#সে_এবং_আমরা (৩)
*********************
সজল বলল, ‘প্লিজ তরী, একটু বুঝতে চেষ্টা করো। এত রাতে সে কোথায় যাবে?’
‘সে কোথায় যাবে, তার আমি কী জানি? আর সে কোথায় যাবে, কী করবে, সেটা নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা হচ্ছে কেন?’
‘আমার কোনোই মাথাব্যথা হচ্ছে না। অন্য যে কেউ যদি এমন বিপদে পড়ত, তাকেও আমি সাহায্য করতে চেষ্টা করতাম।’
‘অযথা এত কথা বোলো না৷ এত কথা বলে তুমি শুধু শুধু সময নষ্ট করছ। ঠিক আছে, বোনের বাসায় যখন সমস্যা, তখন অন্য কারও বাসায় থাকতে বলো। ঢাকায় কী তার পরিচিত আর কেউ নেই?’
‘আমি বলেছিলাম। লিমা বলল, ওর নাকি কেউ পরিচিত নাই।’
‘শোনো, আমার এমনিতে প্রচন্ড মাথা ধরেছে। এত কথা বলতে ভালো লাগছে না। আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। তুমি তাকে চলে যেতে বলো।’
সজল রুমের বাইরে না গিয়ে বিছানায় বসল।
‘কী হল, তুমি এখানে বসে পড়লে কেন? যাও, বলে আসো।’
সজল তাও নড়ল না।
‘তোমার কাছে এসে কেঁদে কেঁদে দুঃখের কথা বলল আর তুমি গলে গেলে? তার দুঃখ শুনে, তাকে রাতে নিজের বাড়িতে থাকতে দিতে রাজি হয়ে গেলে? তাকে আমি ডাইনিং রুমে ঢোকাতে চাইনি আর তুমি এখন তাকে আমার বেডরুমে ঢোকানোর ব্যবস্থা করছ?’
‘আমি রাজি হইনি।’
‘তুমি রাজি হওনি? সে তোমার গলা চেপে ধরে রাজি করিয়েছে?’
‘সে কিছুই করেনি।’
‘কিছুই করেনি? তাহলে আমরা কী নিয়ে ঝগড়া করছি?’
‘আমিই ওকে থাকতে বলেছি।’
আমার গলা দিয়ে অসম্ভব জোরে চিৎকার বের হল, ‘তুমি থাকতে বলেছ মানে?’
‘আস্তে তরী, আস্তে। এই সময়ে তোমার এত উত্তেজিত হওয়া ঠিক না।’
‘আমার সঙ্গে ফাজলামি হচ্ছে? আমাকে উত্তেজিত করার ব্যবস্থা করে এখন বলছ, উত্তেজিত হওয়া ঠিক না! তুমি যাও, এক্ষুনি গিয়ে বলো, সে যেন চলে যায়। কী হল যাও। রাত হয়ে যাচ্ছে।’
সজল রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এল।
‘কী হল, আবার আসলে কেন?’
‘তুমি গিয়ে বলে আসো।’
‘আমি বলব কেন? আমি তাকে থাকার দাওয়াত দিয়েছি?’
‘প্লিজ তরী, তুমি কিছু করো। আমি মুখ ফসকে তাকে থাকতে বলে ফেলেছি। এখন আমি যে কীভাবে না করব….’
‘যেভাবে থাকতে বলেছিলে, সেভাবেই থাকতে না করবে। যাও।’
সজল চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মায়া হল। সে নির্বিবাদী মানুষ। কারও সাথে-পাছে থাকে না। সে হয়ত সত্যিই কিছু না ভেবেই হুট করে কথাটা বলে ফেলেছে। তাকে যথেষ্ট বকাঝকা করা হয়েছে। বেচারাকে আর বকতে ইচ্ছা করছে না। ব্যবস্থা যা করার আমাকেই করতে হবে। সজলকে বললাম, ‘ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি। তুমি সবসময় ভেজাল লাগিয়ে আমার ঘাড়ে সমাধানের দায়িত্ব চাপিয়ে দাও।’
‘তরী প্লিজ, তুমি বেশি রাগারাগি না করে ভালোভাবে বুঝিয়ে বোলো।’
‘খুব মায়া হচ্ছে এক্সের জন্য?’
