সেদিন বৃষ্টি হবে পর্ব-০৩

0
646

#সেদিন বৃষ্টি হবে
#পর্ব_০৩
#সামিয়া_মেহেরিন

পূব আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। নীল আকাশের বুকে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। হেমন্তের শেষভাগ। শীত চুপিচুপি নিজের রাজত্ব কায়েমের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে।

ঘড়িতে ৬টা বেজে ৩০মিনিট। তূর্ণা কাধে একটা ছোট ব্যাগ ঝুলিয়ে গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নেয়। সে তৈরি পালিয়ে যাওয়ার জন্য। যদিও পালিয়ে যাওয়ার সাহস তার কখনোই ছিল না। তবে ভাগ্য বোধহয় তার সহায় হয়েছে। আজ তার বিয়ে আর আজই তার ভার্সিটি থেকে দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্টদের পিকনিকে নিয়ে যাওয়া হবে। তূর্ণা দ্বিতীয় বর্ষেরই ছাত্রী। সে মনে মনে পরিকল্পনা করে নিয়েছে বাড়ি থেকে লুকিয়ে সোজা ভার্সিটি চলে যাবে। পিকনিকে দুইদিন কক্সবাজার থাকা যাবে।

নিজ পরিকল্পনা অনুসারে গুটি গুটি পায়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে তূর্ণা। দোতলা থেকে নিচতলায় নেমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তূর্ণা। এই পর্যন্ত যখন আসতে পেরেছে তাহলে সামনে আর কোনো সমস্যা হবে না।

নিচতলায় দাঁড়িয়ে বাড়ির বাইরে চোখ বুলাতে ব্যস্ত তূর্ণা। এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন কাউকে পেল না তখন বুকে হাত দিয়ে জোরে একটা শ্বাস ফেলে। অকস্মাৎ নিজের পেছনে কারো উপস্থিতি টের পায় সে। সাথে খুব পরিচিত একটা ঘ্রাণ। তূর্ণা যেই না পেছনে ঘুরতে নিবে তার মুখে রুমাল জাতীয় কিছু চেপে ধরে পেছনে থাকা ব্যক্তিটি। তূর্ণা হাত-পা কিছুক্ষণের জন্য ছড়াছড়ি করতে পারলেও মিনিট দুয়েকের মধ্যে নেতিয়ে পড়ে।

জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে তূর্ণা। তার গায়ের চাদর আর ব্যাগটা তার পাশে পড়ে রয়েছে। তূর্ণা উঠে বসে। তার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ বিদ্যমান। তখনকার ঘটনার কথাই মনে করার চেষ্টা করছে সে।

নিলাশা বেগম ঘরে এসে তূর্ণাকে থম মেরে বসে থাকতে দেখেন। তূর্ণার কাছে গিয়ে বলে ওঠেন,
“এতক্ষণে ঘুম ভাঙলো তোর। আমিতো ভাবলাম ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কবুল বলবি নাকি তুই।”

তূর্ণা আড়চোখে মায়ের দিকে তাকায়। সে বেশ ভালোই বুঝে গেছে এই বিয়ে থেকে তার নিস্তার নেই।

পার্লারের মেয়েরা এসে তূর্ণা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। তার গায়ে হালকা আকাশী রঙের একটা বেনারসি শাড়ি। লোকমুখে শুনলো শাড়িটা নাকি উদয় নিজেই পছন্দ করে পাঠিয়েছে। যদিও কথাটা তূর্ণা বিশ্বাস করেনি। তার পূর্ণ বিশ্বাস উদয়ের মতো রাশভারি মানুষের পছন্দ এতো সুন্দর হতেই পারে না। আর যদি হয়েও থাকে তবুও কোনোভাবেই সে কাউকে কিছু পছন্দ করে দেবে না।

অতঃপর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। যদিও তূর্ণার কাছে তা অনাকাঙিক্ষত। তূর্ণার কাজিনরা যখন তাকে ঘর থেকে নিয়ে এলো তখন সে খেয়াল করেছিল বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। এ শহরের আনাচে কানাচে বৃষ্টির পানিতে ভরে উঠছে। তূর্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

বাড়ির ড্রইংরুমে সোফায় তূর্ণা আর উদয়কে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। তূর্ণা একপলক দেখেছিল উদয়ের মুখখানা। আজ উদয়ের চোখে-মুখে কেমন উজ্জ্বলতা দেখতে পেল বলে মনে হলো তূর্ণার। বিয়ের জন্যই কি এই উজ্জ্বলতা? নাকি তূর্ণার চোখের ভুল? ভাবার ভুল?

