সেদিন মুষুলধারে বৃষ্টি ছিল পর্ব-০৬

0
706

#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–6
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

সেজুতি কানে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা ভোভো করছে। চারিপাশে অন্ধকার দেখছে সে। তার পা অসার হয়ে আসছে। সে আপ্রাণ চেষ্টায় আছে ছুটে বের হতে কিন্তু পারছে না। গা কাপুনি দিয়ে উঠছে তার । মাথা কাজ করছে না।

সে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। বড্ড পিপাসা পেয়েছে তার৷ এক গ্লাস পানি খেতে পারলে স্বস্তি পেত সে৷

সে পুনরায় ওই নাম্বারর কল দিতেই ফোন রিসিভ করল সেই ব্যক্তি ।

সেজুতি বলে উঠে, তোমার স্যার এখন কোথায়?

লোকটা একটা ঠিকানা দিলো। সেজুতি ফোন রেখে বের হলো। মুহিবের বাসায় দুইটা গাড়ি আছে। ড্রাইভার নিচেই থাকে।

সে নিচে এসে ড্রাইভারকে ডাক দিলো। মিনিট পাঁচেক পর রওনা দিলো। এর আগে কোন দিন এতো রাতে বাসা থেকে বের হয় নি। সত্যি বিয়ের পর মেয়েরা বড় হয়ে যায় এই কথা ভুল নয়!

বিয়ের আগে মেয়েরা যতো-বড়ই হোক কেন সে ছোট থাকবে আর বিয়ের হয়ে গেলে কমবয়সী হলেও বয়সে বড় হয়ে যায়। কেমন অদ্ভুত নিয়ম!

সেজুতি দম ফেলে স্বচ্ছ কাচের দিকে তাকিয়ে ফুপিয়ে কাদছে৷ মুহিবের ম্যানেজার বা এসিস্ট্যান্ট কেউ একজন কল করেছিলো।উনি ঠিকমতো নিজের পরিচয় দেয়নি। উনি জানালেন মুহিব নাকি ড্রিংক করেছে। এখন নিজের সেন্সে নেই। এইসব কথা শুনে তার হাত-পা কাপছে।তাদের বাসায় আজ পর্যন্ত কেউ মদ খাওয়া তো দূর মদের বোতল চোখে দেখেছে কিনা সন্দেহ। অথচ মুহিব নাকি মদ খেয়ে সেন্সলেস হয়ে আছে! সেজুতির ঘটনাটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে। বিয়ের পরের দিন কোন ভদ্র পরিবারের ছেলে এমন কাজ করতে পারে? বিয়ের পরের দিন কেন যেকোন দিনেই এসব বেহায়াপনা সহ্য সীমার বাইরে৷

সে বড় বড় করে শ্বাস ফেলছে।

ড্রাইভার কে ঠিকানা বলতেই সে এই জায়গা চিনে ফেলেছে তার মানে কি এখানে আগেও মুহিব আসত? আর ড্রিংক করত?

সেজুতি আতকে উঠে।

ঠিকানা অনুয়ায়ী তারা একটা বিল্ডিংয়ের সামনে এলো। ড্রাইভার বের হয়ে তার জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলে, ভাবী লিফটের চারে যাবেন৷

সেজুতি ভ্রু কুচকে বলে, আপনি কিভাবে জানলেন?।

ড্রাইভার উত্তর দিলো না। সে আর জোড়াজুড়ি করল না। ভেতরে ঢুকে যায়। বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকতেই তার গা ছমছমে করতে লাগে। চারিদিকে অন্ধকার। কেবল একটা চল্লিশ ওয়াটের হলুদ লাইট জ্বলছে। সেই হলদে নীলাভ আলোটাই পরিবেশটাকে কেমন যেন বানিয়ে ফেলেছে।

গ্যারেজের ভেতর থেকে সেজুতি বাইরে তাকালো। কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

