সেদিন বৃষ্টি হবে পর্ব-০৪

0
381

#সেদিন বৃষ্টি হবে
#পর্ব_০৪
#সামিয়া_মেহেরিন

মেঘহীন আকাশে সূর্য খাড়াভাবে তার কিরণ ছড়াতে ব্যাস্ত। তূর্ণা বাইরের পরিবেশ দেখে মিষ্টি হাসে। বৃষ্টি হওয়ার আজ কোনো সম্ভাবনা নেই।

তূর্ণা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। আজ সে হালকা গোলাপি রঙের একটা কামিজ পড়েছে। তার শাশুড়ি মা আজ সকালেই তাকে বলেছে সে যে পোশাকে অভ্যস্ত সেই পোশাকই যেন পড়ে। তূর্ণা শাড়ি পরতে পারে ঠিকই কিন্তু সামলাতে পারে না। তাই শাশুড়ি মায়ের অনুমতি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই শাড়ি বদলে নিয়েছে।

আজ তূর্ণা একটু বেশিই খুশি। তার কারণ আজ সে আর উদয় তূর্ণাদের বাসায় যাবে। তূর্ণা তৈরি হয়ে অপেক্ষায় আছে উদয়ের।

তূর্ণার অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে উদয় গোসল করা শেষ করে ঘরে আসে। ছেলে মানুষেরও যে গোসল করতে এতো সময় লাগে উদয়কে না দেখলে জানতো না তূর্ণা।
_____________

তূর্ণাকে নিয়ে উদয় তূর্ণার বাড়ি এসেছে। তূর্ণার পুরোদিন কেটে যায় মা-বাবার সাথে গল্প করা আর তুষারকে জ্বালাতন করার মধ্যে দিয়ে। এই দীর্ঘ সময়ে একবার উদয়ের খোঁজটা পর্যন্ত নেয়নি সে।

রাতের খাবার টেবিলে সাজিয়ে নিলাশা বেগম তূর্ণাকে বলে উদয়কে ডেকে আনতে। এতক্ষণে মানুষটার কথা মাথায় আসে তার।

ঘরে এসে দেখে উদয় তার পড়ার টেবিলে রাখা গল্প আর উপন্যাসের বই গুলো খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখছে। তূর্ণার উপস্থিতি টের পেয়েও তার দিকে তাকায় না উদয়। বইগুলোর দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে
“বিয়ে হয়েছে মানে এই না যে পড়ালেখা চাঁদের দেশে পাঠাতে হবে। তোমার ভার্সিটির বইখাতাগুলো ভালো করে প্যাক করে নিও। যাওয়ার সময় ওগুলো সাথে নিয়ে যাবো।”
_____________

দেখতে দেখতে দুটো দিন কিটে গেল। এই দুই দিনে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি তূর্ণার জীবনে। বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি ফিরে এসেছে। শাশুড়ি মায়ের সাথে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। শ্বশুরমশাইও তাকে খুব স্নেহ করে।

গোমড়া মুখ করে উদয়দের বাড়ির গেরেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তূর্ণা। মনে মনে উদয়ের বংশ উদ্ধার করা হয়ে গেছে।
আজ উদয় নিজে তাকে ভার্সিটি নিয়ে যাচ্ছে। বিয়ের তিনদিনের মাথায় কে বইখাতা কাধে নিয়ে ভার্সিটি যায় ভেবে কুল পাচ্ছে না সে। ভেবেছিল বিয়ে হয়েছে পড়ালেখার জামেলা থেকে মুক্তি হবে। কিন্তু তা আর হলো কই? উদয়ের এক কথা পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে।

গটগট করে পা ফেলে গাড়ির কাছে গিয়ে উদয়ের পাশের সিটে বসলো তূর্ণা। তূর্ণা গাড়িতে উঠতেই উদয় ইশারায় তাকে সিটবেল্ট লাগিয়ে নিতে বললো।

গাড়ি চলতে শুরু করে আপন গতিতে। গাড়ির গতি যত বাড়তে থাকে তূর্ণার অস্থিরতা তত বাড়তে থাকে। অতীতের কিছু আবছা স্মৃতি তার দৃষ্টিপটে ভেসে উঠছে বারবার। তূর্ণা ছটফটানি চোখ এড়ায়নি উদয়ের। কিন্তু তার এই অস্থিরতার কারণ সে বের করতে পারলো না।

গাড়ি এসে ভার্সিটির সামনে থামতে না থামতে তূর্ণা হড়বড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। উদয় নিজেও গাড়ি থেকে নেমে আসে। উদয় এসে তূর্ণার সামনে দাঁড়ানোর আগেই তূর্ণা নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়।

উদয় তূর্ণার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিবে তার আগেই এক মেয়েলি কণ্ঠস্বর কানে আসে।

“আরে উদয় ভাইয়া আপনি!”

