শ্রাবণের অশ্রুধারা পর্ব-০৮

0
292

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#পর্ব_৮
#কলমে_আসমা_মজুমদার_তিথি

তুষারের সাথে তরুর পরিচয় হয় একটা ফেসবুক গ্রুপে।একটা পোস্টের কমেন্টের মাধ্যমেই দুজনের প্রথম আলাপ।এরপর সেই আলাপ ধীরে ধীরে পরিনত হয় প্রনয়ে।যা একটা সময় গভীর প্রনয়ের পর্যায়ে চলে যায়।অল্প বয়স,স্বল্প অভিজ্ঞতা সম্পন্ন তরু ভালেবেসে স্বপ্ন বুনতে থাকে তুষারকে নিয়ে।কিন্তু তুষার তার মনে তরুর জন্য ভালোবাসা বা মোহ কোনটাই নয় বরং রয়েছে একরাশ ঘৃণা যার বিন্দুমাত্র আঁচ তরুলতা করতে পারেনি।যদি আঁর করতে পারতো তাহলে সে ওই ভুল মানুষটাকে ভালোবেসে নিজের ক্ষতিও করতো না আর ওই মানুষটার মনোঃকামোনাও পূর্ণ হতে দিতো না।

তুষার হলো চারুর ভার্সিটির এক সিনিয়র বড় ভাই
ছাত্রনেতাও ছিলো বটে,স্বভাব চরিত্র খুব একটা ভালো নয়।চারুকে ভার্সিটির প্রথম দিনই তার ভালো লেগে যায়।।চারু যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলো তখন থেকে তুষার নানা ভাবে নিজের মনের কথা চারুকে বুঝানোর চেষ্টা করতো।কিন্তু চারু বরাবরই তাকে উপেক্ষা করে যেতো।একটা পর্যায়ে তুষার ঠিক করে যে সে সরাসরিই চারুকে নিজের মনের কথা জানাবে।তাই দেরি না করে এক বর্ষার ঝুম বৃষ্টির দিনে চারুকে ভালোবাসি কথাটি বলেই ফেলে সে।কিন্তু চারুর বরাবরই তুষারকে পছন্দ ছিলো না তার উপর তুষারের জন্য পুরো ক্যাম্পাসের প্রায় প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীই তাকে ভাবি ভাবি বলে ডাকতো,যেটা তার একদমই সয্য হতো না।তার ওপর তুষারের জন্য ভার্সিটির অন্য কোনো ছেলেরাও তার সাথে মিশতো না যদিও সে মিশতে চাইতো কিন্তু অপরপক্ষ থেকে তারা নাকচ করতো।তুষারের পাগলামোর জন্য অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো চারু।কিন্তু তুষার সরাসরি কখনো কিছু না বলায় সেও তার সঙ্গে কিছু করতে পারছিলো না।তাইতো সেদিন যখন তুষার ভরা বর্ষায় পুরো ভার্সিটির ক্যাম্পাসে সবার সামনে তাকে প্রেম নিবেদন করে তখন চারু তার এতোদিনকার ক্ষোভ এক সঙ্গে ছাড়ে তুষারের উপর।তুষারকে চরম অপমান করে সে রিজেক্ট করে দেয়।চারুর অপমানে তুষার সেদিন তাকে হুমকি দিয়ে বলেছিলো,”আমি এর চরম প্রতিশোধ নিবো চারুলতা,আজকের এ কাজের জন্য তুমি এমন শাস্তি পাবে যা তুমি তোমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখবে।আর ভাববে কেনো আমার সাথে এমনটা করেছো তুমি।”
কিন্তু চারু তুষারের সেই হুমকিকে আমলে নেয়নি।সে ভেবেছিলো তুষার হয়তো তাকে ফাঁকা হুমকি দিয়েছে। তাইতো সে আগের মতনই নরমাল লাইফ লিড করতে থাকে।এর কয়েকমাস পরেই অনুজের সাথে পারিবারিক মতে ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হয়ে যায় চারুর।বিয়ের পর নিজের নতুন জীবন নিয়ে এতোটা ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে যে তার মস্তিষ্কের কোনো কোনাতেও তুষারের নাম আর ছিলো না।

