সেদিন বৃষ্টি হবে পর্ব-০১

0
804

#সেদিন বৃষ্টি হবে
#সূচনা_পর্ব
#সামিয়া_মেহেরিন

চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে খেতে এসে নিজেরই বিয়ে করতে হলো তূর্ণার। অতঃপর বাসর ঘরে বসে আছে। বসে আছে বললে ভুল হবে। আয়েশ করে বসে বিরিয়ানি গিলতে ব্যস্ত সে।

এমন সময় তার বর নওশাদ ঘরে এলো। তূর্ণা একপলক তার দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিলো। নওশাদ ঘরের দরজা লাগিয়ে এসে কাঠ কাঠ গলায় বলে,
“তূর্ণা, আমি তোকে সবসময় নিজের বোনের চোখেই দেখে এসেছি। এই বিয়ে মেনে নেয়া আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। আমি জানি তুই নিজেও এই বিয়ে মেনে নিবি না।”

তূর্ণা খুব মনোযোগী শ্রোতার মতো নওশাদের কথা গুলো শুনলো। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। এতো গম্ভীর একটা মুহূর্তেও নিজের বিরিয়ানির কথা মাথায় এলো তার। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে খেতে একটুও ভালো লাগবে না। মনে মনে ভাবলো আগে বিরিয়ানি খাওয়া যাক, বাকি কাজ পরে। সকাল থেকে কিছু খায় নি সে। খুব কষ্টে মায়ের থেকে এই এক প্ল্যাট বিরিয়ানি যোগাড় করে এনেছে। এই ভেবে খাবার খেতে পূর্ণ মনোযোগ দিল তূর্ণা। যেন এই মুহূর্তে খাবার না খেলে খুব বড় অপরাধ হয়ে যাবে।

নওশাদ ড্যাবড্যাব করে তূর্ণার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। সে এতো সিরিয়াস হয়ে এতগুলো কথা বলল অথচ এই মেয়ের কোনো ভাবান্তর নেই। অতঃপর তার চোখে পড়ল তূর্ণার হাতে থাকা বিরিয়ানির প্লেট এর দিকে। এতক্ষণ সে খেয়াল করে নি যে মেয়েটা খাচ্ছে। তূর্ণাকে নওশাদ সেই ছোটবেলা থেকে চেনে। খাওয়ার সময় মেয়েটার সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকে খাবারের দিকে। খাওয়ার সময় কেউ বিরক্ত করলে তূর্ণা ভীষণ রেগে যায়। তাই নওশাদ তূর্ণার খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইল।

নওশাদ খানিকক্ষণ ঘরের ভিতর এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করে পরনের পাঞ্জাবির পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে বারান্দায় চলে গেল। তার মিনিট দুয়েকের মধ্যে তূর্ণার খাওয়া হয়ে যায়। বিছানার পাশের টেবিলটায় প্লেট রেখে বাথরুমের বেসিনে হাত ধুতে যায় তূর্ণা। ঘরের সাথেই আছে বাথরুম।

হাত ধুয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে তূর্ণা। পুরো ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। ঘরটা তূর্ণারই। এটাকে কোনোদিক দিয়েই তূর্ণার কাছে বাসরঘর বলে মনে হচ্ছে না। হবেই বা কীভাবে একটা ফুলওতো নেই এই ঘরে। একবার নিজের দিকে তাকালো সে। বিয়ের কোনো সাজগোজও তার নেই। সাদা আর সবুজের মিশ্রণের একটা কাতান শাড়ি পরে আছে সে।

বাসরঘর যে সাজানো হয়নি এমনটা নয়। সাজানো হয়েছে তবে সেটা নওশাদের ঘরে। তূর্ণা কিছুতেই নিজের রুম ছেড়ে যাবে না বলে জেদ ধরেছিল বিধায় নওশাদই তার ঘরে আসতে বাধ্য হয়েছে।

নওশাদ আর তূর্ণা চাচাতো ভাই-বোন। একই বিল্ডিংয়ে পাশাপাশি দুই ফ্ল্যাটে তারা থাকে। আজ যে তূর্ণার বিয়ে তা তূর্ণা নিজেও জানতো না। তার বাবা তাকে অনেকদিন ধরে নওশাদের সাথে বিয়ের ব্যাপারে বলছিল ঠিকই কিন্তু তূর্ণা তাকে মানা করে দিয়েছিল। তারপর তার বাবা তাকে আর কিছু বলেনি। এক সপ্তাহ আগে সে জানতে পেরেছিল নওশাদের নাকি বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু কার সাথে করা হয়েছে তা তূর্ণা জানতো না।

