সেদিন বৃষ্টি হবে পর্ব-০৭

0
317

#সেদিন বৃষ্টি হবে
#পর্ব_০৭
#সামিয়া_মেহেরিন

প্রকৃতিতে তখন ঋতুরাজ বসন্তের রাজত্ব। শীতে যে গাছগুলোর পাতা ঝরে বিষন্ন রূপ ধারণ করেছিল, সেগুলোয় এখন নতুন পাতা গজানোর ধুম। সেদিকে তাকালেই সজীবতার ছোঁয়ায় চোখ পুলকিত হয়ে ওঠে।

আজ শুক্রবার। তূর্ণার ভার্সিটি নেই। তবে উদয়ের অফিসে কাজ আছে তাই যেতে হবে তাকে। সকালের খাবারগুলো সব গুছিয়ে রেখে তূর্ণা ঘরে আসে। উদয় তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট পরছে। ঘরে ঢুকেই তূর্ণার চোখ যায় বিছানায় ফেলে রাখা ভেজা তোয়ালেটার দিকে। ইদানিং পরিপাটি মানুষটাও কেমন অগোছালো হয়ে গেছে। আত্মনির্ভর মানুষটাও এখন ছোট খাটো কাজে তূর্ণার ওপর নির্ভরশীল।

তূর্ণা বিছানা থেকে তোয়ালেটা নিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে উদয়ের দিকে তাকায়।

“ভেজা তোয়ালে বিছানায় ফেলে রাখেন কেন বলুনতো? আগে তো এমন ছিলেন না। দিন দিন এতো অগোছালো হয়ে যাচ্ছেন কেন?”

উদয় হাতঘড়ি পরতে পরতে রসিকতার সুরে বলে,
” যাক এতোদিনে মনে হচ্ছে আমারও বউ আছে।”

তূর্ণা নাক ফুলিয়ে বারান্দায় চলে যায়। তোয়ালেটা সুন্দর মতো মেলে দেয়। চোখ যায় গতকাল ধুয়ে শুকাতে দেয়া উদয়ের শার্টগুলোর দিকে। শুকিয়ে গেছে সবগুলো। শার্টগুলো তুলে ঘরে নিয়ে আসে তূর্ণা। উদয় বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
“গেলাম আমি।”

তূর্ণা তার দিকে একপলক তাকিয়ে মাথা দুলায়। উদয় বেরিয়ে যায়।

তূর্ণা শার্টগুলো ভাঁজ করে আলমারিতে রাখতে নেয়। কিন্তু আলমারির জামাকাপড়ের অবস্থা খারাপ। সব অগোছালো করে রেখেছে লোকটা। তূর্ণা একে একে সব শার্ট বের করে গুছিয়ে রাখতে উদ্যত হয়।

সহসা তূর্ণা আলমারিতে একটা ডায়েরি পায়। ডায়েরিটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে নেয় সে। বেশ পুরোনো বলে মনে হয় তার। সম্পূর্ণ সবুজ মলাটে আবৃত একটা ডায়েরি। ডায়েরিটা কি কোনোভাবে উদয়ের? উদয়ের আলমারি থেকেই তো পাওয়া গেছে। তারই হওয়ার কথা।

কৌতূহলবশত ডায়েরিটা খুলে রেখে তূর্ণা। প্রথম পৃষ্ঠায় কালো কালির আঁচড়ে লেখা
“এক বৃষ্টিস্ন্যাত দ্বিপ্রহরে তোমায় প্রথম দেখেছিলাম, শুভ্রপরী।”

এতটুকুই লেখা। তৃর্ণার হৃদয়ে কেমন চিনচিনে ব্যথা হয়। কে এই শুভ্রপরী? উদয়ের খুব কাছের কেউ? হবেই হয়তো। নইলে এত সুন্দর একটা নাম অবশ্যই দিতো না।

তূর্ণা পৃষ্ঠা উল্টায়। পরের পৃষ্ঠায় লিখা,
“যেদিন প্রথমবার তোমায় দেখেছিলাম, সেদিন বৃষ্টি ছিল। আমি জানি আমাদের আবার দেখা হবে। আর সেদিন! সেদিন বৃষ্টি হবে।”

অকস্মাৎ বাসার কলিং বেলের আওয়াজে চমকে ওঠে তূর্ণা। হাত থেকে ডায়েরিটা পরে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে ডায়েরিটা আগের জায়গায় রেখে চলে যায় দরজা খুলতে।

দরজা খুলে দেখে উদয় দাঁড়িয়ে আছে। তূর্ণাকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
“অফিসের ফাইলটা ফেলে গিয়েছি।”

