শ্রাবণের অশ্রুধারা পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
610

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#শেষ_পর্ব
#কলমে_আসমা_মজুমদার_তিথি

রোদ ঝলমলে পরিস্কার আকাশ, তার মাঝে যতদূর চোখ যায় ততোদূর কেবল সবুজের সমারোহ।
শরতের মাঝামাঝি সময়ের এই সচ্ছ আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একটা আলাদাই প্রশান্তি অনুভব করছে চারুলতা।এতোগুলো বছর পর আবার সেই চিরচেনা সিলেটে পা রেখেছে সে।ভোরের স্নিগ্ধ আলোতে কটেজের চারপাশটা ঘুরে দেখবে বলে নামাজ পড়েই সে বেড়িয়ে গেছে আজ।একজন যদি জানতে পারে তাকে ছাড়াই চারু কটেজের বাহিরে একা-একা বের হয়েছে তাহলে যে কী একটা তুলকালাম করবে সে সেটা ভেবেই হালকা মুচকি হাসি দিলো সে।মানুষটা সত্যিই তাকে বড্ড ভালোবাসে। তা নাহলে তার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া জীবনটা এতো সুন্দর আলোকিত কেউ কী আর করতে পারতো।মানুষটা পেরেছে,মানুষটা তাকে একটা পরিবার, একটা সংসার দিয়েছে। মাতৃত্বের স্বাদ দিয়েছে,সর্বোপরি তাকে দিয়েছে এক বুক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।
মানুষটা সত্যিই তাকে সুখ দিয়েছে।
ঘন্টা দেড়েক হাটাহাটির পর চারু কটেজে ফিরে এলো।নিজেদের রুমে ঢুকতেই একটা পুরুষালী গলা ভেসে আসল,

=না বলে কোথায় গিয়েছিলে, জানো না আমার চিন্তা হয়!তারউপর ফোনটাও সাথে নেওনি,তুমি কী আমায় হার্ট অ্যাটাক করিয়ে মারতে চাও বিবিজান?

লোকটির কথা শুনে মুচকি হেসে চারু জবাব দেয়,
=তোমাকে মারলে তো আমি নিজের কবর নিজেই খুঁড়বো জনাব,কারণ তুমি ছাড়া তো আমি এ পৃথিবীতে একা হয়ে যাবো।তাই এমন কথা মাথাতেও এনো না।

=মনে তো হয়না এমনটা।তুমিতো হুটহাট আমাকে না বলে কয়ে উদাও হয়ে যাও।তোমার অনুপস্থিতি আমাকে কতটা পোড়ায় তুমি কী সেটা বুঝো!

চারু লোকটির কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে বলে,
=আমাকে নিয়ে এখনো তোমার ভয় দূর হয়নি,১২ বছরতো হয়ে গেলো বিয়ের তবুও আমাকে নিয়ে এতো সংশয়! তোমার বিবিজান তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা অভিরুপ।

চারুর আশ্বাসভরা কথায় তার মাথায় ছোট্ট ভালোবাসার পরশ একে দেয় অভিরুপ।সত্যি বলতে চারুকে হারিয়ে ফেলার একটা চাপা ভয় তার মধ্যে কাজ করে।এটা আগে করলেও গত কয়েকদিন টানা কিছু বাজে স্বপ্ন দেখার পর আরও বেশি হচ্ছে তার।তার মনে হয় তার বিবিজান তাকে ছেড়ে যদি চলে যায়,কোন দমকা হাওয়ায় যদি তার সাজানো ঘর ভেঙে যায় তবে কী করে বাঁচবে সে।তাইতো প্রতিনিয়ত সে চারুকে নিজের চোখে চোখে রাখে।আর অভিরুপের এমন অস্থিরতা অনুভব করতে পেরেই চারু হঠাৎ এই ঘুরতে আসার প্ল্যান করে।তার মনে হয়েছিল অভিরুপের হাওয়া বদল দরকার তাইতো স্নেহাকে তার দাদির কাছে রেখে তারা সিলেটে এসেছে কিছুদিন বেড়াতে।



