সেদিন বৃষ্টি হবে পর্ব-০২

0
471

#সেদিন বৃষ্টি হবে
#পর্ব_০২
#সামিয়া_মেহেরিন

গতকাল পুরো রাত বৃষ্টি হওয়ায় সকালবেলা আকাশ একদম মেঘমুক্ত। মেঘহীন আকাশে সুর্য তার রাজত্ব কায়েম করে অকপটে আলো আর উত্তাপ বিলিয়ে দিচ্ছে ধরণীকে। সুর্যের আলো কাচের জানালা ভেদ করে ড্রইং রুমে প্রবেশ করছে। তূর্ণার দৃষ্টি সেদিকে।

ড্রইং রুমে তূর্ণার বাবা-মা, চাচা-চাচি, তুষার সকলেই উপস্থিত। উপস্থিত আরো দুজন আছে। একজন হলো মাশরুর রশিদ উদয় যে কিনা তূর্ণার অপ্রিয় মানুষ। তূর্ণা মুখে তাকে অপ্রিয় বললেও তার মনে কি আছে তা তো শুধু সে ই বলতে পারে।

উপস্থিত অপর জন হলো নওশাদ। খানিকক্ষণ আগেই তাকে ধরে বেধে আনা হয়েছে। তূর্ণার বাবা তৌসিফ সাহেব পুলিশের চাকরি করেন। নওশাদকে খুঁজতে তার বেশি বেগ পেতে হয়নি। কিছুক্ষণ আগেই তার থানার দুজন হাবিলদার নওশাদকে সাভারে থেকে তার বন্ধুর বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। তুলে নিয়ে আসার দৃশ্যটা অবশ্য বেশ হাস্যকর ছিল। হাবিলদার দুজনই বলতে গেলে নরদা’নব আকৃতির। আর এদিকে নওশাদ ছোটখাটো একজন মানুষ। তার উচ্চতাও খুব বেশি না। হাবিলদার দুজন তাকে দুই দিক থেকে একেবারে বগলদাবা করে তুলে নিয়ে এসেছে।

উপস্থিত সকলের মুখই গম্ভীর শুধু তূর্ণা আর নওশাদ বাদে। খানিকক্ষণ আগেই সে তার বাবা আর চাচাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। এই বিয়ে সে মানে না। যত দ্রুত সম্ভব ডিভোর্স দিয়ে সে এই সম্পর্কটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। তৌসিভ সাহেব এবং তার ভাই তাফসির সাহেব বারবার নওশাদকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছেন কেন সে এই বিয়ে মেনে নিতে চাইছে না। নওশাদের এই কথার কোনো উত্তর দিতে পারছে না। অতঃপর তৌসিভ সাহেব আবারো নওশাদকে একই প্রশ্ন করলে বেশ বিরক্তবোধ করে নওশাদ। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে বলে ফেলে,
“আপনার চরিত্রহী’ন মেয়েকে আমি আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারবো না, চাচা।”

নওশাদের কথায় উপস্থিত সকলে থমকে যায়। তূর্ণার কপালে কিঞ্চিত ভাঁজ পড়ে। ঠোঁট দুটো আপন শক্তিতে একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যায় তার। তৌসিফ সাহেব বেশ রেগে যান। নিজের মেয়ের সম্বন্ধে এমন অপবাদ কোন বাবাই বা সহ্য করতে পারে। তিনি রাগী গলায় নওশাদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
“নওশাদ, অনেকক্ষণ হলো তোমার বেয়া’দবি সহ্য করছি। কিন্তু আর না। তুমি আমার মেয়ের নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছো?”

নওশাদ নিজেও এবার রেগে যায়। নিজের কাধে থাকা ব্যাগ থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে তৌসিভ সাহেবের হাতে দিয়ে বলে,
“নিজেই দেখে নিন না।”

তৌসিফ সাহেব সবগুলো কাগজ দেখে থমকে যান। সেগুলো কাগজ না কয়েকটা ছবি। যে ছবিতে তূর্ণা একটা ছেলেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। আর সেই ছেলেটা আর কেউ নয় বরং উদয়।
তৌসিফ সাহেব ছবিগুলো তূর্ণার হাতে দেন। ছবিগুলো দেখে তূর্ণার চোখ কপালে। এই ছবিগুলো তুললো কে। যে কেউ দেখলে বিষয়টা খারাপ ভাবে নেয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আসল ঘটনা তো তা না। বিয়ের আগের দিন বিকেলে তূর্ণার মা নিলাশা বেগম তূর্ণাকে স্টোররুমে পাঠিয়েছিলেন কিছু জিনিস আনার জন্য। সেগুলো নিয়ে তূর্ণা ফেরার সময় একটা টিকটিকি দেখে বেশ ভয় পেয়ে যায়। কোথা থেকে যেন উদয় নামক মানুষটা সেই সময় তূর্ণার সামনে উদয় হয়। তূর্ণা কিছু না বুঝেই ভয়ে উদয়কে জড়িয়ে ধরেছিল।

তূর্ণা কিছু বলতে নিতেই ডান গালে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে তূর্ণা ছলছল চোখে নিজের বাবার দিকে তাকায়। এই প্রথম তার বাবা তার গায়ে হাত তুললো। তৌসিফ সাহেব আবারো তূর্ণাকে আঘাত করতে নিবেন এমন সময় তাফসির সাহেব গিয়ে তাকে আটকালেন।

কঠিন গলায় তৌসিফ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলেন,
“এখন আর এভাবে গায়ে হাত তোলার মানে হয় না। আমাদেরই ভুল হয়েছে। জীবনটা ওদের। ওরা কার সাথে নিজেদের জীবন কাটাতে চায় তার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সম্পূর্ণ আছে ওদের। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তূর্ণা আর নওশাদের ডিভোর্স যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করিয়ে উদয়ের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা কর।”