বিয়ে পড়ানোর আগে নওশাদ একবার উদয় আর তূর্ণার কাছে এলো। মুখে বিস্তৃত হাসি নিয়ে দুজনের উদ্দেশ্যে বলে,
“অবশেষে এতবছরের অপেক্ষা পূর্ণতা পেতে চলেছে।”

তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে
“গত কয়েক দিন যা হয়েছে তা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা।”

নওশাদের কথা তূর্ণার মাথায় ঢুকলো না। কিছু করতে নিবে তার আগেই নওশাদ তাদের চক্ষুর আড়ালে চলে যায়।
____________

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের ভেজা চুলগুলো চিরুনি করছে তূর্ণা। পরনে খয়েরি রঙের একটা সুতি শাড়ি। তূর্ণা চুলগুলো চিরুনি করছে আর আয়নায় পুরো ঘরটাতে চোখ বুলাচ্ছে। ঘরটা উদয়ের। ঘণ্টাখানেক আগেই সে এই বাড়িতে এসেছে। তার আর উদয়ের বাড়ির মধ্যকার দূরত্ব দশ মিনিটের হেঁটে যেতে লাগে দশ মিনিট আর গাড়িতে পাঁচ মিনিটেরও কম।

এই বাড়িতে আসার পর তার শাশুড়ি মা তাকে বরণ করে ঘরে তুললেন। বাড়িতে খুব বেশি কেউ থাকে না। উদয়, উদয়ের মা আর বাবা আর এখন নতুন যোগ হয়েছে তূর্ণা। বিয়ে উপলক্ষে গুটিকয়েক আত্মীয় এসেছে উদয়দের বাড়িতে।

কিছুক্ষণ আগেই তূর্ণাকে উদয়ের ঘরে রেখে সবাই বেরিয়ে গেছে। উদয়ের জন্য তূর্ণাকে বেশিক্ষণ দেরি করতে হয়নি। তার মিনিট দুয়েক এর মাঝেই উদয় ঘরে এসে পড়েছিল। উদয় ঘরে এসে তূর্ণাকে এক পলক দেখে বারান্দায় চলে যায়। উদয়ের ঘরের সাথে ঝুলন্ত বারান্দা। বারান্দার উপরে ছাদ নেই।
বাইরে তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ছিল। বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়েই উদয় কেমন থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। দৃষ্টি স্থির ছিল। মেঘমিশ্রিত অন্তরীক্ষে।

সেই মুহূর্তে তূর্ণা কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। পরমুহূর্তেই ঠিক করলো আগে ফ্রেশ হয়ে আসবে। ভারি পোশাকে অস্বস্তি লাগছিল তার খুব। সে ফ্রেশ হয়ে এসে উদয়কে ঘরের ভেতর পেল। তূর্ণা বের হলে বিনাবাক্য ব্যয়ে উদয় ফ্রেশ হতে চলে যায়।

বাথরুমের দরজায় খট করে শব্দের আওয়াজ কানে যেতেই ঘোর ভাঙে তূর্ণার। উদয় তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বারান্দার দিকে চলে যায়।

চিরুনিটা ড্রেসিংটেবিলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ায় তূর্ণা। অকস্মাৎ উদয় তার পিছনে এসে দাঁড়ায়। তার হাতের মুঠোয় অতি সন্তর্পণে রাখা স্বর্ণের চিকন চেইনটা নিজ হাতে পড়িয়ে দেয় তূর্ণার গলায়। তূর্ণা হতভম্ব। এমন কিছু সে আশা করেনি।

উদয় তূর্ণাকে চেইনটা পড়িয়ে দিয়েই সরে যায়। বিছানায় গিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। বাইরে বৃষ্টির বেগ তখন বেরেছে। ভূমিতে বৃষ্টি পতনের টুপ টাপ আওয়াজ কানে আসে তূর্ণার। ঘর আর বারান্দার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারি থাইগ্লাসের সামনে এসে দাঁড়ায় তূর্ণা। তার দৃষ্টি সুদূর অন্তরীক্ষে। সেদিনও এমনি বৃষ্টি ছিল, যেদিন উদয়ের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ পেয়েছিল।