সেদিন চারু অনুর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে তার মায়ের বাসায় যায়।মেয়ের সাথে যতই রাগে-অভিমান করুক না কেনো তার মুখে তরুর প্র্যেগনেন্সির কথা শুনে চমকে যান তিনি।অনুজের নামে থানায় কেস করবেন বলেও উদ্যত হন তিনি।কিন্তু চারু আটকেছে। সে চায়নি অনুজ-তরুর সংসারে আর নিজের অস্তিত্ব রাখতে।তাই সে তার মাকে ডিভোর্সের কেস ফাইল করতে বলে।অনুজকে একটা চরম শাস্তি দিতে চেয়েও পারেননি তিনি কারণ চারু চায়নি বলে,তাই মেয়ের সিদ্ধান্তেই তিনি সেদিনই কোর্টে কেস ফাইল করেন।
এদিকে এই শহরটা ধম বন্ধকর লাগছিলো চারুর।মানসিক ভাবে সে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিলো।ধীরে ধীরে তার মানসিস কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছিলো।মেয়ের এমন অবস্থা দেখে চারুর মা তাকে দেশের বাহিরে তার ফুফুর কাছে পাঠিয়ে দেয়।চারু দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেই একদিন হঠাৎ অনুজ আসে তাদের বাড়িতে।হাতে ডিভোর্সের কাগজ নিয়ে।আইনি ভাবেই তার কাছে চারুর সাইন করা কাগজটি চারুর পক্ষের উকিল পাঠায়।চারু তাকে ডিভোর্স দিতে চায় সেটা জেনেই অনুজ এসেছিলো তাকে প্রশ্ন করতে।কিন্তু তার দূর্ভাগ্য চারু তখন দেশে ছিলো না।শাশুড়ীকে সে তরুর বিষয়ে সবটা খুলে বলল,কিন্তু তিনি অনুজের কোন কথাই পাত্তা দিলেন না।বরং আরও তড়িঘড়ি করে ডিভোর্সের কার্যক্রম করতে লাগলেন।কোর্টে চারুকে লুকিয়ে তারই চাচাতো বোনের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।সকল তথ্য-প্রমাণ অনুজের বিপক্ষে হওয়ার অবশেষে বাধ্য হয় অনুজ ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে।
অনুজের সাথে আইনি ভাবে বিচ্ছেদ হয়েছে শুনে বিদেশে বসেও অনেক কেঁদেছিলো চারু।তবুও মন থেকে চেয়েছে অনুজ-তরু আর তাদের সন্তান যেন ভালো থাকে।
এদিকে চারু দিনকে দিন নিজেকে আরও ঘরবন্দী হয়ে যাচ্ছিল।কারোও সাথেই তেমন বিশেষ কথাবার্তা সে বলত না,চুপচাপ একা ঘরে গুটিয়ে নিয়েছিল সে।
অন্যদিকে চারুর মা অনুজের মুখে সবটা ডিভোর্সের আগে জেনে গিয়েছিলেন।তাই ওনার মনে হয়েছিল চারু যদি সবটা জানতে পারে তবে হয়তো আবার সে অনুজের কাছে ফিরে আসবে,তখন তরু যদি তার সাথে অন্যায়ের কথাগুলো চারুকে বলে দেয় তাহলে তাদের মেয়ে যে তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে সেটা তিনি জানতেন।তাইতো তিনি চারুর দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা-ভাবনা করলেন।একটা সময় চারুকে বুঝিয়ে ছয়মাস পরেই তার ফুফাতো ভাই অভিরুপের সাথে পারিবারিক আয়োজনে ছোট পরিসরেই বিয়ে হয় চারুর।অভিরুপেরও আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো মেরি নামের এক ভিনদেশি মেয়ের সাথে।কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মেরি অভিরুপকে ডিভোর্স দিয়ে হেনরি নামের অন্য একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায়।অভিরুপ পেশায় একজন আর্কিটেকচার, বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে।চারুর জীবনের এতো কঠোরতাই তার প্রতি প্রথম আকর্ষিত হয় সে।এরপর তার মামীর কাছে চারুকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সে।চারুর মাও তা সাদরে গ্রহণ করেন।তবে এখানেও চারুর মা ছিলেন সাবধানী মহিলা তাইতো বিদেশেই চারুর বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন আর আগে থেকেই তিনি অভিরুপকে অনুজ-তরুর সব কথাগুলো জানিয়ে দেন।আর বলেন চারুকে যেনো ওদেশেই রাখে কখনো দেশে যেনো না আনে।ওনারা মাঝে মাঝে মেয়েকে গিয়ে ওদেশে দেখে আসবেন প্রয়োজন হলে।
অভিরুপ সায় দিয়েছিলো এবং সে তাই করেছে এতোগুলা বছর।
কিন্তু দু’মাস আগে চারুর বাবা হঠাৎ একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়।এজন্যই এক প্রকার বাধ্য হয়ে তাদের আবার দেশের মাটিতে পা রাখতে হয়েছে।চারু ১২ বছর পর দেশে ফিরে অনেক আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলো,পুরোনো ফেলা আসা সকল দিনগুলো তার চোখের সামনে যেনো ভেসে উঠেছিলো সেদিন।তখন তার কাঁধে ভরসার হাত দিয়ে তাকে শান্ত করেছিলো অভিরুপ।সত্যি বলতে যত যাই হোক অভিরূপ তার বিবিজানকে অনেক ভালোবাসে।এতে কোন সন্দেহ নেই,তাইতো চারুকে হারানোর ভয়ে সে কুঁকড়ে আছে দেশে ফেরার পর থেকে।কারণ তাকে সবটাই বলেছে চারুর মা অনুজ সম্পর্কে।

=স্নেহার সাথে কথা হয়েছে?

=মেয়ে সকাল থেকে এনিয়ে তিনবার ফোন দিয়ে তার মায়ের খোঁজ করেছে, কিন্তু তার মা তো হাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

অভিরুপের কথায় চারু মুখ ফুলিয়ে বলে,
=অভিরুপ প্লিজ এমন ভাবে বলো না।তুমি তো জানো স্নেহা আমার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবুও এমন ভাবে কেনো বলছো।

চারুর গালে আঙুল দিয়ে গুতো দিয়ে অভিরূপ বলে,
=আচ্ছা বিবিজান আর বলবো না,কিন্তু এখন যদি আপনি আপনার মেয়েকে ফোন না দেন তাহলে এর পরের ঘটনার দায় কিন্তু আমি নিতে পারবো না।
অভিরূপের কথায় চারু হুম বলে ফোন হাতে নিলো মেয়েকে ফোন দেয়ার জন্য।
দূরে দাঁড়িয়ে চারুকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে অভিরূপ। মেয়ের সাথে কথা বলার সময়ে চারুর তৃপ্তিময় চেহারার হাসি মাখা মুখ দেখে নিজেকে বড্ড সুখী অনুভব করে অভিরূপ।
_________________________________________
দুপুরে খেয়েদেয়ে অভিরূপ চারুকে নিয়ে বের হয় শ্রীমঙ্গল চা-বাগান ঘুরতে যাবে বলে।
বেড়ানোর জন্য চমৎকার জায়গা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজের হাতছানি। চা বাগানের সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য। এ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে দেখে আনন্দে আত্মহারা চারু আর তাকে দেখে অভিরূপের।
বিকেলের দিকে তারা এসে নামে চা-বাগানে।চা-বাগান ঘুরে তারা গেলো শ্রীমঙ্গলের আরেকটি আকর্ষণ মাধবপুর লেক। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। লেকটি কমলগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত হলেও শ্রীমঙ্গল থেকে প্রতিদিন শত শত পর্যটক স্থানটি দেখতে যান। ছবির মতো সুন্দর এই মনোরম লেকের জলে রয়েছে গোল গোল পাতা আর তারই ফাঁকে ফাঁকে ফুটে রয়েছে নীলপদ্ম। লেকের বাহিরে একটা ছোট্ট বাচ্চার থেকে কয়েকটি নীলপদ্ম কিনবে বলে চারুকে রেখেই অভিরূপ বেড়িয়ে আসে।
অভিরুপ যাওয়ার পর চারু একা একাই লেকের সৌন্দর্য মন্থন করে।হঠাৎ করেই কেউ একজন বলে উঠে,