একটা মেয়ে এসে তাদের দুজনের সামনে দাঁড়ায়। তূর্ণা তাকে চেনে। মেয়েটা তাদের সাথে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তবে তাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা।

মেয়েটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,
“বুঝেছি, বুঝেছি। বউকে ভার্সিটি দিতে এসেছো।”

তূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“তাহলে এটাই আমার ভাবি তাইতো?”

উদয় মৃদু হাসে। মাথা দুলিয়ে বোঝায় হ্যাঁ।
মেয়েটা তূর্ণার কাছে এসে বলে,
“বলতে হবে উদয় ভাইয়ার পছন্দ বেশ। যাই হোক, আমার পরিচয়টাইতো দেয়া হলো না। আমি নওরিন। উদয় ভাইয়ার বাবা আর আমার বাবা দুজন খুব ভালো বন্ধু। তাই আমি আর উদয়ও তেমনি ভালো বন্ধু।”

নওরিন মেয়েটা উদয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তূর্ণাকে সাথে করে ভার্সিটি ক্যাম্পাসের ভেতর চলে যায়।

নিজের ঘরের বিছানায় চুপচাপ বসে আছে নওশাদ। তার চোখে মুখে রাগের আভাস। তার সামনেই তার মা দাঁড়িয়ে আছে হাতে একটা মেয়ের ছবি নিয়ে।

“নওশাদ, বিয়ের কথা উঠলেই তুই এমন ব্যবহার শুরু করিস কেন বলতো।”

নওশাদ বিরক্তি নিয়ে তাকায় নিজের মায়ের দিকে। কিন্তু তার মা দমে যাওয়ার পাত্রী নন। রাগমিশ্রিত গলায় নওশাদের উদ্দেশ্যে বলেন,
“তূর্ণার নাহয় চরিত্রের ঠিক ছিল না। তাই ছেড়ে দিয়েছিস ওকে। কিন্তু এখন তো আবার বিয়ে করে নিজের জীবঁ গুছিয়ে নিতে পারিস। একটা মেয়ের ছবি এনেছি দেখ। আমার আর তোর বাবার তো পছন্দ হয়েছে। এখন তুই শুধু হ্যাঁ বলে দে।”

নওশাদের রাগ এবার বাঁধ ভেঙে যায়। তিরিক্ষি মেজাজে বলে ওঠে,
“প্রথমত তূর্ণা চরিত্রহীনা নয়। আর দ্বিতীয়ত আমি বিয়ে করব না। ইভেন কখনোই ঈরব না।”

নওশাদের কথায় তার মা কিছুটা অবাক হন। অবাক হওয়ার স্বরে বলে ওঠেন,
“চরিত্রহীনা না হলে তুই ওকে ছেড়ে দিলি কেন? আর ওই ছবিগুলোই বা কেন?”

নওশাদ রাগ মিশ্রিত গলায় জবাব দেয়।
“তূর্ণাকে আমি আজীবন আমার বোনের চোখে দেখে এসেছি। আর ওই ছবিগুলো শুধু ছুঁতো ছিল বিয়ে ভাঙার।”

নওশাদের মা যথাসম্ভব নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ছেলেকে বলেন,
“মানলাম তূর্ণা চরিত্রহীনা না আর তুই তকে বোনের নজরে দেখিস। কিন্তু তুই কেন বিয়েতে রাজি হচ্ছিস না?”

এই কেন প্রশ্নের উত্তর নওশাদ দিতে পারে না। এই প্রশ্নের উত্তর তার পরিবার হয়তো সহ্য করতে পারবে না।
_____________

সূর্য খাড়া মাথার উপর দাঁড়িয়ে অকপটে উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে ধরণীতে। মেঘমুক্ত আকাশ থেকে সূর্যের আলোক রোশনিতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় তূর্ণার। সবে ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে। তার সাথে নওরিন মেয়েটাও আছে। একদিনেই খুব ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে মেয়েটার সাথে তূর্ণার।