উদয় ফাইল নিয়ে চলে যায়। তূর্ণা দরজা লক করে আবার ঘরে চলে আসে। মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরছে ডায়েরিটা কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। পরের পৃষ্ঠা গুলো পড়তে হবে। যদি কিছু জানা যায়। তূর্ণা দ্রুত আলমারির কাছে যায়। ঠিক তখনই তার শাশুড়ি মায়ের ডাক পড়ে। তূর্ণা কপালে হাত দেয়। সে তো ভুলেই গিয়েছিল আজ তার শ্বশুরমাশাই একগাদা মাছ কিনে নিয়ে এসেছে। আর তার শাশুড়ি মা একাই সব মাছ কাটতে বসেছে। আগে গিয়ে তাকে সাহায্য করা উচিত।
_______________

রোজকার মতো আজকেও উদয় তূর্ণাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে অফিস চলে গেছে। ইদানিং তূর্ণার ভার্সিটি থাকাকালীন বেশিরভাগ সময় কাটে নওরিনের সাথে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। নওরিন আজ শুভ্র রঙের একটা কামিজ পড়ে এসেছে ভার্সিটিতে। যদিও সবসময় জিন্স আর টপস্ পরে আছে। তূর্ণা কয়েক মুহূর্ত অনিমেষ তাকিয়ে থাকে নওরিনের দিকে। শুভ্র রঙে বেশ সুন্দর লাগছে তাকে। কিন্তু তূর্ণার মাথায় চলছে হাজারো চিন্তা। আর বুকের ভিতর তোলপাড়। বারবার উদয়ের ডায়েরির সেই শুভ্রপরীর কথা মাথায় আসছে। আর চোখের সামনে ভেসে উঠছে শুভ্র রঙে রাঙা নওরিন।

তূর্ণা আর নওরিন, দুজনেরই আজ কোনো ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ক্যান্টিনে চলে আসে। ক্যান্টিনে তখন খুব বেশি কেউ নেই। দুজনে মুখোমুখি দুটো চেয়ার টেনে বসে পড়ে। নওরিন তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

“তূর্ণা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। সত্যি করে বলবে কিন্তু।”

বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে বসে থাকা তূর্ণা সচকিত দৃষ্টিতে নওরিনের দিকে তাকায়। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝায়। নওরিন একটু নড়েচড়ে বসে বলে,
“শুনেছি যারা অন্যের সামনে সবসময় নিজেকে হাসি-খুশি দেখায়, তারাই নাকি একাকিত্বে সব থেকে বেশি দুঃখি হয়। তুমিও তো সবসময় হাসিমুখে ঘুরে বেড়াও। তাহলে কি একাকিত্বে তুমিও কষ্ট পাও?”

তূর্ণা নিঃশব্দে হেসে জবাব দেয়।
“যবে থেকে উদয় নামক মানুষটার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছি, একাকিত্বের সংজ্ঞাটাই ভুলে গেছি।”

তূর্ণা কথা বুঝতে নওরিনের খানিক সময় লাগে। পরে বুঝতে পেরে ঠোঁটে প্রশস্ত হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে।

দুজনের মাঝে কিছুক্ষণ নিরবতা থাকে। নিরবতা ভেঙে তূর্ণা নওরিনের উদ্দেশ্যে বলে,
“এবার আমি একটা প্রশ্ন করি?”

নওরিন নিঃশব্দে হেসে বলে,
“হুম, করো।”

তূর্ণা কোনো রকম ভূমিকা পালন না করে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
“উদয়কে ভালোবাসো?”

নওরিন খানিক সময় হতভম্বের ন্যায় তূর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“আমাদের জানার আর বোঝার মাঝেও অনেক ভুল থাকে তূর্ণা। মুদ্রার যেমন এপিঠ-ওপিঠ দুই দিক, তেমনি আমরা যা জানি তার ওপর দিকেও কিছু সত্য থেকে যায় পর্দার আড়ালে।”

তূর্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রশ্নটা তার করা ঠিক হয়নি ভালোভাবেই বুঝেছে। কিন্তু তারই বা কি করার ছিল! ডায়েরির ওই দুই পাতা পড়ার পর থেকেই তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছে। গত কিছুদিন হলো কেন যেন মনে হয় নওরিনের উদয়ের প্রতি কোনো অনুভূতি আছে। আর আজ নওরিনচে সাদা পোশাকে দেখে নিজের মনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। হুট করেই প্রশ্নটা করে ফেলেছে।
______________