=তুমি চারুলতা না।হ্যাঁ আমি ঠিক চিনেছি তুমি তো চারুলতাই।কেমন আছো চারুলতা।

এখানে হঠাৎ কোন এক পুরুষের মুখে তার নাম শুনে অনেকটা চমকে যায় চারু।পিছন ঘুরে লোকটিকে দেখলে সে চিনতে না পেরে লোকটির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
লোকটি চারুর অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে নিজেই বলল,

=আমাকে চিনতে পারছো না চারুলতা!আমি তুষার,তোমার ভার্সিটির সিনিয়র বড় ভাই তুষার।
মনে পড়ছে?

চারু লোকটির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর বলল,
=হ্যাঁ চিনেছি,আসলে অনেক বছর পর হঠাৎ দেখলাম তো তাই প্রথমে চিনতে পারিনি।তো আপনি এখানে?

=একটা কাজে এসেছিলাম।আমি ভেবেছিলাম তুমি বা তোমার পরিবার কখনো আমার চেহারা ভুলতে পারবে না।কিন্তু এখন তো দেখছি উল্টো আমারই তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে আমি কে?

=মানে,

=তরু কেমন আছে চারুলতা?

=তরুর কথা জিজ্ঞেস করছেন হঠাৎ, আট ওকে আপনি চিনলেনই বা কেমন করে?

=আমি জানি আমি অন্যায় করেছি তার শাস্তিও পাচ্ছি। তুমি প্লিজ একবার আমাকে তরুর সাথে দেখা করিয়ে দাও আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো।হয়তো সে ক্ষমা করলে আমার পাপ কিছুটা কমবে।

=তুষার ভাই আপনি কী বলছেন আমি তার কিছুই বুঝছি না।আর তরুর কোন খোঁজ আমি নিজেও জানি না।গত ১২ বছর ধরে আমিতো বাংলাদেশেও ছিলাম না।দু’মাস আগে বাবা মারা যাওয়ায় দেশে এসেছি।আর তাছাড়া আপনি তরুকেই বা কী করে চিনেন সেটাও তো বুঝতে পারছি না।আমাকে সবটা একটু ক্লিয়ার করে বলবেন প্লিজ।

=মানে তুমি জানো না আমি তরুকে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে বিয়ে করে পরে ওকে ছেড়ে দিয়েছি?
অবাক হয়ে তুষার বলে।
তুষারের চেয়েও চারগুন বেশি অবাক হয়ে চারু কিছুটা চেঁচিয়ে বলে,
=মানেহ্ আপনি এসব কী বলছেন তুষার ভাই।কবে কখন তরুকে আপনি বিয়ে করেছেন।আর কিসেরই বা প্রতিশোধ নিয়েছেন ওর উপর।আমার মাথয় সব তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আমাকে সবটা প্রথম থেকে খুলে বলুন তুষার ভাই।

_________________________________________
বিকেলের পর থেকেই চুপ হয়ে গেছে চারু।নীলপদ্ম কিনে এনে চারুকে দেয়ার আগেই চারু অভিরূপকে বলে সে কটেজে ফিরে আসতে চায়।আর আগামীকালই ঢাকায় ফিরতে চায় তার ব্যবস্থা যেনো অভিরূপ করে।কটেজে ফিরে আর কোন কথা বলেনি চারু।চুপচাপ রয়েছে,অভিরূপ হাজার চেষ্টা করেও কিছু জানতে পারেনি সে।চারুর হঠাৎ এমন চুপ হয়ে যাওয়াতে অভিরূপের ঝড় আসার আগে শান্ত প্রকৃতির কথা মনে হয় বারংবার। তবে কী তাদের জীবনেও কোন ঝড় আসতে চলেছে?তাহলে তার স্বপ্নগুলোই কী সত্যি হয়ে যাবে এবার?কিন্তু কী এমন হয়েছিলো পার্ক থেকে সে বেড়িয়ে যাওয়ার পর?
অস্থিরতায় ছেয়ে গেছে অভিরূপের মন,নিজেকে স্থিরে রাখতে পারছেনা সে।
পরদিন সকালেই তারা সিলেট ছেড়ে ঢাকায় ফিরে যায়।ঢাকায় এসেই চারু তার মাকে তরু-অনুজের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি থমকে যান।এতোগুলা বছর এই ভয়ের জন্যই একমাত্র মেয়েকে নিজেদের কাছ থেকে দূরে রেখেছে কিন্তু সে ভয়টাই আজ সত্যি হলো।
তবে চারুর মা তার প্রশ্নের উত্তরে বলে,
=আমি ওদের কোন খবর রাখিনি আর।জানি না কেমন আছে,কোথায় আছে।

কিছুসময় চুপ করে থেকে চারু বলে,
=বেশ তবে আমি নিজেই জেনে নিবো সবটা।আমার কেনো জানি না মনে হচ্ছে আমার আড়ালে অনেক কিছুই হয়েছে, যা তোমরা আমাকে লুকিয়েছো,আমি সবটা খুঁজে বের করবো এবার।
বলেই সে নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
মেয়ের কথা শুনে অভিরূপকে সবটা জানান তিনি।অভিরূপও চিন্তিত হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ পরে চারু হাতে পার্স নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় অভিরূপ তাকে আটকায়,বলে
=কোথায় যাচ্ছো বিবিজান।
চারু অভিরূপের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
=যাই হোক না কেনো আমি তোমার নীড়েই ফিরবো অভিরূপ। ভয় পেয়ো না।ভালোবাসলে ভয় নয় আগলাতে জানতপ হয়।যা এতো বছর তুমি খুব সুন্দর করে পালন করেছো।বলেই অভিরূপের পাশ কাটুয়ে সে বেরিয়ে পড়ে।
গন্তব্য অনুজেদের বাসা,যেখান থেকে সবটা শুরু হয়েছে সেখানেই তার শেষটা জানতে যাচ্ছে চারু।



