সম্পর্কের_মায়াজাল পর্ব-০৩

0
4896

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৩

যেই বাবা সেই কাজ। ওয়াল কেবিনেট খুলে শুভ্রতা যেই ফাইলগুলো গুলো হাতে নিলো তখন তখনি ওর হাতে কিছু একটা টাচ্ করায় ওর শরীল খুব বড় সরো ঝাঁকি খেলো। ফাইল গুলো রেখে ওই জিনিসটা বের করার পর মুখে শাড়ির আঁচল চেপে ধরলো….

—-” ওয়াক ছিঃএএএএএ।”

স্পন্দনের চুলের জেল রাখা। হাতে তরল পদার্থ লাগায় শুভ্রতার পুরো শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। মুখের কাছে ঘ্রাণ শুঁকতে নিলে মুখ চেপে ওয়াশরুমে দৌড় দিলো শুভ্রতা।

—-” ওয়াক ,ওয়াক, থু থু। কি বিশ্রী গন্ধ ছিঃ ইয়াক এত বাজে জিনিস কিভাবে চুলে লাগায় স্যার। এই জন্যই তো আমার মনে হতো স্যারের শরীর থেকে পঁচা গন্ধ আসে। সেই পঁচা গন্ধ যে এই গন্ধ আমি তো বুঝতেই পারিনি। ইয়াক।”

হাতে গ্লাভস পরে হেয়ার জেলটা ফেলে দিলো। ভালো করে হাত পরিষ্কার করে ফাইল গুলো বের করলো। মাত্র পাঁচটা ফাইল রাখা।

—” এই পাঁচটা ফাইল দেখার জন্য এত টাইম। স্যার এত ভালো কবে থেকে হলো? ভালোই হয়েছে ধীরে ধীরে দেখতে থাকি ফাইল গুলো।”

শুভ্রতার শাশুড়ি অনেকগুলো বাদাম আর চানাচুর দিয়ে গেলো । শুভ্রতা খাচ্ছে আর ফাইল দেখছে।

।।

।।

।।

অফিসের সব কাজ শেষ করে স্পন্দন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে আর বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে….

—” আচ্ছা ওনার সাথে কঠোর ভাবে কথা বলায় ওনি কি রাগ করে? কি করবো ওনার বোন আমায় রিজেক্ট করেছে বিয়ের দিন পালিয়ে গেছে। আমার তো আরো কঠোর হওয়া দরকার কিন্তু পারছি না কেনো? ”

কফির মগে চুমুক দিয়ে স্পন্দন ভাবছে….

—” ওনাকে কঠোর ভাবে কথা বলাতে ওনারই লাভ হয়েছে। একা একা থাকতে তো ওনি বোরিং ফিল করতো। এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করা হলো। এক ওনার বোরিং ফিল দুরও হচ্ছে দুই আমার কাজও ঠিক হচ্ছে। আমার আবার ঠিক সময় সব রেডি থাকা চাই।”

স্পন্দন যখন আবারো চুমুক দিলো কফিতে, কফি তখন ঠান্ডা হয়ে গেছে।

—” ভাবতে ভাবতেই এতটা কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। ওই মেয়েটা থাকলেও লস না থাকলেও লস। এখন ওনার জন্য ঠান্ডা কফি খেতে হবে আমার। উপচয় জিনিস একদম লাইক করি না আমি।”

ঠান্ডা কফি মুখ কালো করে অমৃতির মত খাচ্ছে স্পন্দন।

।।

।।

।।

—” ফাইল গুলোর অর্ধেক কাজেই কমপ্লিট করা। নিজের কাজগুলো আমাকে দিয়ে করাচ্ছে। শালা হার কিপ্টা। নিজেও কাজ করবে আমাকে দিয়েও করাবে। একটা দিন রেস্ট করতে দিবে না হারামী কোথাকার।”

সন্ধ্যার পর স্পন্দনের বাড়িটা কেমন যেনো শুনশান নীরবতা লাগছে শুভ্রতার কাছে। শশুর মশাইয়ের সাথে ভয়ে কথা বলছে না। শাশুড়ি মা পাশের বাড়ির ভাবির কাছে আড্ডা দিচ্ছে। রাগে বাড়িতে ফোন দিচ্ছে না শুভ্রতা। বাড়ি থেকে অনেক ফোন এসেছে কিন্তু ধরছে না শুভ্রতা। শরীলে চাদর মুরিয়ে এই সন্ধ্যায় ছাদে চলে গেলো শুভ্রতা। শশুর মশাই উপন্যাস পড়ছে সেই সুযোগে দৌড় দিলো শুভ্রতা। শুভ্রতা যাওয়ার পর মিস্টার আজম হাসতে থাকে।

—” আমার ভয়ে পাগলী মেয়েটা কি জোড়েই না দৌড় দিলো হাহাহা। অবশ্যই সকালে যা বলেছি তাতে ভয় পাওয়ারি কথা।”

