শ্রাবণের অশ্রুধারা পর্ব-০৯

0
261

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#পর্ব_৯
#কলমে_আসমা_মজুমদার_তিথি

রাতে চারুকে ওয়াদা দিয়ে ভুল করেছে অনুজ সেটা এখন হারে হারে বুঝতে পারছে অনুজ।এজন্যই বুঝি কেউ একজন বলেছিলেন, মা জেনেশুনে কখনো কাওকে কোন প্রতিশ্রুতি দিও না।সে যদি একটি টের পেতো চারু তাকে দিয়ে এমন এক কঠিন ওয়াদা আদায় করে নিবে তবে সে কখনোই সে ওয়াদা তার লতাকে দিতো না।কিন্তু পরিস্থিতি এখন তার অনূকূল সে এখন না পারছে এগুতে, আর না পারছে পিছোতে।সে যদি এগোয় তাহলে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাবে,আর যদি পিছোয় তবে যদি চারুর কোন ক্ষতি হয় তবে সে তা কখনোই মেনে নিবে না।কার অনুজ যে তার চারুলতাকে খুব ভালোবাসে,একটু বেশিই ভালোবাসে।সে কী করে চারুহীন বাঁচবে!
এসব কথা চিন্তা করতে করতেই ভারাক্রান্ত মন নিয় সে অফিসে যাচ্ছে। কিছু ইমপোর্টেন্ট কাজ আছে যা তাকেই হ্যান্ডেল করতে হবে তাইতো মনের কষ্টকে সাইডে রেখে সে নিজের কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছে। এর মাঝেই অনুজ পড়লে ঢাকা শহরের বিখ্যাত জ্যামে।জ্যামে বসেও তার কেমন অস্থিরতা লাগছিলো।গাড়ির মধ্যেই উশখুশ করছে সে।এর মাঝেই তার দৃষ্টি যায় ঢাকা শহরে ব্যস্ত রাস্তায় কোন এক শাড়ী পরিহীতা নারী রাস্তার মাঝে এলোমেলো ভাবে হাটছে।এভাবে হাটলে যে কিছুক্ষণের মাঝেই একটা অঘটন ঘটবে তা গাড়ীতে বসেই সে ভেবে নিলো।মানবিকতার খাতিরে সে নেমে গেলো গাড়ি থেকে।নেমেই ছুটলো ওই মেয়েটির দিকে।কাছাকাছি যেতেই সে দেখলো উল্টো দিক থেকে একটা ট্রাক খুব দ্রুত গতিতে মেয়েটার দিকেই এগিয়ে আসছে।তা দেখে অনুজ আরও জোরে দৌড় দিয়ে মেয়েটাকে মুহূর্তে টান দিয়ে রাস্তার একটা ফুটওয়েতে ফেলে দিলো।মেয়েটার এতোক্ষণে যেনো হুশ এলো,সে মাটি থেকে উঠে পাগলের মতন বারবার বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো।আর অনুজকে বলতে লাগলো কেনো অনুজ তাকে বাঁচালো?সে তো আর বাঁচতে চায় না এজন্যই তো সে মৃত্যুর পথটাকে বেঁচে নিয়েছে।এতোক্ষণে মেয়েটার মুখ দেখে অনুজ থমকে গেলো।এখানে এমন একটা পরিস্থিতিতে যে সে তরুকে দেখতে পাবে তা সে কল্পনায়ও ভাবেনি।কিন্তু মেয়েটার হয়েছেটা কী যে সে এখন আত্মহননের মতন এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।চারুর সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকেই তরুকে নিজের ছোট বোনের মতন দেখে এসেছে।এই দুঃখী মেয়েটাকে তার বড্ড আপন লাগে।তাইতো রক্তের সম্পর্ককে ছাড়িয়ে তারা দুজন দুজনকে ভাই-বোনের মতন শ্রদ্ধা করে,ভালোবাসে।সেই তরুর এমন পরিস্থিতি যেনো একটা বিষ্ময় মনে হলো অনুজের।সে বারবার তরুকে জিজ্ঞেস করছে,
=তোমার কী হয়েছে পিচ্চু, কেনো তুমি এমন পাগলামো করছে।কেনো নিজের জীবন শেষ করতে চাইছো তুমি।আমাকে বলবে না,তুমি তোমার ভাইকে বলবেনা পিচ্চু।
কিন্তু এতেও কোনো ভাবের পরিবর্তন হয়না তরুর। সে কেবলই আত্মহত্যা কারার জন্য মাঝ রাস্তায় ছুটে যেতে চাইছে।কিন্তু অনুজের শক্ত পুরুষালি হাতের বাঁধন ছেড়ে সে দৌড়ে যেতে পারছে না।আর এদিকে তরুর এমন পাগলামো দেখে একটা সময় ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায় অনুজের।তারুর কান বরাবর দিলো একটা থাপ্পড়,,,,, এরপর__________!

