#সুখের_প্রেমাসুখ(০৫)
#ওয়াসেনাত_আরাবী
“আমার পালা?”
মাহার প্রশ্নে মাশহুদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। মাহা খাওয়া শেষ করে প্লেট গুছিয়ে রাখে। মাশহুদ ততক্ষণে শার্ট পাল্টে নিয়েছে। মাহা বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে। মাশহুদকে পরিপাটি হতে দেখে মাহা গাল ফুলিয়ে প্রশ্ন করে,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। মার্কেটেও যেতে হবে। কিছু লাগবে তোর? লাগলে বল নিয়ে আসবো।”
“আমার ভালো লাগছে না।সারাদিন বাড়িতে বসে আছি।”
“বিকেলে ঘুরতে নিয়ে যাবো।”
“এখন যাবো।”
“ওকে।রেডি হয়ে নিচে নাম। আমি অপেক্ষা করছি।”
খুশিতে মাহার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মাশহুদ মুচকি হেসে নিচে চলে যায়।মাহা একটি নীলরঙা শাড়ি পড়লো। চুলে খোপা করেছে। সুন্দর সুশ্রী চেহারা। মাশহুদ বাইক নিল না। রিকশা নিয়েছে রিজার্ভ করে। মাহা রিকশায় ঘুরতে পছন্দ করে।
রিকশায় পাশাপাশি বসে আছে ওরা। মাশহুদ ফোনে কথা বলছে কারোর সঙ্গে। মাহা পরিবেশ, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করছে। আজ ভ্যাপসা গরম পড়েছে। রাস্তায় জ্যাম নেই। মাহাদের পাশ দিয়ে আরও দুটি রিকশা ক্রস করে গেল। অথচ ওদের রিকশা চলে তো, চলে না টাইপের। মাহা খানিকটা বিরক্ত হলে বলল,
“মামা একটু জোরে চালান।”
রিকশাচালক পেছনে তাকিয়ে বললেন,”জোরে চালানো যাবে না তোমার স্বামী আস্তে চালাইতে কইছে। তুমি নাকি ভয় পাও জোরে চালালে।”
মাহা লজ্জা পেল। আড়চোখে মাশহুদকে দেখলো। সে এখনও ফোনে ব্যস্ত। মাশহুদের তরফ থেকে কোনো শব্দ যাচ্ছে না। সে নির্বাক শ্রোতা। ওপাশ থেকে একা একা কে এত কথা বলছে? কী বলছে? মাহা মন খারাপ করে ফেলে। নিজেকে বড্ড একা লাগছে। পাশে মাশহুদ আছে, তারপরেও মনে হচ্ছে সে একা। মাশহুদ একটা হসপিটালের সামনে রিকশা থামিয়ে রিকশাচালককে চা-পানি খাওয়ার টাকা দিয়ে হসপিটালের গেটের কাছে এসে দাঁড়ায়। মাহা তার ছোট ছোট চোখগুলো নিবদ্ধ করে রেখেছে মাশহুদের ওপর। মাশহুদ হসপিটালে কেন এসেছে? মাহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাশহুদ তাড়া দিয়ে বলল,
“দ্রুত চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“কার কাছে যাচ্ছেন?”
“নাম বুরাক। আমার এক সিনিয়র ভাই।”
“ওহ। তাহলে আপনি যান। আমি বাইরে ঘুরে দেখি।”
“এখানে কোথায় ঘুরবি? দেখ মাহা, সঙ্গে আসতে বায়না করেছিস, এনেছি।এখন রাস্তাঘাটে উল্টাপাল্টা আবদার করে দেখ, এই রিকশাতেই বাড়ি পাঠিয়ে দিবো।”
“গিয়ে কী করবো?”