আকাশ এখনও রক্ত লাল। অন্ধকারের ছায়া পড়েছে সব জায়গায়। খুব ভালোই লাগছে দেখতে। রেলিং এ হাত দিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে শুভ্রতা। একাকীত্ব দূর করার জন্য অন্ধকারও ভালো লাগে অনেক সময়। চারপাশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে শীতের কুয়াশায়। মৃদু বাতাস এসে শীতটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে শুভ্রতার।

—” চাদরের বদলে কম্বল মুড়ি দিয়ে আসা উচিত ছিল। এক কাপ গরম চা সাথে বিস্কুট আহা জমে যেতো। সাধনা তো সব সময় আমার হাতের চা খুব পছন্দ করতো। কি করছে কে জানে মেয়েটা? নাম্বার অফ,ফেসবুক আইডি ডিলেট করা, ইমো ও হোয়াটস অ্যাপস দুদিন ধরে অফলাইন। যে মেয়ে একদিন ফোন ছাড়া বাঁচতে পারতো না সেই মেয়ে কি-না এখন ফোন ছাড়া আছে? নাকি নিউ ফোন কিনেছে? ইসসসসসস কিছুই ভাবতে পারছি না মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যাচ্ছে।”

টিং টিং,,,,, চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে ,কদম তলায় কে…….

ফোনের স্কিনের দিকে তাকালো শুভ্রতা। বেস্ট ফ্রেন্ড সমুদ্র ফোন দিয়েছে।

—” হ্যাঁ বল?”

—” শালী, বোনের বিয়ের দাওয়াত দিয়ে নিজের বিয়ে খাওয়ালি এখন বলছিস হ্যাঁ বল!”

—” কোন পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়েছে জানিস তো তুই তাহলে বলছিস কেনো?”

—” যা হয়েছে সব ভাগ্য। এখন আন্টি ফোন দিয়েছে তুই না-কি ওনাদের ফোন ধরছিস না?”

—” কিভাবে ফোন ধরবো বল? নিজেদের সম্মানের কথা ভেবে আমাকে হার কিপটার কপালে ঝুঁলে দিয়েছে তাদের সাথে কোনো কথা নেই আমার।”

—” এইটা ঠিক কথা বলেছিস হাহাহাহা। দুলাভাই কিন্তু এক নম্বরের কিপটা।”

—” ওই আমি কিপ্টা বলবো তুই বলার কে হুম? জানিস ওনি কিপ্টা না মিতব্যয়ী। ”

—-” বাহ কি দরদ । বাদ দে এইসব। বাড়িতে ফোন দে। সাধনা এমনিতে যা করেছে আন্টি আংকেল কষ্টে আছে এখন তুই এমন করলে ওনারা ভেঙ্গে যাবে। মা বাবার কথা ভেবে রাগ,অভিমান মাথা থেকে ঝাঁটা মেরে বিদায় কর।”

—” হুম। বাকি তিনজনের কি খবর?”

—” হ্যাঁ সবাই ভালো আছি আমরা। কিন্তু তোকে মিস করছি। দুলাভাইকে নিয়ে চল একদিন মিট করি।”

—” কাজ রেখে ওনি যাবেন না। আমি সময় পেলে গ্রুপে মিট করার কথা বলবো ওকে।”

—” ওকে মহারাণী।”

ফোন কেটে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শুভ্রতা। সমুদ্রের কথা ভেবে ফোন দিলো বাড়িতে। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দিলো। অনেক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থেকে ঠান্ডায় শরীল জমে যাচ্ছে শুভ্রতা। ছাদ থেকে নামতে গিয়ে সব অন্ধকার দেখে চোখ বন্ধ করে দিলো দৌড়…….

—” এই অভ্যাস কোনোদিন যাবে না আমার। আশে পাশে কেউ না থাকলে অন্ধকারে এইভাবে দৌড় দেই । কেউ দেখলে পাগল ছাড়া কিছু ভাববে না।”

শশুর মশাইয়ের রুমের কাছে আসতেই যেই দৌড় দিয়ে রুম পার হবে তখনি ডাক দিলো মিস্টার আজম।

—” শুভ্রতা?”

শশুর মশাইয়ের সামনে এসে মাথা নিচু করে বললো…..

—” সরি আংকেল, আমার একা ভালো লাগছিলো না তাই ছাদে……!”

শুভ্রতার এমন ভয়ার্ত চেহারা দেখে হাসতে থাকেন মিস্টার আজম। শশুর মশাইয়ের হাসির রহস্য জানার জন্য ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাস করলো শুভ্রতা…..

—” আংকেল আপনি ঠিক আছেন?”

—” খবরদার আংকেল বলবে না। বাবা ডাকবে বাবা ওকে?”

শুভ্রতা শশুর মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে…..

—” বুঝতে পারছি না ভুত কোনজন? ভালো জন নাকি খারাপ জন?”