কলিং বেলের বিশ্রী আওয়াজে বিরক্ত হয়ে দরজা খোলেন, দরজার সামনের বৃদ্ধ মহিলাটিকে দেখে চিনতে ভুল করেনি চারুলতা। বৃদ্ধাকে সালাম জানিয়ে বলে,
=কেমন আছেন আপনি?
রহিমা বেগম চশমার উপর দিয়ে ভালো করে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি কে।চোখেও আজকাল বড্ড কম দেখপন তিনি,চেনা মুখ ছাড়া এ বাড়িতে অন্য কেও তেমন আসে না সেজন্য।
চারু রহিমা বেগমের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে,
=আমি চারুলতা মনে আছে আমাকে,চিনতে পারছেন আমাকে?
চারুলতা নামটি শোনার পর রহিমা বেগম চারুকে চিনতেই হু হু করে কেঁদে উঠেন।হঠাৎ তার কান্না দেখে বিচলিত হয় চারু।সে তাকে ধরে সামলানোর সুরে বলে,
=আপনি কাঁদছেন কেনো,দেখুন আমি অনুজ-তরুর সংসারে ভাঙ্গন ধরাতে আসিনি আমিতো এসেছি তরুকে কিছু প্রশ্ন করতে যার উত্তর আমার অজানা।প্লিজ আপনি কান্না বন্ধ করুন।তরুকে একবার ডেকে দিন প্লিজ।
রহিমা বেগম চারুর কথা শুনে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে তার হাত ধরে বাড়ির পিছনে নিয়ে যায়।বাড়ির পিছনে চারুকে কেনো আনলো রহিমা বেগম তা সে বুঝতে পারলো না।তাই চারু আবার বলল,
=আপনি হয়ত ভুল শুনেছেন আমি বাগান নয় তরুকে দেখতে চেয়েছি।ও কোথায় ওকে ডেকে দিন প্লিজ।
রহিমা বেগম কিছু না বলে সামনে আঙুল দিয়ে কিছু একটা ইশারা করতেই চারু সামনে তাকিয়ে থমকে যায়।
তরুর নামে বড় করে খোদাই করদ একটা নেম প্লেট।তার নিচে মৃত্যুর সাল আর তারিখ লেখা।মূহুর্তেই চারুর মাথা ঘুরতে লাগলো,ধম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হতে লাগল তার।চোখের কোন না চাউতেও জলের আনাগোনা দেখা দিলো,সে রহিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
=কিভাবে এসব,
আর কিছু বলতে পারলো না সে তা গলা ধরে এলো।
রহিমা বেগম তখন ১২ বছর আগের কথা বলতে লাগলেন,
অনুজ তরুর বিয়ে না হওয়ার কথা,কেন এসব করেছে,সবটা বলল রহিমা বেগম।তারপর আবার বলে,
=তুমি সেদিন অনুর বাসা থেকে চলে যাওয়ার পরেই অনু এবাসায় এসে ঝামেলা করে তখনই অনুজ সবটা বলে।তরু ওর স্বামীর এমন হিংস্র রুপ জানার পর সেখানেই জ্ঞান হারায়।এরপর ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে জানায় ওর বাচ্চাটা টিকেনি,দুসপ্তাহ চলছিলে তখন,অতিরিক্ত চিন্তা তার উপর মেঝেতে পড়ে গিয়ে পেটে আঘাত লাগায় বাচ্চাটি নষ্ট হয়ে যায়।এরপর থেকে মেয়েটু নিজের মাঝে একেবারে গুটিয়ে যায়।এদিকে অনুজ পাগলের মতন তোমাকে খুঁজছিল। এরইমাঝে একদিন তোমার সাইন করা ডিভোর্স লেটার আসে বাসায়।সাথে সাথে সে চিঠি নিয়ে অনুজ যায় তোমাদের বাসায়।সে ভেবেছিলো সবটা না জেনেই ভুল বুঝে তুমি ওকে ডিভোর্স দিচ্ছো তাই তোমাকে সবটা জানানোর দরকার। কিন্তু তোমার মা বলে তুমি তখন দেশের বাহিরে তোমার ফুফুর কাছে,তাছড়া তুমি নিজ থেকেই আর এ সম্পর্কে থাকতে চাও না।তুমি নাকি আর অনুজের কাছে ফিরতে চাও না।অনুজ বারবার অনুরোধ করে একটাবার তোমার সাথে যেনো তিনি যোগাযোগের ব্যবস্থা করিয়ে দেন তাহলে হয়তো তুমি সবটা বুঝবে।কিন্তু তোমার মা সেটা করেনি,বরং ওনি অনুজ-তরুর বিরুদ্ধে কেস করেন।কোর্টে উকিলের মুখে নোংরা নোংরা কথা শুনতে শুনতে তরু আরও বেশি বিধ্বস্ত হয়ে যায়।এরপর যেদিন রায় বেড়োয় সেদিন ও সবার আগে কোর্ট থেকে বেরিয়ে যায়।এরপর ও নয় ওর লাশ ফিরে আসে বাসায়। ওর ধারনা ওর জন্যই তোমার আর অনুজের ঘর ভেঙেছে। নিজেও সুখী হতে পারলো না আর তোমাকেও সুখী করতে পারেনি বরং সবটা তছনছ করে দিয়েছে। তাই গাড়ির নিচে
নিজের জীবন দিয়েছে সে।
এদিকে যে দায়িত্ব সামলাবে বলে আমার ছেলে তার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করেছিলো সে দায়িত্ব সামলাতে না পেরে সেও মানসিক ভাবে ভেঙে পরে।
এতোকিছুর মাঝে সবচেয়ে বড় অপরাধী ছিলাম আমি।আমি যদি সেদিন তোমাকে ওভাবে না বলতাম তাহলে হয়তো তুমি অনুজকে ওয়াদা করাতে না আর অনুজও তোমাকে আমাকে বুঝাতে এতো বড় একটা মিথ্যে বলতো না।সবচেয়ে বেশি অপরাধ আমি করেছি কিন্তু শাস্তি পেলো তরু,অনুজ,আর তোমার শশুর।মানুষটা ছেলের শোকে অকালেই আমাকে একা করে চলে গেলেন।অনু মা হিসেবে আমার খোঁজ রাখলেও মন থেকে যে আমি ওর চোখের বালি তা আমি জানি।
মাগো আমি ভুল করেছি,না না আমি অন্যায় করছি তোমার সাথে আমাকে মাপ করে দেও।আমি ভুলে গিয়েছিলাম একটা নারী কেবল সন্তান জন্ম দিলেই পরিপূর্ণ নারী হয়না, বংশধরের আশার আমি অন্ধ ছিলাম।আমাকে ক্ষমা করে দাও মা।তাতে করে যদি আল্লাহ্ আমার শাস্তি কিছুটা কমায়।হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে রহিমা বেগম।।