“বসে থাকবি পাশে। আয়।”
মাহা “হু” বলে মাশহুদের পিঁছু পিঁছু হাটছে। বুরাকের কেবিনের সামনে দাড়িয়ে মাশহুদ তার ফুপাতো বোন জেনিথের রেফারেন্স দিল। বুরাক ওর কলেজের সিনিয়র হলেও মাশহুদের ধারণা বুরাক ওকে চিনতে পারবে না। তাই জেনিথের নাম নিতে হবে। রিসেন্টলি জেনিথের সঙ্গে বুরাকের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ পরে একটা রোগা-পাতলা ছেলে এসে দাঁড়ালো সামনে। মাশহুদকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে বলল,
“আপনি মাশহুদ? স্যার আপনাদের ভেতরে যেতে বলেছেন।”
মাশহুদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওকে।” এরপর মাহার দিকে তাকিয়ে বলে, “বসে আছিস কেন? চল।”
কেবিনের দরজা খুলে প্রবেশ করে মাশহুদ। বুরাক হেসে বলল, “বসো। কী নেবে? ঠান্ডা নাকি গরম?”
“নাথিং স্যার, ইটস ওকে।”
“ইটস নট ওকে। তুমি কী নেবে মেয়ে?” মাহাকে প্রশ্ন করে বুরাক।
মাহা ভড়কে গেল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। দ্রুত বলল, “না, না কিছু খাবো না। শুধু পানি খাবো।”
বুরাক হেসে টেলিফোনে জুস, পানি দিতে বলে। মাশহুদ চেয়ার টেনে বসে। মাহাও বসলো পাশে। বুরাকের ঠিক ডানহাতে টেবিলের ওপর একটা নেমপ্লেট। সেখানে “সার্ফারাজ চৌধুরি বুরাক, নিচে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লেখা”। মাশহুদ হঠাৎ সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে এসেছে কেন? কী হয়েছে? মাহা চিন্তিত চোখে তাকালো মাশহুদের দিকে।মাশহুদ নিশ্চুপ বসে আছে। এরপর চোখ সরিয়ে বুরাকের ওপর দৃষ্টি ফেলতেই দেখলো বুরাক ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই ভয়ে, আতঙ্কে কেঁপে ওঠে মাহা। চোখের পলক ফেলে সময় নিয়ে। শরীর শিউরে উঠলো। বুরাক মাহার চেহারায় নজর বুলিয়ে বলল,
“তোমার বউ তো বেশ রূপবতী মাশহুদ।তোমাকে পছন্দ করলো কী দেখে?আজ-কালকার জেনারেশনের পছন্দের অবস্থা দেখে আমি বেশ অবাক হচ্ছি।”
মাশহুদ হেসে ফেলল। মাহা অর্থ বুঝতে না পেরে নির্বাক তাকিয়ে রইলো। মাশহুদ হাসি থামিয়ে বলে,
“ওর চোখে সমস্যা, বুদ্ধি কম। তাই আমাকে পছন্দ করেছে। এটাই শুনতে চাচ্ছিলেন তো ভাই?”
বুরাক কলম প্রেসক্রিপশনের ওপর রেখে বলল, “সেটাই। সুন্দরীদের বুদ্ধি কম থাকে। তারপর নতুন বউ, সংসার কেমন লাগছে? আজ কতদিন হলো বিয়ের?”
মাহার যান্ত্রিক উত্তর, “আজ দুদিন হবে। গতকাল বিয়ে হয়েছে। আর মাশহুদ যথেষ্ট ভালো,সুদর্শন পুরুষ। তাকে পছন্দ না করার কোনো কারন নেই।”
মাহার রাগতস্বর শুনে মৃদু হাসে বুরাক। স্বামীকে নিয়ে অত্যধিক সংবেদনশীল মেয়েটা। সামান্য একটা মজাও গভীরভাবে নিয়ে ফেলেছে। বুরাক মাহার কন্ঠের তেজ লক্ষ করে বলল,
“আচ্ছা? তাহলে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। কে বেশি সুদর্শন? তোমার স্বামী নাকি আমি?”
মাহা একমুহূর্তও অপেক্ষা করলো না উত্তর দিতে। সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল, “মাশহুদ।”
“আচ্ছা। তারপর কোন ক্লাসে পড়ো?”
“টুয়েলভ।”
“বয়স?”
“আঠারো।”
“নাম?”