—” শুনো তোমাকে বলছি যখন দেখবে আমি তোমার সাথে খারাপ বিহেভ করি তখন ভাববে কোনো কারণ আছে । আমি কিন্তু তোমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছি মা। খারাপ ব্যাবহার গুলোর জন্য মন খারাপ করবে না কেমন?”

শুভ্রতা মাথা এদিক ওদিক হেলিয়ে বুঝালো সে বুঝতে পেরেছে।

—” আচ্ছা যাও আমার জন্য একটা গরম চা বানিয়ে নিয়ে আসো তো। আজ রহিমা আসেনি আবার তোমার শাশুড়ি মাও নেই তাই তোমাকে বলছি। রাগ করো নি তো?”

—” না বাবা। আমি তো অবাক হচ্ছি। জানেন, আমি সব সময় আপনাদের মত শশুর শাশুড়ি যেনো পাই আল্লাহ তায়ালার কাছে চাইতাম। ওনি আমার ইচ্ছা পূরণ করেছেন খুব খুশি আমি। আচ্ছা বাবা কেনো আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যাবহারের নাটক করেন বলবেন প্লিজ!”

—-” মা কথাটা আমার জন্য লজ্জাজনক। প্লিজ জিজ্ঞাস করো না।”

—” ওকে বাবা। আমি আপনার জন্য চা বানিয়ে আনছি।”

শুভ্রতা রান্না ঘরে এসে চা বসালো। তখনি ওর শাশুড়ি মা আসলো…..

—” কি রে তুই রান্না ঘরে রহিমা কই?”

—” ওনার দরকারি কাজ থাকায় চলে গিয়েছে। বাবা না-কি চা খাবে তাই বানাচ্ছি। আপনার জন্য কি বানাবো?”

—” নাহ রে আমি খাবো না। তোর চাচী শাশুরির বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।শুন তোকে একদিন নিয়ে যাবো। স্পন্দনের মন ভালো হোক পরে। ওর কথার বাহিরে তোকে নিয়ে গেলে দেখা যাবে আমাকে আর তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে হাহাহা।”

শুভ্রতা বুঝলো স্পন্দনকে সবাই খুব ভয় পায়। চা বানিয়ে যেই বের হবে তখনি স্পন্দনের চিৎকার…..

—” কি হয়েছে তোর? আসা মাত্র চিল্লাচিল্লি শুরু করছিস কেনো?”

—” আজ দেখো কত টাকার চকোলেট কিনে আনছি কিন্তু যার জন্য এনেছি সে নাকি এখন আসবে না। আমার এত টাকার চকোলেট এখন কি করবো?”

—” তোর বউ আছে ওকে দিয়ে দে তাহলেই তো হয়।”

—” ওকে তুমি দিয়ে দিও।”

—” তোর বউ তুই দে আমি কেনো দিবো আজব! আর শুভ্রতা চা টা আমার হাতে দে আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুই স্পন্দনের সাথে যা।”

ওনি চলে যাওয়ার পর শুভ্রতা স্পন্দনের দিকে তাকালো। বিরক্তি গলায় বললো….

—” চকোলেট কিনে এনেও হিসাব। আচ্ছা আপনি এত টাকা ইনকাম করে কি করছেন বলবেন একটু?”

—” আপনাকে কৈফিয়ত কেনো দিবো আমি। শুনুন, আমরা যা টাকা দিয়ে বিলাসিতা করি সেই টাকা যদি গরিবদের মধ্যে ভাগ করে দেই ওনারা পেট ভরে এক বেলা ভাত খেতে পারবে বুঝতে পারছেন।”

—” হুম বুঝছি। এখন চকোলেট গুলো আমার হাতে দিন। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

স্পন্দন ফ্রেশ হতে চলে গেলো। এই প্রথম স্পন্দনের কথাটা খুব ভালো লেগেছে শুভ্রতার। স্পন্দন যে কেনো হিসাব করে টাকা খরচ করে বুঝতে পেরেছে এখন সে।

—” আমিও আজ থেকে হিসাব করে খরচ করবো। প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ খরচ না করে সেই অর্থ জমিয়ে ভালো কাজে খরচ করবো।”

চকলেট মুখে পুরে খেতে লাগলো শুভ্রতা। স্পন্দনের চিৎকার শুনে মুখ থেকে চকোলেট পরে গেলো। স্পন্দনের সামনে গিয়ে বললো….

—-” চেঁচাচ্ছেন কেনো বাসায় কি ডাকাত এসেছে না-কি ?”

—” আমার হেয়ার জেলটা কোথায়?”

—” আম আম আমি ফেলে দিয়েছি। কেমন একটা বিশ্রী গন্ধ ওইটা।”

স্পন্দন শুভ্রতার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো। শুভ্রতা ভয় পেয়ে বললো….

—” আমি আপনাকে একই ব্র্যান্ডের হেয়ার জেল কিনে দিবো। তবুও প্লিজ বকবেন না।”

শুভ্রতা ভয়ে তাকালো স্পন্দনের মুখের উপর……

চলবে…..

বানান ভুল হলে ক্ষমা করবেন।