সুদর্শন শঙ্খচিল পর্ব-৬+৭

0
270

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[০৬]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

তুয়া কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ঢুকল। প্রত্যয়ের আম্মু সহ কয়েকজন ভাবিরা মিলে তুয়াদের দরজার সামনে গল্প করছিলেন। তুয়াকে দেখে সবার কথা বন্ধ হয়ে গেল। তুয়া কাঁদতে কাঁদতে ওর আম্মুকে জড়িয়ে ধরল। তুয়া উচ্চশব্দে কেঁদে কেঁদে বলল, “আম্মু! আম্মু গো! আমার সাথে কেন এমন হলো? তোমার মেয়ে নোংরা হয়ে গেছে, আম্মু।”

তুয়ার আম্মু মেয়ের কথা শুনে থরথর করে কাঁপছেন। ওখানকার উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। তুয়ার ছেঁড়া জামা, কাটা ঠোঁট, এলোমেলো চুল, গলা-হাতে আঁচড়ের দাগ থেকে স্পষ্ট যে ওর সাথে কি ঘটেছে। তুয়ার আম্মু মেয়ের অবস্থা দেখে যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। তুরাগ কেবল অফিস থেকে বাসায় ফিরল। তুয়ার আম্মু মেয়ের অবস্থা দেখে সেন্সলেস হয়ে গেলেন। সবাই উনাকে ধরে রুমে নিয়ে গেল। তুরাগ বাসায় ঢুকে এত মানুষ দেখে আতংকে উঠল। সে ধীর পায়ে ওর আম্মুর রুমে গেল। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার আম্মুর মুখে পানি ছিটাচ্ছেন, তবুও উনার সেন্স ফিরছে না। তুয়া কাঁদতে কাঁদতে ওর আম্মুর হাতে পায়ে মালিশ করছে। তুরাগ দ্রুত এসে ওর আম্মুকে ডাকতে লাগল। উনার কোনো সাড়াশব্দ নেই। পানি ছিটানো, হাতে-পায়ে মালিশ করার বেশ কিছুক্ষণ পর উনার সেন্স ফিরল। উনি তুয়ার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তুরাগ এবার তুয়ার দিকে খেয়াল করল। তুয়ার অবস্থা দেখে ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বোনকে দেখে ওর কলিজা কেঁপে উঠল। তুয়া কাঁদতে কাঁদতে ওর রুমে চলে গেল।

এতটুকু সময়ের মধ্যে তুয়ার ধর্ষিত হওয়ার খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে গেল। খারাপ খবর নাকি বাতাসের আগে ছড়ায়। এখানে ব্যাপারটা তাই ঘটল। এটা নিয়ে পুরো বিল্ডিং জুড়ে কানাঘুষা চলছে। বিল্ডিংয়ের অনেকে এসে ওদের শান্তণার বাণী দিয়ে যাচ্ছে। কেউ বা আকার ইঙ্গিতে কটু কথা শুনাচ্ছে। কেউ বা তুয়ার বিয়ে নিয়ে আপসোস করছে। তুয়া ওর রুমে বসে উচ্চ শব্দে কাঁদছে। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার আম্মুকে বলছেন, “ভাবি কাঁদবেন না। আপনি ধৈর্য ধরুন। মেয়েটাকে তো আপনাকেই সামলাতে হবে।”
“আমার কপাল পুড়েছে, ভাবি। আমিই জানি আমার কি হচ্ছে। আজকে সবাই আমাকে সান্ত্বনার বাণী শুনাচ্ছে। কাল সবাই আমার মেয়ের দিকে আঙ্গুল তুলবে। তাকে উঠতে বসতে কথা শুনতে হবে। আমি মা হয়ে কিভাবে সহ্য করব? আমার মেয়েটার শরীরে যে ধর্ষিতার কালিমা লেগে গেছে। আমার কলিজার টুকরো মেয়েটার এবার কি হবে? আল্লাহ! আল্লাহ গো! আমি কি অপরাধ করেছিলাম? আমাকে কেন এমন বিপদে ফেললে? গো আল্লাহ?”

প্রত্যয়ের আম্মু আর কিছু বললেন না। তুয়ার আম্মু উচ্চশব্দে কাঁদছেন। উনি মা হয়ে মেয়ের এত করুণ অবস্থা কিভাবে সহ্য করবেন? উনার কলিজার টুকরো মেয়েটার লোকচক্ষুর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে? সমাজের লোকদের কটু কথার হাত থেকে মা হয়ে উনি কিভাবে মেয়েকে রক্ষা করবেন? আমাদের সমাজে ধর্ষকের থেকে ধর্ষিতার শাস্তি হয় বেশি। তুয়াও এখন ধর্ষিতা। তার শরীরেরও লেগেছে ধর্ষিতার ট্যাগ। সমাজের মানুষ আদৌও স্বাভাবিক ভাবে ওকে বাঁচতে দিবে তো?

