সেই তুমি পর্ব-০৩

0
3789

#-সেই তুমি
#-সানজিদা সন্ধি
#-পর্ব-৩
জাফনা জারিফের ফ্ল্যাটে ঢোকার পরপরই আমি হুড়মুড় করে এগিয়ে গেলাম। ও মাই গড! এই মেয়ে কি তাহলে আসলেই জারিফের বোন? যার মায়ার বাঁধনে আমি পড়েছিলাম?ইম্পসিবল। হতেই পারে না। কিন্তু পরিস্থিতি তো অন্য কথা বলছে। যাইহোক ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে কলিংবেল বাজালাম। জাফনার কাছে তো চাবিও ছিলো! ওহ্ নো!

২ মিনিট পরে মিষ্টি দেখতে একটা পরী দরজা খুললো। ডাগর ডাগর চোখ! শ্যামবর্ণ,আর চুল গুলো কোঁকড়া। আমাকে দেখে সে আচমকা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে সবাইকে ডাকতে লাগলো! ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বোবা বনে গেলাম। মেয়েটার চিৎকার শুনে জারিফ দৌড়ে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে সেও জড়িয়ে ধরলো আমায়। দুজনে আমাকে ছাড়ার পরে জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটা কে? জারিফ বললো এ হচ্ছে জাহিন! তার বোন। মাথাটা আরেকটু চক্কর দিয়ে উঠলো তাহলে জাফনা কে? উফ কিছু ভাবতে পারছিনা। জাফনা কি তাহলে জারিফের আরেক বোন? কিন্তু জারিফ তো নিজমুখে বলেছিলো ওর একটাই বোন। এরই মাঝে জাহিন বলে উঠলো, আল্লাহ এই প্রথম তোমাকে সামনাসামনি দেখলাম! দাড়াও তো একটু মন ভরে দেখি। উম প্রায় ৬ ফুট উচ্চতা, ব্রয়লার মুরগীর মতো ধবধবে, আর তোমার চুল গুলো যা জোস না! আমি তো পুরাই ক্রাশ খেয়ে গেলাম। যদিও আগেও বহুবার খেয়েছি। এবার এতোশত কথা ছেড়ে ভেতরে এসো তো! জাহিনের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কি মিষ্টি আর মিষ্টভাষী একটা মেয়ে। যাক তাহলে ভুল কারোর উপর মায়া জন্মায়নি।

ফ্ল্যাটে ঢুকেই জাফনার দিকে চোখ পড়লো। সোফায় বসে বাচ্চাদের মতো কার্টুন দেখছে। তোমার যে আমি কি অবস্থা করবো জাফনা তুমি জাস্ট ভাবতেও পারছোনা। আহনাফ চৌধুরীর সাথে টক্কর নেওয়ার ফলাফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে।

আমাকে দেখে জাফনা মনে হলো বেশ থমকালো। আমাকে এই ফ্ল্যাটে আশা করে নি সে। কার্টুন ছেড়ে আমার দেখি চোখ পড়তেই ভ্রু দুটো এমন করে কুঁচকালো মনে হচ্ছে কেউ তিতা করলা জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। তাকিয়ে আবার কার্টুনে মননিবেশ করলো।