ভার্সিটি থেকে বেরিয়েই চোখ পড়ে গাড়ির সাদে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উদয়ের দিকে। তূর্ণা বেশ বুঝেছে তার জন্যই উদয় অপেক্ষা করছে। নওরিন তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজ গন্তব্যে হাঁটা ধরে। তূর্ণা এগিয়ে যায় উদয়ের দিকে।

তূর্ণাকে আসতে দেখে উদয় গাড়ির গেট খুলে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। তূর্ণা পিলপিল পায়ে হেঁটে তার জন্য নির্ধারিত সিটে বসে। উদয় গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সাথে সাথে আগের মতোই অস্থিরতা শুরু হয়ে যায় তূর্ণার। যা উদয়ের চোখের আড়াল হয় না। কিন্তু কেন এই অস্থিরতা?

উদয় নিজের দৃষ্টি সামনের দিকে রেখেই তূর্ণাকে ডাকে।
“তূর্ণা।”

তূর্ণা কিছুটা চমকে যায়। কোনো রকমে সাড়া দেয়।উদয় তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে
“পিছনের সিটে একটা ব্যাগ আছে দেখো।”

তূর্ণা পিছনে তাকায়। ব্যাগ আছে একটা সেখানে। সে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিজের কাছে আনে। উদয় একপলক তার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে সামনে স্থির করে। স্বাভাবিক গলায় বলে
“ভেতরে ফুচকা আছে।”

তূর্ণা অস্থিরতায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে। উদয় তার অস্থিরতার কারণ বুঝে উঠতে পারে না। এমনি সময় তো মেয়েটা স্বাভাবিকই থাকে। গাড়িতে উঠলেই কেমন যেন অস্বাভাবিকভিবে অস্থির হয়ে ওঠে।
উদয় আবারো ডাকে তাকে।
“তূর্ণা।”

তূর্ণা ছোট করে জবাব দেয়।
“হুম”

“ভেতরে ফুচকা আছে। নরম হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না।”

“হু হুম, খাচ্ছি।”

গাড়ি এসে থামে উদয়দের বাড়ির সামনে। তূর্ণা গাড়ি থেকে নেমে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। উদয়কে গাড়ি থেকে নামতে না দেখে তূর্ণা নিচু হয়ে গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“আপনি নামবেন না।”

“নাহ, অফিসে যাবো আবার।”

তূর্ণা বাড়ির ভেতরে চলে আসে। উদয় গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিজ গন্তব্যে যেতে থাকে।
তূর্ণা সিঁড়ি বেয়ে উঠছে আর আজকে দিনটার কথা বারবার ভাবছে। আজ হঠাৎ করেই সেই বর্ষণের অভিশপ্ত রাতটা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এমনটা হয় বলেই গাড়িতে উঠতে চায় না সে। উঠলেও গাড়ির সামনের সিটে কখনোই বসে না।

ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। কোমর অবধি লম্বা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে বারান্দায় যায় তোয়ালে শুকাতে দিতে। এমন সময় তার ডাক পড়ে। তার শাশুড়ি মা ডাকছে তাকে। তূর্ণা ঝটপট তার কাছে যায়।

ঊর্মিলা বেগম তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলেন
“আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, তূর্ণা। বাসায় তুমি আমি ছাড়া এখন আর কেউ নেই। একা থাকতে কোনো অসুবিধে হবে তোমার মা?”

তূর্ণা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে জবাব দেয়।
“না, মা। কোনো সমস্যা হবে না। আমি একা থাকতে পারব।”

ঊর্মিলা বেগম বেরিয়ে গেলে তূর্ণা দরজা লাগিয়ে ঘরে চলে আসে। সে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে প্রতিদিনই তার শাশুড়ি মা এই সময়টায় বাড়ির বাইরে যায়। ঘণ্টাখানেক পর আবার ফিরেও আসে। যাওয়ার আগে তূর্ণাকে বলে যায় ঠিকই কিন্তু কই যায় তা কখনো বলে না।

ঘরে এসে কিছুক্ষণ বই-খাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করে তূর্ণা। মন বসছে না কিছুতেই শরীরটাও ভালো লাগছে না। মাথা ঝিম ধরে আছে। এমন সময় চোখ যায় জানালার বাইরে। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির সাথে শীতের প্রকোপও বেড়ে চলেছে।

তূর্ণা কোনো রকমে পড়ারটেবিল থেকে উঠে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। শরীরটা অস্বাভাবিকভাবে গরম হয়ে আসছে তার।

চলবে!