সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব-১৮+১৯

0
271

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৮]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

আজকে সকাল থেকে চাঁদ তুয়াকে দেখলেই দাঁত বের করে হেসে, “আপু ভাল আছো?” বলে খিলখিল করে হেসে উঠছে।

তুয়া তখন পারছেনা লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। তুয়াকে লজ্জা পেতে দেখে চাঁদ ইচ্ছে করে একই কাজ বার বার করছে। প্রত্যয়ের আম্মু চাঁদকে ধমক দিতে গিয়ে উনিও হেসে ফেলেছেন। উনাদের হাসি দেখে তুয়া লজ্জায় আর রুম থেকেই বের হয়নি। দুপুরের খাবার সে রুমে বসে খেয়েছে৷ পেশেন্টের ভিড় বেশি থাকায় প্রত্যয় দুপুরে বাসায় আসতে পারল না। তবে তুয়াকে মেসেজ করে বলে দিল, “খেয়ে চুপটি করে ঘুমাও। আমার ফিরতে দেরী হবে।”

তুয়া প্রত্যয়ের মেসেজটা দেখে মুচকি হেসে শুয়ে পড়ল। কলি বেলকনিতে থেকে অনবরত বুলি আওড়াচ্ছে। একটুপরে,
প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার রুমের দরজা নক করে বলল, “তুয়া আসব?”

তুয়া দ্রুত উঠে বসে বলল, “হ্যাঁ আম্মু এসো।” প্রত্যয়ের আম্মু রুমে প্রবেশ করে তুয়ার পাশে বসলেন। তুয়াকে চুপ থাকতে দেখে প্রত্যয়ের আম্মু হেসে বললেন, “প্রত্যয় ফোন করেছিল? কখন ফিরবে কিছু বলেছে?” তুয়া জানাল প্রত্যয়ের ফিরতে দেরী হবে।

প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে বলল, “বোকা মেয়ে এত লজ্জার কিছু নেই।”

তুয়া প্রত্যুত্তর না করে চুপ থাকল। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়াকে ঘুমাতে বলে চলে গেলেন। উনার যাওয়ার পর পরই চাঁদকে ঢুকতে দেখে তুয়া ঘুমের ভাণ ধরে রইল। তুয়াকে ঘুমাতে চাঁদ একপ্রকার হতাশ হল। কয়েকবার তুয়ার মুখের উপর হাত নাড়িয়ে চাঁদ স্থান ত্যাগ করল। চাঁদ যাওয়ার পর তুয়া মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে নিল। এখন তুয়া ঘুমের ভাণ না ধরলে চাঁদ বকবক করে ওর মাথা পাগল করে দিত।

প্রত্যয় সব কাজ সেরে বিকালে বাসায় ফিরল। রুমে ঢুকে তুয়াকে ঘুমাতে দেখে সে নিঃশব্দে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আর এই সুযোগে তুয়া উঠে ওদের বাসায় চলে গেল। প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে এসে তুয়াকে রুমে না দেখে বলল, “হায়রে লজ্জা রে। সকালে লজ্জা পেয়ে নিজে তো ফাঁসলোই সঙ্গে আমাকেও ফাঁসালো।”

কথাটা বলে প্রত্যয় মিটিমিটি হাসতে হাসতে বেলকনিতে পা বাড়াল। কলি প্রত্যয়কে দেখে ডানা ঝাঁপটে অনবরত বলছে, “তুয়া! বউ! ভালবাসি! ভালবাসি! দুষ্টু!” প্রত্যয় হেসে কলিকে খাবার দিতে দিতে সালাম দিল। কলি অস্পষ্ট ভাবে উত্তর নিয়ে ডানা ঝাঁপটাতে লাগল। প্রত্যয় সুন্দর করে সালাম এবং সালামের উত্তম নিল প্রত্যয়ের দেখে কলিও প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল।

কলির বুলিগুলো প্রত্যয় ইচ্ছে করেই কলিকে শিখিছে। যখন কলি প্রত্যয়ের সামনে তুয়াকে অনবরত বউ! ভালবাসি! একথা বলে তুয়া তখন লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। আর এটা দেখে প্রত্যয় মিটিমিটি হাসে।

**!!

প্রিয়ম ওর রুমে উল্টো ঘুরে কিছু একটা করছিল। চাঁদ গুটি গুটি রুমে ঢুকে দুষ্টু হেসে হুট করে প্রিয়মকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়ম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে চাঁদের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। চাঁদ থাপ্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে কাঁদছে। প্রিয়ম চাঁদকে ধাক্কা মেরে বলল, “বেহায়া মেয়ে তোর লজ্জা নেই?”

চাঁদ মাথা নিচু করে নিল প্রিয়ম স্বজোরে থাপ্পড়টা মেরেছে। প্রিয়ম চাঁদকে কিছু বলতে না দিয়ে রুম থেকে বের করে স্বজোরে দরজা আঁটকে দিল।

চাঁদ পেছনে ঘুরে প্রত্যয়কে দেখে থেমে গেল। সে দ্রুত গাল থেকে হাত সরিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, “ভাইয়া কিছু বলবেন? আপুকে ডেকে দিব?”

