সেই তুমি পর্ব-০৪

0
3365

#-সেই তুমি
#- পর্ব-৪
#-সানজিদা সন্ধি
ফোনটা নিয়ে গুরত্বপূর্ণ কাজ করতে করতে কখন যে ঘুমের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম জানিনা। আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা খুঁজে টর্চ জ্বালিয়ে বেলকনিতে গেলাম। হিমশিতল হাওয়া বইছে।ঠান্ডায় শরীরের পশম সব দাড়িয়ে গেছে।

বেলকনিতে গিয়েই সকাল সকাল বিরক্তি ভাব চলে এলো। মিস জাফরান অপ্স জাফনা দাঁড়িয়ে। এই মেয়ে কি নিজের বাসায় যায়না না কি? আমাকে দেখে লম্বা একটা সালাম দিলো সাথে শয়তানি হাসি ফ্রি। কে বলবে এরকম ভোলাভালা দেখতে মেয়েটা এতো ফাজিল। সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এই ঠান্ডায় বাহিরে কি করছো? ট্যারামো করে বললো, “কি আর করুম স্যার! সোয়ামি মরি গেছে দুই বছর অইলো। চাইরডি খাওয় ফাইনা! তাই ভোরবেলা উডি কাম খুঁজতো যাই। “জাফনার কথা শুনে কান গরম হয়ে গেলো আমার। কি বলছে এই মেয়ে? এই ভাষা কোত্থেকে শিখলো সে? আর স্বামী মারা গেছে মানে? বিয়ে না হতেই স্বামীকে মেরে ফেললো! কি ডেঞ্জারাস মেয়েরে। এই মেয়ে কোনো সুস্থ মানুষকে পাগল করার জন্য যথেষ্ট। যাইহোক একে এর মতো করেই ট্রিট করতে হবে। আমিও মুচকি হাসি হেসে বললাম আহারে। এই বয়সে স্বামী মারা গিয়েছে তোমার। বেচারি। শোনো! এককাজ করতে পারো। আমার বাসায় যদিও কাজের লোকের অভাব নেই তবুও তোমার অসহায়ত্বের কথা ভেবে আমি তোমাকে কাজ দিতে চাচ্ছি। তুমি করবে? উহু চিন্তা করিওনা ভালো অঙ্কের বেতনই দিবো। আমার কথা শুনো জাফনা রাগে ফোসফাস করে বেলকনি থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আমি ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলাম। ভুল মানুষের সাথে পাঙ্গা নিয়েছো জাফনা। পদে পদে জ্বালিয়ে শেষ করে দিবো তোমাকে।

হুট করে রিংটোনের শব্দে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। উফ! সেই কাঙ্ক্ষিত কল। যেটার জন্য গত ১৮ দিন ধরে আমি ছটফট করে মরছি। আজ পেয়ে গেলাম। এবার প্রলয় ঘটবে। সবাই কাঁদবে সবাই। ফোনটা রেখে প্রশান্তির প্রশ্বাস ফেলে ঘরে এলাম। ভীষণ ফুরফুরে লাগছে। ভীষণ রকম। এখনই বাসায় পৌঁছুনো প্রয়োজন আমার। গাড়ির চাবিটা বেডসাইড থেকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে দেখলাম জাফনা বসে আছে। যাক ভালো হলো। ওর সামনে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। লিফট দিয়ে নেমে ড্রাইভিং সিটে বসে জারিফকে ছোট্ট একটা টেক্সট দিয়ে ফুল স্প্রিডে গাড়ি চালিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছি। ফাঁকা রাস্তায় নিজেকে রাজা মনে হচ্ছে। এখন থেকে হুটহাট ভোরবেলা বের হতে হবে। বাসায় পৌঁছে মনে বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় চাবি নিয়ে যাইনি। এখন কলিংবেল বাজিয়ে সবার ঘুম নষ্ট করা কি ঠিক হবে? কাম অন আহনাফ! তুই এসব কি ভাবছিস? তোর কাজই তো সবাইকে কষ্ট দেওয়া। যন্ত্রণায় পুড়িয়ে মারা।