তুরাগ আর ওর বাবা সোফাতে বসে চোখের পানি ফেলছেন। বোনের এত করুণ অবস্থা তুরাগও মানতে পারছে না। বোনের চোখের পানি সে সহ্য করতে পারে না। বোনকে শক্ত করতে হবে, ওকে সাপোর্ট দিতে হবে, ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। আর পাঁচজনের মতো সে বোনকে তিলে তিলে মরতে দিবেনা। সবার মতো সে বোনের দিক থেকে মুখ ফিরাবে না। সে তুয়ার সাপোর্টার হবে। ভাই হয়ে বোনের জন্য সব লড়াই করতে সে সর্বদা প্রস্তুত। এসব ভেবে তুরাগ উঠে তুয়ার রুমে গেল।

তুয়া বন্ধ রুমে ততক্ষণে ওর হাতের রগ কেটে ফেলেছে। তুয়া বিরবির করে বলল,” সরি! আমি খুব সরি।” কথাটা বলে তুয়ার নিভু নিভু চোখ বন্ধ হয়ে গেল। ওর রক্তে বেডশীট ভিজে গেছে। সে যে ধর্ষিতা নামক অভিশাপ অভিশপ্ত হয়ে গেছে। তুয়া ধর্ষিতার ট্যাগ নিয়ে বাঁচতে চায় না। কারো কটু কথা শোনার শক্তি তার নেই। বাবা-ভাইয়ের মাথা নিচু করাটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। সে সমাজের চোখে খারাপ হয়ে গেছে। রাস্তা দিয়ে আসার সময় অনেকে ওকে দেখে হেসেছে। কেউ বা অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে। তুয়ার নিজের প্রতি ঘৃণা লাগছে, প্রচন্ড ঘৃণা। আর এই ঘৃণা নিয়ে সে বাঁচতে চায় না, কিছুতেই না। এজন্য সে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দু’বারও ভাবল না।

তুরাগ বোনের অবস্থা দেখে দৌড়ে বোনের কাছে গেল। সে তুয়াকে পাগলের মতো ডাকতে লাগল। তুরাগের চিৎকারে সবাই তুয়ার রুমে দৌড়ে এলো। তুয়ার হাত থেকে অনবরত রক্ত পড়েই যাচ্ছে। তুরাগ ওর রুমাল দিয়ে তুয়ার হাতটা বেঁধে নিল। তুয়ার অবস্থা দেখে সবার চোখে পানি। তুয়ার আম্মুর আহাজারি কান্নাতে বাসাটা থমকে গেছে।

তুরাগ দেরী না করে দ্রুত তুয়াকে নিয়ে হসপিটালে ছুটল। প্রত্যয়ের আম্মু তুরাগকে প্রত্যয়ের হসপিটালে যেতে বললেন। উনি বার বার প্রত্যয়কে ফোন করছেন। কিন্তু প্রত্যয়ের ফোন সুইচ অফ বলছে। প্রত্যয়ের আম্মু জামিলকে ফোন দিলেন। জামিল হলো প্রত্যয়ের সহকারী। জামিল ফোন ধরে জানাল, প্রত্যয় অন্য হসপিটালে সার্জারি করতে গেছে। তাকে তিন থেকে চার ঘন্টার আগে পাওয়া যাবে না। প্রত্যয়ের আম্মু প্রত্যয়কে না পেয়ে নিজেই হসপিটালে আসলেন। উনাকে এখানকার সবাই চিনে। কারণ উনি এই হসপিটালের মালকিন। প্রত্যয়ের আম্মু দ্রুত তুয়ার বেস্ট চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বললেন। কয়েকজন ডাক্তার তুয়াকে নিয়ে দ্রুত ওটিতে ঢুকে গেল। তুয়ার আব্বু-আম্মু আর তুরাগ ওটির সামনে বসে চোখের পানি ফেলতে থাকল।

প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার আম্মুকে কিছু বলার ভাষা পাচ্ছেন না। উনিও চুপ করে বসে চোখের পানি ফেলছেন। তুয়ার প্রতি উনার মায়া জন্মে গেছে। তুয়ার আম্মু কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “আল্লাহ! আমার কলিজাটাকে ফিরিয়ে দাও। আমার বুকটা খালি করে দিও না। আমি আমার মেয়েকে ছাড়া বাঁচব না। আল্লাহ! আল্লাহ গো! দয়া করো গো আল্লাহ!”

রনিত অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আসলো। পলক হাসি মুখে রনিতের জন্য লেবুর শরবত করে আনল। রনিত হেসে হাফ শরবত নিজে খেয়ে বাকিটা পলককে খেতে ইশারা করল। এটা রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এজন্য পলক বিনাবাক্যতে খেয়ে নিলো। রনিত আজকে ফিরতে একটু দেরী হয়েছে। কারণ ওর বন্ধু শিফাত কাতারে চলে গেল। তাকে বিদায় দিয়ে ফিরতেই দেরীটা হয়েছে। রনিত পলকের মুখে দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পলক কেঁদেছে সে বুঝতে পারছে। তবে সে মুখে কিছু বলল না। পলকের সঙ্গে রনিতের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পলকের মনে রনিতের প্রতি আর ভুল ধারণা নেই। বরং সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, ‘স্বামী নামক মানুষটাই একজন স্ত্রীর শক্তি।’