=অনুজ কোথায়,সেও কী,,,,?
অনুজের কথা শুনতেই চারুকে নিয়ে রহিমা বেগম অনুজের রুমে নিয়ে যায়।
শিকলে বাঁধা একটি আধ বৃদ্ধ লোক বসে একটা ইটের টুকরো দিয়ে সমানে ফ্লোরে লিখে যাচ্ছে “লতা ফিরে এসো,আমাকে ক্ষমা করো”।
লম্বা দাঁড়ি, লম্বা চুল,গায়ে ময়লা পোশাকের অনুজকে চিনতে এক মুহুর্ত দেরি হয়নি চারুর।অনুজের এ হাল দেখে তার বুকটা হু হু করে উঠলো।
=তরুর মৃত্যুর পরে ছেলেটা আমার সারাদিন প্রলাপ বকতো তোমাকে যেনো ফিরিয়ে আনি।যে ভালোবাসাকে বাজি রেখে সে দায়িত্বকে কাধে তুলে নিয়েছে সে দায়িত্বই সে সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি।তরুকে একটা সুন্দর জীবন দেয়া তো দূরের কথা তার জীবনটা এতোটাই দূর্বিষহ করে দিয়েছিলো যে মেয়েটা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে।
তোমার মাকে জানিয়েছি কিন্তু তিনি বরাবরের মতন অপমান করেই আমাদের তাড়িয়ে দিতেন।মাসের পর মাস ছেলে আমার নিজেকে ঘর বন্দি রেখেছে,তার মধ্যে তোমার বিয়ের কথা শুনে সে মানসিক চাপ আর ও সয্য করতে পারেনি।সম্পূর্ণ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আজ আমার ছেলে পাগল,বড্স উম্মাদ।ডাক্তার বলেছিলো পাগলাখানায় রাখতে।কিন্তু মা হয়ে কী করে নিজের ছেলেকে পাগলাগারদে রাখি বলো।তাই বাসা
ও ওর মিথ্যের শাস্তি পাচ্ছে মা,তুমি পারলে ওকে ক্ষমা করে দিও।
ঘরে দুটো মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে উপরের দিকে তাকালো অনুঝ।মাকে সে প্রায় নিজের আশেপাশে দেখেন।কিন্তু তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নতুন মানুষটিকে সে নতুন দেখছে।রহিমা বেগম ততোক্ষণে চলে গেছেন ঘরের বাহিরে।
অনুজ চারুকে না চিনতে পারলেও তার অবচেতন মন হয়তো চারুকে চিনেছে তাইতো আচমকাই তার দু’চোখে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো যা দৃষ্টিগোচর হলো না চারুর।
তার বুকটা ভারী হয়ে আসছিলো যেনো,বেশিক্ষণ আর অনুজের সামনে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো সে।

_____________________

পুনশ্চ ঃআজ স্নেহার বিয়ে।পুরো বাড়িতে স্নেহার বিয়ে নিয়ে আজ আনন্দে আত্মহারা। চারু দক্ষ হাতে সবটা সামলাচ্ছে। অভিরূপ মেহমানে আপ্যায়নের দিকেটা তদারকি করছে।
অবশেষে চারু তার জীবনের সত্যিকারের সুখটা পেয়েছে অভিরূপের কাছে,স্নেহাকে পেয়ে মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছে।তার জন্যই অভিরূপ ২০ বছর আগে দু’বছরের এই স্নেহাকে দত্তক নিয়েছিলো তারা।আজ সে মেয়েরই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ভাবতেই চারুর সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে।


সেদিন অনুজের ওই অবস্থা দেখার পরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে চারু।সেদিনই বিদেশে যাওয়ার জন্য অভিরূপকে তাড়া দেয়।যেখানে সবটা শুরু হয়েছিলো সেখানেই চারু সবটা শেষ করে শেষ থেকে নতুন করে শুরু করার প্রতিজ্ঞা করেছিলো।আর সে তাই করেছিলো।কিন্তু সে তার মায়ের সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখেনি তবে অভিরূপ যে যোগাযোগ রাখে তা সে জানে কিন্তু কোন বাধা দেয়না।
যা চলে গেছে তা সে আর মনে রাখতে চায়না।অনুজ-তরু ভুল করেছে তার শাস্তি পেয়েছে তাতে তার আফসোস নেই।সে তার জীবন দিয়ে এটা বুঝেছে মিথ্যে দিয়ে কখনো ভালো কিছু হয়না।উল্টো মিথ্যে সব কিছু শেষ করে দেয়,ধ্বংস করে দেয় এক নিমিষে।

_______________সমাপ্ত _________________

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#শেষ_পর্বের_বর্ধিতাংশ
#কলমে_আসমা_মজুমদার_তিথি