‘তরী!’
‘কী?’
‘আমার এক্স-ওয়াই-জেড কারও জন্য কোনও মায়া নেই। আমার পুরোটুকুই তুমি আর তুমি।’
‘এক্সের কথা জানতাম। ওয়াই-জেড এর কথা তো কখনও বলোনি?’
‘মজা নিচ্ছ আমার সঙ্গে?’
‘হুম মজা নিচ্ছি। যাই, তোমার এক্সকে বিদায় করে আসি।’
লিভিংরুমে এসে দেখি লিমা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। আমাকে দেখে বলল, ‘আমি আসলে একটা ঝামেলায় পড়ে…., মানে আমার ঐ বড়ো আপারা সবাই হঠাৎ ঢাকার বাইরে চলে গেছেন। ওনাদের বাসাটা লক করা। নইলে আমি ওখানেই থাকতাম।’
‘আপনার আপা কী আপনাকে বাসার বাইরে বের করে গেট লক করে দিয়ে গেছেন?’
‘না না। তা হবে কেন?’
‘তাহলে?’
‘আমি একটা কাজে টঙ্গী গিয়েছিলাম। আপাদের খুব তাড়া ছিল তাই আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেনি। আমি রাতের বাসে চলে যেতে পারতাম; কিন্তু আপার কাছে আমার কিছু জরুরি কাগজপত্র রয়ে গেছে। তাই যেতেও পারছি না।’
‘আপনি আমাকে এগুলো কেন বলছেন?’
‘আমি আসলে হোটেলের জন্যও ট্রাই করেছিলাম।’
‘আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার এখানে আপনাকে থাকতে দিতে পারছি না। সেটা সম্ভব না।’
লিমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, ‘এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে আমি যদি আপনার কাছে যেতাম, আপনি আমাকে থাকতে দিতেন?’
সে আমার কথার উত্তর না দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়েই আছে।
‘আপনি তো কয়েক বছর ঢাকায় থেকেছেন। এই শহরে কী আপনার একজনও পরিচিত মানুষ নেই? সব ছেড়ে, আপনি আমার বাসাটাই খুঁজে পেলেন!’
‘স্যরি। আমার আসলে ভুল হয়ে গেছে। এভাবে এখানে চলে আসাটা উচিত হয়নি।’
মনে মনে বললাম, উচিত হয়নি বলছ ঠিকই; কিন্তু যাচ্ছও তো না। এখানে থাকার আশায় তো বসেই আছ। মুখে বললাম, ‘আপনাকে থাকতে বলতে পারছি না দেখে আমি খুবই স্যরি। রাত হয়ে যাচ্ছে, আমার মনে হয় আপনার এখনই বের হওয়া উচিত। বেশি রাত হয়ে গেলে, পরে আবার গাড়িটাড়ি পাবেন না।’
কথাগুলো বলতে আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। আমি কখনোই কারও সঙ্গে এতটা রুক্ষভাবে কথা বলিনি; কিন্তু পরিস্থিতিটাই এমন, যে রুক্ষ না হয়ে আমার কোনও উপায় নেই। লিমা মনেহয় বুঝতে পারছে আমি রেগে যাচ্ছি, তাই সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসি। স্যরি, আপনাদের বিরক্ত করলাম।’
‘আবার আসবেন’ কথাটা মুখ দিয়ে বরে হয়ে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি মুখে লাগাম দিলাম। লিমা দু’কদম হেঁটেও আবার এসে সোফায় বসল। মাথায় হাত দিয়ে বলল,’মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। আমি দুই মিনিট বসে তারপর বের হচ্ছি।’
এ আবার কী নাটক, বাবা? সে কী যে কোনও মূল্যে এখানে রাত কাটানোর চেষ্টায় আছে নাকি? আমি ধৈর্য ধরে নাটকের বাকি অংশ দেখার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। বেশ খানিকটা সময় যাওয়ার পর সে বলল, ‘আরেক গ্লাস পানি দেওয়া যাবে?’