প্রত্যয় সার্জারি শেষ করে সোজা বাসায় চলে গেছে। ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে তার খেয়াল নেই। প্রত্যয় বাসায় ফিরে ওর আম্মুকে না পেয়ে ভাবল হয়তো তুয়াদের বাসায়। কারণ এখানে আসার পর ওর আম্মু তুয়াদের বাসায় বেশি সময় কাটায়। দু’জনে মাঝে মাঝে শপিং করতেও বেরিয়ে পড়ে। এজন্য প্রত্যয় আর কিছু ভাবল না। নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে বাসায় প্রবেশ করল। নিজের রুমে গিয়ে প্রত্যয় একেবারে শাওয়ার নিল। টানা কয়েক ঘন্টা সার্জারি করার পর ক্ষুধা লাগে। আর সার্জারির পর পর সে ভাত খেতে পারে না। এজন্য সাধারণত সে ফল খায়। প্রত্যয় ওর মনমতো কিছু ফল ধুয়ে কাটতে বসল। এক টুকরো আপেলে কামড় বসিয়ে প্রত্যয়ের ফোনটা অন করল। তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠল। সে দ্রুত মুখের আপেলটুকু গিলে ফোনটা রিসিভ করল। জামিল বলল, “স্যার, ম্যম হসপিটালে এসেছেন। তুয়া নামের একটা মেয়ে রেপ হয়েছে, তাকে নিয়ে ম্যম হসপিটালে এসেছেন। আপনি কি আর হসপিটালে আসবেন না?”

কথাটা শুনে প্রত্যয়ের যেন নিঃশ্বাস আঁটকে গেল। সে জামিলকে আসছি বলেই পকেটে ফোনটা ঢুকিয়ে দ্রুত দরজা লক করে বেরিয়ে পড়ল। প্রত্যয়ের খেয়াল নেই সে নরমাল টি-শার্ট আর টাওজার পরিহিত। প্রত্যয় দ্রুত ড্রাইভ করে হসপিটালে ঢুকল। প্রত্যয় ওর আম্মুকে ফোন দিয়ে বলল, “আম্মু! তুয়া এখন কোথায়?”
ওর আম্মু বললেন, “দোতলার দুইশো পাঁচ নং ওটিতে।”
প্রত্যয় কল কেটে দ্রুত পায়ে সেখানে গেল। ওটির বাইরে সবাইকে বসে থাকতে দেখে সে কথা বাড়াল না। প্রত্যয় ওটির দরজা মৃদু ভাবে নক করল। একজন নার্স বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে প্রত্যয় দেখে সরে দাঁড়াল। প্রত্যয় দ্রুত ওটিতে ঢুকে গেল।

প্রিয়ম এসবের কিছু জানে না। সে নিজের জগতে ডুবে আছে। কেউ ওকে কিছু জানায়ও নি। ইচ্ছের আম্মুরা এতক্ষণ বাসায় ছিল না। উনারা ইচ্ছের দাদুর বাসায় থেকে ফিরে এসব শুনে কষ্ট পেল। প্রত্যয় ওটিতে ঢুকে তুয়ার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ডক্টরদের সাথে কথা বলল। তুয়ার হাতের রগটা গভীরভাবে কাটেনি। এখন সে বিপদমুক্ত। তুরাগ বুদ্ধি করে তুয়ার হাতটা না বাঁধলে অন্য কিছু ঘটতে পারতো।

সত্যি কথা হলো হাত কাটলে মানুষ কখনো মরে না। বোকারা ভাবে হাতের রগ কাটলে মানুষ মারা যায়। এটা তাদের সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারণ হাতের রগই না একটা মানুষের পুরো হাত কেটে ফেললেও সে বাঁচে। আর রগ কেটে মানুষ মারা যায় রক্তশূন্যতা হয়ে। হাতের রগ কাটার ফলে শরীর থেকে রক্ত নির্গত হতে থাকে। যার ফলে সেই ব্যাক্তির শরীর রক্তশূন্য হতে থাকে, ফলে সে মানুষ মারা যায়। প্রত্যয় তুয়ার বিপদমুক্ত হওয়ার কথাটা নার্সকে বলল বাইরে জানতে। প্রত্যয় নিজে আরেকবার তুয়ার হাত চেক করে নিলো। এরপর তুয়াকে আইসিইউ’তে রাখার পারমিশন দিল। কয়েকজন মিলে স্টেচারে করে তুয়াকে ওটি থেকে আইসিইউ রুমে রাখতে গেল। তখন সবাই এক পলক তুয়াকে দেখে নিলো।

প্রত্যয় এসে সবার মুখের দিকে তাকাল। উপস্থিত সবার মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। প্রত্যয় বলল, “আংকেল-আন্টি, তুয়া এখন বিপদমুক্ত। আপনারা এবার শান্ত হন। আর বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট করুন।”

কথাটা শুনে তুয়ার আম্মু কান্নামাখা কন্ঠে বললেন, “আমার কলিজাটাকে ছেড়ে কিভাবে যাব? আমার সোনার টুকরো কত কষ্ট পেয়েছে! আমি কিছুতেই যাব না।”

তুয়ার আব্বু চুপ করে আছেন। মেয়ের এমন অবস্থায় উনি যেন জীবন্ত লাশে পরিণত হয়েছেন। তুরাগ দূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। প্রত্যয় একপ্রকার জোর করে ওর আম্মুর সঙ্গে তুয়ার আম্মু আর আব্বুকে বাসায় পাঠাল। প্রত্যয় উনাদের শান্ত ভাবে বুঝাল সে হসপিটালেই আছে। তুয়ার কোনো সমস্যা সে হতে দিবে না। প্রত্যয়ের অনেক বুঝানোর পর উনারা মানল। তুরাগ আর প্রত্যয় হসপিটালে থেকে গেল। প্রত্যয় তুরাগকে ওর কেবিনে নিয়ে গিয়ে রেস্ট নিতে বলল। প্রত্যয় তুরাগকে কেবিনে রেখে বেরিয়ে গেল। তুরাগ প্রত্যয়ের কেবিনের বেডের উপর শুয়ে পড়ল। তখন ওর চোখের কোণা বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গাড়িয়ে পড়ল।