“রাদিআহ্ সামরীন মাহা।”
“মাহা। বেশ সুন্দর নাম। মাশহুদকে কতদিন ধরে চেনো? তোমাদের লাভ ম্যারেজ নিশ্চই।”
“না,অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ।আর উনি আমার খালাতো ভাই। আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন আমাকে?”
“জানার জন্য। এবার মাশহুদের সঙ্গে কথা বলি।তো মাশহুদ তুমি..”
মাহা বিরক্তি নিয়ে বসে থাকে। বুরাক মাশহুদকে নানা প্রশ্ন করে। অহেতুক কথা বাড়াচ্ছে যাকে বলে। অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা। মাশহুদের রোগ কিংবা ওদের কথার আগাগোড়া খুজে পেল না মাহা। তবে রাগ হচ্ছে। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মাথার ব্যাথায় অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। বুরাককে কেন জানি ওর পছন্দ হচ্ছে না। ভালো মানুষ মনে হচ্ছে না। তাকানো ভালো না, কথা বলার ধরণ ভালো না। মানুষকে ছোট করে কথা বলার স্বভাব। মাশহুদকে ছোট করে কথা বলেছে। এটা পছন্দ হচ্ছে না মাহার। কথা বলার এক পর্যায়ে দরজায় কেউ নক করে। বুরাক অনুমতি দিল না প্রবেশের। তারপরেও দরজা খুলে একটি মেয়ে প্রবেশ করে। মাহা মেয়েটিকে দেখলো। উঁচু পেটটা ধরে ধীরগতিতে আসছে। বুরাক মেয়েটিকে দেখামাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটি ইশারায় বুরাককে বসতে বলে, এগিয়ে এসে মাহার পাশের সীটে বসলো। মাহার মনে হলো মেয়েটা বিদেশী। নীলচোখ, অতিরিক্ত শ্বেত ত্বক। হাসিটাও চমৎকার। মেয়েটি বলল,
“সৌহার্দ্য কোথায়? আসবে কখন?”
বুরাক বলল,”বোর্ড মিটিংয়ে আছে হয়তো।”
“ওহ। জেনিথ যাদের কথা বলেছিল তারা?”
বুরাক দ্রুত মাশহুদদের দেখিয়ে বলে, “ও মাশহুদ আর ওর স্ত্রী মাহা। আর ও হচ্ছে সম্রাজ্ঞী..”
মেয়েটি বুরাককে থামিয়ে বলল, “আমার পরিচয় আমি দিচ্ছি। প্রিটি গার্ল! আমি, সেহনাত। জেনিথের বন্ধু। নাইস টু মিট ইয়্যু।”
মাহা হাসার চেষ্টা করে বলল,”আপনাকে দেখে আমারও ভালো লাগলো আপু।”
বুরাক বলল, “তাহলে তোমরা বসো। আমরা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”
সেহনাত বলল, “বাকি পেসেন্টদের কে দেখবে? এখন ঘোরার সময়? রিডিকিউলাস!”
“ইটস আর্জেন্ট ম্যাডাম।”
“ওকে।আসার সময় সৌহার্দ্যকে ডেকে আনবেন।”
বুরাক থমথমে মুখে মাশহুদের সঙ্গে বেড়িয়ে গেল।মাহা প্রসন্নিত। বুরাককে হেনস্তা হতে দেখে ভালো লেগেছে। সেহনাত সেটা দেখে মুচকি হাসে। পরপরই মুখটা গম্ভীর করে বলে,
“এসব টাইমসেন্সলেস, ম্যানারলেস ডাক্তারদের জন্যই হসপিটালটা রসাতলে যাবে। অসহ্য। তারপর মাহা তুমি বলো। কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ আপু। ভালো আছি। আপনি?”
“আপনি নয়, আপনারা। আমরা দুজনেই ভালো আছি।” নিজের পেটটা দেখিয়ে বলল সেহনাত।
“হা হা হা। তাই তো! আপনারা তো এখন দুজন। আমার ভুল হয়েছে প্রশ্নে। আপনি জেনিথ আপুর কেমন বন্ধু?”
“ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। ওর বাবা আর আমার বাবা বন্ধু। তাই আমরাও বন্ধু। তোমার শাড়িটা বেশ সুন্দর। কে পছন্দ করেছে?”
“খালামনি। মানে আমার শাশুড়ি।”
“ওহ হো! জেনিথ বলেছিল তোমরা খালাতো ভাইবোন। আমার মনে ছিল না। তারপর বলো, মাশহুদকে কেমন লাগে? স্বামী হিসেবে কেমন?”
“ভালো।”
“তোমাকে ভালোবাসে?”
“হুম।”
“যাক! ভালো। শুনেছি তোমরা ছোট থেকেই নিজেদের ভাইবোন হিসেবে দেখেছ। প্রেম না থাকলে মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে। মানুষ ভাবে, বিয়ে হলেই সব ঠিক হয়ে যায়। হয়তো কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এ কথা সত্য। তবে এমনও কিছু ছেলে-মেয়ে আছে যাদেরকে সম্পর্কের জটিলতা আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। দীর্ঘসময় একজন মানুষকে নিজের ভাইয়ের মত দেখে, ভেবে বড় হওয়ার পর হুট করে তাকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া যায়না। তোমার সঙ্গে এমন হয়নি জেনে ভালো লাগলো।”
মাহা মলিন চেহারায় তাকায়। মনের ভেতরের গোপনীয় সত্যগুলো যেন কানে ভেসে আসলো। মুখে ভালোবাসে বললেও মাহা তো সত্য জানে। ওদের ভেতরের জটিল সম্পর্কও জানে। এখনও কেউ কাউকে মেনে নিতে পারেনি। মাশহুদ মেনে নিয়েছে বললেও মাহা জানেনা মাশহুদের বলা কথাটির সত্যতা কতটুকু? সেহনাত পুনরায় হেসে বলল,
“তুমি কী এমন চুপচাপই থাকো?”
“হুম। আপনি এখানে কী করছেন?”
“এটা আমাদের হসপিটাল। আমার চেক-আপের জন্য এসেছি। আমার বরকে খুজে পাচ্ছি না, ফোনে পাচ্ছি না। তাই বুরাক সাহেবের কাছ থেকে খোজ নিতে এখানে আসা। আর এসে তোমাদের পেলাম। তাছাড়া আমার একটা বন্ধু দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অশান্তিতে ভুগছে সে ব্যাপারেও বুরাকের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন ছিল।”
“কী হয়েছে তার?”
“ছোট থাকতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো। তারপর থেকে হুটহাট সেন্সলেস হয়ে যায়। পুরুষদের স্পর্শ ভয় পায়। চাপা স্বভাবের। বোকা বোকা কথা বলে। নিজের স্বামীর সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারছে না। নিজেকে সর্বদা বিষন্নতার চাঁদরে ঢেকে রাখে। ওর হাসবেন্ডের সঙ্গে কথা হলো। সে বলল, ওদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয়। এ ব্যাপারে কোনো হেল্প করা যায় কীনা!”
“এমন হলে এর সমাধান কী?” মাহার কন্ঠে উত্তেজনা ও আগ্রহ প্রকাশ পেল।
সেহনাত বলল,”আমি তো ডাক্তার নই যে সমাধান জানবো। তবে আমার মতে, এর একটা খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন। যে আলোচনা দ্বারা সমস্যার মূল উপড়ে ফেলা যায়। বুঝলে মাহা! মেয়েটা জানে তার সমস্যার কথা। কিন্তু বুঝিয়ে বলতে পারে না। নিজেকে ছোট করে দেখে। ভাবে সে বাকিদের মত বুদ্ধিমান নয়, ভীষণ বোকা। তাই সবাইকে ভালোবাসতে চায়। আবেগী ভীষণ। কারোর কষ্ট সহ্য করতে পারেনা। নিজেকে পরিবর্তন করতে চায়। কিন্তু সেটাও পারেনা। এজন্যই হীনম্মন্যতায় ভোগে। আমি ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি, রীতিমতো গবেষণা করেছি। এটা শুধুমাত্র একটা রোগ। পিটিএসডি বা মস্তিষ্কে ক্ষত সৃষ্টি হলে এমন হয়। তবে প্রপার ট্রিটমেন্ট পেলে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তারা অতিরিক্ত আবেগী হওয়ায়, স্বনির্ভর না হওয়ায়, এর সমাধান নিয়ে ভাবার মতো মনোবল পায়না। মনে জমা কথা ও ব্যাথা,কাছের মানুষের কাছে প্রকাশ করলে কষ্ট কমে।”
মাহা অন্যমনস্ক হয়ে বলে,”কেউ বোকা সাজতে চায়না। কিন্তু বোকামি করে বারবার লজ্জায় পড়লে কারোরই সে কথা বলতে ইচ্ছে করেনা।”
সেহনাত মাহার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি চেহারা নিয়ে বলে, “লোকে বলে, আমার পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা প্রখর। তাই আমি তোমাকে এই উপদেশ দিবো, নিজের কাউন্সিলিং করাও। আমার ধারণা তুমিও কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। তোমার চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে সে চিন্তার ছাপ।”
“আমার চেহারায়?”
