সেই তুমি পর্ব-০৫

0
3018

#-সেই তুমি
#-পর্ব-৫
#-সানজিদা সন্ধি

স্টাফরুমের সামনে তাদের কলেজ জীবনের বন্ধুকে দেখে তারা দুজনেই চমকালো। সঞ্জয় এসে আহনাফকে জড়িয়ে ধরতেই আহনাফ বলে উঠলো, কী ব্যাপার কৃঞ্চ! তুই এখানে কি করে? কৃঞ্চ তার আসল পরিচয় দিতেই সবটা খোলাসা হলো দুজনের কাছে। কলেজে পড়াকালীন সময়ে বাংলার এক শিক্ষক সঞ্জয়ের নাম দিয়েছিলো কৃঞ্চ। নামটার প্রচলন এতো ব্যাপকহারে বেড়ে যায় যে সবাই তার আসল নাম ভুলে কৃঞ্চ বলে ডাকতে থাকে। নামের পিছনের কারণও একটা আছে। সঞ্জয়ের ক্লাসমেট রাধার সাথে স্কুল থেকে তার সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু কলেজে ওঠার পরপরই রাধার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সঞ্জয় আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তখন থেকেই স্যার তাকে কৃঞ্চ বলে ডাকে।

মালিহা আর আহনাফ দুজনেই অন্য জগতে বিভোর থাকায় সঞ্জয় নামটার প্রতি বিশেষ একটা খেয়াল করেনি কেউ। সঞ্জয় টিচার্স মিটিংয়ে এটেন্ড করতে না পারায় আগে তাদের সাথে দেখাও হয়নি। তবে এটা সে জানতো আহনাফ তার সাথেই কলেজে জয়েন করবে।

মালিহা আর আহনাফকে একসাথে দেখে ভ্রুকুটি করে সঞ্জয় বলে উঠলো, “কিছু অতীত পিছু ছাড়ে না তাইনা?” মালিহা কুশল বিনিময় করে বললো, দিনগুলো কিন্তু আমি ভুলিনি আর হ্যাঁ খুব তাড়াতাড়ি আমার আর আহনাফের বিয়ের দাওয়াত পাচ্ছিস তুই। মালিহার কথা শুনে আহনাফ দৌড়ে এসে ওর গাল চেপে ধরে বললো, বড্ড সাহস বেড়েছে তাইনা? অনেক কাহিনি করেছিলে তুমি। সেসবের জন্য তোমাকে ক্ষমা করে দিলেও এবার আর করবোনা৷ প্রচন্ড ব্যাথায় মালিহা আহনাফের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলোনা। শেষে সঞ্জয় এসে মালিহাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আহনাফকে বললো, হোয়াট ইজ দিস আহনাফ? তুই এটা কি করলি? তোর রাগ বরাবরই বেশি কিন্তু মেয়েদের গায়ে হাত তোলার মতো স্বভাব তো তোর নয়। ”

আহনাফ রাগে গজগজ করতে করতে বলে উঠলো স্বভাব বদলাতে খুব একটা সময় লাগে না। যাইহোক একে আমার সামনে থেকে চলে যেতে বল। মালিহা কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে অ্যাটেন্ডনেস নেওয়ার খাতাটা নিয়ে সময়ের আগেই ক্লাসরুমের পথে পা বাড়ালো। প্রথম পিরিয়ডে সঞ্জয় আর আহনাফের ক্লাস নেই। নানা বিষয় নিয়ে কথার ফাঁকে সঞ্জয় বলে উঠলো অদিতির কি খবর আহনাফ?