প্রত্যয় তুয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তুয়ার এই অবস্থা প্রত্যয় মানতেই পারছে না। ওর বুকের ভেতরে চিনেচিনে ব্যথা অনুভব করছে৷ ওর চোখ দু’টো বড্ড জ্বালা করছে। মনে হয় চোখ দু’টো থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে। সে কেন কষ্ট পাচ্ছে? ওর তো কষ্ট পাওয়া কথা না। প্রত্যয় তুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। প্রাণবন্ত মেয়েটার মুখ থেকে হাসিটা হারিয়ে গেছে। চোখ দু’টো ফুলে আছে, মুখের কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। প্রত্যয় চুপ করে বসে আছে। একটুপর তুয়া পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাল। তুয়া প্রত্যয়কে ওর সামনে দেখে কেঁদে কেঁদে বলল, “আমি ধর্ষিতা! আমি অপবিত্র! আমি নোংরা হয়ে গেছি। আমি বাঁচতে চাই না। আমি খারাপ।”

কথাটা বলে সে চিৎকার করে উঠে হাতের ক্যানোলা খুলে ফেলল। আচানক এমন করাই হাতের ক্যানোলা খুলে হাত থেকে রক্ত পড়তে থাকল। তুয়ার চিৎকার শুনে দুইজন নার্স দৌড়ে আসলো। প্রত্যয় ইশারায় ওনাদের যেতে বলল। উনারা দরজা আটকে বাইরে চলে গেল।

তুয়ার কোনো দিকে খেয়াল নেই। সে দ্রুত নামতে গিয়ে কাটা হাতে বারি খেয়ে কঁকিয়ে উঠল। তুয়ার মাথায় নিজেকে শেষ করার জেদ চেপেছে। সে ধর্ষিতা নামক কালিমা থেকে মুক্ত হতে চায়। তুয়ার বেগতিক অবস্থা দেখে প্রত্যয় দ্রুত উঠে তুয়াকে জাপটে ধরল। তুয়া প্রত্যয়কে ওর থেকে সরাতে চাচ্ছে। কিন্তু সে জোর খাটিয়েও প্রত্যয়কে এক চুলও নড়াতে পারল না। তুয়া এখনো ছোটাছুটি করেই যাচ্ছে। ওর ছোটাছুটিতে কাটা হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

তুয়া নিজেকে প্রত্যয়ের থেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হলো। সে রেগে প্রত্যয়কে কিল ঘুষিও দিল, তবুও প্রত্যয় ওকে ছাড়ল না। অবশেষে তুয়া ক্লান্ত হয়ে প্রত্যয়ের বুকের টি-শার্ট খামচে ধরে কাঁদতে লাগল। ওর চোখের এক এক ফোঁটা অশ্রু প্রত্যয়ের টি শার্টে পড়ছে। তুয়ার আতনার্দ গুলো প্রত্যয়ের বুকে গিয়ে বিঁধছে। তবুও প্রত্যয় তুয়াকে ছাড়ল না। বরং সে আরো শক্ত করে ওর বাহুডোরে তুয়াকে যত্ন করে আবদ্ধ করে নিল। আর মনে মনে বলল,

“আমি আছি তো।”

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[০৭]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

পরেরদিন সকালে প্রিয়ম বান্দরবান বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাল। সেখানে নাস্তা সেরে মাহিন্দ্রাতে উঠে বসল। প্রিয়ম এখন যাত্রা শুরু করল নীলগিরির উদ্দেশ্যে। এক লেনের রাস্তা ধরে তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে মাহিন্দ্রা। প্রিয়মের নীলগিরিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পৌণে দশটা বেজে যায়। সেখানে একটা রিসোর্টে উঠে ফ্রেশ হয়ে সে আবার ঘুরার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বেলা এগারোটার পরেও চোখের সামনে মেঘগুলো কুয়াশার মতো উড়তে দেখা যাচ্ছে। প্রিয়ম এমন মনোরম দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করে মুচকি হেসে বলল, “পরেরবার আর একলা নয় বরং দোকলা আসব।”

খুব সকালবেলা তুয়ার আব্বু-আম্মু হসপিটালে ছুটে এসেছেন। রাতে উনারা বাসাতে গেলেও ওনাদের জানটা যেন এখানেই পড়েছিল। হসপিটালে এসে মেয়েকে ঘুমাতে দেখে তবেই উনারা শান্ত হয়ে বসেছেন।

গত রাতে কাঁদতে কাঁদতে তুয়া প্রত্যয়ের বুকেই সেন্স হারিয়ে ফেলে। প্রত্যয় দ্রুত তুয়াকে ধরে শুইয়ে দেয়। তুরাগ এসেছিল আইসিইউ’র বাইরে থেকে বোনকে একপলক দেখার জন্য। কিন্তু বাইরে থেকে প্রত্যয়কে তুয়ার মুখে পানি ছিটাতে দেখে সে নার্সকে উপেক্ষা করে ভেতরে ঢুকে যায়। মিনিট দু’য়েক পর তুয়ার সেন্স ফিরতে দেখে তুরাগ বোনকে জড়িয়ে ধরে। তুয়া কাঁদতে কাঁদতে তুরাগকে বলে, “ভাইয়া! ভাইয়া রে! আমি অপবিত্র হয়ে গেছি। আমি এখন ধর্ষিতা। ভাইয়া, এই কালিমা নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না রে। তুই আমাকে মেরে ফেল, ভাইয়া। আমি আর বাঁচতে চাই না।”