“আমার কথাগুলো তুমি বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনেছ। আগ্রহ জন্মেছে তোমার মনে। কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারোনি। কিন্তু বাইরের একজনের বিষয়ে তোমার মতো শান্তস্বভাবের মেয়ের এত কৌতুহল থাকার কথা নয়। তুমি ঘামছো। চেহারা মলিন। তোমার চেহারা দেখে যে কেউ এটা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারবে তুমি এ ব্যাপারে জানার চেষ্টা করছো। হয়তো কিছুটা জানো। সেটা কতটুকু? যদি কাউকে নিজের সমস্যার কথা না বলো, তাহলে সবাই বুঝবে কী করে?”
“আমি অনুভূতি চেপে রাখতে পারিনা। সবাই ভুল বোঝে আমাকে।”
সেহনাত মাহার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার চোখ দেখো। এই নীল চোখের কিছু বিশেষত্ব আছে। অনেকের ধারণা, আমি চোখ দিয়েই সম্মোহন করতে পারি। ইউনিক না?”
_______________________
ঘন্টাখানেক পর মাহা ও সেহনাত এলো ওয়েটিং রুমে। সেহনাতের রিপোর্টগুলো চলে এসেছে। মাশহুদ মাহার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মাহা ঘেমেনেয়ে একাকার হওয়া সত্ত্বেও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। সামনে একজন সুদর্শন পুরুষ তার স্ত্রীর যত্ন নিতে গিয়ে উতলা হয়ে পড়ছে। সেহনাতের হাত ধরে, ওকে নিয়ে আসছে। মূলত কোলে তুলতে চেয়েছিল, সেহনাত রাজি হয়নি। চোখ রাঙায় বিধায় বেচারা শুধু হাত ধরাতেই শান্ত হলো। তবে এটাও বলেছে, হসপিটালের গণ্ডি পেরোলেই সে তার বউকে কোলে নেবে। কেউ আটকাতে পারবে না তাকে। মাহা এই সুদর্শন ভদ্রলোককে চেনে। বউয়ের জন্য প্রিয় পেশা ছেড়ে দিয়েছিল, অথচ তার অভিনয়ের প্রসংশা পুরো দেশে এখনো চর্চা করা হয়। মাত্রাতিরিক্ত বউপাগল এই অভিনেতা। মাহা মাশহুদের দিকে তাকালো। মাশহুদও হাস্যজ্জ্বল চেহারা নিয়ে দেখছে এক পাগল প্রেমিকের প্রণয়। মাহার কাছাকাছি আসতেই সেহনাত বলল,
“এই বউপাগল মানুষটা আমার বর। তোমাকে আমি যে সুখের কথা বলেছি, এই তারছেড়া মানুষটাই সেই সুখ। আর, এই যে ভ’য়’ঙ্ক’র পাগলামি দেখছো, তার ভাষ্যমতে এটা আমার জন্য হওয়া তার সর্বকালের অসুখ যাকে প্রেমাসুখ বলে। আশা করছি তোমার জীবনেও শীগ্রহই #সুখের_প্রেমাসুখ শুরু হবে। নিজেকে সময় দাও। সবটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
“যদি ভুল করি?”
“সংশোধনের উপায় খুজে না পেলে পুনরায় আমার কাছে এসো। তবে ভুল করার ভয় না পেয়ে,চেষ্টা করো।”
মাশহুদ সরুচোখে তাকায়। দুজনের ফিসফিসানি দেখে বোঝা যাচ্ছে না, তারা কী নিয়ে কথা বলছে। সেহনাত চলে যেতেই মাশহুদ প্রশ্ন করে,
“মেয়েটা কী বলছিল রে মাহা?”
“বলা যাবে না। পার্সোনাল কথা।চলুন বাড়ি যাবো।” গলা কাঁপে মাহার। কষ্ট হয় মাশহুদকে উত্তর দিতে না পারায়। কিন্তু কিছু করার নেই। সমস্যার সমাধান করতে হলে পরিবর্তনের প্রয়োজন।
মাহা হাটতে শুরু করলে মাশহুদ বুরাককে বলল,
“আজ প্রথম, কোনো কথা গোপন করলো মাহা। ও কখনও কারোর থেকে কিছু গোপন করতো না। হঠাৎ পরিবর্তন..”
“বুঝতে শিখছে। শেখার চেষ্টা করছে। তুমি তো এটাই চেয়েছিলে।”
মাশহুদ গলার স্বর নামিয়ে বলে,”চেয়েছিলাম। কিন্তু হুট করে ওর পরিবর্তন অনুভব করে কেমন জানি লাগছে।”
“সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করোনা, ও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।”
রিকশায় দুজনে পাশাপাশি বসলেও মাঝে দূরত্ব থাকে। মাহা দূরত্ব ঘুচিয়ে মাশহুদের গা ঘেসে বসলো। মাশহুদ মাহার হাতের ওপর হাত রাখে। মাহা নিশ্চুপ থেকে বলে,
“আপনার হাত এত ঠান্ডা কেন?”
“কাছে সরে আয়, তোর গায়ে জ্বর। ”
“আপনার কাছে গেলে জ্বর কমে যাবে? আপনি ডাক্তার নাকি ঔষধ?”
“কাঁধে মাথা রেখে শান্ত হয়ে বোস।”
“যদি ঘুমিয়ে পড়ি?”
“ঘুম আসলে ঘুমা।”
“তখন আমাকে রাস্তা থেকে বাড়িতে কীভাবে নিয়ে যাবেন? পাঁজকোলা করে তুলে নিবেন? ওই নায়কের মতো?”
মাশহুদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো।মাহা মাশহুদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে। মাহা মাশহুদের কাঁধে মাথা রাখে। তপ্ত শ্বাস ফেলে। অধিকার নিয়ে বলে,
“আপনি শুধু আমার সঙ্গেই রিকশায় চড়বেন।আমাকে ভালোবাসবেন।আমি যা চাই তাই করবেন। করবেন তো?”
মাশহুদ বা-হাতে মাহাকে আগলে নিয়ে বলল,”করবো। তুই যা বলবি তাই হবে।”
“তুমি করে বলবেন, নাহলে লোকে ভাববে আমি আপনার বোন হই। তখন অন্য মেয়েরা আপনার পেছনে লেগে যাবে। অনেকে আগের মতো বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে। সকলের জানা উচিত আপনি বিবাহিত। তাই সবাইকে বলে দিবেন, আপনি বিবাহিত আর আমি আপনার বউ। ঠিক আছে?”
“বলে দিবো। মামা এবার একটু দ্রুত চলুন।”
রিকশাচালক মাশহুদের কথামতো রিকশার গতি বাড়ালেন। মাশহুদ মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
শরীরের তাপ বাড়ছে।
মাশহুদ বুঝতে পারে মাহা জ্বরের ঘোরে কথা বলছে। পরমুহূর্তেই মাহা মাশহুদের শরীরের সঙ্গে মিশে গেল। দুহাতে জড়িয়ে ধরলো মাশহুদকে।
চলবে..