অদিতির নাম শুনতেই আহনাফ রক্তচক্ষু নিয়ে সঞ্জয়ের দিকে তাকালো। এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন এখনই খেয়ে ফেলবে। সঞ্জয় বিষয়টা বুঝতে না পেরে সঞ্জয় আবার জিজ্ঞেস করে উঠলো কি ব্যাপার আহনাফ? অদিতি ঠিক আছে তো? ওর কোনো ক্ষতি হয়নিতো? কথাটা বলা শেষ হয়েছি কি হয়নি আহনাফ এসে সঞ্জয়ের গলা চেপে ধরে বললো কি ব্যাপার? তুই এতো অদিতি অদিতি করছিস কেন? ও তোর কারণেই আমার সাথে এমন করেছে তাইনা? তোর কারণেই। ও আচ্ছা, এবার বুঝতে পারছি। তোকে তো আজ মেরেই ফেলবো আমি। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝতে না পেরে সঞ্জয় বললো, আহনাফ কি বলছিস এসব? আর প্লিজ ছাড় আমাকে। আমার নিঃশ্বাস ক্রমশ আটকে আসছে। ছাড়! ছাড় বলছি! সঞ্জয়ের কথাগুলো যেন কর্ণগোচরই হলো না আহনাফের। হুস জ্ঞান ভুলে সে শক্ত করে চেপে রাখলো সঞ্জয়ের গলা। একপর্যায়ে সঞ্জয় দিশা না পেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আহনাফকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলো৷ দেয়ালের সাথে ধাক্কা লেগে হুস আসলো আহনাফের। এরপর কি ভেবে যেন পাগলের মতো ঢুকরে কাঁদতে লাগলো। কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে সঞ্জয় বোতল থেকে পানি নিয়ে একঢোকে খেয়ে নিয়ে আহনাফের কাজকর্ম দেখতে লাগলো।পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে সঞ্জয় বুঝতে পারছে না। এদিকে আহনাফ অঝোরে কেঁদে চলছে। কোনো ছেলেকে পাগলের মতো এই প্রথম কাঁদতে দেখছে সঞ্জয়। আর আহনাফের মতো কোনো ছেলে কাঁদতে পারে এটা যেন অবিশ্বাস্য তার কাছে। আহনাফের কান্না দেখে মনে হচ্ছে এভাবে পাগলের মতো কান্না করার জন্য কত যুগ ধরে অপেক্ষা করছে সে। কিন্তু কেন, কি কারণে এই অশ্রুপাত সেটা অজানা সঞ্জয়ের কাছে। এদিকে আহনাফের কাছে যেতেও ভয় পাচ্ছে সে। পাছে কিছু করে বসে। একপর্যায়ে আহনাফকে কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরে টেবিল থেকে মাথা তুলে সোজা ওয়াসরুমে চলে যায়। সঞ্জয় হাজার চিন্তা মাথায় নিয়ে টেবিলে বসে পড়ে। ওয়াসরুম থেকে বের হতেই সঞ্জয়কে ডেকে ছোট্ট করে সরি বলে ল্যাপটপে মুখ গুঁজলো আহনাফ। সঞ্জয় যেন বেশ ভরকে গেলো। আহনাফের চেহারা দেখে কেউ বুঝতে পারবে না একটু আগে পাগলের মতো কেঁদেছে সে। যেন কিছুই হয়নি এরকম ভাব নিয়ে কলেজ সংক্রান্ত কথা শুরু করলো
আহনাফ। গুমট ভাবটা দূর করতে সঞ্জয়ও ভয় কাটিয়ে গল্পে মননিবেশ করলো। কিন্তু অদিতির নাম শুনে কেন আহনাফ এমন আচরণ করলো এটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো! দীর্ঘদিন কলেজ জীবনের কারো সাথে টাচে না থাকায় কিছুই জানেনা সে। দ্বিতীয় পিরিয়ডের ঘন্টা পড়তেই দুজনে স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। জাফনার সাথে এই পিরিয়ডে ক্লাস রয়েছে আহনাফের। মেজাজ খারাপ থাকায় এটা নিয়ে খুব একটা না ভেবে সোজা ক্লাসরুমের দিকে গেলো।