কলিংবেল বাজাতেই মামনি এসে দরজা খুলে দিলো৷ চোখ মুখ দেখে বুঝলাম সারারাত ঘুমোয়নি। রাগে উত্তেজিত হয়ে বললাম হোয়াট দা হেল মামনি! তোমাকে তো বলেছিলাম আমি বন্ধুর বাসায় আছি। তারপরেও কেন টেনশন করে ঘুমাওনি? এখন অসুখ বাঁধালে কে দেখবে? আমার রাগান্বিত গলা শুনে মামনির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বরং মুখে তৃপ্তির হাসি। তৃপ্ত গলায় বলে উঠলো আমার ছেলে পুরোপুরি বদলে যায়নি। এখনো মা অসুস্থ হয়ে পড়বে বলে আমার বাচ্চাটার কতো চিন্তা! মামনির কথাগুলো শুনে আমি তাচ্ছিল্য স্বরে হোহো করে হেসে বললাম। ওহ্ প্লিজ! শাট আপ মামনি। তোমার শরীরের কথা ভাবার সময় আমার নেই। তুমি অসুস্থ হবে আর বাবা আমাকে বিয়ের জন্য প্রেসারাইজ করবে যাতে আমার বউ তোমার সেবা করে। এই জিনিসটার জন্যই আমি রেগে গেছি আর এটা ভালোবেসে বলিনি, প্রচন্ড ক্ষোভ থেকে বলেছি । মাইন্ড ইট। আমার কথাগুলো শুনে মামনির চোখ ছলছল করে উঠলো। কিন্তু এসব দেখার সময় কোথায় আমার কাছে?

রুমে এসে হট শাওয়ার নিলাম। ফ্রেশ লাগছে অনেক। এখন নিজের প্ল্যান সাজাতে হবে। আমি আসছি! আসছি তোমার কাছে! আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো! আমি আসছি। আচ্ছা আমার পরিবর্তন দেখে তুমি চমকাবে তাইনা? ভাববে এ কে? তুমি অবাক হবে। ভীষণ অবাক হবে আর আমার কাছে শুধু একটা জিনিসই চাইবে। কিন্তু আমি তো তা তোমাকে দিবোনা বেইবি। কিছুতেই না। আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। তোমাকেও হারাতে হবে। তোমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তোমাকে হারাতে হবে। নিজের সমস্ত প্ল্যান করে নিয়ে কলেজের জন্য রেডি হলাম।

ডায়নিং এ গিয়ে দেখলাম মামনি ব্রেকফাস্ট রেডি করে রেখেছে। গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম মামনি খেতে দাও। হুট করে আমার এরকম আচরণ দেখে মায়ের হাতে থাকা গ্লাসটা পরে গিয়ে ভেঙে গেলো। আমি না চেঁচিয়ে শফিক চাচাকে ডেকে পরিস্কার করে দিতে বললাম। এসব দেখে মনে হলো মামনির প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। তাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে বেড়িয়ে চলে এলাম।