_____________________________________
রহিমা বেগম বাহিরে এসেই অনুকে ফোন করলো,
ফোন রিসিভ হতেই অনু কিছু বলে উঠার আগেই তিনি বলেন,
=আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করছে অনু।তুই খুব শীঘ্রই ফুফু হতে চলেছিস।
অপর পাশে তখন নিস্তব্ধতা হয়তো ফোনের অপারের ব্যাক্তিটি ঠিক কি রিয়াকশন দিবে বুঝে উঠতে পারছেনা।
এদিকে অনু খুশিতে বাক্যহারা হয়ে গেছে ভেবে রহিমা বেগম দুবার হ্যালো হ্যালো বলে লাইনটা কেটে দিলেন।তার এখন অনেক কাজ,সবাই কে জানাতে হবে তো তার বংশের বাতি আসছে এতো বছর পর,তাছাড়া মাদ্রাস এতিম বাচ্চাদেরও খাওয়াবেন বলে তিনি ঠিক করেছেন।অবশেষে তার মনের বাসনা পূর্ণ হতে চলল।তিনি দাদু হচ্ছেন এর চেয়ে বড় খুশি তিনি হয়তে স্বর্নের খনি পেলেও খুশি হতেন না।আনন্দে গদগদ হয়ে তিনি মহসিন আহসানকে ফোন দিলেন খুশির সংবাদ দিতে আর বাসায় মিষ্টি আনিয়ে রাখতে।তিনি নাতি আসার খুশিতে পুরো মহল্লায় আজ মিষ্টি বিতরণ করবে।



অনু বাচ্চাকে খাওনোর বর্থ চেষ্টা করতে করতে বড্ড ক্লান্ত। তার এই দস্যি মেয়ের জন্য তার চিন্তার শেষ নেই।মেয়েটা অতিরিক্ত চঞ্চল। এ নিয়ে যদি সে নির্ভীককে কিছু বলে তবে সে বলে,
=তোমার মেয়ে তোমার মতন হয়েছে। পুরাই বিচ্ছুর রানী।
ব্যস এর পরেই বাচ্চাকে রেখে তুমুল ঝগড়া লেগে যায় তাদের। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।নির্ভীক-অনু যখন নিজেদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি করছিলো তার মাঝেই তাশরীন (অনুর মেয়ে)এসে মায়ের শাড়ির আঁচল টান দেয়।আঁচলে টান পড়ায় অনু মেয়ের দিকে ঝুকতেই তাশরীন বলে,
=মামীমা কই আম্মু, মামীমা কই।আমি মামীমার সাথে খেলা করবো।
মেয়ের কথায় অনুরও হঠাৎ মনে পড়লো তারা ছাড়াও ওদের বাসায় এখন চারুরও বাস।কিন্তু এতো চেচামেচির পরও চারু একবারোও রুম থেকে এলো না ভাবতেই সে একটু অবাক হলো।সচরাচর চারু এমনটা করেনা,তারউপর মেয়ে বলছে চারু ঘরে নেই তাহলে চারু গেলো কোথায়।সে নির্ভীকের সাথে ঝগড়া বাদ দিয়ে ছুঁটলো চারুর রুমের দিকে।উত্তরের প্রশস্ত রুমে ঢুকে চারুকে দেখতে পেলো না অনু।সে তখন ভাবলো হয়তো বারান্দা কিংবা ওয়াসরুমে আছে চারু।সেই স্থানগুলোও দেখলো।কিন্তু নাহ্ চারু নেই,অনুর খোঁজাখুঁজি দেখে নির্ভীকও তার সাথে পুরো বাড়ি খুঁজলো চারুকে,এমনকি সামনের রাস্তাটায় ও একবার দেখে এলো নির্ভীক।কিন্তু চারু নেই,কোথাও নেই,হঠাৎ যেন কর্পূরের মতন উবে গেছে চারু।হঠাৎ চারুর চলে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলো না অনু।পরে আবার ভাবলো হয়তো কাল সে তাকে সবটা বুঝিয়েছে বলে আবার সেই বাসায় ফিরে গিয়েছে। তাই সে দ্রুত ঘরে গিয়ে নিয়ে ফোন হাতে নিলো মাকে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হতে আদৌও চারু ওবাড়ি গিয়েছে কিনা।
রহিমা বেগম অনুর ফোন পেয়েই সাথে সাথে তা রিসিভ করে বলেন,
=কিরে ফুফু হবি শুনে তোর কথাই বন্ধ হয়ে গেলো
যে তখন কোন কথাই বললিনা।
মায়ের কথা শুনে অনু যেনো আকাশ থেকে পড়লো এমন অবস্থা, সে তার মায়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।তাই সে মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
=কিসব বলছো মা,আমি ফুফু হতে চলেছি মানে চারু কী প্রেগন্যান্ট?

