ইরাবতীর চুপকথা পর্ব-০১

0
731

#ইরাবতীর চুপকথা
লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ১

রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার আগ মুহুর্তে বিয়ের পাত্র উঠে দাড়ালো। চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,

‘ একজন ধর্ষিতা মেয়েকে কিছুতেই বিয়ে করবো না আমি। বিয়ের দু’দীন আগে যে মেয়েটা রেপ হয়েছে, তাকে তো নয়’ই। ‘

পাত্রের হঠাৎ হুংকারে স্তব্ধ হয়ে গেলো পুরো বিয়ে বাড়ি। গমগমে পরিবেশ হয়ে উঠলো শীতল, নিশ্চুপ। আত্বীয় স্বজন যেন চমকে উঠলেন আকাশের কথায়। সাথে চমকে উঠলো ইরাও। কি শুনলো সে? ধর্ষিতা? কে? ইরা? নাক অব্ধি টানা ঘোমটাটা কিঞ্চিৎ তুলে তাকালো তার হবু স্বামীর দিকে। আকাশের মুখশ্রী লাল টকটকে।কন্যার পাশে বসে থাকা কন্যার পিতা সাদিক সাহেব তিনিও চমকালেন আকস্মিক ঘটনায়। কেদারা ছেড়ে আড়ষ্ট গলায় বলে উঠলেন,

‘ এসব তুমি কি বলছো আকাশ? বিয়ে করবে না মানে? ‘

আকাশ আরও গর্জে বলে উঠলো,

‘ বিয়ের দু’দীন আগে যে আপনার মেয়ে রেপ হয়েছিলো সেটা গোপন কেন করেছেন আমাদের থেকে? একজন ধর্ষিতা মেয়েকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিলেন? এতটুকু লজ্জা নেই আপনাদের? ‘

সাদিক সাহেব ভেবে পাচ্ছেন না কি থেকে কি হচ্ছে। ফুলের মতো মেয়েটাকে ‘ধর্ষিতা’ তকমা লাগিয়ে দিলো কেউ? কেন? পাত্রের পিতা উঠে দাড়ালেন পাশ থেকে। নিজের ছেলেকে একটানে নিজের দিকে ফিরিয়ে শাসিয়ে উঠলেন,

‘ এসব কি বলছো তুমি? যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছো-‘

পিতার শাসিত কন্ঠ এতটুকু রাগ দমাতে পারলো না আকাশের। আকাশ দু হাত মুঠো করে তাকালো ইরার বাবার দিকে। রাগঝড়া গলায় বলে উঠলো,

‘ তুমি ওনাদের জিজ্ঞেস করো বাবা। জিজ্ঞেস করো, দুদীন আগের ঘটনা মিথ্যা কি’না। আমি মিথ্যা বলছি কিনা। ‘

ইরার মা কোথথেকে ছুটে এলেন। হু হু করে কেঁদে বলে উঠলেন,

‘ এসব মিথ্যা বাজান, আমার মেয়ে পবিত্র। কেউ মিথ্যা লুটিয়েছে। ‘

‘ মিথ্যা? কিসের মিথ্যা? আপনাদের লোকই বলেছে কথাটা। এ বিয়ে আমি কিছুতেই করবো না। মা, চলো এখান থেকে। ‘

আকাশের মা তাকালেন বধূরুপে বসে থাকা ইরার দিকে। মুখ কালো করে তিক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ চল, যে যাই বলুক না কেন! একবার যখন শুনেছি এই মেয়ে বারোনারী তখন আর এ বাড়িতে বিয়ে দেবার প্রশ্নই আসে না। চলুন আকাশের বাপ! আর থাকার মানে হয় না এখানে। ‘

তৈমুর আলী তিক্ন দৃষ্টিতে তাকালো ইরার পরিবারের দিকে। তার চোখে ঘৃনা। বড্ড জ্বলছে তার। ছেলের বিয়েতে এসে যে এভাবে ঠকবেন আশা করেননি উনি।আর যাই হোক, সরকারি চাকুরি করা ছেলের সাথে তো আর পতিতার বিয়ে দেয়া যায় না। যেই হাটা ধরবেন, সাদিক সাহেব ছুটে এলেন আকাশের বাবার সামনে। দুহাত উঁচু করে করে আকুতির স্বরে বললেন,