প্রত্যয় চাঁদের কান্নাভেজা কন্ঠস্বর শুনে শান্ত কন্ঠে, “অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট। শুধু একটু ধৈর্য্য ধরো।” কথাটা বলে প্রত্যয় মুচকি হেসে রুমে চলে গেল।

চাঁদ চোখ মুছে প্রিয়মের রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, “কি জিনিস জন্মাইলেন গো শাশুড়ি আম্মা। একটু কিছু করলে দাম দুম করে ফেটে পড়ে।”

চাঁদ তুয়াকে ডেকে জানাল প্রত্যয় ডাকছে। তুয়া রুমে ঢুকে দেখে প্রত্যয় ওর ট্রলি গুছাচ্ছে। প্রত্যয় তুয়াকে দেখে বলল, “আপনি কি খুব বেশি ব্যস্ত?” তুয়া ড্রেসিং টেবিলে সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচঁড়ানো থামিয়ে বলল, “কই না তো।”

প্রত্যয় তুয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তা আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? আমার অপরাধ কি শুনি?” তুয়া হাতের চিরুনীটা রেখে ঘুরে বলল, “তেমন কিছু না জনাব। এখন চলুন, ইচ্ছের আম্মু আপনাকে ডাকছে।”

প্রত্যয়কে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে তুয়া বলল, “ইচ্ছের জ্বর এসেছে। ওকে ইনজেকশন পুশ করতে হবে।” ইচ্ছের জ্বরের কথা শুনে প্রত্যয় তুয়াকে নিয়ে নিচে গেল। চাঁদ প্রত্যয়ের আম্মুর সঙ্গে তখন ওখানেই ছিল। প্রত্যয় ইচ্ছের জ্বর মেপে ইনজেকশন রেডি করল। ইচ্ছে এখন ঘুমাচ্ছে, এই সুযোগে ইনজেকশন দিতে হবে। না হলে লঙ্কা কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে।

তুয়া চাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ধীর কন্ঠে বলল, “চাঁদ তোমার গালে কি হয়েছে?” চাঁদও আস্তে করে বলল, “তোমার দেবর চুম্মিয়ে গাল লাল করে দিয়েছে।”

তুয়া কিছু বলার আগে প্রিয়ম পেছন থেকে রেগে বলল, “তুই কি মানুষ হবি না? জংলী সারাজীবন জংলীই থাকবি?” প্রিয়ম ইশারায় ওর আম্মুকে বলে বাইক নিয়ে চলে গেল। চাঁদের মুখের অবস্থা দেখে তুয়া মুখে ওড়না গুঁজে হাসতে লাগল। তুয়াকে হাসি দেখে প্রত্যয় ইনজেকশন দিতে গিয়ে থেমে গেল। তুয়া হাসি আঁটকাতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে বাসায় চলে এল।

প্রত্যয় ইচ্ছেকে ইনজেকশন পুশ করে দ্রুত সিরিঞ্জ সরিয়ে ফেলল। ইচ্ছে একটু ব্যাথা পেয়ে চোখ বন্ধ খুলে চোখ বড় বড় করে তাকাল। প্রত্যয় হেসে বলল, ” ইচ্ছেমণি তোমার জ্বরের আমাকে জানাও নি কেন? আমি এজন্য তোমাকে দেখতে আসলাম।”

প্রত্যয় কৌশলে ইচ্ছেকে কোলে তুলে ইনজেকশন পুশ করা স্থানে হালকা করে ডলতে লাগল। ইচ্ছে প্রত্যয়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আমি সূচ দিব না।”

প্রত্যয় হেসে বলল, “কার এত সাহস তোমাকে সূচ দিবে? যে সূচ দিবে তাকে আমি পুলিশের কাছে রেখে আসব।” প্রত্যয়ের কথা শুনে রুমের সবাই হাসল। প্রত্যয় খুব সহজে ইচ্ছেকে সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিল। এখানে অন্য কেউ থাকলে এতক্ষণে ইচ্ছে তাকে কামড় আর খামচি দিয়ে আধমরা করে দিত। মূলত এজন্যই ইচ্ছের আম্মু বুদ্ধি করে প্রত্যয়কে ডেকেছে।

ইচ্ছে প্রত্যয়ের কাঁধ থেকে মাথা তুলে বলল, “প্রত্তুয় কানাচুর আনো নি।” প্রত্যয় ইচ্ছেকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতে যেতে বলল, “উহুম, এখানে আনলে রুমের সবাই কেড়ে খেতে নিত। এখন তুমি আমার বাসায় চল ওখানে গিয়ে চানাচুর খাবে।” ইচ্ছে রুমের সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “সব্বাই লুভি।”

ইচ্ছের কথা শুনে সবাই উচ্চশব্দে হাসতে লাগল। আর প্রত্যয় ইচ্ছেকে নিয়ে বাসায় চলে এল। তুয়া ড্রয়িংরুমের মেঝেতে বসে এখনও হাসছে। আর চাঁদ গাল ঝুলিয়ে সোফায় বসে আছে। এখন তুয়া চাঁদকে দেখে বার বার বলছে, “আর আদর লাগবে চাঁদ ডালিং?” কথাটা বলে তুয়া আবার হাসতে লাগল। প্রত্যয় ইচ্ছে কে সোফায় বসিয়ে চানাচুর এনে দিল।