আচমকা কেউ একজন তার দিকে এসে তাকে সালাম দিয়ে বলে উঠে, ভাবী লিফট কল করেছি। আসুন।

সেজুতি বড় বড় পা ফেলে লিফটের দিকে গেল।তার কাছে পরিবেশটা ভালো ঠেকছে না। লিফট বন্ধ হতেই তার মনে ভয় হতে লাগলো। আচ্ছা কেউ কি তার ক্ষতি করার জন্য এইখানে ডেকে এনেছে কৌশলে? দেখা গেল চারতলায় মুহিব নেই তার বদলে তিন-চার দীর্ঘদেহী পুরুষ,,,,,,

সেজুতির গলা শুকিয়ে এলো। সে লিফটের বাটন চাপতে লাগে। লাভ হলো না। লিফট দোতলা থেকে তিনতলা এবং চারতলায় এসে গেট খুলে গেল।

সেজুতি অবাক হয়ে গেল। নিচের পরিবেশ আর চারতলার পরিবেশে আকাশ-পাতাল ফারাক। চোখ ধাধানো লাইটিং। যার জন্য কিঞ্চিৎ চোখ কুচকে যায় সেজুতির। লিফট থেকে বের হয়ে সে চমকে উঠে। দিনাজপুরের মতো ছোট শহরে এতো চাকচিক্য বাসা! দেখে মনে হচ্ছে ঢাকার গুলশানের কোন ফ্লাটের সামনে দাড়িয়ে আছে সে৷ মেইন গেটের সামনে পেইন্টিং। আয়না, সু রেক,ফুলদানি৷ পাপসের উপরের মুহিবের সু ফেলে রাখা সঙ্গে দুইদিকে দুইটা কালো মুজা। মানে ভেতরে মুহিব আছে।

সেজুতি মনে সাহস সঞ্চার করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। মেইন গেট খোলাই ছিলো। ধাক্কা দিতে গেট খুলে যায়। সে ভেতরে প্রবেশ করল।

বাসার ভেতরে ঢুকে হতাশ হলো সেজুতি।বাহিরটা যতো সুন্দর ভেতরটা তার এক অংশ ও না। কেমন ঘুপচি। ঠাসা ঠাসা মালামাল। সোফায় কাটুন রাখা কয়েক গাদা। বোঝাই যাচ্ছে অফিসের কাজের জন্য এই বাসা ভাড়া নেওয়া।

সেজুতি মুহিব বলে ডাক দিলো। পাশের রুম মুহিবের কন্ঠে শব্দ এলো, কে?

তখনি ফোন বেজে উঠল। আগের আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে৷ সে রিসিভ করতেই লোকটা বলে, ম্যাডাম আপনি কি চারতলায় যেতে পেরেছেন?

সেজুতি ছোট্ট করে হু বলে ফোন কেটে পাশের রুমে যেতেই আতকে উঠে ।

মুহিব একটা অপরিষ্কার নোংরা বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছে। খালি গা। চুল গুলো এলোমেলো। হাতে হুইস্কির একটা বোতল।

সেজুতি তার সামনে গিয়ে দাড়াতেই মুহিব অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকালো। মনে হয় চিনতে পারছে না।

মুহিব হুইস্কিত বোতলে মুখ দিয়ে এক চুমুক খেয়ে নিয়ে বলে উঠে, কি? নতুন নাকি? এইসব ব্যবসায় নতুনত্ব মুখ দরকার! ভালো! ভালো!

সেজুতি মুহিবকে স্পর্শ করতেই মুহিব ছিটকে বিছানার অন্য প্রান্তে চলে গিয়ে হুংকার দিয়ে বলে উঠে, আমার থেকে দূরে থাক।
তোর সাহস কিভাবে হয় আমাকে স্পর্শ করার?

সেজুতি ভ্রু কুচকে হালকা গলায় বলে, মুহিব? এইসব কি? তোমার হয়েছেটা কি? এমন গোঙাচ্ছো কেন? আর তুই তুরাকি কেন করছো?

মুহিব ঝাঝালো কন্ঠে উত্তর দেয়, আমার নাম মুখে নিবি না। তোদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মালিক-চাকরের আর টাকার!