“সোনা বোন আমার, এসব বলতে নেই। তুই তো আমার কলিজার টুকরা। তুই আমার কাছে আগের মতোই আছিস। আমি তোকে অনেক ভালবাসি, বোন।”

তুরাগ তুয়াকে অনেক বুঝিয়েছে। প্রত্যয় কেন জানি একটা শব্দও তখন গলা দিয়ে বের করতে পারেনি। সে শুধু তুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রত্যয় আর তুরাগ কেউই দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি সারারাত। তুয়া উচ্চশব্দে কেঁদেছে আর পাগলামি করেছে। তুয়াকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছিল না। তুরাগও একপর্যায়ে হাল ছেড়ে বোনের সঙ্গে কেঁদেছে। প্রত্যয় অনেক কষ্ট তুয়াকে শান্ত করলেও ওর কান্না থামাতে পারেনি। তুয়া সারাটা রাত শুয়ে শুয়ে আতনার্দ করে কেঁদেছে। ওর কষ্টটা হয়তো সে কেঁদে কমাতে চাইছে। কিন্ত আদৌও কি চোখের পানি দিয়ে কষ্ট কমানো সম্ভব? তুয়ার এই চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। ভোরের দিকে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে তবেই তুয়া ওর দু’চোখের পাতা এক করেছে।

প্রত্যয়ের কথামতো নার্স তুয়ার জন্য একটা কেবিন রেডি করল। তুয়া ঘুমানোর পর তুরাগ তুয়াকে কোলে করে কেবিনে এনেছে। তুরাগ বোনের হাত ধরে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছে। তার উপর দিয়েও কম ধকল যাচ্ছে না। কালকের অফিসের শার্ট এখনও তুরাগের পরনে। প্রত্যয় ভাই-বোনকে ঘুমাতে দেখে নিঃশব্দে দরজা আঁটকে নামাজ পড়তে গেল। সে নামাজ পড়ে ওর চেম্বারে গিয়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বসল।

এখন ঘড়িতে সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। প্রত্যয় চোখে মুখে পানি দিয়ে আবার তুয়ার কেবিনের সামনের আসলো। কেবিনের বাইরে তুয়ার আব্বু-আম্মুকে বসে থাকতে দেখে প্রত্যয় ধীর কন্ঠে উনাদের সালাম দিয়ে বলল, “আন্টি-আংকেল, তুয়া এখন ঠিক আছে। আপনারা নিজেরা শক্ত হোন।”

“মেয়েটার এমন অবস্থা আমরা যে আর সহ্য করতে পারছিনা, বাবা।”

“আপনারা ভেঙ্গে পড়লে তুয়া ওর বাঁচার ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে ফেলবে। আপনাদের সাপোর্টাই এখন ওর খুব প্রয়োজন।”

তুয়ার বাবা উনার চোখের পানি মুছে বললেন, “আমার আম্মুটার হাত কি খুব গভীরভাবে কেটেছে, আব্বু?”
“না আংকেল! চিন্তা করবেন না, এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে ও।”
“হুম! আব্বু তুমি বাসায় যাও। সারারাত তো হসপিটালেই ছিলে, তোমার শরীরেরও তো বিশ্রামের প্রয়োজন।”
“জ্বি আংকেল।”

প্রত্যয় তুয়ার কেবিনে ঢুকে আর একবার তুয়ার হাত চেক করে নিল। কালকে তুয়া হাতের ক্যানোলা টেনে ছুঁড়ে ফেলে জেদের বশে নিজের হাতের ব্যান্ডেজটাও টেনে খুলে ফেলেছে। তুয়া তখনও নিজেকে শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তুরাগ আর প্রত্যয় কেউ ওকে থামাতে পারছিল না। ওর কাটা হাত দিয়ে তখনও ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। তুরাগ বোনের পাগলামি দেখে নিজেও উচ্চশব্দে কেঁদেছে। শুধু প্রত্যয় নিজেকে শক্ত রেখে তুয়াকে জোর করে বসিয়েছিল।
তুয়া ওর হাতে অবশের ইনজেকশন পুশ করতে দেয়নি। তাই অবশ ছাড়াই কাটা স্থানে নতুন করে সেলাই করতে হয়েছে। তুয়ার আর্তনাদে প্রত্যয়ের বুকটাও কেঁপে উঠেছিল। তবুও প্রত্যয় হাত থামায় নি। বরং সে কাঁপাকাঁপা হাতেই সেলাইটা করেছে। অন্য কারো বেলায় প্রত্যয়ের হাত দ্রুত চললেও তুয়ার আর্তনাদে ওর হাতটা ক্ষণিকের জন্য থেমে গিয়েছিল। তুয়ার চিৎকার করে বলছিল, “তোমরা আমাকে আর কষ্ট দিও না, আমি সহ্য করতে পারছি না। তোমরা আমাকে মেরে ফেলো তা-ও আমার আর কষ্টটা বাড়িও না।”

একথা যেন প্রত্যয়ের বুকে গিয়ে বিঁধেছে। তবুও সে কর্ণপাত না করে নিজের কাজ সম্পূর্ণ করেছে।

প্রত্যয় তুয়ার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে কেবিন থেকে বের হলো। তুয়ার আব্বু-আম্মুকে বলে সে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতে গেল। একটু পরে প্রত্যয়ের আম্মু এসে প্রত্যয়কে জিজ্ঞেস করলেন, “আব্বু, তুয়া এখন কেমন আছে?”
প্রত্যয় বলল,”সারারাত কেঁদেছে।”
প্রত্যয়ের আম্মু ছেলের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললেন, “আব্বু! তোর চোখ এত লাল হয়ে আছে কেন? তুই কি কেঁদেছিস?”