ইচ্ছে চানাচুর নিয়ে প্রত্যয়ের বুকে সাথে লেপ্টে বসে রইল। তুয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “ইচ্ছে তুই এত লোভী কোনো? তুই সত্যিই খুব পঁচা মেয়ে।” ইচ্ছে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল, “তেনু?” তুয়া রাগের অভিনয় করে বলল, “আমার বরের বুকে মাথা রাখছিস কেন? সর, সর বলছি।”

তুয়ার কথা শুনে ইচ্ছে প্রত্যয়ের দিকে ছলছল চোখে তাকাল। প্রত্যয় হেসে ইচ্ছের চোখ মুছে দিয়ে বলল, “আরে ও তো একটা পাগলি। ওর কথা একদম শুনবে না।” ইচ্ছে তুয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে তুয়া রেগে তাকিয়ে আছে। প্রিয়মকে বাসায় ঢুকতে দেখে ইচ্ছে ওর দিকে বাড়িয়ে বলল, “প্রিউুম কোলে যাব।” প্রিয়ম হাতের ব্যাগটা রেখে হেসে ইচ্ছেকে কোলে নিল। ইচ্ছা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,”তুয়া আপু বকছে। তুমি বকা দাও।”

প্রিয়ম বাহানা করে তুয়াকে বকা দিল। প্রিয়মের বকা দেখে তুয়া আর চাঁদ হো হো করে হেসে দিল। ওদের হাসতে দেখে ইচ্ছে করুন চোখে প্রিয়মের দিকে তাকাল। তুয়া উঠে ইচ্ছেকে বলল, “যা আমার শশুড়বাড়ি একদম আসবি না। এবার আসলে মেলা বকা দিব।” ইচ্ছেও এবার রেগে বলল, “একদম বকা দিবা না, না হলে আমিও শুশুর বালি চলে যাব।”

ইচ্ছের কথা শুনে চাঁদ তুয়া সহ প্রিয়মও হেসে দিল। ইচ্ছে আর সহ্য করতে না পেরে প্রিয়মের চুল টেনে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল। প্রত্যয় উঠে প্রিয়মের চুল ছাড়িয়ে ইচ্ছেকে কোলে নিল। প্রত্যয়ের আম্মু চাঁদ তুয়াকে দেখে বললেন, “কি রে এত হাসছিস কেন?”

প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “সারাটা দিন কানের কাছে খ্যা খ্যা করতেই থাকে। আম্মু ইট দিয়ে এদের দাঁত ভেঙ্গে দাও যাতে লজ্জায় হাসতে না পারে।” প্রিয়মের কথা শুনে চাঁদ তুয়াসহ প্রত্যয়ের আম্মুও হাসতে লাগলেন। প্রিয়ম সোফাতে বসে বলল, “এই দু’টোকে রাজশাহীতে রেখে আসবে। এদের আর আনার দরকার নেই।” প্রত্যয়ের আম্মু হেসে প্রত্যয়কে বলল, “কি আব্বু সত্যি ওদের রেখে আসব?” প্রত্যয় তুয়া মুচকি হেসে বলল, “হুম রেখে এসো, আরেকটা বিয়ে করতে পারব।” প্রত্যয়ের আম্মু হাসতে হাসতে বললেন, “ছেড়ে থাকতে পারবি তো আব্বু?”

প্রত্যয় কিছু বলতে পারল না পেরে ইচ্ছেকে নিয়ে রুমে চলে গেল। তুয়ার ততক্ষণে হাসি থেমে লজ্জা এসে লাল হয়ে গেছে। প্রত্যয়ের আম্মু হেসে রুমে চলে গেলেন। তুয়াও উঠে প্রত্যয়ের রুমে ঢুকল। প্রিয়ম সোফাতে শুয়ে টিভির চ্যালেন বদলাতে লাগল। চাঁদ দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে প্রিয়মকে করুণ সুরে বলল, “আমাকে একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? ভালবাসার অধিকারটুকু না হয় দাও।” প্রিয়মের প্রত্যুত্তর না পেয়ে চাঁদ মন খারাপ করে উঠে দাঁড়াল।

**!!

রনিত পলককে নিয়ে বাজার থেকে কেবল ফিরল। রনিতের আম্মু বার বার ফোন দিয়ে কান্না কাটি করছেন। রনিত উনাকে বলে দিয়েছে মাঝে মাঝে বেড়াতে যাবে। একথা শুনে উনি নতুন করে পলকের নামে অভিযোগ তুলে ধরেছেন। বার বার বোঝাচ্ছেন পলক মেয়ে ভাল না। এসব শুনে রনিত রেগে কল কেটে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। সংসার যদি সুখের হয় সেটা জান্নাতে পরিণত হয়। আর যদি সংসারে অশান্তি লেগে থাকে সেটা জাহান্নামে পরিণত হতে সময় লাগে না। একথা সে যেন হারে হারে টের পাচ্ছে।

পলক ওদের ফ্ল্যাটটা মনমত গুছিয়ে নিয়েছে। এখানে ওরা দু’জন মিলে ভালবাসায় মুড়ানো ছোট্ট একটা সংসার পাতবে। রনিত ইচ্ছের ঔষুধ আর কিছু ফল ইচ্ছেদের বাসায় দিয়ে বাসায় আসল। পলককে রান্না ঘরে দেখে রনিত সোফায় বসে বলল, “যা করবে সাবধানে। হাতে কাটে না যেন।” কথাটা শুনে পলক মুচকি হাসল।