=চারু নয় তরু আমার ছেলের সন্তানের মা হতে হলেছে অনু।
মায়ের কথা শুনে তরু যেনো এবার সত্যি সত্যিই বাকহারা হয়ে গেলো,নিজেকে সামলে কিছুক্ষণ পরে সে তার মাকে কিছুটা রেগে বলে,
=মা তোমার কী জ্ঞান -বিবেচনা বোধটুকুও লোপ পেয়েছে,যে দিনের বেলা এসব অবাস্তব কথাবার্তা বলছো।তরু কী করে প্রেগন্যান্ট হয়?

=অনুজ তরু বিবাহিত ওদের সন্তান হওয়াটা কী স্বাভাবিক নয় অনু।
কিছুটা রেগে বলেন রহিমা বেগম।মায়ের রাগের তোয়াক্কা না করে অনু উল্টো চেচিয়ে তাকে বলে,
=মা তুমি বংশ রক্ষায় এতোটাই অন্ধ হয়ে আছো যে ঠিক-বেঠিক তো দুরস্ত তো লজিক্যালি কোন কিছু ভাবার পর্যায়েও নেই।

=কি বলছিস কী তুই এসব!

=আমি ঠিকই বলছি মা।দেখো তোমার ভাষ্যমতে তরুকে ভাইয়া বিয়ে করেছে,এবং এখন ওর গর্ভে ভাইয়ার সন্তান তাইতো।

=এগুলো বলে তুই কী বোঝাতে চাইছিস অনু?

=মা একটু বুদ্ধি খাটিয়ে ভাবোতো বিয়ের একসপ্তাহ গড়াতে না গড়াতেই তরু প্র্যগনেন্ট।এটা আদৌও কী বিশ্বাসযোগ্য কথা তুমিই বলো?.

=এখানে তুই অবিশ্বাসের কী দেখলি অনু?

=খুশিতে আত্মহারা না হয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করো উত্তর পেয়ে যাবে।
বলেই ফোনের লাইনটা কেটে দিলো অনু।লাইন কাটতেই তার মোবাইল স্কিনে মায়ের নাম্বার থেকে আরোও আধা ঘন্টা আগের মিসড কল ভেসে উঠলো।কিছু একটা ভেবে অনু মায়ের কল লিস্ট টা চেক করতেই বুঝে গেলো মায়ের কলটা তখন চারুই রিসিভ করেছে,আর মা অনু ভেবে হয়তো তরুর প্রেগন্যান্সির কথাটা চারুকেই বলেছে।তাহলে কী চারু আবার অনুজকে ভুল বুঝলো?তরুর গর্ভে অনুজের বাচ্চার কথা শুনে কী তবে এবার চারু তার আশ্রয় ছেড়েও চলে গেলো,কিন্তু কোথায় গেলো চারু,এতো কষ্ট করেও সে তার ভাইয়ের ভালোবাসাটাকে আগলে রাখতে পারলো না।এখন তার ভাইয়ের কী হবে তা ভেবেই অনুর কষ্ট হচ্ছে।
চারু নেই,চারুহীন অনুজ যে তবে প্রান হীন দেহ নিয়েই কেবল বেঁচে থাকবে!

অতঃপর আরোও কিছু দিন চলবে,,,