সেদিন ছিল পূর্ণিমা পর্ব-০৩

0
327

#সেদিন_ছিল_পূর্ণিমা
#পর্ব:- তিন (০৩)

” কে আপনি? তাছাড়া আপনি আমার ব্যাগের ভেতর থেকে কেন নিয়েছেন? আপনি কি জানেন ওই প্যাকেটের জন্য আমি কতটা বিপদে আছি? ”

” হ্যাঁ জানি। ২০ লাখ টাকার মতো জিনিস যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তখন সেই জিনিসের মালিক সেটার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। এটা স্বাভাবিক। ”

” কতো টাকা? ”

” ২০ লাখের বেশি হবে। এটা নিষিদ্ধ একটা ড্রাগস এর প্যাকেট। যে মহিলা আপনার পাশে বসেছিল তিনিই ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিল। ”

” তিনি আমার ব্যাগে কেন রাখলেন? ”

” আপনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন তখন মাঝপথে বাস পুলিশ চেকিং করে। পুলিশ দেখে আপনার পাশে বসা সেই মহিলা এগুলো আপনার ব্যাগে রেখেছিল। আপনার সিট ছিল D4 আর আপনার পাশের মহিলা D3, আমি ছিলাম D2 সিটে। সত্যি বলতে আপনাকে আমি কাউন্টার থেকে ফলো করছিলাম। যখন কাউন্টারে বসে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তখন আপনাকে দেখে ভালো লেগেছিল। বাসে উঠে যখন দেখলাম আপনার পাশাপাশি সিট পড়েছে তখন বেশ খুশি হলাম। কিন্তু আফসোস হলো কারণ আরেকটু কাছে যদি বসতে পারতাম। ”

” তারপর কি হলো? ”

” আপনি ঘুমাচ্ছেন, আমি প্রায় সারাক্ষণ আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। পুলিশ বাসে ওঠার পরে হঠাৎ দেখি মহিলা ঘাবড়ে গেলেন। তারপর তার নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বাহির করেন। সেই প্যাকেট আপনার ব্যাগে রেখে দিয়ে সে চুপ করে বসে থাকে। ”

” কি বলছেন এসব? ”

” ঠিকই বলছি! পুলিশ কিন্তু আপনার ব্যাগ চেক করেনি, চেক করলে আপনি ফেঁসে যেতেন। তবে আমার একটা ভুল হয়ে গেছে, তখন যদি পুলিশের কাছে বলতাম তাহলে মহিলা ধরা পড়তো। ”

” করলেন না কেন? ”

” আসলে মানুষের মাথায় সবসময় সব ধরনের বুদ্ধি কাজ করে না। সেজন্যই প্রচলিত প্রবাদ আছে ‘ চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে!’ ”

” আপনি কীভাবে নিলেন ব্যাগটা? ”

” একটা পেট্রোল পাম্পে গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছিল মনে আছে? আপনিসহ সেই মহিলা এবং আরও অনেকে বাস থেকে নেমেছেন। ”

” হ্যাঁ ওয়াশরুমে গেছিলাম। পাশের সেই মহিলা আমাকে ডেকে নিয়ে গেছিল। ”

” আমিও নেমেছিলাম, কিন্তু যখন দেখলাম যে আপনারা নামছেন তখন চট করে বাসে উঠি। খুব সাবধানে আর কৌশলে ব্যাগটা খুলে প্যাকেটটা নিজের কাছে নিয়ে যাই। তারপর সেটা একদম পিছনে নিয়ে রাখি। ”

” কেন করেছেন? ”

” আমার সন্দেহ ছিল এটা নিষিদ্ধ কিছু হতে পারে। কারণ আপনি আসার আগেই সেই মহিলা দ্রুত বাসে আসে। তারপর আপনার ব্যাগ খুলে ওটা নিজের রাখা প্যাকেট খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু তাকে হতাশ হতে হয়েছে কারণ সেটা অলরেডি আমি সরিয়ে ফেলি। ”