‘আনছি।’
পানি নিতে এসে দেখলাম, আমাদের বেডরুমের দরজা বন্ধ। তারমানে, এখানে কী ঘটছে, সজল উঁকিঝুঁকি মেরে সেটা দেখার চেষ্টা করেনি। আমি পানি নিয়ে এসে লিমার সামনে রাখলাম। গ্লাস তুলে নিয়ে দুই চুমুক পানি খেয়ে সে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল। মনে হচ্ছে সে একটু-আধটু হাঁপাচ্ছে। বললাম, ‘আপনার কী খারাপ লাগছে?’
‘একটু খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে।’
তার চোখ দু’টো টলটল করছে। তার চেহারা দেখে সত্যিই অসুস্থ মনে হচ্ছে। কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে দেখি জ্বরে কপাল পুড়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, ‘আপনার তো অনেক জ্বর। আপনি যেতে পারবেন তো?’
‘পারব।’
‘কোথায় যাবেন এখন? হোটেলে তো বললেন সিট পাবেন না।’
‘দেখি চেষ্টা করে। হোটেলে সিট না পেলে, স্টেশনে চলে যাব।’
‘কমলাপুর?’
‘হুম।’
‘ওখানে কী করবেন? রাতের ট্রেন আছে?’
‘রাতটা স্টেশনে কাটিয়ে দেবো। রাতে ট্রেন থাকলেও যাওয়া হবে না। ওখানে তো সারারাত মানুষ থাকে, সমস্যা হবে না। আপার বাসায় আমার কাগজপত্র আছে। ওগুলো নিয়ে কালকে চলে যাব।’
‘আসি।’
‘আপনার তো অনেক জ্বর। আপনি তো ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছেন না।’
‘সমস্যা নেই। ম্যানেজ করে নিতে পারব।’
‘আপনি একটু বসেন, আমি এখনই আসছি।’
ডাইনিং রুমে এসে চেয়ার টেনে বসলাম। কী করব বুঝতে পারছি না। আমি তাকে কেন অপেক্ষা করতে বললাম? সে তো চলে যাচ্ছিল, আমি সেধে কেন এত কথা বলতে গেলাম? ঝামেলা বিদায় হচ্ছিল, আমি আবার কেন তাকে আটকালাম? তার জ্বর নাকি অন্য কোনও ঝামেলা আছে, তাতে আমার কী যায়-আসে? থাকুক সারারাত স্টেশনে। আমার তাতে কী? সে যে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলছে না, সেটাই বা কে জানে? কথা নাই, বার্তা নাই, হুট করে বেলজ্জের মতো প্রাক্তনের বাসায় হাজির! যাই, ‘ঠিক আছে যান’ বলে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আসি।
উঠে দাঁড়িয়ে মনে হল, তার জ্বরটা তো আর অভিনয় না। জ্বরে তার টালমাটাল অবস্থা। এই অবস্থায় একটা মানুষকে কীভাবে বের করে দেবো? এতটা অমানবিক হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। সে তো আমার শত্রু না, অবশ্য মিত্রও না। সে সজলের স্ত্রী ছিল, এটাই তো তার অপরাধ? কী করব, বুঝতে পারছি না। হঠাৎ মনে হতেই মোবাইলটা হাতে নিলাম।
‘হ্যালো, আপা?’
‘হ্যাঁ, তরী বল। আমি এখনই তোকে ফোন করতাম। শোন, তুই বড়ো ইলিশ খেতে চেয়েছিলি, অনেক খুঁজে আজকে বড়ো ইলিশ পাওয়া গেছে। করিম ওদের বাড়ি থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছে।’
‘আপা শোন….’