মেয়েকে বিদায় দিয়ে তার শূন্য ঘরে বসে আছে চারুলতা। আজ তারও নিজের বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ছে।প্রথম যখন অনুজকে বিয়ে করে তার বাড়িতে সে পা রেখেছিলো সেসব দিনগুলো আবারো চোখের সামনে ভেসে উঠছে চারুর।আজ এতোগুলো বছরেও সেসব দিনগুলো যেনো বিলিন হয়নি চারুর কাছে।
বাহিরের সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে অভিরূপ চারুকে খুঁজতে তাদের ঘরে গেলো কিন্তু চারুকে না পেয়ে স্নেহার ঘরের দিকে গেলো।গিয়ে দেখলো মেয়ের বিছানার উপর পা ঘুটিয়ে বসে আছে চারু।অভিরূপ ধীর পায়ে তার পাশে গিয়ে বসল,
=বিবিজান তোমার কী খুব কষ্ট হচ্ছে?
চারু চুপ
=মেয়ের বাবা-মা হলে এমন একটা দিন আসবে এটাই স্বাভাবিক। তুমি এভাবে কষ্ট পেলে মেয়েটা তো মন দিয়ে সংসার করতে পারবে না।
চারু তখনও চুপ।
=তুমি আজও কথা বলবেনা বিবিজান।আমার কী দোষ ছিলো যে আজ এতোগুলো বছর হয়ে গেলো তবুও তুমি একটিবারের জন্য আমার সাথে কথা বলোনি।এর থেকে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে আমি তা সয্য করে নিতাম কিন্তু এভাবে আমাকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে কী আনন্দ পাও তুমি।একবার তো বলো আমার কী দোষ?
চারু চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আবার ব্যর্থ হয়েছে ভেবে সে হাল ছেড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো তখনই চারু বলে উঠলো,
=তোমার দোষ একটাই তুমি যেমন আমাকে মিথ্যে বলোনি তেমনি সত্যিটাও কোনদিন বলোনি।যদি সেদিন তুমি সত্যিটা বলতে তাহলে আজকের গল্পটা হয়ত অন্যরকম হতে পারতো।আমার বোনটা হয়তো বেঁচে থাকত,আর অনুজও,,,,
আর বলতে পারলো না চারু।নিশ্চুপে নিজের চোখের পানি ঝরাচ্ছে সে।
অভিরূপ মাথা নত করে চলে গেলো,কারণ এছাড়া তার আর করার কিছু নেই।সত্যিই যদি সে সেদিন অনুজ-তরুর সত্যিটা চারুকে জানাতো তাহলে আজ হয়তো চারুর জীবনের গতিটা অন্যরকম হতো।কিন্তু সেতো মানুষ তারও তো লোভ হয় ভালো থাকার।তাইতো সেদিন সব সত্যিটা জেনেও সে চারুকে কিছু বলেনি।সে ভেবেছে নিজের ভালোবাসা দিয়ে চারুর জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট দূর করে দিবে।কিন্তু নাহ্ সে ভুল ভেবেছে,মিথ্যে বলা যেমন অপরাধ তেমনিই সত্যি গোপন করাটাও একটা মস্ত বড় অপরাধ। আর সে অপরাধের অপরাধীই সে।
অভিরূপ চলে গিয়েছে বুঝতে পেরে রুমের দরজাটা ভিতর থেকে আটকে দিলো চারু।
সেদিন অনুজের ওই অবস্থা দেখে সে যখন বিদেশে ফিরে নিজের জীবনটাকে নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিলো অভিরূপের সাথে তখনই সে জীবনের আরেকটা বড় ধ্বাক্কা খায় সে।তার মা আর অভিরূপের কথোপকথন আড়াল থেকে শুনে সে এ পৃথিবীতে থাকার কোন আগ্রহই পাচ্ছিলো না।
নিজেকে শেষ করে দিতে যখন সে ঘুমের ঔষুধ গুলো হাতে নিয়েছিলো তখনই তার ফোনে স্নেহার হাসোজ্জল মুখটা ভেসে উঠে।স্নেহার ফোন পেয়েই আত্মহত্যার চিন্তা দূর করে সে।অনাথ মেয়েটার তো কোন দোষ নেই,তাহলে এসবের শাস্তি মেয়েটা কেনো পাবে।শাস্তিতো তার প্রাপ্য,অভিরূপ আর তার মায়েরও শাস্তি প্রাপ্য কিন্তু এই নিষ্পাপ মেয়েটার নয়।সেদিনের পর থেকে চারু তার মাকে আর মা বলে ডাকেনি।মাকে শুধু একটা কথাই বলেছিলো সে,
=তুমিও সার্থপরতা করলে শেষ পর্যন্ত মা।তাহলে তোমার আর আমার শাশুড়ীর মধ্যে পার্থক্য কোথায় ছিল বলো তো।ওনিও চেয়েছিলেন ওনার ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকুক তাইতো আমার সাথে ওমনটা করেছিলেন আর তুমি কী করলে আমার সুখের কথা ভাবতে গিয়ে আমার বোনটাকেই মৃত্যুর পথে ঠেলে দিলে।মেয়েটার সাথে এতোটা অন্যায় করে তুমি এখনো কী করে শ্বাস নেও বলোতো?
তোমাকে মা বলে ডাকতেও আমার ঘৃণা লাগছে।
অনুজের মা তার শাস্তি পাচ্ছে যতদিন বাঁচবে ততোদিনই তিনি শাস্তি পাবেন কারণ যে সন্তানের সুখের জন্য তিনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন সেই সন্তান আজ তারই সামনে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এর চেয়ে বড় শাস্তি তুমি পাবে মা।তুমি আমার জন্মদায়িনী তা তো অস্বীকার করতে পারবো না কিন্তু কখনো আর স্বীকারও করতে চাইনা।আজ থেকে তোমার মেয়ে বেঁচে থাকবে কিন্তু তোমাকে কখনো মা বলে ডাকবে না আর।
অভিরূপ প্রথমে বুঝতে পারেনি চারু তার লুকায়িত সত্যিটা জেনে গেছে আর তার শাস্তি স্বরুপ তার সাথে এক ছাঁদের নিচে থাকলেও তার সাথে কখনো কোন বাক্যবিনিময় আর করবে না তার বিবিজান।
বরং তারা সবাই ভেবেছে চারু তার নিয়তি মেনে নিয়েছে,শেষ থেকে নতুন করে সবটা শুরু করেছে কিন্তু কেউ ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি চারুও অনুজের দেখানো পথ অনুসরন করবে,আর ভালোবাসার তাগিদে নয় দায়িত্ব পালনের জন্য সে সবার সামনে ভালো থাকার অভিনয় করে যাবে কিন্তু দিন শেষে সে যে কতটা আত্মগ্লানিতে ভুগে তা কেউ কখনো দেখেনি।

