূরের। বরং আদিত্যর কথায় হাসি পাচ্ছে তার। লোকটা যে ওর মন ভালো করার জন্যই এসব করছে তা বুঝতে পারছে নূর। নূর নিজের কাজে আবার মনোযোগ দিলো। যদিও কী করবে তার ঠ্যাং,মাথা কিছুই বুঝতে পারছেনা। ডাউল একবার ঢালছে আবার কম হলো নাকি ভেবে আবারও ঢালছে। এমন করতে করতে তিন চারবার ঢাললো। আদিত্য নূরের কান্ড সব দেখছে আর ঠোঁট টিপে হাসছে। নূরের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধের কাছে হালকা ঝুঁকে এক ভ্রু নাচিয়ে বলল ,
–আম জাস্ট লিটল বিট কিউরিয়াস। হোয়াট আর ইউ এক্সুয়ালি ট্রাইং টু ডু? না মানে,এটা কী তোমার কোনো নতুন এক্সপেরিমেন্ট?

নূর থতমত খেয়ে বলল,
–কী করছি মানে আবার কি? দেখতেই তো পারছেন রান্না করছি।

আদিত্য বিস্ময়ের সুরে বলল,
–রিয়েলী? থ্যাংক গড তুমি বললে, নাহলেতো আমি ভাবছিলাম তুমি হয়তো তোমার গাড়ী তৈরির কোনো প্রডাক্ট বানাচ্ছ।

নূর চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
–মজা করছেন আমার সাথে?

–মজাতো তুমি করছ। তুমি যা করছ এটাকে যদি রান্না বলে থাকো তাহলে আমি হলাম প্রিন্স চালস আর তুমি লেডি গাগা।
বলেই হাসতে লাগলো আদিত্য। এবার নূরের ইগোতে লাগলো। সে জবাবে বলল,
–এমন করে বলছেন যেন আপনি একেবারে মাস্টার সেফ অফ বাংলাদেশ। পার্ট টাইম বাবুর্চির কাজও করেন নাকি?

আদিত্য আত্মগর্ব করে বলল,
— হ্যাঁ মাস্টার সেফ বলতেই পারো।সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য পারেনা এমন কোনো কাজ নেই।

নূর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–চাপাবাজীর কোনো কম্পিটিশন থাকলে আপনি অবশ্যই পেছন থেকে ফাস্ট হতেন।

–ইনসাল্ট! আদিত্য দ্য গ্রেটের এতবড় ইনসাল্ট! এখন তো প্রুফ দেখাতেই হবে আমাকে। আদিত্যর সম্মান নিয়ে কথা। এখনতো এই রান্না আমিই করে দেখাবো।

–হোয়াট! কী বলছেন আপনি এসব? আপনি কেম রান্না করতে যাবেন? আপনি বাইরে গিয়ে বসুন। আমি একাই পারবো করতে।

–হ্যাঁ তাতো দেখতেই পাচ্ছি কতো সুন্দর পারছ।তুমি কী ভেবেছ আমি তোমার ষড়যন্ত্র বুঝিনা? এমনিতেতো আমার থেকে নিস্তার পাচ্ছোনা। তাই তোমার এখন এই রান্না খাইয়ে মারতে চাইছ আমাকে তাইনা? তবে আমি তোমার ষড়যন্ত্র সফল হতে দিবোনা। রান্নাতো আজ আমিই করবো।

নূর পেরে না উঠে বলল,
–ফাইন, করুন যা খুশি তাই।

বলেই চলে যেতে নিলো সে। আদিত্য বলে উঠলো,
–আরে আরে কোথায় যাচ্ছো? আমি তোমাদের রান্নাঘরের সবকিছু চিনি না কি? আমাকে জিনিসপত্র দেখিয়ে দিবে কে? তুমি এখানে একপাশে গিয়ে বসো। আর আমাকে সব জিনিস দেখিয়ে দাও। আর ফ্রীতে কীভাবে রান্না করতে হয় সেটাও শিখে নাও। এমন ফ্রী অফার সবসময় পাবে না।

