#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৪
—” আমি আপনাকে একই ব্র্যান্ডের হেয়ার জেল কিনে দিবো। তবুও প্লিজ বকবেন না।”
শুভ্রতা ভয়ে তাকালো স্পন্দনের মুখের উপর। স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে স্পন্দন মঙ্গল গ্রহের কোনো প্রাণী বা এলিয়েন দেখছে। শুভ্রতা স্পন্দনের দিকে ছোট চোখে তাকিয়ে বললো…..
—-” আমাকে এইভাবে দেখার কি আছে? উগান্ডা থেকে আসিনি আমি। বাংলাদেশেই আমার বসবাস।”
—” নাহ দেখছি তোমার নাক আছে না-কি নাই।”
—” মাম মানে?”
—” ওইটা হেয়ার জেল না। গোবর আর নানান উপাদান দিয়ে আমার এক ফ্রেন্ড সার বানিয়ে আমাকে দিয়েছে। প্রতিদিন ফুল গাছে পানির সাথে মিশিয়ে দিলে পোকা ধরবে না। আর তুমি ওইটা ফেলে দিয়েছো? ”
—“ওয়াক থু থু। ছিঃ কি বলছেন আর আমি ওইটা হাতে টাচ্ করেছি। নাকে ধরে গন্ধ শুকছি ইয়াক।”
—” তুমি যেভাবে ইয়াক ইয়াক করছো মনে হচ্ছে গর্ভবতী। প্লিজ তোমার সন্তানের বাবা কিন্তু আমি না। আমাদের মাঝে কিচ্ছু হইনি। এক বছর পর ডিভোর্স আমাদের।”
স্পন্দন তুমি করে বলছে শুভ্রতাকে কিন্তু স্পন্দনের সে দিকে খেয়াল নেই। শুভ্রতা মজা করে বললো…..
—-” বাসর রাতের পরে প্রেগনেট হইছি তার মানে বাচ্চার বাবা আপনি। নিজের বাচ্চাকে অস্বীকার করতে লজ্জা করে না?”
—” ওই খবরদার একদম তোমার বাচ্চার দায় আমার উপরে ফেলবে না। তাছাড়া আমি এখনও বাচ্চা এখন বাচ্চার বাপ হলে লোকে কিছুদিন পর বলবে দুই ভাই যাচ্ছে।”
শুভ্রতা বাঁকা চোখে তাকালো। স্পন্দন সাদা শার্ট পরে আছে। স্পন্দনের ঠোঁটের বা দিকটায় নজর কাড়া তিল যেমন মেয়েদের থাকে। শুভ্রতার খেয়াল হলো স্পন্দন তাকে তুমি করে বলছে…….
—” আপনি কিন্তু রুলস ভঙ্গ করেছেন। বার বার তুমি করে বলে ফেলছেন। ভুলে যাবেন না সম্পর্কে আমি আপনার বড় শালীকা হতে যাচ্ছিলাম।”
—” আপনিও ভুলে যাবেন না আপনি আমার অফিসের সামান্য কর্মচারী। সো আপনাকে আমি তুমি বা আপনি যা ইচ্ছা তাই বলেই ডাকতে পারি।”
—” ধ্যাত আসতে না আসতেই ঝগড়া শুরু করে দিছেন। আস্ত ঝগড়ুতে!”
—” হুম বুঝতে পারছি আমি, কে ঝগড়ুতে আর কে সাধু। আমার এত টাকার সার নষ্ট করেছেন তার শাস্তি স্বরূপ আমার জন্য চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি করে আনুন যা ঠান্ডা পড়েছে ।”
—” ব্ল্যাক কফি মানুষ খায় ওয়াক।”
—” আমাকে কি মানুষ বলে মনে হয় না আপনার। আপনি জানেন না, একেক জনের রুচি একেক রকম। আপনার যেখানে কোল্ড কফি , এসপ্রেসো কফি বা ক্যপাচিনো কফি পছন্দ অনেকের কিন্তু সামান্য র-চা পছন্দ। একজন যেমন এক বেলা মাছ, সপ্তাহে একবার মাংস খেয়েই তৃপ্তি অনেকে আছে প্রতিদিন মাছ,মাংস,সবজি সব খেয়েও তৃপ্তি না। তাই বলবো কোনোদিন খাবার নিয়ে বাজে কথা বলবেন না। যার রুচি যেমন সে ঠিক তেমনই খাবে। বুঝাতে পেরেছি আমি?”