অতঃপর আজ বিকেলে যখন সে বিয়ে খেতে কমিউনিটি সেন্টারে হাজির হলো তখন জানতে পারলো বিয়ে নাকি তার সাথেই। সে বিয়েতে মানা করে দিয়েছিল বলে তার বাবা প্ল্যান করে সব করেছে। তবুও তূর্ণা বিয়ে করবে না ডলে বেঁকে বসেছিল। কিন্তু তার বাবা তৌসিফ সাহেবও কিছু কম যান না। বুকে হাত দিয়ে বসে পরলেন। তূর্ণার না চাইতেও বিয়েটা করতে হলো। তবে অবাক করার বিষয় হলো তূর্ণার কবুল বলার সাথে সাথেই তৌসিফ সাহেবের বুকে ব্যাথা কোথায় যেন ফুরুৎ করে পালিয়ে গেল।

নওশাদ বারান্দা থেকে ঘরে এলো। তূর্ণার ঘোর কেটে যায় তাতে। নওশাদ আস্তে করে ঘরের দরজা হালকা খুলে দিল। বাইরে থেকে একটা হাত একটা বড় ব্যাগ নওশাদের হাতে ধরিয়ে দিল। হাতটা কার তা তূর্ণা দেখতে পেল না। তার আগেই নওশাদ ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। ব্যাগটা মেঝেতে রেখে তূর্ণার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“সময় নষ্ট করতে চাইছি না। যা বলার সরাসরিই বলছি। এই বিয়েতে আমার মত ছিল না, তূর্ণা। কিন্তু বাবা আর চাচার জন্য বিয়েটা করতেই হলো। বিয়ে করব না বলে সকালে বাড়ি থেকে পালিয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু তোর পুলিশ বাপ কেমনে কেমনে যেন আমাকে খুঁজে বের করে বিয়ের আসরে বসিয়ে তবে ছাড়লো।”

শেষের কথাটা নওশাদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল। যেন তূর্ণার বাবাকে এই মুহূর্তে সামনে পেলে তাকেও চিবিয়ে খেয়ে নিবে। বড় বড় দুটো শ্বাস ফেলে নওশাদ আবারো বলে ওঠে,
“আমি আজই আবার পালিয়ে যাবো।”

তূর্ণা কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। পালাবে মানে! কীভাবে পালাবে?

এদিকে নওশাদ তূর্ণার আলমারি খুলে সেখান থেকে একটা শাড়ি বের করে নিল। শাড়ি আর ব্যাগ হাতে নিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ায় নওশাদ। তূর্ণাও তার পিছু পিছু যায়। উদ্দেশ্য নওশাদের কাণ্ডকারখানা দেখা।

তূর্ণারা দোতলায় থাকে। তূর্ণার বারান্দায় গ্রিল দেয়া নেই। পালাতে বেশ সুবিধাই হবে নওশাদের। তূর্ণার আলমারি থেকে নেয়া শাড়িটা ভালোভাবে বারান্দার রেলিং এর সাথে গিট্টু দিয়ে নেয় নওশাদ। নিচু স্বরে তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে,
“আমি নেমে গেলে শাড়িটা খুলে আবার আলমারিতে রেখে দিস।”

নওশাদ তূর্ণার প্রতিউত্তরের অপেক্ষা করল না। হাতে থাকা ব্যাগটা নিচে বাগানে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর আস্তে আস্তে শাড়িটা ধরে নিচে নামতে লাগল। তূর্ণা বেশ মনোযোগ দিয়ে নওশাদের নামা দেখছিল। মনে হচ্ছিলো নওশাদের এভাবে পালানোর বেশ অভিজ্ঞতা রয়েছে।

নওশাদ আর বাগানের মাটির মধ্যকার দূরত্ব যখন মাত্র আর একহাত তখনই হঠাৎ হাত ফসকে যায় নওশাদ। ফলাফল নওশাদ ধুপ করে নিচে পড়ে। তা দেখে তূর্ণা মুখ টিপে হাসে। পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে নইলে এতক্ষণে সে হেসে গড়াগড়ি খেতো।
নওশাদ উঠে দাঁড়ায়। খুব একটা লাগেনি তার। তূর্ণাকে ইশারায় জানায় সে ঠিক আছে। তারপর নিচে থেকে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় নওশাদ। যতক্ষণ তাকে দেখা যাচ্ছিলো ততক্ষণ তূর্ণা অপলক তাকিয়ে ছিল। দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলে সেও রেলিং থেকে শাড়িটা খুলে আলমারিতে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ক্লান্ত থাকায় মিনিট দুয়েকের মাঝে ঘুম ধরা দেয়।