প্রত্যয় ওর হাতের টাওয়ালটা বেলকণিতে মেলে দিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আমি কাঁদব কেন? সারারাত জেগে ছিলাম, তাই হয়তো চোখ লাল লাগছে।”

প্রত্যয়ের আম্মু প্রত্যয়কে নাস্তা করতে ডেকে চলে গেলেন। প্রত্যয় জামিলকে ফোন দিয়ে বলে দিল আজকে সে সকাল এগারোটা থেকে পেশেন্ট দেখবে। প্রত্যয় হালকা নাস্তা সেরে প্রিয়মকে ফোন দিল। এত ব্যস্তার মধ্যে সে ছোট ভাইটার খোঁজ-খবর নিতে পারেনি। প্রিয়মের ফোন বন্ধ পেল, হয়তো নেটওয়ার্ক সমস্যা। প্রত্যয় ওর রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর চোখ দু’টো বড্ড জ্বালা করছে। চোখ খুলে রাখাটাও কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। এখন চোখের পাতা দু’টোও মনে হয় একটু বিশ্রাম চাচ্ছে।

বিল্ডিংয়ের কয়েকজন মহিলা ছাদে গিয়ে আলোচনায় বসেছেন। উনাদের আলোচনার বিষয় ধর্ষিতা তুয়াকে নিয়ে।
ইচ্ছের আম্মু কোনো কাজে ছাদে গিয়েছিলেন। হঠাৎ উনাদের মন্তব্য শুনে উনি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। একজন মহিলা ফিসফিস করে আরেকজনকে বলছেন, “মাইয়ার প্যাটে বাচ্চা না আইলেই হয়। কয়জন মিইল্লা ধর্ষণ করছে কিছু শুনছেন?”

“না! তা কইতে পারুম না। তয় ধর্ষিত মাইয়াগোরে হসপিটালে ভর্তি করাইলে প্যাট ওয়াশ কইরা দেয়। বাচ্চা প্যাটে না আসার ইনজেকশনও নাকি দেয়।”

“যাই কন, ভাবি! মাইয়াডার জীবনখান শ্যাষ। কোনো ব্যাডা মানুষই জাইনা শুইনা এমন মাইয়া ঘরে তুলল্যা নিবো না। হায়রে আল্লাহ! মাইয়াডার রুপ, গতর, জীবন ওই পোলাগোর হাতেই নষ্ট হইয়া গেল।”

“তুয়াদের সামনের ফ্ল্যাটের ওই ভাবির দুইখান জুয়ান পোলা আছে না? আমি তো ভাবছি ওই ভাবির ছোট পোলার লগে তুয়ার লটঘট আছে। একদিন আমি ওদের দু’জনরে রাস্তায় কথা কইতেও দেখছি।”

“লটঘট যতই থাকুক, বিয়া কেউ আর করবে না। না জানি কত পোলা ওর শরীর ছুঁইছে, ছিহ্! একথা ভাবতেও আমার শরীর ঘিনঘিন করতাছে।”

উনারা এমন ভাবে কথাগুলো বলছে যেন এটা দারুন মজার একটা টপিক। ইচ্ছের আম্মু চুপচাপ নিচে চলে গেলেন।

সকালবেলা পলক ঘর-উঠান ঝাড়ু দিয়ে রান্না ঘরে এলো। ওর শাশুড়ি পরোটা ভাজছে আর দিশা বেলে দিচ্ছে। পলক এসে বেসিনে রাখা থালা বাসন ধুয়ে নিলো। একটু পর রনিতের ডাকে পলক রুমের দিকে পা বাড়াতেই দিশা হাসতে হাসতে খোঁচা মেরে বলল, “কি গো পলক, রনিতকে কি দিয়ে বশ করেছ? তোমাকে ছাড়া যে সে রুমে একা থাকতেই চায় না।”

কথাটা বলে দিশা হাসতে থাকল। পলক ওর শাশুড়ির সামনে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। ওর শাশুড়ি কিছু বললেন না। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমে চলে গেল। রনিত ফ্রেশ হয়ে এসে দাঁড়াতেই পলক রুমে ঢুকে বলল, “আমি রুমের বাইরে থাকলে আমাকে ডাকবেন না। সব তো রেডি করে দিয়েছি। তাহলে এত ডাকাডাকি করছেন কেন?”

রনিত পলকের দিকে হাতের টাওয়ালটা ছুঁড়ে মারল। পলক টাওয়াল ক্যাচ ধরে চেয়ারের উপর মেলে দিল। রনিত হাসতে হাসতে বলল, “সকালবেলা আমার বউটা এত রেগে আছে কেন, শুনি?”

