সেদিন বৃষ্টি হবে পর্ব-০৬

0
312

#সেদিন বৃষ্টি হবে
#পর্ব_০৬
#সামিয়া_মেহেরিন

ভার্সিটির সামনের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আছে তূর্ণা। ছুটি হয়েছে মাত্রই। সাথে আকশ চিরে নেমেছে ঝুম বৃষ্টি।
মিনিট দুয়েকের ভিতর উদয় বাইকে করে আছে। বাইকটা সাইড করে রেখে তূর্ণার কাছে গিয়ে ছাউনিতে দাঁড়ায়। রেইনকোট পড়া ছিল বিধায় সে ভিজে যায়নি।

এসেই তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে,
“সরি আজ দেরি হয়ে গেলো একটু।”

তূর্ণা তার দিকে তাকিয়ে পিটপিট করে বার কয়েক চোখের পলক ফেলে। কি এমন দেরি হয়েছে যে সরি বলতে হচ্ছে মানুষটাকে?

উদয় তূর্ণাকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে কই যেন চলে যায়। তীব্র বৃষ্টির কারণে সে কোথায় গেল তূর্ণা তা দেখতেও পারে না। তূর্ণা কাচুমাচু হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। শীত করছে ভীষণ।

কিছুক্ষণের মধ্যে একটা রিকশা এসে থাকে তূর্ণার সামনে। তাতেই বসে আছে উদয়। গায়ের রেইনকোটটা নেই। খুলে হাতে নিয়ে বসে আছে। ইশারায় তূর্ণাকে রিকশায় উঠতে বলে। তূর্ণাও বাধ্য মেয়ের মতো বসে যায়। উদয় পলিথিনে বড় অংশটুকু দিয়ে আবৃত করে দেয় তূর্ণার ক্ষীণ দেহখানা।

রিকশা চলতে শুরু করে। উদয় লম্বা হওয়ায় হুড তোলা রিকশায় তার মাথা সোজা রাখতে পারে না। তার মাথা তূর্ণার দিকে হেলে আছে। উদয়কে নিজের এতো কাছে পেয়ে বুকের বা পাশটায় যেন হাঁতুড়ি পেটা চলছে তূর্ণার।

মিনিট বিশেকের ভিতর তারা বাড়ি পৌঁছে যায়। পুরো সময়টায় দুজনের কেউ কোনো কথা বলেনি। তূর্ণা রিকশা থেকে নামে। উদয় নেমে পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে।

তূর্ণা উদয়ের অপেক্ষায় না থেকে চলে আসতে নিলে উদয় পিছু ডাকে। তূর্ণা পিছে ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। উদয় তা দেখে বলে ওঠে,
“তোমার চুলের শ্যাম্পু বদলিও।”

“হু?”
তূর্ণা উদয়ের কথা বুঝতে পারেনি। উদয় আবারো বলে,
“তোমার শ্যাম্পুর স্মেল আমার পছন্দ হয়নি। শ্যাম্পু বদলিও।”

তূর্ণা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কি বলে কি লোকটা! বান্ধবীদের কাছে কত শুনেছে হুড তোলা রিকশায় প্রেমিক বা স্বামীর দূরে বেড়ানোর গল্প। স্বামী বা প্রেমিকরা তখন কত রোমান্টিক কথাবার্তা বলে। আর এই মানুষটা! ইনি কিনা তূর্ণার শ্যাম্পুর ত্রুটি খুঁজতে ব্যস্ত!

তূর্ণা গাল ফুলিয়ে গটগট করে হেঁটে ভেতরে চলে আছে। তা দেখে উদয় নিজের ঠোঁট কামড়ে হাসে। মেয়েটা একটুতেই অভিমান করে বসে থাকে।

সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। পশ্চিমাকাশে রক্তিম বর্ণে ধারণ করে সূর্য তার বিদায়ের ঘোষণা দিয়ে চলেছে। তূর্ণা বারান্দায় দাঁড়িয়ে টবে লাগানো গাছগুলো দেখছে। বেশিরভাগ গাছের পাতা ঝরে গেছে। শীতকালে এমন হবেই। আবার শীতের শেষে নতুন পাতা গজাবে গাছের ডালে ডালে। পৃথিবীতে কোনো কিছুর শুরু যেমন হয় একদিন শেষ হওয়ার জন্য, তেমনি কোনো কিছু শেষ হয় নতুন কিছুর শুরুর তাগিদে।