নূর ফোঁৎ করে এক বিরক্তিকর নিঃশ্বাস ছেড়ে রাান্নাঘরের সিঁংকের উপর পা ঝুলিয়ে বসলো। আদিত্যকে এক এক করে সব জিনিস দেখিয়ে দিলো। আদিত্য শার্টের হাতা গুটিয়ে অনেক গুছিয়ে সব কাজ করছে। পেঁয়াজ কুঁচি করা দেখে নূর সত্যিই অবাক না হয়ে পারলোনা। কি সুন্দর একেবারে শেফদের মতো দ্রুত বেগে কুঁচি করছে। ছেলে মানুষ হয়ে কি সুন্দর দক্ষতার সহিত রান্নার কাজ করছে। নূর মুগ্ধ না হয়ে পারছে না। সবকিছু মাখিয়ে খিচুড়ি চড়িয়ে দিলো আদিত্য। নূরকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদিত্য মুচকি হেঁসে এগিয়ে গেল তার কাছে। নূরের সামনে এসে দুই হাত নূরের দুইপাশ দিয়ে সিঁংকের ওপর রাখলো। নূর এখন আদিত্যের দুই হাতের মাঝে আটকানো। আদিত্য নূরের মুখের দিকে ঝুঁকে নেশালো চোখে তাকিয়ে বলল,
–জানো, আমি আমার ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। যখন তুমি আমার রাজ্যের রাজরানী হবে। তখন এভাবেই রাণীর মতো তুমি আমার সামনে বসে থাকবে আর এই অধম তোমার সেবায় নিয়জিত থাকবে। তোমার যা খেতে ইচ্ছে করবে আমি নিজে হাতে তোমাকে বানিয়ে খাওয়াবো। কতই-না সুখময় হবে সেই মুহুর্ত। দেখ ভাবতেই আমার লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ভাবো এমন হ্যান্ডসাম বাবুর্চি কোথাও পাবে? তাই হাত ছাড়া করতে না চাইলে জলদিই রাজি হয়ে যাও। আই প্রমিজ নূর,তোমাকে আমার রাজ্যের রাণী করে রাখবো।

নূর বিমোহিত হয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদিত্যের পানে। হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে। এই লোকটা আজকাল তার কাছে আসলেই এমন হয়। শরীরের সব কাজকর্ম তখন এলোমেলো হয়ে যায়। লোকটার কথা আজকাল এতো মন্ত্রমুগ্ধের মতো কেন মনে হয়? মনে হয় কোনো মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে যায় সে। তার কথায় এই প্রথম আজকাল কেমন রঙিন স্বপ্ন দেখতে মন চায় নূরের। দিবাস্বপ্ন, যে স্বপ্ন দেখতে আগে ভয় পেত নূর। তবে ইদানীং তার কেমন যেন আর ভয় লাগেনা। মনে হয় তার স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে। এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করারও অধিকার আছে। কারণ ওর কাছে এই ভরসাদায়ক মানুষটা আছে যে। যার উপর নির্দ্বিধায় ভরসা করতে মন চায়। প্রেসার কুকারের বাঁশির শব্দে ঘোর কাটলো নূরের। অপ্রস্তুত ভাবে বলল,
–এসব ফিল্মি ডায়লগ বন্ধ করুন। দেখুন আপনার খিচুড়ির কী অবস্থা।

আদিত্য সরে আসতে আসতে বলল,
–কী আর হবে, তোমার মতোই তোমার বাসার প্রেসার কুকারও পাঁজি। অসময়ে বেজে ওঠে।

নূর অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে মুচকি হাসলো। রান্না শেষে নূর টেবিলে প্লেট লাগিয়ে খিচুড়ি সার্ভ করে সবাইকে ডাকলো খাওয়ার জন্য। মিছরি আর ইভান এগিয়ে এলো। ইভান বলে উঠলো,
–ওয়াও ঘ্রান তো অসাম আসছে। কে রান্না করেছে, মা?

নূর আদিত্যর কথা বলতে যাবে তখনই আদিত্য বলে উঠলো,
–তোমার আপু রেঁধেছে।

ইভান আর মিছরি ভয়ে ঢোক গিলল।ইভান জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
–আপু,আসলে আমার না পেটে কেমন এসিডিটি ভাব হয়েছে। তাই এখন বরং খাবোনা আমি। যাই হ্যাঁ!