‘আগে তুই শোন, তুই কালকে সকালেই চলে আসিস। কালকে ইলিশ পোলাও করব আর সর্ষে ইলিশও হবে।’
‘আসব। এখন তুই আমার কথা শোন।’
‘বল।’
‘দুলাভাই কোথায়?’
‘দুলাভাই কোথায় মানে কী? তোর দুলাভাই তো পরশুদিন ফিরবে। তুই ভুলে গেছিস?’
‘ওহ, আচ্ছা। শোন, আমার এখানে একটু ঝামেলা হয়েছে।’
‘কী হয়েছে, তরী? তুই ঠিক আছিস তো?’
‘তোর ড্রাইভার কোথায়? আছে না চলে গেছে?’
‘করিম আছে তো, ও খাচ্ছে। কেন, তোর কিছু লাগবে?’
‘করিমের খাওয়া শেষ হলে, আমার বাসায় পাঠিয়ে দে। আমাদের একজন গেস্ট আছে, সে আজকের রাতটা তোর বাসায় থাকবে।’
‘কে এসেছে?’
‘তুই চিনবি না? সজলের গ্রামের মানুষ।’
‘সজলের গ্রামের মানুষ তোর বাসায় থাকুক। আমার এখানে কেন পাঠাচ্ছিস?’
‘আপা, শোন তোকে এখন আমি ডিটেলে কিছু বলতে পারব না। তুই করিমকে পাঠিয়ে দে। আপুটা ভীষণ বিপদে পড়ে আজকের রাতটুকু থাকতে চাচ্ছে। কাল সকালেই চলে যাবে।’
‘মেয়ে?’
‘হুম।’
‘আমি ভাবলাম কোনও ছেলে। মেয়ে হলে ওখানেই থাকুক না। আম্মার রুম তো খালিই আছে।’
‘আপা, আমার এখানে সমস্যা দেখেই আমি তোকে ফোন করেছি। তোর গেস্ট রুম খালি আছে। ওখানে থাকবে।’
‘তা থাকল; কিন্তু সজল ভালো করে চেনে তো? চোরটোর না তো আবার?’
‘কী সব বলিস? চোর হবে কেন! সজল ওকে খুব ভালো করে চেনে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, করিম খাওয়া শেষ করে যাচ্ছে; কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝলাম না।’
‘আপা, আমার কোনও দরকারে, কোনও সমস্যায় আমি তো তোকেই নক করব, নাকি? এখন কিছু জানতে চাস না, প্লিজ। ওকে আজকের রাতটুকু থাকতে দে। আমি কালকে এসে সব বলব।’
‘ঠিক আছে। আমি করিমকে পাঠাচ্ছি।’
আপার সঙ্গে কথা শেষ করে মনে হল, মাথা থেকে বড়ো একটা বোঝা নেমে গেল। লিভিংরুমে ঢুকে দেখি, লিমা কুশনে মাথা রেখে সোফায় হেলান দিয়ে আছে। আমাকে দেখে সোজা হয়ে বসল। তার জ্বর মনেহয় আরও বেড়েছে। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। আমি বললাম, ‘আপনার আজকে রাতটা থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’
‘হোটেল পাওয়া গেল?’
‘হোটেল না, আমার আপার বাসায়। পাশেই ওর বাসা, জি ব্লকে। ওদের ড্রাইভার আসছে। আপনি ওর সঙ্গে যান। ওখানে আপনার কোনও সমস্যা হবে না। এই শরীরে স্টেশনে রাত কাটাতে পারবেন না।’
লিমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ।’
‘আপনি বসেন। করিম একটু পরে আসবে। আরেকটা কথা, আমার আপা বা আম্মাকে আপনার আর সজলের সম্পর্কের কথাটা বলবেন না। আমি বলেছি আপনি সজলের গ্রামের লোক।’
‘ঠিক আছে।’………………………