বাইকের হর্নের আওয়াজ কানে আসে তূর্ণার। নিচে তাকিয়ে দেখে উদয় এসেছে। ঘণ্টাখানেক আগে বৃষ্টি থামার পর বেরিয়েছিল বাইক ভেরত আনতে।
অকস্মাৎ তূর্ণা তার গায়ে শীতল কিছু অনুভব করল। আবারো বৃষ্টি এসেছে। তপ্তশ্বাস ফেলে ঘরে চলে আসে সে। ঘরে সে বারান্দার দরজা আর ঘরে জানালা বন্ধ করে দেয়। পর্দাগুলোয় সুন্দর মতো টেনে দেয়।

“এতো বৃষ্টি বিদ্বেষী কেন তুমি বলোতো।”

পুরুষালি কণ্ঠস্বরে কিঞ্চিত চমকায় তূর্ণা। তবে কণ্ঠস্বর চিনতে অসুবিধা হয় না।

উদয়ের প্রশ্নটির জবাব কি দেবে বুঝে উঠতে পারে না। উদয় তার জবাবের অপেক্ষাও করে না। হাতঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে বাথরুমে চলে যায়। তূর্ণা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
_______________

আজ শুক্রবার। ভার্সিটি নেই। সকাল সকাল উঠে রান্নাঘরে শাশুড়ি মাকে সাহায্য করতে চলে যায় তূর্ণা। রান্না শেষ করে সকলে একসাথে সকালের খাবার খেয়ে তবে ঘরে আসে তূর্ণা।

ঘরে এসেই চোখ যায় বিছানায় থাকা সাদা আর গোলাপির মিশ্রণের কাতান শাড়িটার দিকে। তূর্ণা শাড়িটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে। বেশ সুন্দর শাড়িটা। সহসা বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ আসে। তূর্ণা সেদিকে ফিরে তাকায়। উদয় বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। পরনে ধূসর রঙের একটা পাঞ্জাবি। তূর্ণার উদ্দেশ্যে বলে,
“শাড়িটা পড়ে নাও। বেরোবো আমরা।”

তূর্ণার মনে অনেক প্রশ্ন জাগলেও মুখে কিছু না। উদয় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাতঘড়ি পড়তে উদ্যত হয়। তূর্ণা শাড়িটা হাতে নিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে ইতস্তত হয়ে বলে,
“আপনি একটু ঘরের বাইরে যান।”

উদয় কিঞ্চিত কপাল কুঞ্চিত করে তার দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তূর্ণাকে পরখ করে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বোধহয় বুঝতে পেরেছে তূর্ণা শাড়ি পরবে বলে তাকে বের হতে বলেছে।

শাড়িটা পড়ে চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক পড়ে নেয় তূর্ণা। ব্যাস্, তার সাজা শেষ। তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

উদয় তূর্ণাকে নিয়ে একটা রিকশায় চড়ে বসে। তূর্ণা ঠিকঠাক ভাবে রিকশায় বসেছে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে রিকশাওয়ালা মামা রিকশা চালাতে বলে।

আজ দ্বিতীয়বারের মতো তূর্ণা উদয়ের এতো কাছে। আগের বারের সময়টাতে তো ইতস্ততবোধ আর লজ্জায় সময়টা উপভোগই করা হয়নি তূর্ণার। তবে এবার মনে মনে তূর্ণা আগে থেকেই প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে শুধু শুধু আড়ষ্ট হয়ে থেকে সময়টা নষ্ট করবে না। বরং উদয়ের সান্নিধ্য উপভোজ করবে।

তূর্ণা নিজেই উদয়ের হাতে হাত রাখে। উদয় আগের ন্যায়ই থাকে। তূর্ণা যা করছে তাতে বাঁধাও দেয় না। এতে তূর্ণা এটাকে উদয়ের মৌনসম্মতি ধরে নেয়। নিজেদের মধ্যে দূরত্ব আরো ঘুচিয়ে দিয়ে উদয়ের কাঁধে মাথা রাখে সে।

রিকশা এসে থামে কাজি অফিসের সামনে। তূর্ণা কপাল কিঞ্চিত কুঞ্চিত করে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। উদয় রিকশা থেকে নেমে তাকে ইশারায় নামতে বলে। তূর্ণা তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।

“আমরা এখানে এসেছি কেন?”