**!!

ইচ্ছের আম্মু এসে ইচ্ছেকে বাসায় নিয়ে গেল। হালকা নাস্তা সেরে প্রত্যয়ের বাসার সবাই রেডি হচ্ছে। তুয়াকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে হিজাবে পিন আঁটকে ঘুরতেই প্রত্যয় তুয়াকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলল, “আমার বউটাকে তোমার কাছে আমানত রাখলাম। আমি ফিরে এসে আমার বউকে নিখুঁতভাবে বুঝে নিব।”

প্রত্যয় কথাটা বলে তুয়ার কপালে আদর দিল। তুয়া ছলছল চোখে অন্য দিকে তাকাল। সে অনেকক্ষণ থেকে চোখের পানি আঁটকে রেখেছিল। কিন্তু প্রত্যয়ের কথা শুনে হার মেনে অশ্রুটুকু গড়িয়ে গেল। প্রত্যয় তুয়ার দুই গালে হাত রেখে বলল, “সাবধানে থাকবা আর যা লাগবে আম্মু আর প্রিয়মকে বলবে।”

তুয়ার চোখের পানি মুছিয়ে প্রত্যয় মৃদু হেসে পা বাড়াতে যাবে, তখন তুয়া প্রত্যয়ের শার্ট টেনে জড়িয়ে ধরে বলল, “জনাব আপনার অপেক্ষা থাকব। আপনি দ্রুত আমার কাছে ফিরে আসবেন।”

প্রত্যয় সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল। কলিকে তুয়াদের বাসায় রেখে উনাদের থেকে বিদায় নিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ল। ওদের যেতে দেখে ইচ্ছে বায়না ধরবে তাই কেউ আর ইচ্ছের সঙ্গে দেখা করল না। এয়ারপোর্টে পৌঁছে প্রত্যয় প্রিয়মের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “সাবধানে যেও আর সবার খেয়াল রেখো।” প্রিয়ম প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমিও সাবধানে যেও ভাইয়া। চিন্তা করো না আমি আছি।”

প্রত্যয় ওর আব্বু আম্মু চাঁদ আর তুয়াকে সাবধানে থাকতে বলল। তুয়াতের ফ্লাইট আগে তাই তুয়ারা আগে যাবে। তুয়া সামনে এগোতে এগোতে কতবার যে পেছন ফিরে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়েছে তার হিসাব নেই। প্রত্যয় মুচকি হেসে ওদের যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে। তুয়াদের যাওয়ার বিশ মিনিটে পরে প্রত্যয়ও ওর পথে যাত্রা পথে রওনা দিল।

সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৯]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

মাত্র পঁচিশ মিনিটে তুয়ারা ঢাকা থেকে রাজশাহীতে পৌঁছে গেল। প্রিয়ম প্রত্যয়কে মেসেজ করল,” আমরা পৌঁছে গেছি।”

পাঁচজন এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে অটোতে উঠে বসল। প্রত্যয়ের আব্বু অটো ওয়ালার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। চাঁদ আর তুয়া রাজশাহীর রাতের সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে। শিক্ষার নগরী রাজশাহীর রাস্তা গুলোতে ছাত্র ছাত্রীদের ভিড় দেখা যাচ্ছে, যদিও তারা নিজ নিজ কাজের ব্যস্ত। লাইটের ঝলকানিতে পরিষ্কার পরিছন্ন রাজশাহী দেখতে বেশ লাগছে।
প্রত্যয়ের আব্বু তুয়া চাঁদকে ইশারা করে এটা ওটা দেখাচ্ছেন। প্রায় পনেরো মিনিট পর প্রিয়মরা ওদের বাড়ির গলিতে ঢুকল। এটা প্রিয়মদের নিজস্ব বাড়ি আর পাশের টা ওর ছোট চাচার বাড়ি। ওর চাচি ওদের বাড়িটা খুব সুন্দর গুছিয়ে পরিপাটি করে ওদের জন্য রান্নাও করে রেখেছেন।

প্রিয়মদের কে বাড়ির দরজায় ঢুকতে দেখে পাশের ছাদ থেকে এক ভাবি বললেন, “কি গো প্রত্যয়ের আম্মু মেয়ে দুইটা কে?” প্রত্যয়ের আম্মু বললেন, “আমার পুত্রবধূ।” ভাবিটা আর একটু ঝুঁকে তুয়া আর চাঁদকে পরখ করে বললেন, “লালডা নাকি কালোডা?”