‘ এমন করবেন না! আমার মেয়ে এমন নয়। এ বিয়ে ভাঙবেন না। কেউ হিংসায় খারাপ কিছু বলেছে হয়তো। মেয়েটাকে বিয়ে দিতে সমস্যায় পড়ে যাবো। ‘

সাদিক সাহেবের আকুতি শুনলো না কেউ। পাত্রপক্ষ হতে আসা আত্মীয়-স্বজন স্ব স্ব ভাবে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। মাথার পাগড়ি ছিটকে ফেলে দিলো আকাশ। আসরের এক কোনে পড়ে রইলো তা। অতঃপর বেড়িয়ে গেলো। তৈমুর আলী সাদিক সাহেবকে বেশ কড়া ভাবে বলে গেলেন,

‘ যে মেয়ের মাঝে সতিত্ব নেই, তাকে আমার ছেলের সাথে বিয়ে দেব না! ‘

বলেই বেড়িয়ে গেলেন তিনি। সাদিক সাহেব ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। তার বুকটা হাহাকার করছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো। প্রানপ্রীয় মেয়েকে বিয়ের আসরে এসে পেলো ধর্ষিতা আখ্যা। মেঝেতে দু হাত দাপড়িয়ে কেঁদে উঠলেন সাদিক সাহেব। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কে এতো বড় শত্রুতা করলো? কেন ভাঙলো এ বিয়ে? ইরার মা ছুটে গেলেন ইরার কাছে। জড়িয়ে নিলেন বুকে। কষ্টটা বেড়ে দ্বিগুণ হলো যেন। মেয়ের দেহ আঁকড়ে বাধভাঙ্গা নদীর মতো কেঁদে উঠে বলতে লাগলেন,

‘ এ কি হলো আমাদের? কে লটালো এমন কুৎসিত কথা? মেয়েটার ভাগ্য কি এতটাই খারাপ? ‘

এতক্ষণ নিশ্চুপ থাকা ইরা ঘোমটা তুললো। তার আঁখি অশ্রুসিক্ত। ফর্সাসাদা গালদুটি লাল,ভেজা। চোখমুখ শক্ত। অথচ, তার বুকে চলছে প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডব। হবু শ্বামীর মুখে ‘ধর্ষিতা’ শব্দটি একজন নরীর পক্ষে সহ্য করা কতটা কঠিন ইরা যেন হারে হারে টের পাচ্ছে। কে করলো এমন কুটিল কাজ? কে ভাঙলো তার বিয়ে? আপাতত ইরার চিন্তা এসবে নেই। তার সতিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সে নাকি ধর্ষিতা! যে ছেলেটা কালই বলেছিলো, তোমার অতিতে যাই থাকুক, আমি তোমাকেই ভালোবাসি। আর আজ কোথ থেকে মিথ্যে একটি কথায় ভেঙে দিলো বিয়ে। উঠে চলে গেলো আসর থেকে। শুকনো ডোগ গিলে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো ইরা।

ইরার ভাবি ইলিমা কোথ থেকে ছুটে এলেন। ইরার পাশে বসে কর্কষ গলায় বলে উঠলেন,

‘ কার কাছে নিজের দেহ বিক্রি করেছিস ইরা? বরপক্ষ মিথ্যে বলছে না নিশ্চই? ‘

ইরা ঘোলাটে চোখে তাকালো। এতো প্রীয় ভাবি ও যে এক বাক্যে কথাটা বিশ্বাস করবে আশা করেনি ইরা। ইরার মা চিৎকার দিয়ে উঠলেন,

‘ এসব কি বলছো বৌমা? তোমার কি মনে হয় আমাদের ইরা এসব করতে পারে? ‘

‘ সামনে যতোই ভালো দেখাক মা, দেখো ভেতরে ভেতরে হয়তো…! ‘

ইলিমাকে থামিয়ে ধমকে উঠলেন ইরার মা,

‘ বৌমা! ‘

‘ ধমকে কি কোন লাভ আছে? যা করার তো করেই ফেলেছে। আগেই যদি পায়ে শিকল দিতেন, আজ আর এই দিনটা দেখতে হতো না! ‘