অন্যদিকে, এক কাপ কফি মগ হাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ব্যাস্ততম শহরকে দেখতে থাকলো অদিতি। ৬ তলার বেলকনি থেকে নিচে তাকালে অটো, রিকশা, ফেরিওয়ালা সহ হাজার মানুষের পদচারণায় মুখরিত শহর দেখতে পাওয়া যায়। একেকজন একেক উদ্দেশ্য নিয়ে বেড়িয়েছে । সংসারের হাজার ঝামেলা, গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া, হতাশা, ব্যার্থতা এসব নিত্যদিনের কাহিনিকে পেছনে ফেলে মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। জীবন কখনো থেমে থাকে না। সময় সময়ের নিয়মেই বয়ে চলে। শীতকালে সকাল ১০-১১ টাও যেন ভোরের মতো। শীতের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে কফি খেতে খেতে পুরনো স্মৃতিচারণে মগ্ন হয়ে পড়েছিলো অদিতি। আজ আহনাফকে ভীষণ রকম মনে পড়ছে তার। কেন পড়ছে সেটা সে জানে না। তবে মনে পড়ছে। দীর্ঘদিন পরে আহনাফকে দেখতে পেয়ে বুকের ভেতরে কেমন একটা ব্যাথা অনুভুত হয় অদিতির। এই ব্যাথা কোন ঔষধে সারবে এটা সে জানে না। তবে ওই মুহুর্তে তার মনে হয়েছিলো আহনাফের সাথে একবার যোগাযোগ করা ভীষণ জরুরি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফির কাপের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো তার প্রশ্বাস কফির কাপে পড়ে একধরণের ঢেউ সৃষ্টি করেছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওই ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো অদিতি। ইদানীং ভীষণ ছোট ছোট বিষয়ই মুগ্ধতা সৃষ্টি করছে। সে কি তবে বদলে যাচ্ছে? ইশ! এ বদলটা যদি তিনবছর আগে আসতো! গল্পটা তবে হয়তো ভিন্ন হতো। আবার নানান ভাবনায় ডুবে গেলো অদিতি।

আহনাফ ক্লাসরুমে ঢুকতেই সব স্টুডেন্সরা দাড়িয়ে গেলো! কিন্তু বন্ধুদের সাথে মগ্ন থাকায় জাফনা টের পায়নি স্যার এসেছে। সে আপনমনেই গল্প চালিয়ে যেতে লাগলো। এদিকে জাফনার কাহিনি দেখে আহনাফের রাগ হতে লাগলো। প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলে উঠলো, লাস্টবেঞ্চের তিনজন দাঁড়াও। এরপর একটু আগে সঞ্জয় আর মালিরার উপরের রাগটা এই তিন জনের উপর ঝাড়তে লাগলো সে। তিনজনকে ক্রমাগত বকাবকি করতে লাগলো। টিচার আসলে সম্মান প্রদর্শন পূর্বক দাড়াতে হয় এই সেন্স কি নেই তোমাদের? ইডিয়ট একেকটা। ম্যানার শিখোনি? জাফনা জেদী,রাগি হলেও। লেখাপড়ায় ভালো। ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করে চলে আর পাংচুয়ালও বটে। জীবনে প্রথমবার এই বিষয় নিয়ে বকা খেয়ে কেঁদে দিলো তিনজনই। সে যেন এক অন্য রকম দৃশ্য। এটা দেখে আহনাফ পূণরায় ধমকিয়ে বলে উঠলো, অন্যায় করেছো আবার বকেছি বলে কাঁদছো? নেক্সট টাইম যেন এমন না হয়।মাইন্ড ইট। নাউ সিট ডাউন। সবাইকে বসতে বলে আহনাফ লেকচার শুরু করলো বায়োলজির টিচার হিসেবে জয়েন করেছে সে। এদিকে স্টুডেন্টদেরকে সে বুঝাচ্ছে আর জাফনা রাগে ফোসফাস করছে। ভরা ক্লাসে সবার সামনে বকা খাওয়াটা সে মেনে নিতে পারছিলোনা। শোধ নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ক্লাসে মন দেয় সে। আর মনে মনে বলে এভাবে সবার সামনে আমাকে অপমান করার ফল গোনার জন্য রেডি থাকেন স্যার।

চলবে,,,,