—” হুম।”
—” গুড। এখন নিয়ে আসুন কফি।”
শুভ্রতা স্পন্দনের জন্য কফি বানাতে আবারো নিচে আসলো। স্পন্দনের কথার জালে বার বার আটকে যাচ্ছে সে। এত সুন্দর ভাবে কিভাবে বুঝাতে পারে একটা মানুষ? ঠিকই তো মানুষের খাবার নিয়ে বাজে মন্তব্য করা ঠিক না। যার যেমন রুচি সে তো তেমনিই খাবে।
শুভ্রতা নিজের জন্য দুধ চা আর স্পন্দনের জন্য চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি বানালো। সিড়ি দিয়ে উঠার পর শশুর শাশুড়ির রুমে উকি দিলো। মিস্টার আজম এখনও উপন্যাস পড়ছেন। মিসেস সাবিনা বেগম বিরক্তি নিয়ে বার বার কথা বলছেন। উপন্যাস পড়া নিয়ে খুবই বিরক্ত তিনি। পুরো বিছানায় বইয়ের ছড়াছড়ি। বইগুলো বুক সেলফ এ রাখছেন তিনি, সাথে কথা শুনাচ্ছেন। মিস্টার আজম ওনার স্ত্রীর কথা এক কান দিয়ে শুনছে অন্য কান দিয়ে বের করছে। মাঝে মাঝে হুম হুম করছেন। শুভ্রতা শশুর শাশুড়ির এমন সুখময় ঝগড়া দেখতে ভালোই লাগছিলো। স্পন্দনের চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি তাদের রুমে ঢুকলো…..
—” এই নেন আপনার ব্ল্যাক কফি। এমা আপনাকে এখন দেখতে ডাকাত ডাকাত লাগছে।”
স্পন্দন শীতের পোশাক পড়েছে। মাথায় মাঙ্কি টুপি পড়েছে বাচ্চাদের মতন। পায়ে মুজা হাতে শীতের গ্লাভস। পুরাই বাচ্চাদের মতো অবস্থা। স্পন্দনের এমন কাণ্ড দেখে শুভ্রতা চা রেখে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
—” এতটা শীত এখনও আসে নাই যে আপনার এমন করে পোশাক পড়তে হবে। আপনাকে দেখে আমার এখন জঙ্গি মনে হচ্ছে হাহাহা।”
—” হাসবেন না তো। আমার শীত , গরম দুইটাই খুব বেশি। ”
—” জানেন আজ আপনার বাবা মার…..”
—” ওনাদের রুমে উকি দিয়েছেন?”
—” হুম। কেনো?”
—” আপনাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি ওই লোকটার কথা আমার সামনে কোনোদিন বলবেন না। ওনাকে বাবা বলতেও আমার বাধে। খুব জগণ্য লোক ওনি । খুব খুব খুব যত পারবেন দূরে থাকবেন ওই লোকটার কাছ থেকে। ”
—” আমার তো তেমন মনে হলো না। ওনি তো খুব ভালো একজন বাবা। আমি তো ভাবী আপনার মতো লোকের এত ভালো বাবা কিভাবে হলো?”
স্পন্দন রাগের বশে চড় মারে শুভ্রতাকে। চেঁচিয়ে উঠে স্পন্দন। হাত পা কাপছে তার।
—” বলছিনা ওই লোকের কথা আমার সামনে বলবেন না। ঘৃনা করি খুব ঘৃনা করি। ”
শুভ্রতা ভয়ে আর কথা বাড়ালো না। স্পন্দন যে তার বাবাকে খুব ঘৃনা করে ভালোই বুঝতে পারলো সে। রাতে খাবার টেবিলে স্পন্দন না যাওয়ায় মিসেস সাবিনা বেগম শুভ্রতা আর স্পন্দনের খাবার উপরে পাঠিয়ে দিলেন।
শুভ্রতা স্পন্দনকে খাবার বেড়ে দিলো। স্পন্দন চুপচাপ খাচ্ছে। হটাৎ খাবার মুখে না নিয়ে শুভ্রতার মুখের সামনে ধরে বললো…..