সেদিন,
অভিরূপকে ফ্লাইটের টিকিট বুক করতে বলে চারু নিজের বেগ প্যাক করতে যায়।পরে একটা দরকারে মায়ের ঘরে আসলেই সে শুনতে পায়,
=মামী চারু যদি কখনো জানতে পারে আমি সবটা জেনেও তাকে কিছু বলিনি তাহলে সে যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়,তাহলে আমি কী করে বাঁচবো বলুন তো।

=চুপ কর রূপ এসব কথা এখানে বলিস না।তুই নিশ্চিত থাক চারু এসব কথা কখনো জানবে না
আর ওর আর অনুজের ডিভোর্স যে আমি উকিলকে দিয়ে তাড়াতাড়ি করিয়েছি সেটাও যেনো চারু না জানে।তাহলে সবটা এলোমেলো হয়ে যাবে আবার, এবার আমি চাইলেও আর কিছু ঠিক করতে পারবো না।আর যদি জেনেও যায় তাহলে আগেরবার বিয়েতে যেভাবে রাজি করিয়েছি এবারেও তাই করবো।

অভিরূপও এর সাথে জড়িত জানার পর নিজেকে বড্ড ছোট মনে হলো চারুর।সেদিন বাবা-মায়ের ব্ল্যাকমেইলের স্বীকার হয়ে অভিরূপকে সে বিয়ে করলেও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি কোনদিন। কিন্তু তার প্রতি লোকটার এতো ভালোবাসা দেখে একটা সময় সে দূর্বল হয়ে পরে ।ভেবেছিলো অনুজ-তরু নিজেদের জীবনে এগিয়ে যেতে পারলে সে কেনো পারবে না,আর অতীত আঁকড়ে জীবনে চলা যায় কয়দিন তাই মেনে নিয়েছিলো নিজের নিয়তি।কিন্তু সেই অভিরূপও তাকে ঠকিয়েছে এযেন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। তবুও বাস্তবতা তাকে মেনে নিতে হবে।।
সবটা জানার পর আর বিদেশে ফিরে যায়নি চারু।স্নেহা আর ফুফিকেও দেশে আনিয়েছিলো সে।এরপর বাংলাদেশেই আবার থাকা শুরু করে।
কিন্তু মনের মাঝে এক আলাদা দহন হতো তার প্রতিনিয়ত।তার একটা কর্মের শাস্তি আজ এতোগুলো বছর কতগুলো মানুষ পেলো।তার হয়তো অনুজের সাথে শেষবার কথা বলে সবটা ক্লিয়ার হওয়ার দরকার ছিলো।তাহলে এতো কিছু ঘটতো না।যে আত্মগ্লানি থেকে চারুকে মুক্ত করতে অনুজ একদিন তরুর দায়িত্ব নিয়েছিলো তার ভালোবাসাকে বাজি রেখে সে আত্মগ্লানির দহন শেষ পর্যন্ত চারুকে না ছুঁয়ে পারেনি।সেদিনের পর প্রতিটি রাত তার চোখের পানি ঝরেছে।এক অদৃশ্য দেয়াল টেনেছিলো অভিরূপের সাথে।নিজের মেয়েকে নিয়েই যেন তার জীবন আশেপাশের বাকি সব কিছু ফিকে ছিলো তার কাছে।
মাঝে মাঝে স্নেহাকে স্কুলে দিয়ে সে লুকিয়ে লুকিয়ে অনুজকে দেখতে যেতো।এই মানুষটা আজ তাকে ভালোবেসে পাগল।কী অদ্ভুত এই ভালোবাসা, একটা মানুষকে যেমন জীবন দান করে তেমনিই দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিতেও জানে।
ধর্মের দেয়ালে অনুজ আজ তার কাছে হারাম কিন্তু ভালোবাসা তো এতোকিছু বোঝে না।তাইতো সময় পেলেই ছুটে যেত সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে অনুজকে চোখ ভরে দেখতো আর নিজের হটকারিতার জন্য আফসোস করতো।ইশ পিছনের সময়টা যদি আবার ফিরে আসত তবে সে কখনো অনুজকে আর ভুল বুঝতো না,কিন্তু সময় সে তো বহমান।একবার গেলে সে কী আর ফিরে আসে!
লজ্জায়, ঘৃনায় আর আত্মগ্লানিতে সে আর অনুলেখার সাথে দেখা করেনি।অনুলেখা অবশ্য তার সাথে অনেকবার দেখা করতে এসেছিলো কিন্তু চারু লজ্জায় তার মুখোমুখি আর হয়নি।তার জন্যই তো আজ অনুলেখার একমাত্র ভাই পাগল হয়েছে কোন মুখে দেখা করবে সে।
চোখ বন্ধ করে নিজের সমস্ত অতীতটা একবার ভেবে নিলো চারু,তরু মেয়েটা ছোটবেলা বাবা-মাকে হারিয়ে তাদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলো।তরুর বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ পরিচালনা করেই তার বাবা শহরের নাম করা ব্যবসায়ী হয়েছিলেন,কিন্তু বেঁচারি তরু তার কোন ভাগই পায়নি উল্টো আশ্রিতার মতন থেকেছে তাদের বাসায়।চারু যতটা সম্ভব তরু সব সময় আগলে রাখার চেষ্টা করতো।কিন্তু বিয়ের পর সে যেনো তরু নামের মেয়েটির কথা একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলো। সে যদি বিয়ের পরেও তরুর সাথে সৌহার্দ্যপূর্ন সম্পর্ক রাখত তাহলে তরু হয়তো তুষারের নোংরা ফাঁদে পা দিতো না।
আবার ভাবলো অনুজের কথা যে মানুষটা সন্তান হবে না জেনেও চারুকে কখনো ছাড়তে রাজি ছিলো না সে মানুষটাকেই ভুল বুঝেছে চারু।সে চোখের সামনে দেখা কিছু ঘটনাকেই বিশ্বাস করে ভুল বুঝে ছেড়ে এসেছিলো অনুজকে।তার একবার অন্তত অনুর কথা শুনে তরু-অনুজের সাথে শেষবারের মতন কথা বলা উচিত ছিলো।কিন্তু তা সে করেনি,বরং বাবা-মায়ের মিথ্যে অভিনয়ের কাছে পরাজিত হয়ে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলো অভিরূপকে।সে যদি অভিরূপ কে বিয়ে না করতো তাহলে হয়তো আজ অনুজ সুস্থ থাকতো।
কিন্তু তরু কিছু না বললেও,অনুজ মিথ্যে বললেও এখানে তারও যে দোষ আছে তা জানে চারু।কিন্তু শুধুমাত্র স্নেহার দায়িত্ব নিয়েছিলো বলেই আজও সে নিজের জীবনটা রেখেছে।
অবশেষে চারুর সব দায়িত্ব ফুরিয়েছে,স্নেহাকে পড়াশোনা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করিয়ে আজ বিয়ে দিয়েছে তারই পছন্দের ছেলের সাথে।ছেলেটা বড্ড ভালো তা বুঝতে পেরেছিলো চারু,তাইতো এবার নিজের নেয়া দায়িত্ব স্নিগ্ধের হাতে তুলে দিয়ে আজ সে নিশ্চিন্ত।