উদয় ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলে,
“আবার বিয়ে করব বলে।”

তূর্ণা থতমথ খেয়ে যায়। অতঃপর উদয়ের অট্টহাসি তার কানে বারি খায়। তূর্ণা তাকে মুখ ভেংচি দিয়ে রিকশা থেকে নেমে আসে। উদয় তূর্ণার হাত ধরে ভেতরের দিকে হাঁটা দেয়।

এখানে উদয়ের এক বন্ধুর বিয়ে আজ। বিয়েতে ছেলেপক্ষের হয়ে সাক্ষী দিতে এনেছে উদয় তূর্ণাকে। নিজেও দিয়েছে। তূর্ণা প্রথমে ভেবেছিল উদয়ের বন্ধু হয়তো পালিয়ে বিয়ে করছে। তাই কাজী অফিসে বিয়ে করছে। কিন্তু না! আসলে উদয়ের সেই বন্ধু অনাথ। বাবা-মা বাদ থাক, কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই তার। উদয়কে বলেছিল বিয়ের সাক্ষী দিয়ে দিতে। কিন্তু সাক্ষী লাগে প্রত্যেক পক্ষে দুজনের। তাই উদয় তূর্ণাকে সাথে নিয়ে এসেছে। বিয়েতে কোনো রকম জাঁকজমক করবে না বলে বিয়েটা কাজি অফিসে হচ্ছে।

উদয়-তূর্ণার বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। সূর্যাস্তের পরপরই ফিরেছে দুজনে। আজ তূর্ণা ভীষণ খুশি। খুশি হবেই না কেন! প্রিয় মানুষটা সাথে থাকলে যেকোনো তুচ্ছ বিষয়ও প্রিয় হয়ে দাঁড়ায়। তূর্ণার স্মৃতির ভীড়ে আজকের দিনটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিয়ের কাজ শেষে উদয় তূর্ণাকে প্রথমে নিয়ে গিয়েছিল ফুচকা খাওয়াতে। উদয় আর ফুচকা দুটো জিনিসই তার প্রিয়র তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। ফুচকা খাওয়ার শেষে কাছেই একটা মেলায় নিয়ে গিয়েছিল তাকে। হরেক রকমের হরেক রঙের চুড়ি কিনে দিয়েছে উদয় তাকে। সেই চুড়ি গুলোই নাড়াচাড়া করতে করতে ঘরে ঢুকে তূর্ণা। তার পিছন পিছন উদয়ও। ঘরে এসেই কানে বাজে ঝুমঝুম শব্দ। বুঝতে বাকি থাকে না। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তূর্ণা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আর একটু দেরি হলেই এই অসময়ের বৃষ্টিতে তাদের দুজনকে ভিজতে হতো।

সহসা উদয় তূর্ণার হাত থেকে চুড়ির প্যাকেটটা নিয়ে বিছানায় রেখে তূর্ণার ডানহাতটা শক্ত করে ধরে টানতে টানতে বারান্দায় নিয়ে যায়। ঝুম বৃষ্টিতে পলকেই ভিজে চুপচুপ হয়ে যায় দুজনা। হঠাৎ হওয়া এই কাণ্ড বুঝে উঠতে সময় লাগে তূর্ণার। যতক্ষণে বুঝেছে ততক্ষণে উদয় তাকে পেছন থেকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। উদয়ের উষ্ণ আলিঙ্গনে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় তূর্ণার।

উদয় তূর্ণার কাঁধে নিজের থুতনি রাখে। চোখ বুজে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো অনুভব করতে লাগে। তূর্ণা বরফের মতো জমে যায়। এমন সময় এক অঘটন ঘটিয়ে বসে উদয়। তূর্ণার গলায় নিজের শীতল ঠোঁটের ছোঁয়া এঁকে দেয়। দিয়েই আবার আগে ন্যায় কাঁধে থুতনি রেখে চোখ বুজে। তূর্ণার শরীরে কাঁপন উঠে যায়। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায় উদয়ের হাতের বন্ধন হতে। তখনই কানে আসে শীতল কণ্ঠস্বর।

“ভয় নেই। তোমার অনুমতি ব্যতীত তোমাতে বিলীন হওয়ার দুঃসাহস আমি দেখাবো না।”

এই শীতল কণ্ঠস্বরে জমে যায় তূর্ণার পুরো শরীর। মনে মনে প্রার্থনা করে সময় যেন এখানেই থেমে যায়। প্রিয় মানুষটার আলতো আলিঙ্গনের এই সময়টুকু থেমে যাক অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য।

চলবে!