আন্টির সাথে কথা বলার পরে জাহিনের সাথে কথা বলতে লাগলাম। জাহিনকে আমি কখনো আগে দেখিনি ইভেন জারিফ কখনো ওর নামটাও বলেনি আমাকে। ফোনে কথা না হলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না জারিফের একটা বোন আছে। জারিফ সবসময়ই সাসপেন্স ক্রিয়েট করতে পছন্দ করে। যার কারণে বেশ কিছু উত্তর পাওয়া হয়নি আমার। সে অবশ্য বলে ধৈর্য ধর! সময় হলে সব জানতে পারবি। কিছু জিনিস ঠিক সময়মতো জানাই ভালো। আমিও চুপচাপ সুবোধ বালকের মতো ওর কথা মেনে নিয়েছি তবে অন্য ওয়ে তে অসংখ্য বার জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যার্থ হয়েছি৷
আজ রাতটা এখানে কাটাবো বলেই ঠিক করেছি। ফোন সুইচ অফ হওয়ার কারণে জারিফের কাছ থেকে চার্জার নিয়ে ওর রুমে চলে গেলাম। ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলাম জারিফ আমার ফোনটা নিয়ে কিছু একটা করছে। পেছন থেকে তাকে ডাকতেই হকচকিয়ে ফোনটা রেখে বলে উঠলো, আন্টি বারবার ফোন দিচ্ছে বুঝলি। ফোনটা রিসিভ করে বল তুই ঠিক আছিস। নয়তো টেনশন করবে। মায়ের মন জানিসই তো! জারিফের গলার স্বরে কেমন যেন একটা আতঙ্ক দেখতে পেলাম। কিছু তো ঘাপলা আছেই কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে উঠলাম সে আমি ফোন করে জানিয়ে দিবো নাহয়। কিন্তু তুই এমন শীতকালে ঘামছিস কেন রে? এনিথিং রং? জারিফ ফের ঘাবড়ানো গলায় বলে উঠলো না না, এভ্রিথিং ইজ অলরাইট! তুই আন্টিকে ফোন করে ডাইনিং এ আয়। ওই কারণেই ডাকতে এসেছিলাম আর কি! জারিফের কথা জড়ানো শুনে আমি শিওর হলাম কিছু তো হয়েছেই৷ এগুলো ভাবা বাদ দিয়ে এই ফাঁকে জিজ্ঞেস করে নিলাম ওকে। জাফনা কে? ও বললো জাফনা ওর চাচাতো বোন। নিচতলায় থাকে। পুরো ফ্যামিলির সবার আদরের। আর এই ফ্লাটেই পড়ে থাকে বেশিরভাগ সময়। জারিফের কথা শুনে আমি ক্লিয়ার হলাম পুরো বিষয়টা।

ওকে যেতে বলে মামনিকে ফোনটা দিলাম। আর এই হয়েছে আমার মা! এতোবছর আমাকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিয়ে এখন এসেছে ভালোবাসা দেখাতে। যখন তার ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন আমার নেই আমার। আমার মামনি আতিয়া চৌধুরী। বনেদী পরিবারের মেয়ে। তারা দুইভাইবোন। মামনি ফোনটা রিসিভ করেই ভাঙা গলায় বলে উঠলো, বাবা তোর এতো রাগ কেন? না খেয়ে চলে গেলি বাসা থেকে। জানিসই তো তোর বাবা আর আমি কতো চিন্তা করি৷ বাসায় আয় বাবা। গলা শুনে বুঝলাম ইতিমধ্যে কান্নাকাটি করে সাগর বানিয়েছে। মামনিকে বললাম, তুমি চিন্তা করিওনা! আমি বন্ধুর বাসায় আছি। একটুপর খাবো। তোমরা খেয়ে নিও। আমি ঠিক আছি। বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। এতো নেকামো দেখে রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো আমার।

ফোনটা চার্জে রেখে ডায়নিং এ গেলাম। জাফনার চোখে চোখ পড়তেই শয়তানি একটা হাসি দিলাম, প্রতিত্তোরে তার মুখভঙ্গি দেখে শরীর জ্বলে গেলো আমার। খাবার টেবিলে দুজন মুখোমুখি। জারিফ বললো শোন আহনাফ তোর কলেজে কিন্তু জাফনা আছে। আমি বললাম হ্যাঁ জানি তো আমি। আমার স্টুডেন্ট সে। পরিচয় হয়েছে তার সাথে। জাফনা অপ্রস্তুত হয়ে বললো, হ্যাঁ জারি,সারি,বাউল,ভাটিয়ালি আমি চিনি আমার স্যারকে। জাফনার কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। মেয়ের মাথায় সমস্যা আছে না কি? জারি, সারি হোয়াট ইজ দিস? উৎসুক দৃষ্টিতে জারিফের দিকে তাকাতে দেখলাম বেচারার মুখটা পাংশু হয়ে গেছে। জারিফ বললো আমার জারিফ নাম কেটে জারি বানিয়েছে৷ আর মহারাণী এতেই ক্ষ্যান্ত হননি তার সাথে বাকিসবও বলে। আমাদের কথার মধ্যে জাহিন বললো এবার তোমরা খাওয়া শুরু করো৷ হ্যাঁ হ্যাঁ খাবে তো বটেই তুই এতো লাফাচ্ছিস কেন জাহিন? এতো তাড়া কীসের? জাফনার খোঁচামারা কথা শুনে জাহিনও উত্তর দিলো। কি যে বলো না আপু! আমার পছন্দের মানুষের জন্য আমি পাগল হবো নাতো তুমি হবে? এই দুই বোনের কথার আগামাথা কিছু না বুঝলেও জাহিনের উত্তরটা জোস লাগলো! কিছু আছে না কি দু বোনের মধ্যে? যাইহোক সেটা জারিফের কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাবে নাহয়।