কফিশপে কপাল কুঁচকে বসে আছে তূর্ণা। তার দৃষ্টি সামনে বসে থাকা তার বান্ধবী আসমার লাজুক লাজুক মুখভঙ্গিতে। প্রায় আধ ঘণ্টা হলো এভাবেই বসে আছে তারা।

ভার্সিটি শেষে তূর্ণার ফোনে আসমার ফোন আসে। তারা দুজন আলাদা ভার্সিটিতে পড়ে। আজ হুট করে আসমা ফোন দিয়ে তূর্ণাকে দেখা করতে বলল। তূর্ণা মানা করেনি। অনেক দিন পর নিজের প্রিয় বান্ধবীর সাথে দেখা করবে ভেবে খুশিই হয়েছিল। তাই উদয়কে আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। তাকে আসতে বারণ করে দিয়েছে।

তূর্ণা এবার বিরক্ত হয়ে বললো,
“লজ্জা পাওয়া বাদ দিয়ে এবার অন্তত বল আমাকে কেন ডেকেছিস এখানে। গত আধ ঘণ্টা ধরে তোর এই লজ্জা পাওয়া দেখতে দেখতে আমি পঁচে গেছি ভাই।”

আসমা আবারো লাজুক ভঙ্গিতে তূর্ণার দিকে তাকায়। কিছু বলতে নিলেই তার ফর্সা গালে লালাভ রেখা ফুটে ওঠে। বলতে গিয়েও থেমে যায়।

তূর্ণা বিরক্ত হয়ে বলে,
“তুই এখানেই বসে লজ্জা পেতে থাক। আমি চললাম। আমার বাবা একটাই জামাই। আমি সময়মতো বাড়ি না ফিরলে টেনশনে অক্কা পাবে।”

তূর্ণা উঠতে নিলে আসমা তাকে আটকায়। লজ্জায় লাল হয়ে বলে,
“তূর্ণা, তুই বোধহয় খালামণি হতে চলেছিস।”

আসমার কথা বুঝতে তূর্ণার খানিকক্ষণ সময় লাগে। বুঝতে পেরে খুশিতে আসমাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। তার খুশি আর দেখে কে!

আসমা আমতা আমতা করে বলে,
“আসে ছাড়। আমি এখনো শিওর না।”

তূর্ণা আসমাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
“মানে? এখনো টেস্ট করাসনি?”

আসমা না বোধক মাথা নেড়ে জবাব দেয়,
“তোর দুলাভাইকে এখনো বলিনি। আজ টেস্ট করাবো। পজিটিভ হলে তবেই বলব। তুই একটু আমার সাথে হাসপাতালে যাবি প্লিজ?”

তূর্ণা সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যায়। অতঃপর দুজন চলে আসে হাসপাতালে।
যেই না আসমার সিরিয়াল নাম্বার এলো, অমনি তূর্ণার ফোনে কল এলো। কানাডা থেকে তার খালামণি ফোন করেছে। আসমা তাকে কলে কথা বলতে বলে একাই ডাক্তারের কেবিনে ঢুকলো। তূর্ণা ফোনে কথা বলতে বলতে হাসপাতালের অন্যদিকে চলে আসে। খালামণির সাথে দীর্ঘ দিন পর কথা হচ্ছে তার। তাই কথার পরিমাণটা একটু বেশি।

কথা শেষে কল কাটতেই তার চোখে পড়ে অনাকাঙিক্ষত এক মুখশ্রী। তাকে হাসপাতালে দেখবে এমন আশা করেনি তূর্ণা। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
“আপনি?”

উদয়ও কিছুটা হতভম্ব হয়েছে ঠিক, কিন্তু তা প্রকাশ করে না তূর্ণার সামনে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ছোট করে জবাব দেয় “হুম।”

তূর্ণা উদয়ের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
“আপনি হাসপাতালে কেন?”

উদয় বেশ স্বাভাবিকভাবেই জবাব দেয়।
“নওরিনের সাথে এসেছি?”

“কেন?”

তূর্ণার প্রশ্নে খানিকক্ষণ চুট থেকে উদয় জবাব দেয়।
“নওরিনের এবোর্শন করাতে।”

প্রশ্নের এমন উত্তর আশা করেনি তূর্ণা। কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। তাই ছোট করে বলে
“ওও।”

উদয় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
“বাচ্চার বাবা কে জিজ্ঞেস করবে না?”

তূর্ণার কাঠের পুতুলের মতো বলে,
“কে?”

“যদি বলি আমি?”

চলবে!