সেজুতি হতভম্ব হয়ে বলে, মুহিব? আমি তোমার স্ত্রী!

এরপর কাদো কাদো হয়ে বলে, তুমি ঠিক আছো?

মুহিব বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে দুই চুমুক হুইস্কি খেয়ে চোখ বুজলো।তার চোখের কোনে পানি। নড়াচড়া করছে না বললেই চলে৷

সেজুতি বিছানায় উঠে বসে মুহিবের কাছে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল। তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না। নির্বাক সে। চুপচাপ চোখের জলে গাল ভাসাচ্ছে৷

মুহিব বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘন নিশ্বাসের শব্দ পড়ছে। রাত বাড়তে লাগে। চারপাশ অতিমাত্রায় নিশ্চুপ।

সেজুতির কেমন অস্থির লাগছে৷ মনে হচ্ছে এই চার দেয়ালে কারা যেন বন্দী! কেউ বোধহয় সুখে নয়। কোথা হতে বন্দীনী নর্তকীর চাপা আর্তনাদ ভেসে আসছে যেন!

মুহিবের বলা কোন কথাই তার বোধগম্য হয়নি। মুহিব কি কষ্টে আছে? কিসের কষ্ট তার?

সে ফোনের স্ক্রিনে বারবার ঘড়ি দেখছে। রাত গভীর হতেই মুহিব নড়াচড়া শুরু করল।

সেজুতি জেগেই ছিলো৷ মুহিবকে অস্থিরতা করতে দেখে তার কাছে গেলেই বুঝতে পারল সে ঘুমের মধ্যে কাদছে৷

সেজুতি চমকে উঠে। মুহিব কাদছে? এই প্রথম সে কোন পুরুষ কে কাদতে দেখছে৷ একটা পুরুষ অনেক বেশী অসহায় না হয়ে পড়লে কাদে না!

মুহিব বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে, জুই আমাকে ক্ষমা করে দিও! তোমার সাথে যা করেছি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি।

সেজুতি মুহিবের অস্পষ্ট কথা বুঝতে পারলো না। কিন্তু জুই আর অন্যায় শব্দটা কানে গিয়ে ঠেকেছে।

হুটহাট মুহিব উঠে বসে চোখ খুলে মুখ ভর্তি করে বিছানা এবং গা ভাসিয়ে অদ্ভুত ভাবে সেজুতির দিকে তাকালো হয়তো বা বমি করার জন্য তার মদের বুদ নেশা কেটে যাচ্ছে৷চোখ লাল হয়ে আছে তার। মুহিবিকে দেখেই মায়া হতে লাগে তার৷ কি হয়েছে ওর? অফিসে কোন ঝামেলা হয়েছে কি?

সেজুতি চুপচাপ অসহায় ভরা চোখে মুহিবের দিকে তাকিয়ে আছে।

মুহিব করুণ গলায় বলে উঠে, সেজুতি তুমি? এখানে কিভাবে এলে?

— এখন কেমন লাগছে আপনার?( নরম সুরে

মুহিব উত্তর দিলো না৷ অবিশ্বাস্য চোখে খানিকক্ষন তাকিয়ে থেকে সেজুতি কে খুব শক্ত করে চেপে ধরে।

সেজুতি মূর্তির মতো বসে থাকে। মুহিব আরো শক্ত করে চেপে ধরে তাকে।

মুহিবের বমির গন্ধে গা এলিয়ে যায় তার। মুহিব তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠে, ভালোবাসি সেজুতি!

এরপর এলোপাতাড়ি ভাবে সেজুতির গালে।চুমু দিতে লাগে। সেজুতি সরে এসে বসল।

ভালোবাসি শব্দটা প্রতিটা মানুষের মনে আনন্দের অনুভূতি দোলা দেয়৷ কিন্তু সেজুতি আনন্দিত হতে পারলো না। ভালোবাসি বলা কথাটা এবং মুহিবের স্পর্শ কাটার মতো বিধতে লাগে সেজুতির মনে।

চলবে।