ইভানের দেখাদেখি মিছরিও পল্টি খেয়ে বলল,
–হ্যাঁ আপু,আমিও তখন এতো চকলেট খেয়েছি। এখন আর পেটে একটা দানা দেওয়ারও যো নেই। আমি বরং গিয়ে শুয়ে পড়ি।

বলেই দুটো লেজ গুটিয়ে পালাতে নিলো। তখনই হেঁসে দিলো আদিত্য। নূর রাগে কড়মড় করে তাকালো আদিত্যর পানে। তার এই হাসি যে নূরকে বিদ্রুপের উদ্দেশ্যেই হচ্ছে তা ভালোই বুঝতে পারছে সে। নূর দুজনের উদ্দেশ্যে ধমকের সুরে বলে উঠলো,
–এই বেয়াদব দুটো, ড্রামা বন্ধ করে চুপচাপ খেতে বয়। রান্না আমি করিনি, মিঃ নায়ক করেছে।

এবার দুজন স্বস্তিকর হাসি দিয়ে বসতে বসতে বলল,
–আরে আগে বলবাতো, শুধু শুধু ভয় পাইয়ে পাইয়ে দিয়েছিলে।

নূর চোয়াল চিবিয়ে বলল,
–ও আমার হাতের রান্না তোদের কাছে ভয়ের বিষয়? এতো খারাপ রান্না করি আমি?

মিছরি বলে উঠলো,
–আপু রান্নার কথাতো সিলেবাসেই আসে না। একবার তুমি আমার জন্য মিল্কশেক বানিয়েছিলে। সেটার ভেতরে তুমি লবন,মরিচ আর হলুদের গুঁড়া দিয়ে দিয়েছিলে মনে আছে? তিনদিন যাবৎ পাতলা পায়খানা হয়েছিল আমার। এরপরও তোমার রান্না খাওয়ার সাহস কার হতে পারে।

নূর একটু লজ্জায় পড়ে গেল। সে সত্যিই এমনটা করে ফেলেছিল। আদিত্য ঠোঁট টিপে হাসছে। আজ এই লোকটার সামনে নূরকে বারবার লজ্জিত হতে হচ্ছে তাকে।ইজ্জতের ঝালমুড়ি হয়ে যাচ্ছে। মিছরিকে ধমক দিয়ে দ্রুত খাবার সার্ভ করে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেল নূর।

খাওয়া দাওয়া শেষে আদিত্য এবার বের হতে উদ্যোত হলো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো সে। নূর সেদিনের মতো আজও এলো আদিত্যকে এগিয়ে দিতে। দুজন হাঁটছে পাশাপাশি। মৌনতা কাটিয়ে প্রথমে আদিত্য বলে উঠলো,
–আচ্ছা শোনো, অমালিয়ার সব ডিটেইলস আমাকে বলোতো। কোথায়? কখন? আর ওকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল এভরি ডিটেইলস ইম্পর্ট্যান্ট। তাহলে সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করতে পারবো।

নূর ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সবটা বলল আদিত্যকে।তারপর বলল,
–পুলিশের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ভালো রেসপন্স পাওয়া যায়নি।লিয়া যে ডিসকোর কথা বলেছিলো সেখানেও খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওখানকার স্টাফ সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে দিলোনা কিছুতেই। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। কাল আবারও যাবো আমি। একবার সিসিটিভি ফুটেজটা দেখতে পারলে কমসেকম অপরাধীর চেহারাটা চিহ্নিত করতে পারবো। তারপর তাকে ধরা কঠিন হবে না।

–হুম ঠিক আছে। আমিও যাবো কাল তোমার সাথে। দেখবো কীভাবে ফুটেজ না দেখায় তারা।

–দেখুন প্লিজ, আপনি এসব ঝামেলায় পড়েন না। কেউ চিনে ফেললে এতে আপনার ক্যারিয়ারে সমস্যা হতে পারে। আমি সবটা দেখে নিবো।

আদিত্য দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি, যাবো সেটা জানাচ্ছি । তোমার কী মনে হয়, তোমার চাইতে আমার কাছে ক্যারিয়ার ইম্পর্ট্যান্ট? যেখানে তোমার চাইতে আমি নিজের সত্ত্বাকেও ইম্পর্ট্যান্ট ভাবি না। সেখানে এই সামান্য ক্যারিয়ারের কথা বলছ তুমি? জানি তোমার কাছে ফিল্মি ডায়লগ মনে হবে তবুও শুনে রাখো, যদি তোমার বিপরীতে পুরো পৃথিবীটাও কেউ দিয়ে দেয় তবুও আমি শুধু তোমার পক্ষেই রবো। এমনিতেও তোমার চিন্তায় আমি এক সেকেন্ডও শান্তিমতো থাকতে পারবোনা। তাই আমি আসছি। অ্যান্ড দ্যাটস ফাইনাল।