অন্যদিকে তুষার চারুর সব খবরই নিয়মিত রাখতো গোপনে।চারুর বিয়ের খবরটাও সে পেয়েছিলো সে কিন্তু তাতেও সে চুপ ছিল। কারণ তুষার জানতো চারুকে আঘাত করলে সে আঘাত একটা সময় চারু হয়তো ভুলে যেতো,নিজের জীনের এগিয়ে যেতো তাতে করে তুষারের রাগ বা ঘৃণা কোনটাই কমতো না।তাই সে চারুর দূর্বলতা খুঁজে বের করে তাকেই আঘাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।আর সে সেটাই করেছিলো।তরুকে নিজের ভালোবাসার জালে ফাঁসানো তুষারের বা হাতের কাজ ছিলো।তাইতো ফেসবুকে তরুর সাথে কথা বলতে বলতে একটা সময় তাকে তার প্রতি দূর্বল করে নিয়েছিলো।আর সেই দূর্বলতার সুযোগ নিয়েই তার চরম সর্বনাশে মেতে উঠতে উঠে পরে লাগে তুষার।
তরু তুষারকে অনেক ভালোবাসতো,আসলে অল্প বয়স তো তাই ডিপ্রেশনের সময় যাকে পেয়েছিলো তাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে সে।


তখন চারুর বাবা দেশের বাহিরে যান,আর তরু তার জেঠিমাকে বলে সে বন্ধুদের সাথে ট্যুরে যেতে চায়।চারুর মা প্রথমে রাজি মা হলেও তরুর জোরাজোরিতে শেষমেষ রাজি হয়ছিলো।তরুও খুশিমনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় নিজের ভালোবাসাকে চিরকালের জন্য নিজের করে পেতে।আসলে তুষার তরুকে বুঝিয়েছে তারা আপতত লুকিয়ে বিয়ে করে নিবে পরে তুষার যখন চাকরী পাবে তখন দুজনের বাসাতে জানাবে।তরু প্রথমে রাজি হয়নি কিন্তু তুষার তার কুচক্রী বুদ্ধি দ্বারা তরুকে শেষপর্যন্ত রাজি করিয়ে নেয় নিজের কথায়।তাইতো বাসায় মিথ্যে বলেছে সে।আসলে সেদিন সে আর তুষার বিয়ে করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।বাসার বাহিরে আসতেই তরুকে নিজের বাইকে বসিয়ে শাই করে চলে যায় তুষার।ঘন্টা দেড়েক পর একটা বাড়ির সামনে এনে বাইক দাড় করিয়ে তরুকে নিয়ে ভিতরে যায় তুষার।তরু তখনো বিষ্ময়কর চাহনি নিয়ে কেবল সবটা দেখছে।কিছুক্ষণ পরে যখন একটা ফ্ল্যাটে কয়েকজন লোকের সাক্ষীতে তাদের বিয়ে হয়ে যায় তখন তরু বুঝতে পারে তার জীবনের সমীকরণ ওই মুহূর্ত থেকে বদলে গেছে। পারত পক্ষে তরু তখনো বুজেনি তার জীবনে কী ভীষণ বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছিলো।
বিয়ে পড়ানোর পর তুষার কাজি আর তার বন্ধুদের নিয়ে বাসার বাহিরে চলে যায়।
বাহিরে আসতেই অনিক তুষারকে জিজ্ঞেস করে,

=কিরে শেষ পর্যন্ত তুই তরুকে সত্যি সত্যিই বিয়ে করে ফেললি?

তুষার রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলে,
=চোখের সামন সব সময় যা ঘটে তা সত্যি নাও হতে পারে,তার পিছনে হয়তো অন্য কোনোও সত্যিও থাকতে পারে বন্ধু!

=তার মানে তুই তরুকে বিয়ে করিসনি?