ড্রয়ার থেকে একটা পুরোনো ডায়েরি বের করলো চারু।তার ভিতর থেকে বহু বছরের পুরোনো একটা ছবি বের করে তার দিকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। অনুজ মারা গিয়েছে কয়েক মাস হলো,এবার চারুরও সব দায়িত্ব শেষ তাই সেও তার তরু আর অনুজের কাছে ফিরে যেতে চায়।এ জীবনে বেঁচে থাকতেও তার আর অনুজের মিল হয়নি কিন্তু সে তার পরকালে অনুজকেই নিজের পাশে চায়।শাড়ির আঁচল থেকে কতগুলো ঔষুধ একসাথে মুখে পুরে নিলো সে।
বাহিরে আজও শ্রাবণের সেই তুমুল ধারা বইছে বাহিরে।বহু বছর আগে এমনই এক শ্রাবণের ধারায় তার জীবনের যে ঝড়ের শুরু হয়েছিল আজ সেই শ্রাবণের ধারাতেই সবটা শেষ হলো।ভুল যেনো সবটাই ভুল।ঝাপসা চোখে অনুজের হাস্যোজ্বল ছবিটিকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে চারু পাড়ি জমায় তার সত্যিকারের সুখের কাছে!!!
এভাবেই শেষ হয় চারু, তরু আর অনুজের শ্রাবণ মাসের হঠাৎ ঝড়ের গল্প।
তরুর যেমন ভালোবেসে ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকে নিজের জীবন দিয়েছে,অনুজ যেমন দায়িত্বের জন্য ভালোবাসা হারিয়ে উম্মাদ হয়েছে তেমন চারুও এতোবছরের আত্মগ্লানির দহন থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুকেই বেঁচে নিয়েছে । পৃথিবীতে সবাই ভালোবাসা চায় দিনশেষে কয়েকজন নিজের সত্যিকারের ভালোবাসাকে পায়?
তাই যারা এতোটুকু ভালোবাসা পাচ্ছেন প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে তাকে কখনো অবহেলায় হারাতে দিবেন না।আগলে রাখুন তাকে।হ্যাঁ অবশ্যই ভালোবাসার চেয়ে নিজের আত্মসম্মান বড় তাই বলে সেই আত্মসম্মানকে কখনো আত্ম অহংকারে পরিবর্তন করবেন না।
ভালো থাকুক এ পৃথিবীর সকল ভালোবাসার মানুষগুলো সে প্রত্যাশা রেখে শেষ করলাম শ্রাবণের অশ্রুধারা।

(কিছু কথা,
একসাথে সবাইকে খুশি করা যায়না। তাই গল্পের শেষটা অনেকের ভালো নাও লাগতে পারে তাতে আমি দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবো না।তবে যারদ আবেগ নয় বাস্তবতা দিয়ে বিচার করবেন আশা করি তারা গল্পের শেষটা নিয়ে আর অভিযোগ করবেন না।এখানে সবারই ভুল ছিলো কারো কম,কারো বেশি।আর গল্পে কাহিনি যাই হোক না কেনো শেষে নায়ক-নায়িকার মিলটাই ঘটাতে হবে এমনটা কিন্তু নয়।এখানে আমি একজন নারী হিসেবে বিচ্ছেদটাকেই সাপোর্ট করেছি তাই সেটাকে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করেছি।
তুষারের পরিনতি টা নাহয় আপনারা নিজেদের মতন ভেবে নিবেন।যারা মনে করেছেন গল্প পড়ে আপনাদের সময় অপচয় হয়েছে তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।অবশেষে একটাই প্রশ্ন পাঠকদের কাছে রেখ যাবো,বাস্তবে কী কখনো মিথ্যে বলে আপনার জীবনে ভালো কোন কিছু হয়েছে?মিথ্যে বড় হোক কিংবা ছোট সেটা কিন্তু মিথ্যেই হয়।
ধন্যবাদ সবাইকে।)