ছেলের হুট করে ভালো আচরণ দেখে আতিয়া চৌধুরী বেশ ভরকে গেলেন। গত তিন বছর ধরে তার ছেলে কখনো তার সাথে ভালো আচরণ করেনি। এমনকি কারো সাথেই না। সেই ছেলের আজকে কি হলো? এতো ভালো ব্যবহারের পিছনে কারণ কি? কোনো প্ল্যান নেই তো তার? আতিয়া চৌধুরী আর ভাবতে পারলেন না। ধপাস করে সোফায় বসে পড়লো। তার স্বামী সিঁড়ি থেকে তার এই অবস্থা দেখে দৌঁড়ে এসে বললো কি হয়েছে আতিয়া? তোমার হুট করে শরীর খারাপ করলো কেন? পইপই করে কাল রাতে বলেছিলাম আহনাফ ঠিক আছে। তুমি চিন্তা করিওনা। অথচ তুমি ঠান্ডার মধ্যে সারারার বসে রইলে। আতিয়া তার স্বামীর মিষ্টি শাসন দেখে বলে উঠলো, কি করবো বলো? মায়ের মন তো! আর তুমিও যে ঘরে সারারাত পায়চারি করেছিলে এটা আমার জানা। ছেলেটা রাগ করে বেড়িয়েছিলো বলে আমার টেনশন হচ্ছিলো! তবে এখন অন্য কারণে ভয় লাগছে আমার। আহনাফ আজ তিনবছর পরে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে আবির। আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। ছেলেটা একাকীত্বে থেকে ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না তো? ও আবির! আমার ছেলেটা ঠিক থাকবে তো? আতিয়াকে শান্তনা দিয়ে আবির বুকে টেনে নিলেন! রান্নাঘর থেকে তাদের ভালোবাসা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তারা বেগম। ছয় বছর ধরে এ বাড়িতে কাজ করে সে। আগে মনে হতো এর চেয়ে সুখি পরিবার আর নেই কিন্তু এখন শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে সংসারটাতে যেন শান্তি ফিরে আসে।

কলেজের প্রবেশের পর শুরুতেই অরিনের সাথে দেখা হয়ে গেলো আহনাফের। অরিনের চেহারা দেখে মনে হলো সে ভয় পেয়েছে আহনাফকে। কিন্তু তারপরেও সালাম দিয়ে ক্লাসরুমের দিকে হুড়মুড়িয়ে চলে গেলো।

আহনাফ এটেন্ডনেস দিয়ে স্টাফ রুমে প্রবেশ করতেই মালিহার চোখে চোখ পড়লো তার। রাগের বদলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আহনাফ বললো আমার চারিদিকেই কেন এতো অপ্রিয় মানুষের বসবাস। চারতলার স্টাফরুমে স্থান হয়েছে মালিহা,আহনাফ এবং সঞ্জয় নামের এক শিক্ষকের। সঞ্জয় স্যার এখনো স্কুলে আসেনি৷

আহনাফকে দেখে মালিহা চতুর হেসে বলে উঠলো। কি কপাল দ্যাখো আহনাফ! তুমি আমাকে দুচোখে দেখতেই পারোনা অথচ এখন আমার সাথেই অধিকাংশ সময় কাটাতে হবে তোমাকে। উফ কথাটা ভাবলেও আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। তবে একটা বিষয় তুমি ভুল জানো বেইবি! আমি এখন আগের মতো হ্যাবলা নেই। অনেক স্মার্ট হয়ে গিয়েছি। হুম ট্রাস্ট মি। আগের বার তোমার কাছ থেকে রিজেকশন পেয়ে চুপচাপ ছিলাম কিন্তু এইবার আর থাকবোনা। বুঝলে?যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তোমাকে আমার করে নিবো! মালিহারর কথা শুনে আহনাফ হাত মুঠ করে টেবিলে সহজে আঘাত করে চেঁচিয়ে উঠে বললো, সাহস তো কম হয়নি মালপোয়া। উফ মালিহা৷ তোমার মনে আছে কলেজ লাইফে সবাই তোমাকে মালপোয়া বলে ডাকতো। কিন্তু তুমি তো জানো আমি মিষ্টি একদম পছন্দ করিনা আর মালপোয়া তো একদমই না। যাইহোক মন দিয়ে শুনে রাখো মিস মালিহা! আমাকে রাগানোর চেষ্টা করিওনা। আগের বার ছেড়ে দিয়েছি বলে এইবারও ছেড়ে দিবো এটা একদম ভেবোনা। আর আহনাফ চৌধুরীর দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টাও করোনা। হাত ঝলসে যাবে। মাইন্ড ইট। কারো আসার শব্দ পেয়ে দুজনেই নিজ কাজে মন দিলো। স্টাফরুমের দরজায় এসে, “মে আই কাম ইন টিচারস?” বলা মানুষটাকে দেখে মালিহা আহনাফ দুজনেই চমকালো । এ কোন অদ্ভুতুরে অবস্থায় পড়েছে আহনাফ? কি হবে এরপর?
চলবে,,,,,,