” কি দরকার ছিল ভাই বলেন? ওরা যদি সেটা নিয়ে যেত তাহলে আমি এমন বিপদে পড়তাম না। এভাবে বাসায় লুকিয়ে থাকতে হতো না। সব দোষ আপনার। ”

” আমি জানি। বাস থেকে নেমে আপনাকে আমি হারিয়ে ফেলি। প্যাকেটের ভেতরের ড্রাগস গুলো দেখে আর সেগুলোর দাম শুনে আমি রিতীমত অবাক হলাম। তখনই বুঝতে পারি যে আপনার উপর বিপদ আসবে। ”

” আপনি আমার নাম্বার পেলেন কীভাবে? ”

” কাউন্টার থেকে। আমরা যেই বাস কাউন্টার থেকে উঠেছি সেখানে আমার এক পরিচিত লোক আছে। তাকে বললাম D4 সিটের যাত্রীর নাম্বার যোগাড় করতে হবে। আমাদের ভ্রমণের তারিখ ও বাসের কোচ নাম্বার বললাম। আমার সেই পরিচিত ভাই আপনার নাম্বার ম্যানেজ করে দিয়েছে। ”

” আপনি দয়া করে ওদের জিনিস ফিরিয়ে দেন তাহলে ওরা আমার পথ থেকে সরে যাবে। ওদের জন্য আমি চাকরি করতে পারি না। ”

” কি বলেন এসব? আমি তো তাদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতে চাই। আর সেজন্য সবচেয়ে বেশি সহোযোগিতা করবেন আপনি। ”

” আমি…? কীভাবে! ”

” ওরা আপনার উপর নজর রাখবে। আর সেই সুযোগটা আমরা কাজে লাগাবো, তাদের ধরিয়ে দেবার সুযোগ পাবো। ”

” কিন্তু….! ”

” দেখুন, এরা খুব খারাপ একটা চক্র। এরকম অনেক ভালো মানুষ তারা ড্রাগসের মাধ্যমে শেষ করে দিচ্ছে। মারাত্মক বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে সমাজে। এদের আইনের হাতে তুলে দেওয়া আপনার আমার কর্তব্য। ”

” আপনি নিজে তো সবকিছু করতে পারেন। ”

” আমি তো তাদের চিনি না। তারা তো আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে কারণ তারা ভেবেছে আপনি সেগুলো সরিয়ে ফেলেছেন। ”

” এখন আমাকে কি করতে হবে? ”

” আপনি আপনার ঠিকানা দিন, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করবো। তারপর আমরা দুজন মিলে পুলিশের কাছে গিয়ে সবকিছু তাদের বলবো৷ তারপর তাঁরাই বলে দিবে আমাদের কি করতে হবে। ”

” আপনাকে কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে, আপনি কি ওদের দলের কেউ? ঠিকানা বের করার জন্য বা আমাকে…….

টুট টুট টুট। শব্দ করে কলটা কেটে গেল। আমি মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলাম, তারপর নিজ থেকে কলব্যাক করলাম কিন্তু নাম্বার বন্ধ।
আশ্চর্য!

মোবাইল বিছানায় রেখে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আকাশে কিছু হালকা মেঘ জমেছে, তার ফাঁকে ফাঁকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। আমি আমার একটা হাত গ্রিলের সঙ্গে রাখলাম। বিপদ যেন আমার ছায়া সঙ্গী হয়ে গেছে। অথচ বছর খানিক আগে আমার জীবন অন্যরকম ছিল। আমার এই ছোট্ট জীবনে কতো বিচিত্র মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল।

টগর ভাইয়ের নাম্বার এখনো বন্ধ। রাবুর কাছে কল দিলাম, সে নাকি তার শাশুড়ীর সঙ্গে কোথায় যেন গেছে। পরে কথা বলি, বলে কল কেটে দিল।