পলক কিছু বলতে যাবে, তখন দিশা রান্নাঘর থেকেই বলে উঠল, “পলক, তোমাদের আদর আহ্লাদ শেষ হলে নাস্তা করতে এসো।”

পলক দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেল। বাসায় শশুড়, ভাসুর আছে। তারা শুনলে কি ভাববে? সে রনিতকে কিছু বলার সুযোগটুকুও দিল না। রনিতও এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। ওর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে দিশাকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। শুধু ওর ভাইটা কষ্ট পাবে বলে সে কিছু বলে না। আর সে পলককে ডেকেছিল পলকের আম্মু ফোন দিয়েছিল, তাই কথা বলার জন্য।

হঠাৎ করে বুকের কাছে ছোট ছোট হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রত্যয়ের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। প্রত্যয় চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ইচ্ছে ওর বুকে টোকা দিচ্ছে আর বলছে, “প্রত্তুয়! প্রত্তুয়! তুমি উতবে না?”

প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “হুম! ইচ্ছেমণি, এই তো আমার উঠে গেছি।”

ইচ্ছের মুখে আজকে কোনো হাসি নেই। প্রত্যয় ইচ্ছেকে ওর বুকের উপর বসিয়ে মুচকি হেসে বলল, “আমার ইচ্ছেমণির মন খারাপ কেন?”

ইচ্ছে ঠোঁট উল্টিয়ে ছলছল চোখে বলল, “আমি তোমাল সাতে দাবো।”

প্রত্যয় বলল, “আমার সাথে কোথায় যাবে? কাঁদে না সোনা, বলো আমাকে?”

ইচ্ছে বলল,”তুয়া আপুল কাছে।”

প্রত্যয় হেসে বলল, “আচ্ছা, নিয়ে যাব। তুমি রেডি হয়ে এসো।”

ইচ্ছে উঠে “আচ্ছা” বলে দৌড়ে চলে গেল। প্রত্যয় উঠে ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে রেডি হয়ে নিলো।

বিল্ডিংয়ের সবাই বলাবলি করছে তুয়া হসপিটালে। ইচ্ছে ছোট, সে জানে না ধর্ষিতা শব্দের মানে। তাই এই শব্দটা বার বার শুনেও বুঝতে পারেনি। সে শুধু বুঝেছে তুয়ার হাত কেটে গেছে। তাকে প্রত্যয়ের হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। এজন্য সে এসে প্রত্যয়ের কাছে এই আবদারটা করল। এদিকে ইচ্ছের আম্মু ইচ্ছেকে যেতে দিবে না। তাই ইচ্ছে কেঁদে একাকার অবস্থা। প্রত্যয় এসে ইচ্ছেদের দরজা নক করল। প্রত্যয়কে দেখে ইচ্ছে দৌড় এসে প্রত্যয়ের কোলে উঠে গেল। ইচ্ছের আম্মু বললেন, “প্রত্যয়, ইচ্ছে গেলে খুব জ্বালাবে। এখন ওখানকার যা অবস্থা, সবাই বিরক্ত হবে।”

প্রত্যয় বলল, “সমস্যা নেই, আমি সামলে নিব।”

ইচ্ছের আম্মু আর কথা বাড়ালেন না। প্রত্যয় ইচ্ছে কে নিয়ে চলে গেল।‌ তুয়ার চোখের সামনে ছেলেগুলো বিশ্রীভাবে হাসছে। ওর শরীরে হাত দিচ্ছে, ওড়না কেড়ে নিজেরা হাসাহাসি করছে। ওর দিকে তাকিয়ে নোংরা নোংরা কথা বলছে। একটা ছেলে তুয়াকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। এতটুকু দেখে তুয়া চিৎকার করে বলল, “আম্মু! আম্মু! আমাকে বাঁচাও! আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও। আব্বু! আব্বু কোথায় তুমি? আমি বাসায় যাব, আমাকে নিয়ে যাও। আম্মু! ভাইয়া! ভাইয়া! আমাকে তোমরা বাঁচাও।”

কথাটা বলে তুয়া চিৎকার করে কেঁদে উঠে বসল। ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কালকে রাত থেকে সে চোখ বন্ধ করলেই এই স্বপ্নটাই দেখছে। তুয়ার আম্মু মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো, উনিও কাঁদছেন। হয়তো সেই সময়ও সে ভাবেই উনাদের ডেকেছিল। তুয়া ওর আম্মুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে আছে। তুয়ার আব্বু চোখের পানি মুছে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “মা! আমার সোনা মা! আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। তুমি ভয় পেও না, মা। তোমার কিচ্ছু হবে না।”

তুরাগসহ ওর আব্বু-আম্মু তুয়াকে বুঝাচ্ছে। তুয়া চুপটি করে ওর মায়ের বুকে মাথা রেখে বসে আছে। সবাই অনেক জোড়াজোড়ি করেও ওকে কেউ কিচ্ছু খাওয়াতে পারেনি। একটুপরে প্রত্যয়ের হাত ধরে ইচ্ছে নাচতে নাচতে কেবিনে ডুকল। ইচ্ছে এক হাত দিয়ে প্রত্যয়ের এক আঙ্গুল ধরে আছে। আর ওর অন্য হাতে একটা পুতুলের পা ধরে আছে। যার ফলে পুতুলটা উল্টো করে ঝুলছে। এই পুতুলটা তুয়া ইচ্ছের জন্মদিনে ইচ্ছেকে উপহার দিয়েছিল। তুয়াকে দেখে ইচ্ছে দৌড়ে তুয়ার কাছে গিয়ে বললে, “তুয়া আপু, পুতুলেল বিয়ে দিবা না? বাসায় দাবে না?”