—” সরি, ওইভাবে চড় মারার জন্য। আসলে আমি ওই লোকটার কথা শুনতে চাই না। কেউ যদি বলে তখন ওই লোকটার প্রতি রাগ তাকে দেখিয়ে ফেলি। খেয়ে নিন।”
—” আমি কারো হাতে খেতে পারি না।”
—-” এক বছরের জন্য হলেও আপনি আমার স্ত্রী। জানেন তো স্বামী স্ত্রী এক প্লেটে খাবার খাওয়া সুন্নত। যতদিন একসাথে আছি সুন্নত আদায় করতে দোষ কি?”
শুভ্রতার পেটেও প্রচুর ক্ষুদা লেগে ছিল। পেটে যেনো বিড়াল তারা করছে তাই খপ করে হাত থেকে খাবারটুকু মুখে পুরে নিলো।
—” প্রথম খাবে না এখন আমার হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত খেয়ে নিতে লাগলো। জানতাম খাবারে লোভ দেখাচ্ছে তাই খাবারের জন্য বললাম। পরে দেখা যেতো আমার পেট ব্যাথা করছে বাথরুম পাচ্ছে।”
—” এখন প্লিজ এমন বলবেন না। পরে আর খেতে পারবো না।”
দুইজন খাওয়া দাওয়া সেরে বসে রইলো। শুভ্রতা তার কাজের ফাইল গুলো স্পন্দনকে দেখালো। স্পন্দন একটু চোখ বুলিয়ে রেখে দিলো। ল্যাপটপ হাতে নিয়ে কাজ করতে লাগলো।
—” আগামীকাল দশটায় মিটিং আছে। তাড়াতাড়ি চলে যাবেন। আমি মিটিং শুরু হওয়ার দশ মিনিট আগে যাবো।”
—” হুম। রিক্সা ভাড়াটা দিয়ে দিলেই হবে। আমার কাছে কোনো টাকা নেই।”
—” বাসার গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন। রিক্সা দিয়ে অফিস গেলে মানুষ বলবে, স্পন্দন চৌধুরী তার বউকে রিক্সা করে অফিস পাঠাচ্ছে। বুঝেন তো যার যেমন সামর্থ্য তার তেমন চলাই মানুষ আশা করে। ”
—” হুম।”
শুভ্রতা চোখ বন্ধ করে স্পন্দনের কথা ভাবছে। স্পন্দনকে তার আজব দেশের আজব প্রাণী মনে হয়। যখন যা বলে যুক্তিসহ বলে। মনে হয় আগে থেকেই যুক্তি ঠিক করে রাখে। স্পন্দন মাথা শান্ত রেখেই কথা বলে কিন্তু হটাৎ করেই হিংস্র হয়ে যায় যেমন আজ তার বাবার কথা বলাতে হলো।
।।
।।
।।
রাত তিনটায় শুভ্রতার ঘুম ভেংগে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে সামনে স্পন্দনকে এখনো ল্যাপটপে কাজ করতে থেকে অবাক হয়ে গেলো। এত রাত পর্যন্ত জেগে আছে স্পন্দন?
—” আপনি এখনো ঘুমান নি?”
—” দেখতেই তো পাচ্ছেন।”
—” দেখতে তো পাচ্ছি। কিন্তু এত রাত পর্যন্ত কি এমন কাজ করছেন বুঝতে পারছি না।”
—” বুঝতে হবে না।”
—” প্লিজ বলুন প্লিজ প্লিজ প্লিজ!”