উনার কথাটা শুনে তুয়া আর চাঁদ একে অপরের দিকে তাকাল। প্রিয়ম হাতের ট্রলি টা রেখে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। ওই ভাবিটা উত্তর না পেয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, “লালডা প্রত্যয়ের নাকি কালোডা?” প্রত্যয়ের আম্মু উনার কথা বুঝতে না পেরে তুয়াদের দিকে তাকালেন। তুয়া কালো রংয়ের ড্রেস পরিহিত আর চাঁদ লাল রংয়ের। এবার উনি ব্যাপারটা বুঝে হেসে বললেন, “কালোডা প্রত্যয়ের আর লালডা প্রিয়মের।”

প্রত্যয়ের আব্বু আর প্রিয়ম হাসতে হাসতে বাড়িতে ঢুকে গেল। প্রত্যয়ের আম্মু ওই ভাবির সঙ্গে কথা বলছেন। উনাদের কথা শুনে চাঁদ তুয়াকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে বলল, “এতকিছু থাকতে অবশেষে গরুর সঙ্গে তুলনা করল।”

তুয়া বিরবির করে বলল,” চাঁদ, আমরা যদি সত্যি গরু হতাম। তাহলে উনারা বলতেন কালো গরুটা প্রত্যয়ের আর লাল গরুটা প্রিয়মের। এখন গরুর খেতাব পেলাম তবে গরু হয়নি আমাদের ভাগ্য ভাল।”

কথাটা শুনে চাঁদ করুণ চোখে তুয়ার দিকে তাকাল। ওরা ভাবিটাকে কিছু বলতে পারল না। শুধু জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে পিলারের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

প্রত্যয়ের চাচি তুয়া আর চাঁদকে রুম দেখিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললেন। তুয়া প্রত্যয়ের রুমে ঢুকে ট্রলি রেখে পুরো রুমে চোখ বুলালো। রুমে প্রত্যয়ের বেশ কয়েকটা ছবি টানানো আছে। তন্মধ্যে ডান দেওয়ালে ডক্টরের এপ্রোণ পড়ে গলায় থ্রোথোস্কোপ ঝুলিয়ে, দুই হাত বুকে আড়াআড়ি ভাবে রেখে প্রত্যয়ের একটা ছবি বড় করে বাঁধিয়ে রাখা। তার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে মুচকি হাসি। তুয়া ছবিটার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, “জনাব আপনাকে দেখতে বেশ লাগছে।”
ছবিটাতে প্রত্যয় মুচকি হেসে যেন তুয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে।

তুয়া হিজাব খুলে রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। এটা যে কোনো ডক্টরের রুম বোঝাই যাচ্ছে। রুমের এক কোণে ইউনিক ডিজাইনের বইয়ের তাকে ইয়া মোটা মোটা বই সাজানো। ডাক্তারী সব জিনিসপত্রসহ পরিপাটি করে রুমটা সাজানো গুছানো। তুয়া ফ্রেশ হয়ে এসে ওর আম্মু সঙ্গে কথা বলল। তারপর প্রত্যয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে মুচকি বলল, “পঁচা ছেলে হ্যাংলার মত তাকাবেন না।”

একটুপরে, প্রত্যয়ের আম্মু চাঁদ তুয়াকে ডেকে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখালেন। প্রিয়মের চাচীর সঙ্গে অনেক গল্প করে
রাতে খেয়ে যে যার রুমে শুতে চলে গেল।

**!!

প্রত্যয় যথাসময়ে প্যারিসে পৌঁছে রেস্ট নেওয়ার সময়টুকুও নিল না। ওর এক টিচারের চিকিৎসা করতেই সে মূলত এখানে এসেছে। উনার অবস্থাও এখন খুব একটা ভাল নয়। হার্ট ব্লক হয়ে যে কোনো মুহূর্তে কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। উনি আপাতত হসপিটালেই ভর্তি আছেন আর প্রত্যয় নিজে এসেছে উনার সঙ্গে দেখা করতে। প্রত্যয়ের উনার সব রিপোর্ট দেখে উনার দিকে তাকালেন। উনিও একজন কার্ডিওলজিষ্ট উনার থেকে কিছু লুকানো সম্ভব নয়। প্রত্যয়কে তাকাতে দেখে উনি প্যারিসের ভাষায় মৃদু হেসে বললেন, “ওয়াসিক, আমার অপারেশনটা তুমি নিজে করো। হতাশার কিছু নেই মৃত্যু তো আমাদের সৃষ্টিকর্তার হাতে।”

হার্ট ব্লকের প্রাথমিক অবস্থায় উনি ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। মাঝখানে কয়েক বছর ভালোই ছিলেন কিন্তু গত ছয়মাস ধরে আবার সমস্যা দেখা দিয়েছে। এবং বুঝেছে উনার হার্টে ব্লকের সংখ্যা বেশি হওয়াই রিং বসানোটা সুবিধাজনক হবে না। আর এক্ষেত্রে উনাকে বাইপাস সার্জারি করাতে হবে। উনি প্রত্যয়কে এটাও জানালেন, সার্জারিটা রিস্কি তাই কেউ রাজি হচ্ছে না। অনেকে ভাবছে, বয়স বেড়েছে ধকলটা উনি সামলে উঠতে পারবেনা।

প্রত্যয় আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ওর লক্ষ্য স্থির করল। এবং জানাল কালকে সকাল ছয়টায় উনার অপারেশনটা সে করবে। একথা শুনে এর স্যার খুব খুশি হলেন। প্রত্যয় উনার থেকে বিদায় নিয়ে কালকে ওটি রেডি রাখার কথা জানিয়ে কেবিনে আসল। এই হসপিটালেই প্রত্যয়ের জন্য স্পেশাল কেবিন বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রত্যয়ের যে টেনশন হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। সকল টেনশনকে দূর করে প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে খেয়ে টানা কয়েক ঘন্টা নিশ্চিন্তে ঘুমাবে বলে ঠিক করল। তারপর কালকে সকালে ঠান্ডা মস্তিষ্কে সার্জারি করতে যাবে।