খাওয়ার মাঝখানে জারিফ কি ভেবে যেন তাড়াতাড়ি উঠে ওর রুমে গেলো। ওর চেহারায় একধরনের আতঙ্ক দেখতে পেলাম। কি হয়েছে সেটা দেখতে যাবো এমন সময় জাহিন আমাকে খেতে বলে নিজে গেলো। এখন শুধু আমি আর জাফনা৷ আন্টির শরীর হুট করে খারাপ হয়ে যাওয়ায় তিনি শুয়ে পড়েছেন। জাফনা চোখ বড় বড় করে বললো স্যার থাপ্পড়টা আমাকে না দিলেও পারতেন।জাস্ট “আই লাভ ইউ ” বলার কারণে কেউ কাউকে থাপ্পড় মারে স্যার? ওর কথা শুনে বললাম বিষয়টা তুমি ওই অবধি মিটিয়ে নিতে পারতে। আমি টিচার হিসেবে একটা থাপ্পড় মেরেছি এটা সহজভাবে নিতে পারতে৷ বাট ইউ আর সো স্টুপিড। বিষয়টাকে এতদূর গড়িয়ে নিয়ে আমার রাগ বাড়িয়েছো। এবার বুঝবে আহনাফ চৌধুরী কি জিনিস! জাফনা শয়তানি হেসে বলে উঠলো! আচ্ছা স্যার! আপনি জিনিস। মানুষ নন। উফ যেখানে মানুষেরাই জাফনা’র সাথে পেরে উঠে না সেখানে আপনি একটা জিনিস হয়ে কীভাবে আশা করছেন আপনি আমার সাথে জিততে পারবেন? উফ ইনটলারেবল এই মেয়ে। খাবার ছেড়ে উঠতে যাবো এমন সময় সে আবার মুখ দিয়ে চু চু জাতীয় শব্দ করে বলে উঠলো দেখলেন তো স্যার এখনই আমার সাথে তর্ক করে খাবার ছেড়ে উঠে যাচ্ছেন। পরে কি হবে বুঝতেই তো পারছেন তাইনা? আহারে বেচারা! এই মেয়ে আসলেই অন্য রকম। যাক ভালোই হলো! প্রতিদ্বন্দ্বী গো বেচারা হলে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে মজা নেই। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে জারিফের ঘরে যেতে নিলাম।

দরজার সামনে গিয়ে দেখছি জাহিন জারিফকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে আর জারিফ বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এতক্ষণ ভাবছিলাম শুধুমাত্র জারিফই আমার কাছে কিছু লোকাচ্ছ কিন্তু এখন মনে জাহিনও এমনটা করছে। আমার সাথে সম্পর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে তারা দুজনেই আতঙ্কিত রয়েছে।আমাকে দরজার সামনে দেখে তারা দুজনেই স্বাভাবিক থাকার ব্যার্থ প্রচেষ্টা চালাতে লাগলো! আমি কিছু দেখেছি বিষয়টা বুঝতে না দিয়ে জারিফকে বললাম, জারিফ আমি খানিকটা টায়ার্ড। জারিফ আমার শোয়ার ব্যাবস্থা করে বাহিরে চলে গেলো। আর আমি ফোনটা হাতে নিয়ে নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ভাবনার অতলে প্রবেশ করলাম
চলবে,,,,