নিশুতি রাত। কালো মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ। আঁধারিয়া রাত যেন আরো অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। পলকেই ঝুম বৃষ্টি নামলো। গ্রীষ্মের তৃষ্ণার্থ ধরণী বৃষ্টির জলে তৃষ্ণা মেটাতে লাগল।
জানালা দিয়ে তেরছাভাবে আসা বৃষ্টির ফোঁটা তূর্ণার চোখে মুখে ছিটিয়ে পড়তেই ঘুম হালকা হয়ে আসে তূর্ণার। বৃষ্টির প্রকোপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। সাথে জানালা দিয়ে আসা পানির ফোঁটাও। তূর্ণার ঘুম ভেঙে যায়। পরিস্থিতি বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগে তার। অতঃপর বিছানা ছেড়ে উঠে আসে। জানালা আর বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। ঠায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরের বৃষ্টি পতনের দৃশ্য অনিমেষ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। মেয়েটার জীবনের সব অনাকাঙিক্ষত ঘটনাগুলো এই বৃষ্টির দিনেগুলোতেই হয়। তার মনের বদ্ধমূল ধারণা বৃষ্টি তার জীবনে বিষাদ বয়ে নিয়ে আসে। বর্ষণ মুখর দিনগুলো ইদানিং তার কাছে কেমন অভিশপ্ত দিনের মতো মনে হয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার পর্দাগুলো ভালোভাবে টেনে দেয় তূর্ণা। শুনেছি যারা সবসময় মানুষের সামনে হাসিখুশি থাকে তারাই নাকি ভেতরে ভেতরে একাকিত্বে সবথেকে বেশি অসুখী থাকে। তূর্ণার ক্ষেত্রেও কি তাহলে তাই!

সকালে আজ ঘুম থেকে উঠতে তূর্ণার দেরী হয়ে যায়। যদিও সে সবসময় ভোর ভোরই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। হয়তো রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়নি বলেই সকালে উঠতে দেরি হয়েছে।

তূর্ণা ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমে আসে। সেখানে তার বাবা-মা আর চাচা-চাচি আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন। তূর্ণা খুব ভালো ভাবে তাদের সকলের মুখের ভাবভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে নেয়। তূর্ণার মা বাদে সবার মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ।

তূর্ণা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে ঝুড়ি থেকে একটা আপেল নিয়ে তাতে কামড় দেয়। তূর্ণার ভাবলেশহীন কর্মকাণ্ডে তার চাচি কিছুটা রেগে যান। তিরিক্ষি মেজাজে বলে ওঠেন,
“তূর্ণা, তোর কি কোনোদিন আক্কেল-জ্ঞান হবে না? তোর বর পালিয়ে গিয়েছে। তোর জন্য ডিভোর্স পেপার রেখে গেছে। কিন্তু তুই! তুই তো দিব্বি আছিস।”

বলেই ডিভোর্স পেপার তূর্ণার সামনে টেবিলের ওপর রাখলেন। তূর্ণা বাঁকা চোখে তা একবার দেখে নিল। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

তূর্ণা আরেকবার আপেলে কামড় দিতে নিবে এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। তূর্ণার মা নিলাশা বেগম গিয়ে দরজা খুলে দেন। তূর্ণা ঘাড় কাত করে দেখার চেষ্টা করে কে এসেছে। তার ভাই তুষার এসেছ দেখে সোজা হয়ে বসে আপেলে কামড় দেয় সে। কিন্তু আপেলের সেই কামড়ে নেয়া অংশটুকু তার গলা দিয়ে নামলো না। খুব পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর কানে আসায় তা গলায় আটকে গেল। কয়েকবার কাশি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে আবারো দরজার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো। তুষার একা আসেনি। তার সাথে তার বন্ধুও এসেছে। আর সেই বন্ধু আর কেউ নয় বরং তূর্ণার খুব অপ্রিয় একজন মানুষ মাশরুর রশিদ উদয়।

চলবে!