পরেরদিন সকালে প্রত্যয় ওটির ড্রেস পড়ে ওটিতে ঢুকল। কয়েকজন ডক্টর আর নার্স আগেই সব রেডি করে রেখেছিলেন। প্রত্যয় নার্সকে ইশারায় কিছু বলল। তারপর ওর স্যারের সামনে বসে উনার হাতটা শক্ত করে ধরে মুচকি হেসে বললেন, “স্যার, দোয়া করবেন যেন সফল হতে পারি।”

স্যার প্রত্যয়ের গালে হাত রেখে মৃদু হেসে বললেন, “আমার গর্ব হচ্ছে যে আমার ছাত্র আমার হার্ট অপারেশন করছে। আর হ্যাঁ ফল যেটাই আসুক ভাববে সৃষ্টিকর্তার মর্জি।”

কথাটা বলে উনি ধীরে ধীরে চোখ দু’টো বন্ধ করে নিলেন।অঙ্গানের ইনজেকশন পুশ করায় উনি অঙ্গান হয়ে গেলেন। উনার চোখের কার্ণিশ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, আর প্রত্যয়ের হাত থেকে উনার হাতটা ঢিলে হয়ে গেল। প্রত্যয় উনার হাতটা সাইডে রেখে উনার মুখের দিকে তাকাল। তারপর সবাইকে কাজ শুরু করার ইশারা করল। ওটিতে অতি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা সম্পূৃর্ণ নিষেধ, এখানে মস্তিষ্ক ঠান্ডা রেখে হাতের কাজ করতে হয়। প্রত্যয় হাতে গ্লোভস আর মুখে মাস্ক পড়ে আল্লাহকে স্মরণ করে কাজ শুরু করল।

ওর স্যারের বাড়ির লোকেরা অশ্রু ঝরিয়ে ওটির বাইরে অপেক্ষা করছে। প্রত্যয় জানেনা উনাদের মুখে হাসি ফুটাতে পারবে কি না। তবে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে আর বাকিটা আল্লাহ ভরসা।

**!!

ইচ্ছে সুস্থ হয়ে আজকে সকালে প্রত্যয়ের বাসায় এসেছে। ওর ছোট ছোট হাতে ফ্ল্যাটের দরজায় বারি মেরে ডাকছে, “প্রত্তুয়! প্রিউুম! দলজা খুলছ না কেনু? আমি বাসায় ঢুকব দলজা খুলে দাও। তুয়া আপু, তাঁদ আপু দরজা খুলে দাও। প্রত্তুয়ের আম্মু দলজা খুলে দাও।”

ইচ্ছের গলা শুনে তুরাগ বেরিয়ে ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিলে। প্রত্যয়রা দরজা খুলছেনা দেখে ইচ্ছে কেঁদেও দিয়েছে। তুরাগ ইচ্ছের চোখ মুছে দিয়ে বলল, “ওরা কেউ বাসায় নেই।” ইচ্ছে ঠোঁটে ফুলিয়ে একহাত দিয়ে চোখ ডলে হেঁচকি তুলে বলল, “ওলা সব্বাই কুথায়?” তুরাগ ইচ্ছেকে ওদের বাসায় নিয়ে যেতে যেতে বলল,” ওরা সবাই রাজশাহীতে বেড়াতে গেছে কিছুদিন পর ফিরবে।” ইচ্ছে শব্দ করে কেঁদে বলল, “আমি লাজসাইতে বেলাতে যাব।”

তুরাগ ইচ্ছেকে ওর ফোনে টকিং টম বের করে দিল। কিন্তু সে ফোনটা নিচ্ছে বরং একমনে কেঁদেই যাচ্ছে। তুরাগ আর না পেরে ইচ্ছেকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরতে বের হল। আশেপাশে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে তুরাগ ইচ্ছেকে বলল, “ইচ্ছে আমি রাজশাহীর রাস্তা চিনতে পারছিনা। আমরাও মনে হয় এখন হারিয়ে গেছি।”

ইচ্ছে চমকে উঠে তুরাগের দিকে তাকিয়ে চুপ থেকে বলল, “প্রিউুমকে ফুন দাও।” এবার তুরাগ আড়চোখে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে বোকা সেজে দাঁড়িয়ে রইল। ইচ্ছে প্রচুর টাউট একটা বাচ্চা ওকে সহজে ঘোল খাওয়ানো যায় না। তুরাগ ফোন বের করে ওরই একটা বন্ধ সিমে কল দিয়ে ইচ্ছেকে ধরিয়ে দিল। ইচ্ছে ফোন বন্ধ পেয়ে মন খারাপ করে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “ওদের সাতে আল কথা বলব না। ওলা আমাকে মেলা দুঃখু দিসে।”

তুরাগ ইচ্ছেকে বুঝিয়ে আর কিছুক্ষণ ঘুরে দু’জনে মিলে বাসায় ফিরল। ইচ্ছে পেছনে ফিরে তাকাও নি সোজা ওর বাসায় ঢুকে গেছে।