=করিনি সেটাতো বলিনি আবার করেছি সেটাও বলছি না।আমি শুধু আমার লক্ষ্যে পোঁছাতে চাই।এর জন্য যা করা লাগবে আমি তাই করতে রাজি।আমি শুধু ওই চারুলতার মস্তিষ্কে সারাজীবন অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া দেখতে চাই।
বলেই সে আবার ফ্ল্যাটের ভিতর চলে যায়।


রাত ১২,
দুজন মানুষের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বইছে দ্রুত গতিতে।দুটি দেহো কিছুক্ষণ আগে একে অপরের সাথে মিশে গিয়েছিলো,পৌঁছে গিয়েছে ভালোবাসার এক অতল সমুদ্রে। একজন ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পেয়েছে অন্যজন নিজের প্রতিশোধের এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে।দুজনের মুখেই তখন তৃপ্তির হাসি।কিন্তু সেই হাসির পিছনের কারণটা ভিন্ন।
________________________________________
সকালের স্নিগ্ধ আলোতে নিজের বাহুবন্ধনে চোখ খুলেই তরুকে দেখে একটা কুটিল হাসি দিলো তুষার।তরুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে সে বলছে,
=মেয়েটা বড্ড বোকা, বড্ড সরল,তাইতো তাকে ঠকাতে তার এতোটুকু পরিশ্রম হয়নি।যাক এরপরে তরুর সাথে সে এমন একটা কাজ করবে যার দরুন চারুলতা সারাজীবন নিজের মনের ভিতর গুমরতে থাকবে,চারুর চোখে যখন তার অপরাধবোধ যখন সে দেখবে তখনই তার শান্তি, তখনই সে তৃপ্ত। তার মনে তরুর জন্য একটু ভালোবাসা নেই শুধু আছে ঘৃণা! কিন্তু এখানে আদৌও তরু কী সে ঘৃণার যোগ্য কিনা তা একবারও বিবেচনা করেনি তুষার। সে শুধু নিজের স্বার্থে অনড়।
____________________________________
বর্তমান,
তরুকে হসপিটালে এডমিট করেছে অনুজ।সঙ্গে তার মাও এসেছে।ডাক্তার তরুর সব টেস্ট আর চেকআপের পর অনুজ আর রহিমা বেগমকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠায়,

=আচ্ছা পেশেন্ট আপনার কী হয় মি.অনুজ আহসান?
ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তর অনুজ দেয়ার আগেই রহিমা বেগম বলে উঠেন
=আমার ছেলের বউ।কেনো ডাক্তার তরুর কী কেনো সিরিয়াস কিছু হয়েছে। উদ্বিগ্ন গলায় বলেন শেষ কথাটি।
ডাক্তার হেসে বলেন,
=না ম্যডাম সিরিয়াস কিছু হয়নি,আসলে আপনি দাদু হতে চলেছেন।প্রেশেন্ট প্রেগনেন্ট।
ডাক্তারের কথা শুনে রহিমা বেগম যেনো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন।খুশিতে তিনি ছেলেকে চেয়ার ছেড়ে উঠে জড়িয়ে ধরলেন। আর বলেন,

=আমি বলেছিলান তুই আবার বিয়ে করলেই বাবা ডাক শুনতে পারবি দেখলি আমার কথাই সত্যি হলো।আল্লাহ্ আমার দোয়া কবুল করেছে।আমি এখনই অনুকে খবরটা জানিয়ে আসি।
বলেই উনি কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এদিকে অনুজ এবার ঠিক করলো এখন সময় এসে গেছে সবকিছু সামনে আসার।সে যেমন তার লতাকে ভালোবাসে তেমনই তরুকেও স্নেহ করে। তাই এখন তাকেই সবটা ঠিক করতে হবে।এবার যার দায়িত্ব তাকেই সবটা বুঝিয়ে দিতে হবে, আর তাকে তা কিভাবে বুঝাতে হবে সেটাও অনুজ আহসান খুব ভালো করে জানে।এবার সবার সব কৃতকর্মের শাস্তি পাওয়ার সময় এসে গেছে!

চলবে,