বিয়ের আসর এখন সমালোচনায় ভরপুর। সবাই ইরাকে ছি ছি করতে ব্যাস্ত। কেউবা ছিলো এর’ই অপেক্ষায়। এমনকি খুব কাছের মানুষগুলো,আত্মীয়-স্বজন সান্তনা দেবার বদলে দিয়ে গেলো আরও বিষাক্ত উক্তি। কিছু কিছু মানুষ তো মুখের উপরেই বলে ফেললো,
‘ কবে থেকে মেয়েকে দিয়ে এসব অকাম-কুকাম চলাচ্ছেন? পাড়ার মান-মর্যাদা সব শ্যাষ! এই মেয়ের তো গলায় ফাসি দিয়ে মরা উচিৎ! ‘
এসব কথা ইরার কান অব্দি পৌঁছাতে পেরেছে কি না বোঝা গেলো না। মন খানিক ওজনের ভারি লেহেঙ্গার ওড়নাটা এক হাতে পেঁচিয়ে এক ছুটে নিজের রুমে চলে গেলো ইরা। সে হঠাৎ কান্ডে স্তব্ধ! তার কানে বরংবার বেজে চলেছে ধর্ষিতা শব্দটি। কয়েক’শ লোক তাকে গালি দিলো, কটু কথা বললো, ঘৃণা ও করলো! ছিহ্! ইরার মন চাইছে মরতে। জিবন শেষ করে দিতে। গলায় ফাঁস নিতে। আর যাই হোক সতিত্ব নেই, ধর্ষিতা নামক এক দলা বিষ নিয়ে এ জিবন রাখার মানে হয় না। মনে মনে ইরা স্থির করলো আজই সে আত্মহত্যা করবে। পাড়াপ্রতিবেশির গালাগাল তার পিতা সাদিক সাহেব সহ্য করতে পারবেন না। হয় হার্ট এট্যাক করবেন, নয়তো উনি আত্মাহত্যা করবেন। তার থেকে ভালো নয় কি ইরা নিজে মরে সবাইকে বাঁচানো? এটাই ঠিক! হাতে পেঁচানো ওড়নাটা বিছানায় ছুড়ে মারলো ইরা। টি-টেবিলের পাশে থাকা চেয়ার টেনে ফ্যান বরাবর দাড়ায় ইরা।

সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে পুরো ঢাকা শহর। এর থেকেও আধার আজ ইরার মনে। ফ্যানে ওড়না বাঁধা শেষ। এখন মুক্তির পালা। আজ ইরা ভীতু। নিজেকে এতোটা ভিতু দেখে নিজেই চমকালো সে। তবুও! সে এভাবে বাঁচতে পারবে না। কিছুতেই না। ফাঁসে মাথা ডুকানোর আগ মুহুর্তে ঘটে গেলো অদ্ভুত এক ঘটনা। পুরুষালি স্বরে বুক কেঁপে উঠলো ইরার,

‘ বলেছিলাম না, আপনার বিয়ে ভাঙবো মিস ইরাবতী? ভেঙেছি। আমি কথা রেখেছি। আপনি যে এতোটা ভিতু জানা ছিলো না। ওপাড়ে ভালো থাকবেন। ‘

সোডিয়ামের আলকা আলো এসে পড়েছে বেলকনিতে। তাতে স্পষ্ট একটি পুরুষের অবময়। ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইরা। আগুন্তক বেলকনি থেকে ঘরে এলো। সুঠাম সুন্দর দেহ। পরনে সাফেদ শার্ট, বলিষ্ঠ দেহে ফুটে উঠছে প্রতিটি পেশি। ফুল ব্লাক প্যান্ট। মাখে কালো মাস্ক। ইরা থমকে গেলো। আগুন্তকঃ ছোট্ট একটা হাসি হেঁসে আবারো বেলকনির মৃদু আবছা আলোয় হাড়ালো। ইরা চিনলো না, বুঝলো না। শুধু মনে হলো, সে জ্ঞান হাড়ালো।

[চলবে…..]