তুয়া একটা কথাও বলল না দেখে ইচ্ছে তুরাগের দিকে তাকাল। তুরাগও কোনো কথা বলল না। ইচ্ছে একে একে সবার দিকে তাকাল। কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে ইচ্ছে ছলছল চোখে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ইচ্ছেকে ইশারায় বলল তুয়াকে খাইয়ে দিতে। ইচ্ছে পুতুলটাকে ছুঁড়ে ফেলে তুয়ার সামনে বলল, “নাও খাও! ছুটু বাবু! ছুটু বাবু নাও, খাও।”

তুয়া খাচ্ছে না দেখে ইচ্ছে মাথা নিচু করে বলল, “আমলা সবাই তোমাতে কুব ভালুপাশি, আপু। তুমি আল দুঃখু পেও না।”

তুয়া ইচ্ছেকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠল। এই তোতাপাখিকে তুয়া খুব ভালবাসে। ইচ্ছে তুয়ার চোখের মুছে দিচ্ছে। প্রত্যয় এই কারণেই ইচ্ছেকে এখানে এনেছে। কারণ ইচ্ছের সাথে তুয়ার সম্পর্কটা খুবই মধুর। এটা প্রত্যয় নিজে খেয়াল করেছে। তুয়াকে একটু নরমাল করতে এখন ইচ্ছেকেই দরকার।

প্রত্যয় ইশারায় তুয়ার আম্মুকে বলল খাইয়ে দিতে। তুয়ার আম্মু তুয়ার মুখের সামনে খাবার এগিয়ে দিলেন। তুয়া দুই বার ফিরিয়ে দিয়ে তিন বারের বেলায় লোকমাটুকু মুখে নিল। তুয়ার চোখের পানি অঝরে ঝরে যাচ্ছে। এদিকে ইচ্ছে ততক্ষণে হা করে বসে আছে। ইচ্ছের হা করা দেখে তুয়া বাদে সবাই হাসল। গুমোট থাকা পরিবেশটা একটু স্বাভাবিক হলো। প্রত্যয় মেডিসিন সাইডে রেখে কেবিন থেকে চলে গেল। জামিলকে বলে প্রত্যয় ওর পেশেন্ট দেখা শুরু করল।

কেবিনের মধ্যে সবাই চুপ করে ইচ্ছের গল্প শুনছে। ইচ্ছে গল্প বলে ওর পুতুলকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ইচ্ছের গল্প শুনতে শুনতে তুয়া একটা সময় ঘুমিয়ে গেল। তুরাগ ইচ্ছেকে ইশারায় চুপ করতে বলল। সে তো চুপ থাকার বাচ্চা না। তাই ইচ্ছে প্রত্যয়ের কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগল। তুরাগ ইচ্ছেকে নিয়ে বাইরে গেল। জামিল তুরাগকে দেখে বলল, “ইচ্ছেকে আমার কাছে দিয়ে স্যার আপনাকে বাসায় যেতে বলল।”

ইচ্ছে ফট করে বলল,”আমি প্রত্তুয় এর কাছে দাবো।”

তুরাগ জামিলকে বলল, “প্রত্যয় ফ্রি হওয়ার পর ইচ্ছেকে ওর কাছে দিবেন। নাহলে ওকে বিরক্ত করবে।”

তুরাগ ইচ্ছেকে দুষ্টুমি করতে বারণ করে চলে গেল। প্রত্যয় আসার সময় তুয়ার আব্বু-আম্মুর জন্য খাবার এনেছে৷ আর তুরাগকে বাসায় ওর আম্মুই খাওয়াবে।
তুরাগ যাওয়ার পর জামিল ইচ্ছেকে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল। পেশেন্টের ভীড় কিছুটা কমেছে, তাই জামিল ইচ্ছেকে প্রত্যয়ের কাছে নিয়ে গেল। প্রত্যয় বলল, “ইচ্ছেমণি, তুমি খেলো। আমি পেশেন্ট দেখি কেমন? তারপর আমরা তোমার তুয়া আপুর কাছে যাব।”

“আতথা।”
খেলার জন্য প্রত্যয় ইচ্ছেকে অনেক গুলো কলম দিল। ইচ্ছেও আর কথা বাড়াল না। সে ভদ্র বাচ্চার মতো খেলতে লাগল। আর প্রত্যয় পেশেন্ট দেখতে লাগল।

প্রিয়ম আশেপাশে ঘুরে দেখতে দেখতে একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। মেয়েটা এখানে পর্যটকদের আশপাশটা ঘুরে দেখায়। প্রিয়ম কথায় কথায় জানতে পারল মেয়েটার নাম অপরাজিতা। অনেক বড় নাম তাই সবাই ওকে অপু বলে ডাকে। অপু প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, বিহা টো করেক লাই?”

“উহুম! আমার বড় ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে তারপর আমি বিয়ে করব।”

“ভালবাসার মানুষ টো আনছে নাকি?”

“তা তো আছেই। আচ্ছা তুমি কোন জেলার ভাষায় কথা বলছ?

“আমি বিহারের মাইয়া। সবজেলা টোর মানুষের সঙ্গে কথা টো বুইলার লাইগ্যা মিশকুর টো কইরাই এখন কথা টো বুলি।”

“ওহ আচ্ছা।”

চলবে।