**!!

দুইদিন পর তুয়া মন ভার করে রুমে বসে আছে। এই দুইদিনে প্রত্যয়ের সঙ্গে ওর কোনো কথা হয়নি। প্রত্যয় ওর আম্মুকে শুধু ফোন করে শুধু জানিয়ে, সে খুব ব্যস্ত ফ্রি হয়ে ফোন দিবে। এতটুকু তাছাড়া প্রত্যয়ের কোনো খবরই তুয়া জানেনা। তুয়া প্রত্যয়ের ছবির দিকে অভিমান নিয়ে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরাল। ওর মনে প্রত্যয়ের প্রতি এক পাহাড় সমান অভিমান এসে জমেছে।

প্রত্যয়ের আম্মু চাঁদকে নিয়ে পাশের বাড়ি বেড়াতে গেছে। তুয়া দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছিল তাই আর ওকে ডাকেনি। প্রিয়ম এসে রুমের দরজায় নক করল, তুয়া শরীরে ওড়না জড়িয়ে প্রিয়মকে ভেতরে আসতে বলল। প্রিয়ম মুচকি হেসে তুয়াকে বলল, “দ্রুত রেডি হও আমরা দু’জন ঘুরতে যাব।” তুয়া চাঁদকে ডাকার কথা বললে প্রিয়ম নিষেধ করে দেয়। এবং প্রিয়মের জোরাজুরিতে তুয়া প্রিয়মের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়।

প্রিয়ম রাজশাহীর টি বাঁধে তুয়াকে ঘুরতে নিয়ে গেল। শান্তির নগরী রাজশাহীতে নিমিষেই মন ভাল হওয়ার মত এই জায়গাটি। অনেক মানুষ ঘুরতে এসেছে একটা বাচ্চা ছেলে খিলখিল করে হেসে, ওর বোনকে ধরার চেষ্টা করছে। ওর বোনটা ফোকলা দাঁতে হেসে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। পদ্মা নদীর পাড়ে টি বাঁধটি তৈরী করা হয়েছে। প্রিয়ম তুয়াকে নিয়ে সুন্দর একটা জায়গায় বসল। বিকেলের মৃদু বাতাসে এসে শরীরে লেগে মনটাও ঠান্ডা করে দিচ্ছে। নদীর ছোট ছোট ঢেউ এসে তীরে বারি খেয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে।
তুয়ার চোখ বন্ধ করে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “বাতাসের সঙ্গে মিষ্টি একটা ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে।”

নদীর ছলাৎ ছলাৎ পানি শব্দে দমকা বাতাস এসে তুয়া চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। প্রিয়ম তুয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। তুয়া উঠে খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটাহাটি করছে আর ওর উড়ন্ত চুলগুলো উন্মুক্ত হয়ে উঠছে। প্রিয়ম ওর ফোন বের করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিল। তুয়া প্রিয়মকে ছবি তুলতে দেখে বলল, “পরে ছবিগুলো আমাকে দিয়ে দিবেন।”

প্রিয়ম হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে হাসল। প্রিয়ম তুয়ার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে সেও তুয়া সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে শান্ত কন্ঠে বলল, “তুমি তো ধর্ষিতা নয় তুমিও জানো। তাহলে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলে কেন? আমার কাছে শেয়ার করতে পারো।”

তুয়া হাঁটা থামিয়ে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিল। প্রিয়ম এর আগেও এই কথাটা বলেছে সেদিন তুয়া কিছু বলতে পারেনি। তাই আজকে কিছু বলার জন্য আগের স্থানে এসে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে বলল, “আপনি জানলেন কিভাবে?” প্রিয়ম দ্বিধাহীন ভাবে অকপটে বলল,” ভাইয়া বলেছে।”

প্রত্যয় প্রিয়মকে বলেছে কথাটা শুনে তুয়া অবাক হল। প্রত্যয়েরও তো জানার কথা না সে বা জানল কিভাবে? তুয়ার ভ্রু কুঁচকানো দেখে প্রিয়ম বলল, “যেদিন হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলে সেদিনই ভাইয়া তোমার সব রিপোর্ট দেখেছিল। একজন ধর্ষিতাকে বেশ কয়েকটা টেষ্ট করা হয় আর তাতে প্রমানও মিলে ধর্ষণ হওয়ার। কিন্তু তোমার বেলায় রিপোর্টে এসেছে,” সি ইজ নট রেপড।” অর্থাৎ তুমি কারো কাছে ধর্ষিতা হতে যাচ্ছিলে কিন্তু হওনি।”

তুয়া এই মুহূর্তে স্বীকার করল সে ধর্ষিতা নয়। আর ওই ছেলেগুলোর এটাই মূল লক্ষ্য ছিল। যে তাকে ধর্ষণ না করেও তার শরীরে ধর্ষিতার কলিমা লাগানো। এজন্যই তারা তাকে বাজে ভাবে ছুঁয়েছে, জামা ছিঁড়ে দিয়েছে, ওকে থাপ্পড় মেরে ঠোঁটে কেটে দিয়েছে, ওর গলায় ইচ্ছেমত নখ দিয়ে আঁচড় কেটেছে, বিশ্রী ভাবে হেসে ওর হাত বেঁধে ওর কাঁধে,গালে, গলায় কামড় বসিয়েছে। তারপর রাস্তায় স্বজোরে ধাক্কা মেরে বলেছে,” এবার প্রমান কর তুই ধর্ষিতা নয়।”