তখন তূর্ণা সবে কলেজের উঠেছে। তার কলেজ ড্রেস ছিল সম্পূর্ণ সাদা রঙের। সেদিন ছাতা নেয়ার কথা একদম মনে ছিল না তূর্ণার। আর সেদিনই কলেজ ছুটির সময় তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল। তূর্ণা কলেজের ভিতর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে ছিল বৃষ্টি কমার। কিন্তু বৃষ্টি থামার কোনো নাম-গন্ধ নেই। ততক্ষণে কলেজ পুরো ফাঁকা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে তূর্ণার। কোনো উপায় না পেয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল তূর্ণা। এতটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু অঘটন ঘটলো বাড়ি এসে। সেদিনই উদয় এসেছিল তাদের বাসায়।

সম্পূর্ণ শুভ্র রঙের জামা পড়ে থাকায় তূর্ণার শরীরের কিছু অংশের ভাঁজ স্পষ্ট দৃশ্যমান ছিল। আর তাই নিয়ে সেদিন উদয় তাকে বেশ অপমান করেছিল। উদয়ের কথা ছিল একটাই। তূর্ণা মেয়ে হয়েও কেন নিজের সম্মানের সুরক্ষা নিজে করতে ব্যর্থ হলো। কেন সে এভাবে ভিজে নিজেকে প্রদর্শন করেছে। কিন্তু মানুষটা সেদিন তূর্ণার অসহায়ত্ব বোঝার সামান্য চেষ্টা করেনি। একা একা কলেজে দাঁড়িয়ে থাকতে যে তার ভীষণ ভয় লাগছিল সেদিন। উদয়ের করা অপমানে সেদিন সে ভীষণ কেঁদেছিল। যদিও তার কান্নার সাক্ষী সে নিজে বাদে কেউ ছিল না।

সেদিনের কথা মনে করে তূর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়। ঘুম পাচ্ছে তার ভীষণ। কিন্তু উদয়ের সাথে একই বিছানায় শুতে বেশ অস্বস্তিকর লাগছে তার। নিজের গলা আস্তে করে ঝেড়ে নিয়ে নিচু গলায় বলে,
“শুনছেন?”

উদয়ের কোনো হেলদোল নেই। যদিও সে এখনো ঘুমিয়ে যায়নি। বোধহয় তূর্ণার মিষ্টি ডাকটা আরো শুনতে চাইছে। তাই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

তূর্ণা আবারো মিহি গলায় ডাকে।
“উদয়?”

উদয় এবার চোখ খুলে। কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই বলে ওঠে,
“আমার ঘরে একটাই খাট। কোনো সোফা নেই। আর থাকলেও আমি সোফায় শুতাম না। তোমার ঘুমাতে হলে ঘাটে ঘুমাও নয়তো এই যে দেখছো সুন্দর মেঝে আছে। সেখানে ঘুমাও।”

কথাটুকু বলেই উদয় উল্টোপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। আর তূর্ণা ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে উদয়ের পাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ে।

তৌসিফ সাহেব মলিন মুখে বিছানার কোণায় বসে আছেন। এই প্রথম তার মেয়ে তার থেকে এতো দূরে গেল তাও আবার সম্পূর্ণ একা। নিলাশা বেগম তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে আসে।

“এভাবে বসে আছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”

তৌসিফ সাহেব মলিন গলায় বলেন,
” শরীর খারাপ কেন হবে?”

নিলাশা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন,
“তাহলে কি মন খারাপ? মেয়ের জন্য?”

তৌসিফ সাহেব জবাব দেন না। মৌনতা যে সম্মতির লক্ষণ। নিলাশা বেগম মৃদু হাসেন। নরম গলায় বলেন,
“মেয়েদের একদিন না একদিন বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যেতেই হয়। আমাদের মেয়ের ক্ষেত্রেও তাই। চিন্তা কর না। আমাদের মেয়েকে উদয় ভালো রাখবে।”

তৌসিফ সাহেব মলিন গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন,
“এতটা বিশ্বাস তোমার উদয়ের ওপর?”

নিলাশা বেগম নিঃশব্দে হাসেন। বলেন,
“উদয়ের হাতে নিজের মেয়েকে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত।”

তৌসিফ সাহেব হতাশার সুরে বলে ওঠেন
“মেয়েকে নিজের কাছে রাখবো বলে জোর করে দুই ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষে কি হলো!”

চলবে!