হঠাৎ কদম থমকে গেল নূরের মাথা তুলে তাকালো আদিত্যর পানে। রাস্তার সোডিয়াম আলোতেও তার মায়াময় দৃষ্টি উপলব্ধি করতে পারছে সে।যদিও কথাগুলো সিনেমার ডায়লগের মতোই।তবে আজ আর তার বাক্য ফিল্মি ডায়লগ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তার হৃদয়ের বাগিচা থেকে রঙিন শব্দকোষের এক ঝাক প্রজাতিরা উড়ে এসে নূরের হৃদয়ের ফুলবাগানে সন্ধি করতে চাইছে। নূরের চাহুনিতে স্থির হলো আদিত্যর নেশাময় আঁখি যুগলও। একে অপরের চোখের গভীরতায় হারালো যেন। চোখে চোখে হলো হাজারও অব্যক্ত অনুভূতির আদান-প্রদান। মায়ার অসীম সমুদ্রে ঢেউ খেলছে মন মঞ্জিল। সুখময় এক অমায়িক হাসির রেখা ভাসলো আদিত্যর ঠোঁটের কোণে। সেই হাসি বজায় রেখে বলল,
–এভাবে আঁটকে রাখলে কী করে যাবো? এমন নয়নের শেকলে বেঁধে রাখলে আজীবনও ছুটিয়ে যেতে পারবোনা।

নূর অপলক তাকিয়ে থেকে ঘোরের মাঝে আনমনেই বলে উঠলো,
–তাহলে যেওনা।

চমকিত হলো আদিত্যর আঁখি যুগল। আশ্চর্যান্বিত হয়ে সে বলল,
–হোয়াট? হোয়াট ডিড ইউ সে? ক্যান ইউ ইট অ্যাগেইন প্লিজ?

ঘোরের মাঝে কথাটি বলে ফেলে নিজেও থতমত খেয়ে গেল নূর। চরম অপ্রস্তুত হয়ে অন্য দিকে ঘুরে গিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। কী বলে ফেললাম এটা আমি? মাথা পুরোই গেছে। গাড়ির মতো মাথাও এবার সার্ভিসিং-এ দিতে হবে। নাট বল্টু টাইট দিতে হবে। নাহলে আর হচ্ছে না। নূরের অবস্থা বুঝতে পেরে আদিত্য মুচকি হেঁসে বলল,
–ইচ্ছেতো আমারও সেটাই। কিন্তু কী বলোতো, বিয়ের আগে একসাথে থাকার ব্যাপার টা না, আমার কেমন লজ্জা লাগে। আমার আবার লজ্জা বেশি জানোতো। লজ্জায় একেবারে ম,রে যাই আমি। কিন্তু তুমি যদি ইনসিস্ট করো তাহলে আর কী করার। তোমার কথাতো আর অমান্য করার সাধ্য নেই এই অধমের। আমিতো তোমার চরণের দাস। তাই তোমার জন্য নাহয় লজ্জায় মরতে মরতেই তোমার ইচ্ছে পূরণ করবো।

অপ্রস্তুত ভাব মুহূর্তেই উড়ে গিয়ে কটমটে চোখে তাকালো নূর। তা দেখে শরীর কাঁপিয়ে হাসলো আদিত্য। হেসে বলল,
–ওকে ওকে রিল্যাক্স, জাস্ট কিডিং। যাচ্ছি আমি এখন। আর হ্যাঁ আমি না আসা পর্যন্ত কোনোরকম একশান দেখাবেনা খবরদার! যা করার আমি আসার পর করবে।

কথা শেষ করেই গাড়িতে চড়ে রওয়ানা হলো আদিত্য। নূর তাকিয়ে রইলো সেদিকে। অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক হাসির রেখা।লোকটা বুঝি তার ষড়যন্ত্রে সফল হয়েই গেল।

চলবে…….