তাফসির সাহেবের কথায় তৌসিফ সাহেব কিছুটা দমে গেলেন। আসলেই ভুল তো তাদের দ্বারা হয়েছেই। বিয়েতে দুই ছেলে-মেয়ের কারোই মতামত তারা নেন নি। দুই ভাই নিজেদের সম্পর্ক গভীর করতে গিয়ে ছেলে-মেয়েরা কী চায় তা তারা একবারো জানার প্রয়োজন মনে করেনি।

তৌসিভ সাহেব থমথমে গলায় উদয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,
“উদয়, আজই তোমার বাবা-মাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলো। যা কথা হওয়ার আজই হবে।”

তূর্ণা এতক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। তৌসিফ সাহেবের কথা শেষ হতেই সে থমকে যাওয়া দৃষ্টিতে তুষারের পাশে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা উদয়ের দিকে তাকায়। শ্যামবর্ণের মুখশ্রীতে কোনো চিন্তার ছাপ নেই। যেন এমনটা হবে সে আগে থেকেই জানতো।

উদয়ের বাবা-মা আধাঘণ্টার মধ্যেই তূর্ণাদের বাসায় এসে উপস্থিত হলেন। তৌসিফ সাহেব সমস্ত বিষয় তাদেরকে বিস্তারিত বললে তারা সঙ্গে সঙ্গেই তূর্ণা আর উদয়ের বিয়েতে মত দেন।

আর এই পুরো সময়টাতে তূর্ণা থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুতেই তার মাথায় আসছে না। আর এই ঘটনায় বাসার সবার মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ দৃশ্যমান হলেও স্বাভাবিক ছিল তিনজন। প্রথম জন উদয়। দ্বিতীয় জন তুষার আর তৃতীয় জন হলেন তূর্ণার মা নিলাশা বেগম।
____________

তূর্ণা নিজের ঘরে বিছানায় থম মেরে বসে আছে। মনে মনে পরিকল্পনা আঁকছে কীভাবে বিয়ে আটকানো যায়। কিন্তু কোনো উপায়ই সে বের করে উঠতে পারছে না। সে নিশ্চিত বাড়ির সবাই তার উপর ভীষণ ক্ষেপে আছে। কিছু বললেও কেউ এখন আর তার কথা শুনবে না। তার থেকে বড় কথা ওই ছবিগুলোই বা কোথা থেকে এলো। এসব চিন্তা করতে করতে ভীষণ বিরক্ত বোধ করে তূর্ণা। অকস্মাৎ তার চোখ যায় জানালার বাইরে। বৃষ্টি পড়ছে। প্রকৃতিতে বর্ষার আগমন ঘটেছে মাত্র কয়েক দিন। আর তারপর থেকেই সময়ে অসময়ে ধরিত্রীতে বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু তূর্ণার কাছে তা বৃষ্টি বলে মনে হয় না। মনে হয় সুদূর অন্তরীক্ষ হতে বিষাদেরা দল বেঁধে ধরণীতে হানা দিয়েছে।

কয়েকমাস পর-

তূর্ণা আর নওশাদের ডিভোর্স কার্যকর হয়েছে এই সপ্তাহ খানেক হলো। এর মধ্যেই তাদের বাড়িতে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে তূর্ণা আর উদয়ের বিয়ের। গায়ে হলুদ শাড়ি আর মুখে একগাদা হলুদ নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে তূর্ণা। তার দৃষ্টি আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। হালকা সাজ আর তারওপর অনেকখানি হলুদ রয়েছে তার গোলগাল মুখখানায়। একটু আগেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। হ্যাঁ, আজ তার গায়ে হলুদ ছিল। আর কাল তার বিয়ে। বিয়েটা উদয়ের সাথেই। তৌসিফ সাহেব মেয়ের বিয়েতে বেশি দেরি করতে চাননি। তাই ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরপরই বিয়ের ডেট ফেলেছেন।

তূর্ণা ধীর পায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে গাঢ় সবুজ রঙের একটা কামিজ পড়ে বেরিয়ে আসে। তার হলদে ফর্সা গায়ের রঙের সাথে সবুজ রঙটা বেশ মানিয়েছে। ওয়াশরুম থেকে ঘরে আসতে না আসতে কানে আসে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। তূর্ণা গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

দরজার সামনে নওশাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। এই কয়েক মাসে নওশাদের সাথে তার দেখা হয়েছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকবার। নওশাদ গত কয়েক মাস এই বাড়িতে থাকেনি। কই থেকেছে বাড়ির কেউ জানে না। কেউ জিজ্ঞেস করলেও তার সঠিক কোনো উত্তর মেলেনি নওশাদের থেকে।

নওশাদ তূর্ণার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসে। তূর্ণা নওশাদকে একবার ভালো করে দেখে নেয়। মানুষটা কেমন শুকিয়ে গেছে। আগের মতো চেহারায় উজ্জ্বলতা নেই। মনে হয় খুব দুর্বল সে।

নওশাদ স্বাভাবিক গলায় তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“আমি জানি তোর মনে অনেক প্রশ্ন আছে। এই প্রশ্নগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে দে। কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানলেও চলে। যা হচ্ছে হতে দে। এটাই তোর জন্য, সবার জন্য ভালো।”

নওশাদ তূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়েদিয়ে আবার বলে,
“তুই ভীষণ সুখী হবি দেখিস।”

কথাটুকু শেষ করে নওশাদ নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। তূর্ণা হতভম্বের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আনমনে বলে ওঠে, যা হচ্ছে তা তো আমি হতে দিতে চাইছি না, নওশাদ ভাই।

চলবে!