তুয়া ওই অবস্থায় বাসায় ফিরার সময় অনেকজন কটু কথা বলেছে। কেউ কেউ ঘৃণিত চোখে তাকিয়ে বলেছে, মরে যেতে। রাস্তার পথচারীরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। দুইজন ছেলে ওর পাশাপাশি হেঁটে বিশ্রীভাবে হেসে বলেছে, “আমাদের সঙ্গে আর একবার যাবি?” তুয়া কেঁদে কেঁদে ছেলে গুলোকে চিৎকার করে বলেছে, ”সে ধর্ষিতা নয়।”

কিন্তু তুয়ার কথা শুনে ছেলেগুলো নোংরা ভাবে হেসে বলেছে , ‘চোর মার খেয়ে বলে সে চোর নয় চুরি করেনি। তুইও দেখি এখনও একই বুলি আওড়াচ্ছিস। সে যাই হোক খাওয়া মাল খাওয়ার ইচ্ছে আমাদের নেই।”

কথাটা বলে ছেলে দুইটা হাসতে হাসতে চলে গেছে। তুয়ার মস্তিষ্কে তখন এটাই ঘুরছিল ধর্ষিতা না হয়েও তাকে শাস্তি পেতে হবে। সে কাউকে বোঝাতেও পারবেনা সে ধর্ষিতা নয়। শুধু নিজে সত্যি জেনে তো আর সবাইকে বিশ্বাস করানো যাবে না। এসব ভেবে একপর্যায়ে সেও মেনে নিয়েছিল, সে ধর্ষিতা। হাস্যকর ব্যাপার হলেও সত্যি ধর্ষিতা প্রমান করা সহজ হলেও, ধর্ষিতা নয় প্রমান করা সহজ নয়। শরীরে এত দাগ নিয়ে সে যদি বলত সে ধর্ষিতা না, তাহলে সবাই বলত সে মিথ্যা বলছে। জোর করে ধর্ষিতার কলিমা শরীরে লেপ্টে দিত। তাই অন্যের থেকে না নিয়ে তুয়া নিজেই মেনে নিয়েছিল সে ধর্ষিতা। আর প্রত্যয় সব জেনেও চুপ ছিল কারণ তখন কিছু বললে কেউ বিশ্বাস করত না। বরং সবাই বলত মিথ্যা রিপোর্ট বানিয়ে সত্যিটা আড়াল করছে। মূলত এজন্যই প্রত্যয় বোকার মত জল ঘোলা না করে চুপ ছিল।

কথাগুলো বলতে বলতে তুয়া নিঃশব্দে অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়ম কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেল না। প্রিয়ম বোঝাতে পারছেনা ওর বুকে তখন কেমন তোড়পাড় হচ্ছিল আর এখন কেমন হচ্ছে। চাঁদকে বাসায় নিয়ে আসার দিন রাতে প্রত্যয় ছাদে প্রিয়মকে শুধু এতটুকুই জানিয়েছিল, তুয়া ধর্ষিতা নয়। আর একথা মাত্র তিনজন জানে তুয়া, প্রত্যয় আর প্রিয়ম।

তুয়া দুরে দৃষ্টি রেখে কান্নারত কন্ঠে বলল,”প্রত্যয়ের প্রতি আমার ভালবাসাটা না ঠুনকো ছিল আর না আছে। মনের গহীনে ওকে হারানোর ভয় এসে বাসা বেঁধেছে। জানিনা কেন মনে হচ্ছে প্রত্যয় আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। আজকে দুইদিন ওর সঙ্গে কথা হয়নি। সে কবে ফিরবে? আর আদৌও ফিরবে কি না তাও জানিনা।”

তুয়ার বলা শেষ কথাটা শুনে প্রিয়ম আঁতকে উঠল। প্রত্যয় তো ওর মনের সব কথাও জানে, তাহলে কি প্রত্যয় সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল? নাকি প্রিয়মের উপর রাগ করে এমন সিধান্ত নিল? এসব প্রশ্ন প্রিয়মের মাথায় এসে ভর করল। যদি এমন কিছু হয়ে থাকে তাহলে ওদেরকে কঠিন ঝড়ের সম্মুখীন হতে হবে। এসব ভেবে অজানা এক ভয়ে প্রিয়মের বুকটা কেঁপে উঠছে। প্রিয়ম সন্ধ্যায় পর পরই তুয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আবার চলে গেল।

প্রিয়ম ভাবছে সে সরাসরি প্রত্যয়ের সঙ্গে কথা বলবে। তুয়াকে সে পায়নি ঠিক আছে, তারমানে এই না প্রত্যয়ের থেকে তুয়াকে কেড়ে নিবে। আর মূল কথা তুয়া জানেও না প্রিয়ম ওকে ভালবাসে। চিন্তিত হয়ে প্রিয়ম বেশ কয়েকবার প্রত্যয়কে ফোন দিল কিন্তু ফোন বন্ধ পেল। টেনশনে প্রিয়ম ঘামতে শুরু করেছে। প্রত্যয়ের সঙ্গে কোনো ভাবেই যোগাযোগ করতে না পেরে, প্রিয়ম ওর চুল মুঠো করে ধরে বিরবির করে বলল, “এমন ধ্বংস লীলা শুরু করো না, ভাইয়া। সব শেষ হয়ে যাবে, সব।”

To be continue….!!