★★★

বিছানায় শুয়ে ছিলাম। তামান্না আপুর দুপুরের খাবার খেতে বাসায় এলেন। তামান্না আজকে রোজা রাখেনি। গতকাল রাতে আমাকে বলেছিল ‘আমি অসুস্থ, কাল থেকে ৪/৫ দিন আর রোজা রাখা হবে না।’ একটা মেয়ে হিসেবে এটা আমি জানি। তাই আর কিছু বলিনি।

আমি দরজা খুলে দিতেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

” কি ব্যাপার কান্না করছো নাকি? ”

” বাড়ির কথা মনে পড়ছে, তাই মন খারাপ। ”

” চাকরির কিছু ব্যবস্থা হলো? ”

প্রশ্ন করে তামান্না ওয়াশরুমে চলে গেল। তারপর বের হয়ে এসে খেতে বসে ভাতের থালা হাতে নিয়ে খেতে খেতে বললো,

” মাত্র এক ঘন্টা সময় পাই অবন্তী। অফিস থেকে বাসায় আসতে বারো তেরো মিনিট হয়ে যায়। আবার বের হতে হবে পনের মিনিট আগে। ”

” তোমাদের অফিস থেকে দুপুরের খাবার খেতে দেয় না? ”

” আরে না। ইপিজেডের মধ্যে হলে দেয় কিন্তু আমরা যেখানে চাকরি করি সেখানে দেয় না। তাছাড়া এখন তো রমজান মাস। ছোট কোম্পানি তো, তাই কখনো খেতে দেয় না। কাজের কতো চাপ সারাক্ষণ একটু বসার সুযোগ পাই না। আমি সুপারভাইজার হবার আগে অপারেটর ছিলাম, তখন সারাদিন বসে বসে কাজ করতাম। বিরক্ত হয়ে একটু দাঁড়ানোর সুযোগ খুঁজে বেড়াতাম। আর এখন সারাদিন লাইনের মধ্যে দৌড়াতে হয়, ইচ্ছে থাকলেও বসতে পারি না। ”

” খুব কষ্টের তাই না? ”

” হ্যাঁ। তবে মাস শেষে বেতন পেলে মনটা ভালো হয়ে যায়। গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে আনন্দে আনন্দে সপ্তাহ খানিক কাটে। তারপর আবার সেই মাস শেষ হবার অপেক্ষা। আমাদের জীবন পেরিয়ে যায় মাস শেষ হবার অপেক্ষা করতে করতে। কিন্তু জীবন থেকে যে দিনদিন সময় কমে যাচ্ছে সেই হিসাব করি না। ”

” তোমার বেতন কত? ”

” সবমিলিয়ে ১৬/১৭ হাজার পাই। স্টাফ তো। ”

” কতটুকু পড়াশোনা করছো? ”

” এসএসসি পাশ করে এসে গার্মেন্টসে চাকরি নিছিলাম। ”

” আমাকে একটা চাকরি দিতে পারবে? ”

” তুমি গার্মেন্টসে চাকরি করবা? ”

” এছাড়া কি করবো? ”

” টগর ভাই কিছু ব্যবস্থা করে নাই? ”

” তার নাম্বার বন্ধ। কোনো যোগাযোগ নেই আমার সঙ্গে, একটা ছোট্ট ঝামেলা হয়ে গেছে। ”

” তাহলে তো চিন্তার বিষয়। ইদের আগে গার্মেন্টসে চাকরি পাওয়া সম্ভব না। তবুও আমি গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখি, যদি হয় তাহলে তোমাকে নিয়ে যাবো কালকে। ”

খাবার শেষ করে তামান্না আয়নার সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক লাগিয়ে ওড়না বাঁধলো। তারপর রুম থেকে বের হবার সময় আমাকে বললো,

” একটা লোক তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, ঘটনা কি বুঝতে পারছি না। ”

” কে সে? ”

” চিনি না, সকালে আমি বের হতেই একটা লোক আমাকে তোমার একটা ছবি দেখালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো ‘ এই মেয়েটা বিল্ডিংয়ের কত তলায় থাকে জানেন? ‘ আমি তোমার ছবি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, ‘ না জানি না। ”