শুভ্রতার ঘুম ঘুম চোখে কৌতুহল দেখে স্পন্দন আর বারণ করতে পারলো না……
—” অনাথ আশ্রম, বৃদ্ধা শ্রম আর একটা গরীব এলাকায় কিছু অর্থ আর তাদের সুখ সুবিধার জন্য বিদ্যুৎ, পানি, বাচ্চাদের জন্য স্কুল, মাদ্রাসা এইসবের জন্য কি কি লাগবে? অর্থ কত লাগবে সব কিছুর প্ল্যানিং করছি।”
শুভ্রতা মুগ্ধ নয়ণে স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পন্দনের মন যে এতটা বড় সে কোনোদিন বুঝতেই পারেনি। শুভ্রতা ভাবছে…..
—-” সাধনা ভালো একজন মানুষকেই ভালোবেসেছে। আমিও তো বার বার মুগ্ধ হচ্ছি ওনার কাজ কর্মে।”
—” আপনি জেগে আছেন কেনো? সকালে মিটিং আছে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
—-” আপনারও তো মিটিং আছে। তাছাড়া এই ভালো কাজে আমায় অংশীদার করবেন না আপনি?”
—-” কেনো নয়? আপনি চাইলে অবশ্যই থাকতে পারেন। কেননা, গরীব মানুষদের হোক আছে আমাদের মত উচ্চ শ্রেণীর মানুষের উপর।”
—-” হুম। আপনি হিসাব করুন আমি আপনার জন্য কফি বানিয়ে আনছি। খাবেন কফি?”
—-” মন্দ হবে না ব্যাপারটা। যদি পারুন তাহলে নিয়ে আসুন।”
হাঁসি মুখে বললো স্পন্দন। শুভ্রতা এই প্রথম তিল ঠোঁটের মিষ্টি হাঁসি দেখলো কাছ থেকে। বার বার স্পন্দনের সেই হাঁসি দেখার জন্য ইচ্ছা করছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না।
—-” আচ্ছা আমি আনছি। সাথে আর কিছু লাগবে?”
—-” সত্যিই বলতে খুব ক্ষুদা লেগেছে। যদি কিছু পারেন তাহলে আনবেন। না পারলে আনার দরকার নেই।”
—” আনছি স্পেশাল রান্না।”
শুভ্রতা রান্না ঘরে গিয়ে, ডিম, নুডলসের প্যাকেট,পেয়াজ, কাচা মরিচ,ময়দা, পাউরুটি আর মসলার বক্স গুলো নিলো।
দুইজনের পরিমাণ অনুযায়ী সব কিছু ভাগ করলো। পরিমাণ মতো পানি দিয়ে নুডলস একটু বেশি নরম করে সিদ্ধ করে নিলো। এবার পানি ভালো মতো ঝরিয়ে তাতে পেঁয়াজকুচি, কাঁচামরিচ-কুচি, প্যাকেট মাসালা, মিক্সড স্পাইসি মসলা ও ময়দা দিয়ে ভালো মতো চটকিয়ে মিক্স করলো শুভ্রতা।
একটা প্লেটে ডিম ফেটে রেখে আর এক প্লেটে ব্রেডক্রাম রাখলো। পাউরুটির পাশগুলো কেটে নিয়েছে শুভ্রতা।
এবার একটি পাএে কিছু পানি নিয়ে একটা করে পাউরুটি পানিতে ভিজিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তুলে হাতে চেপে পানি বের করে নিলো শুভ্রতা। তারপর ভিতরে পরিমাণ মতো নুডলস দিয়ে রোল করে প্রথমে ডিমে চুবিয়ে পরে ব্রেডক্রামে গড়িয়ে নিলো। তেল ভালো করে গরম করে রোল গুলো ভাজলো শুভ্রতা। রোলের সাথে টমেটো সস,পেয়াজ কুচি, মরিচ, শসা কেটে নিলো। ব্ল্যাক কফি আর দুধ কফি ট্রে তে করে নিয়ে রুমের দিকে রওনা দিলো……
—-” এই যে হাজির আমার স্পেশাল রান্না।”
স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে ঘড়ি দেখলো……..
—-” ৩১ মিনিট ৫ সেকেন্ড লাগলো এই জিনিস গুলো বানানোর জন্য? আপনার আশায় থাকলে পেটের ক্ষুদা পেটেই রাখতে হবে।”
চলবে……
বানান ভুল হলে ক্ষমা করবেন।