” কিরকম ছবি? আমার ছবি তারা পাবে কোই? ”

” তা তো জানি না। তোমার সঙ্গে আরেকটা ছেলে ছিল। তোমার পরনে লাল একটা থ্রি পিছ আর সঙ্গে ছেলেটার পরনে সাদা টিশার্ট। ”

” তাহলে মনে হয় আমার স্বামী আর আমার ছবি ছিল ওটা। ”

” তোমার বিয়ে হয়েছে? ”

” হ্যাঁ। ”

” বলো কি, জানতাম না তো। আচ্ছা দেরি হয়ে যাচ্ছে এখন যাই তাহলে। বাসায় ফিরে সবকিছু শুনবো তুমি বাসা থেকে বের হইও না। আর ওরা মনে হয় দারোয়ানের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করে নাই। কারণ দারোয়ান তাহলে সন্দেহ করবে, আর ওরা সবসময় ঘুরঘুর করতে পারবে না। ”

তামান্না চলে গেল। আমাদের পাশের রুমের যে দুটো মেয়ে ছিল তারা বাসায় আছে। এদের নাম জানি কিন্তু ভালো করে পরিচয় হয়নি এখনো।

আমি তামান্না আপুর কথা ভাবতে লাগলাম। সোহাগের সঙ্গে তোলা আমার ছবি রাস্তার একটা লোক কীভাবে পাবে? তাহলে কি সোহাগ নিজে দিয়েছে সেই ছবি? কিন্তু সোহাগকে পাবে কোথায় এরা?

সকাল থেকে হালকা পেটে ব্যথা ছিল। দুপুরের পর থেকে সেটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। সাড়ে চারটার দিকে হঠাৎ অনুভব করলাম আমার ব্লাডিং হচ্ছে। সেদিন টগর ভাইয়ের যখন ডাক্তার বলেছিলেন আমি প্রেগন্যান্ট তখন বাসায় ফিরে আমি অনেক ভেবেছিলাম।

আমার ডিভোর্স হয়েছে মাস খানিক আগে। আর ডিভোর্সের দুমাস আগে থেকে স্বামীর সাথে এক বিছানায় থাকা হয়নি আমার।

সবমিলিয়ে তিন মাস। তবে আমার স্পষ্ট মনে আছে, শেষ যেবার আমার পিরিয়ড হইছে তারপর থেকে আর সোহাগের সঙ্গে ছিলাম না। তাহলে আমার গর্ভে সন্তান আসবে কীভাবে?

এইসব জটিলতা খোলাসা করার জন্য আবারও ভালো করে ডাক্তারের কাছে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হবার কারণে নিজের শারীরিক সমস্যাটা গোপনেই রইল।

পেটে ব্যথা নিয়ে শুয়ে ছিলাম। একটু পর পর খুব মারাত্মকভাবে ব্যথা অনুভব করছি। রাবুর কাছে আরেকবার কল দিলাম, রিসিভ করে নাই।

মিনিট দশেক পরে আমার মোবাইলে কল এলো। ভেবেছিলাম রাবু হয়তো কলব্যাক করেছে। কিন্তু মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি সোহাগ কল দিয়েছে। একবার ভাবলাম রিসিভ করবো না। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো ছবিটার কথা জিজ্ঞেস করা দরকার।

” হ্যালো অবন্তী, আমি সোহাগ! ”

” চিনতে পেরেছি, হঠাৎ কি মনে করে? ”

” আমি তো ঢাকা এসেছি। ”

” ঢাকায়? কিন্তু কেন? ”

” তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তুমি যে বাসায় থাকো আমি সেই বাসার নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। তুমি একটু নিচে আসবে? ”

[ সকলের মতামত আশা করছি। ভালো লাগলে অবশ্যই নিজের উপস্থিতি জানিয়ে যাবেন। ]

চলবে….

লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম।