সে এবং আমরা পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
332

#সে_এবং_আমরা(শেষ পর্ব)
***************************
আপা বলল, ‘কী হল, কথা বল। সে এখানে কেন এসেছে?’

‘আমি জানি না, আপা। আমাকে বলল সজলের সঙ্গে নাকি কী কথা আছে?’

‘কী কথা? সজল বলেনি তোকে?’

‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। সজল বলল, সে নাকি ক্ষমা চাইতে এসেছিল।’

‘কিসের ক্ষমা?’

‘সজল বলেনি আমাকে। শুধু বলেছে সজল কোনও অন্যায় করেনি, আমি যেন এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকি।’

‘বুঝলাম সজল কিছু করেনি; কিন্তু এতদিন পর আগের বউ এসে কিসের ক্ষমা চাইবে আর ক্ষমা চাইবেই বা কেন? সে কী ক্ষমা পেয়ে সজলের সঙ্গে আবার সংসার শুরু করবে?’

‘আপা, তুই কী বলিস এসব?’

‘কী বলি মানে কী? যা বলছি, ঠিকই বলছি। তুই নিজেই ভেবে দেখ, এতদিন পর সে কোনো কারণ ছাড়া এমনি এমনি ক্ষমা চাইতে চলে আসল! তুই ওকে বাসায় ঢুকতে দিলি কেন?’

‘একটা মানুষ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, তাকে আমি ভেতরে ঢুকতে দেবো না?’

‘না, দিবি না। সে একটা মানুষ না। সে তোর বরের আগের বউ। ভুলে যাস না এটা।’

‘আগের বউ, আপা। এখনকার না। সজলের অতীত নিয়ে আমি মোটেও উদ্বিগ্ন না।’

‘কিছু একটা হয়ে গেলে, তখন বুঝবি মজা।’

‘আপা, ওরা যদি আমার আড়ালে দেখা করত, আমি তো সেটা জানতেও পারতাম না। তারচেয়ে এটাই ভালো না, সে সরাসরি বাসায় চলে এসেছে।’

‘তুই কী দিন দিন বোকা হয়ে যাচ্ছিস, তরী? তুই কী সত্যি বুঝতে পারছিস না, সে যে তোর ক্ষতি করতে তোদের জীবনে ফিরে এসেছে?’

‘সে আমার কী ক্ষতি করবে, বল তো আপা?’

‘একদিনে হয়ত করবে না, ধীরে ধীরে করব। কালকে সে বাসায় ঢুকে ক্ষমা চাওয়ার ঢং করল। এরপর থেকে যখন তখন আসতে শুরু করবে। বাসায় না আসুক, বাইরে কোথাও দেখা করবে দু’জন। আর ছেলেদের চরিত্র আমার খুব ভালো জানা আছে। ঐ মেয়ে দুইদিন হেসে হেসে কথা বলবে, পটানোর জন্য নানা রঙঢঙ করবে। এতেই সজল কাত হয়ে যাবে। ঐ মেয়ের জন্য রঙঢঙ করা খুবই সহজ হবে। সে তো সজলের নাড়িনক্ষত্র চেনে। আমি নিশ্চিত, সে এই ধান্দাতেই আবার ফিরে এসেছে। তুই আমাকে রাতে এই কথা বললে তো, আমি তখনই ওকে ধরতাম।’

‘কাকে ধরতি তটিনী? কে, কোন ধান্দায় ফিরে এসেছে?’

নাজমা বেগমের গলার আওয়াজ শুনে, তাঁর দুই মেয়ে চমকে উঠল। তটিনী বলল, ‘সেলিমের মার কথা বলছিলাম, আম্মা। এখন আবার কাজে ফেরত আসতে চায়।’

নাজমা বেগম সোফায় বসে বললেন, ‘ঐ বেটি বহুত চোর ছিল। ওরে আর বাসায় ঢুকাবি না, খবরদার।’

‘জি আম্মা।’

‘তরী, ঐ মেয়েটা কে ছিল? সকালে উঠেই, জ্বর শরীর নিয়ে চলে গেল কেন? আমরা এত করে বললাম আরেকটু পরে যাও, মেয়ে তো কোনও কথাই শুনল না। সজলের কী হয় রে ঐ মেয়েটা?’

‘ওদের গ্রামের পরিচিত।’

‘রাতের বেলায় কত কথা জিজ্ঞেস করলাম৷ সব কথার উত্তরও দিল না। শরীর খারাপ ছিল দেখে ও মনেহয় চুপ ছিল৷ তাই না?’

‘আমি জানি না আম্মা।’

‘তাকে এই বাসায় কেন পাঠিয়েছিলি? সমস্যা কী? তোদের ওখানেই তো রাখতে পারতিস।’

আপা তাড়াতাড়ি বলল, আম্মা চলো তো, কাঁথা সেলাই করার জন্য শাড়িগুলো বের করো। বিউটি খালা শাড়িগুলো নিয়ে যাক।’

আপা আম্মাকে নিয়ে অন্য রুমে চলে গেলে, প্রসঙ্গটা চাপা পড়ে গেল।

———————

সজল অফিস থেকে আপার বাসায় চলে এসেছিল। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ আগে আমরা বাসায় ফিরে এসেছি। সজল থমথমে চেহারা করে টিভির সামনে বসে আছে। তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে শুধুমাত্র টিভির স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে তার মনোযোগ নেই। আপা সরাসরি লিমাকে নিয়ে কিছু না বললেও, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দু-একটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে। সজল বুদ্ধিমান ছেলে। সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেছে বিষয়টা। আমি নিশ্চিত, আপা যদি কথাগুলো সজল খেতে বসার আগে বলত, তাহলে সে আজকে না খেয়েই ওখান থেকে চলে আসত। কাউকেই কিছু বলত না, শুধু খিদে নেই টাইপ অযুহাত দিয়ে সরে যেত।

আমি ফ্রেশ হয়ে এসে সজলের পাশে বসে বললাম, ‘বাইরে থেকে এসেই টিভির সামনে বসে পড়লে যে? চেঞ্জ করে আসো। আমি চা নিয়ে আসছি।’

সজল, আমার কথার উত্তর দিল না। চ্যানেল চেঞ্জ করতে লাগল। আমি রিমোটটা কেড়ে নিয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?’

‘আমি আবার কী করলাম?’

‘এমন গম্ভীর হয়ে বসে আছ কেন?’

‘রিমোট দাও।’

‘দেবো না। তুমি চেঞ্জ করতে যাও।’

আমি টিভির সুইচ অফ করে দিলে, সজল উঠে চলে গেল। আমি কিচেনে এসে চায়ের কাপে দুধ চিনি মেশালাম। চুলায় চায়ের হাঁড়িতে লিকার ফুটছে। লিকার এখনও ঘন হয়নি। আমি চুলার জ্বাল একদম কমিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সামনে উঁচু বিল্ডিং না থাকার কারণে, আমাদের বারান্দা থেকে আকাশের বিশাল অংশ দেখা যায়। আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ হল। লিমা আসার পর থেকে আমার মনের ভেতর একটু খচখচানি শুরু হয়েছে; কিন্তু আজকে আপা যেভাবে বলল, তারপর থেকে আমার অস্থিরতা অনেক বেড়েছে। লিমা আসায় আমি কিছুটা বিরক্ত হয়েছি; কিন্তু মনের ভেতর কোনও আশংকা জন্ম নেয়নি। আপা আজকে আমার মনে আশংকার মেঘ তৈরি করে দিয়েছে। তার ওপর সজলের এই মুখ গোমড়া ভাব আমাকে আরও হতাশ করে দিয়েছে।

দরজার খোলার আওয়াজে ঘোর কেটে গেল। চা নিয়ে রুমে এসে দেখি, সজল চুল আঁচড়াচ্ছে। বেড সাইজ টেবিলে চায়ের কাপ দুটো রেখে সজলের দিকে তাকিয়ে আছি। সজল চুল আঁচড়ে রিভলভিং চেয়ারে বসে মোবাইল হাতে নিল। আমি বললাম, ‘ওখানে বসলে কেন?’

‘এমনি।’

‘চা খাবে না?’

সজল নিরুত্তর। আমি চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে তোমার, এমন করছ কেন?’

‘কিছু হয়নি।’

‘কিছু না হলে তুমি এমনিতেই আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছ?’

‘তুমি, তোমার বোনের বাড়িতে লিমাকে পাঠিয়ে কী করেছ, বুঝতে পারছ তো? তোমার বোকামির কারণে আপা আমাকে ইংগিতে ঠিকই কথা শুনিয়ে দিল।’

‘আমি বোকামি করেছি? এই বাসায় তাকে থাকতে দিলে, খুব বুদ্ধিমানের কাজ হতো? নাকি তাকে কেন থাকতে দিলাম না, সেটাই তোমার রাগের কারণ?’

‘আমি বলেছি সেই কথা?’

‘বলোনি ; কিন্তু আচরণে বুঝিয়ে দিচ্ছ।’

‘কী করেছি আমি?’

‘তুমি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছ আর আমি চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছি; কিন্তু তুমি কাপটা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছ না।’

সজল চায়ের কাপ নিয়ে আর কোনও কথা বলল না। চুপচাপ চা শেষ করে, ল্যাপটপ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বুঝলাম, সে এখনও রেগে আছে। এখন এই বিষয়ে কথা বললে তিক্ততা আরও বাড়বে। আমি চায়ের কাপগুলো কিচেনে রেখে রুমে এসে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না। লিমা নামের মানুষটা হঠাৎ কেন আমাদের জীবনে এসে হাজির হল? সে কী আসলেই আমার জীবনে উপদ্রব হয়ে আবির্ভূত হতে চাচ্ছে? এমন কিছু হলে, তখন কী হবে?

————————-

সজল সকালেও তেমন একটা কথা বলেনি আমার সঙ্গে। চুপচাপ নাস্তা করে অফিসে চলে গেছে। বিউটি খালা সমস্ত কাজ শেষ করে কিছুক্ষণ আগে চলে গেল। আমি গোসল শেষ করে বের হয়েছি, এমন সময় ইন্টারকম বেজে উঠল। ‘হ্যালো….’

‘হ্যালো, ম্যাডাম, আপনার কাছে একজন ম্যাডাম এসেছেন। লিমা নাম। উপরে পাঠাব?’

বুকটা ধুক করে উঠল। লিমা আবার কেন এসেছে? তার না গতকাল ঝিকরগাছায় চলে যাওয়ার কথা? যাক বা না যাক, সেটা তার বিষয়; কিন্তু সে আবার কেন এসেছে এখানে!

‘হ্যালো ম্যাডাম, ওনাকে পাঠাব?’

‘না, পাঠানোর দরকার নেই। বলে দেন আপনার স্যার এখন অফিসে আছেন।’

লিমা কিছু একটা বলল, তারপর গার্ড আমাকে বলল, ‘ম্যাডাম উনি আপনার কাছে এসেছেন। কী করব? পাঠাব?’

এ কী উৎপাত শুরু হল? সে কী এখন থেকে যখন-তখন এখানে আসা শুরু করবে নাকি? আগের দিন ভালো ব্যবহার করেছি দেখে মজা পেয়ে গেছে। আমারই ভুল হয়ে গেছে। নিজের ওপর ভীষণ বিরক্ত লাগছে এখন।

‘হ্যালো তরী, আমি লিমা। আপনার সঙ্গে আমার খুব জরুরি একটা দরকার ছিল। প্লিজ আমি একবার উপরে আসি। আমি বেশি সময় নেব না। প্লিজ তরী।’

এরপর আর কিছু বলা যায় না। গার্ডকে বললাম তাকে ওপরে আসতে দিতে।

সঙ্গে সঙ্গেই ডোরবেল বাজল। দরজা খুলে দেখি লিমা দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার পরনে সালোয়ার-কামিজ। বললাম, ‘আসেন।’

সে ভেতরে এসে আগেরদিনের জায়গাতেই বসল। আমার অস্থিরতা আবারও ফিরে আসছে। সে কী বলতে চায়, কী এমন জরুরি কথা আছে আমার সঙ্গে? আমি তার কথা বলার অপেক্ষা করছি। সে বলল, ‘স্যরি, আবার আসতে হল। আমি সেদিনই কাজটা শেষ করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু পারলাম না। তাই আজকে আসতে হল।’

কী কাজ করতে এসেছে? সে কী আমাকে মারতে এসেছে নাকি? হঠাৎ কেমন ভয় লাগল আমার। পেপারে তো এমন কত খবরই পড়ি। আমি কী তাকে বাসায় ঢুকিয়ে আবারও একটা ভুল করলাম?

সে তার ব্যাগের চেইন খুলল। আমি শক্ত হয়ে বসে আছি। ব্যাগের ভেতর থেকে ছোটো আরেকটা ব্যাগ বের করে এনে টেবিলের উপর রাখল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কী?’

‘এটা আপনার জিনিস।’

‘আমার জিনিস মানে?’

‘আমার কাছে রাখা ছিল। ফেরত দিতে দেরি হয়ে গেল। সেটার জন্য আমি দুঃখিত।’

কোন দিক দিয়ে যে কোন চাল চালছে, বুঝতে পারছি না। সে বোধহয় আমার চেহারা দেখে কিছু আঁচ করতে পারল। ব্যাগের মুখটা খুলে আমার সামনে ধরল, ‘এই টাকাটা সজল আমাকে রাখতে দিয়েছিল। তাকে ফেরত দেওয়া হয়নি আর এই চুড়ি দুটো আমার শাশুড়ি, স্যরি, আপনার শাশুড়ির। এগুলো তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। উনি এই চুড়ি দুটো ফেরত চেয়েছিলেন; কিন্তু তখন আমি দিইনি।’

আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে সত্যি বলছে না মিথ্যা বলছে, বুঝতে চেষ্টা করছি৷ হঠাৎ তার এত ভালো হয়ে যাওয়ার কারণ কী? কোনও কারণ ছাড়াই বাড়িতে বয়ে এসে সব ফেরত দিচ্ছে! বিষয়টা অবশ্যই সন্দেহজনক। আমি বললাম, ‘এগুলো সেদিন সজলকে দেননি কেন?’

‘আমার ঐ আপার কাছে রাখা ছিল, তাই আনতে পারিনি। আমি আসি।’ কথা শেষ করেই সে উঠে দাঁড়াল। আবারও ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা খাম বের করে আনল। এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা পড়বেন, তাহলে সব বুঝতে পারবেন। আসছি। ভালো থাকবেন।’

আমি খামটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। লিমা দরজা খুলে বের হয়ে গেল। টেবিলের ওপর টাকা আর চুড়িগুলো পড়ে আছে। দরজা বন্ধ করে এসে, ওগুলো ব্যাগে ভরে কেবিনেটে রাখলাম। লিমা কী লিখেছে চিঠিতে? সে আমাকে কী জানাতে চায়? সেই ঘটনা, যেটা সজল গতকাল আমাকে বলেনি?

আমি তাড়াতাড়ি বিছানায় বসে খামের ভেতর থেকে কাগজগুলো বের করে আনলাম।

“প্রিয় তরী,

খুব অবাক হচ্ছ তোমাকে চিঠি লিখছি দেখে? তুমি করে বললাম দেখে রাগ করো না। আপনি সম্বোধনে লিখলে, কেমন পরপর মনে হয়। তাছাড়া তুমি আমার চেয়ে বয়সে বেশ খানিকটা ছোটোই হবে।

আজকে নিজের কিছু দোষ স্বীকার করতে এসেছি। দোষ স্বীকার করে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই; কিন্তু তাতে আমার ভুলের ক্ষমা পাব কি না জানি না।

সজল নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে, কী কারণে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল। আমাদের প্রেমের বিয়ে ছিল, শুনেছ নিশ্চয়ই। সবই ঠিকঠাক চলছিল। এত বেশি ঠিকঠাক ছিল বলেই বোধহয় কারও নজর লেগে গেল আমার সংসারে। যদিও এই নজর-টজর আমি একদম বিশ্বাস করি না।

আমারই এক বন্ধু ছিল, নিধি। সজলের সঙ্গে আমি যতবার দেখা করতে গেছি, নিধি সবসময় আমার সঙ্গে থাকত। সঙ্গে থাকতে থাকতে, সে-ও বোধহয় সজলকে পছন্দ করে ফেলেছিল। এটা অবশ্য আমার ধারণা। আমার বিয়ের পরেও নিধি সারাক্ষণই আমার বাসায় আসত। সজলও নিধিকে অনেক পছন্দ করত। ওদের পছন্দের মধ্যে কোনও নোংরামি ছিল না; কিন্তু আমার খুঁতখুঁতে মন সারাক্ষণ নিষিদ্ধ কিছু খুঁজে বেড়াত। আমি, সজলকে বেশি ভালোবাসতাম বলেই কী খুব ইনসিকিউরড ফিল করতাম? নিধি আমার ছোটোবেলার বন্ধু, ওর সবকিছু আমার জানা, ওকে সাথে নিয়ে আমি প্রেম করতে গেছি; কিন্তু আমার সংসারে আমি নিধিকে ঠিক সহ্য করতে পারছিলাম না।

একবার নিধি আমার বেডরুমের জন্য চমৎকার পর্দার সেট এনেছিল। তার কিছুদিন আগেই আমি ডাইনিং রুমের পর্দা কিনেছি। সজল খুব স্বাভাবিকভাবেই বলেছিল, নিধির আনা পর্দাগুলো খুব সুন্দর হয়েছে। ওগুলো সত্যি সত্যি অনেক সুন্দর ছিল; কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, সজল আমার আনা পর্দার চেয়ে নিধির আনা পর্দাগুলোকে বেশি ভালো বলেছে। অথচ সে দুটোর মধ্যে কোনও তুলনাই করেনি।

আমি পরদিনই পর্দাগুলো খুলে, কাজ করতে আসা খালাকে দিয়ে দিয়েছিলাম।

এরপর থেকেই নিধির ছোটোখাটো সব বিষয়ই আমার ভীষণ চোখে লাগত। একদিন হঠাৎ নিধি ওর ম্যাসেঞ্জারে ঢুকে আমাকে একটা ছবি দেখাল। ছবিটা সে সলজকে পাঠিয়েছে। বিয়ের আগে আমরা একবার তিনজন মিলে কপোতক্ষ নদ দেখতে গেছি। সেখানেই ছবিটা তোলা হয়েছিল। নিধি আর সজল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, আমি নিধির মোবাইলে ছবিটা তুলেছিলাম।

সজল ছবিটা দেখে লাভ ইমোজি পাঠিয়েছে। খুবই সাধারণ একটা বিষয়। না ধরলে, কিছুই না; কিন্তু আমি এটাকেই ধরে বসলাম। নিধিকে বললাম, ‘তুই এটা আমাকে না পাঠিয়ে সজলকে পাঠালি কেন?’

নিধি বলল, ‘এটায় তুই আছিস যে তোকে পাঠাব? যে আছে, তাকেই পাঠিয়েছি।’

আমার রাগ আরও বেড়ে গেল। আমি বললাম, ‘তুই সজলকে ম্যাসেঞ্জারে নক করিস কেন? তোর সঙ্গে তো ওর প্রতিদিনই দেখা হয়।’

নিধি দুষ্টুমি করে বলেছিল, ‘তোর বরের সঙ্গে আমি প্রেম করছি। দেখছিস না, সে আমাকে লাভ ইমোজি পাঠিয়েছে।’

এরপর নিধিকে আর কিছু বলিনি। সজলের ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। রাতে সজল ফিরলে, তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, নিধির সঙ্গে ওর কী চলছে। আমি আসলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিলাম না। রাগে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। সজল প্রশ্ন শুনে আমার চেয়েও বেশি রেগে গেল। সে আমাকে এমন খারাপ কথা বলার জন্য স্যরি বলতে বলল। আমি স্যরি তো বললামই না, উলটো বলেছিলাম, ‘তুমি চুপেচাপে আমার বন্ধুর সঙ্গে প্রেম করবে আর আমি স্যরি বলব?’

তখনও আমি বুঝিনি, আমি কীভাবে নিজের সর্বনাশ শুরু করে দিয়েছিলাম। সজল আমার কথায় ভীষণ রাগ করল। রাগ না, তার হয়ত অভিমান হয়েছিল খুব। তারচেয়েও বেশি অপমানে লেগেছিল। আমি তাকে সন্দেহ করতে পারি, এটা সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।

সজল বিষয়টা যত সহজ করতে চাচ্ছিল, আমি সবকিছু ততই জটিল করে ফেলছিলাম। সর্বনাশের চুড়ান্ত করলাম, যখন আমার শাশুড়িকে বললাম, ওরা দুইজন প্রেম করছে। শাশুড়ি আমার কথা বিশ্বাস করলেন, কারণ নিধির এত ঘনঘন আমার বাসায় আসা তিনি পছন্দ করতেন না।

তরী, তুমি বিশ্বাস করবে না, পাঁচ বছর প্রেম করার পর, দুই বছর আমরা সংসার করেছিলাম; কিন্তু সংসারটা ভাঙতে পনেরো দিনও লাগল না। আমি সজলকে এতটাই অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, যে সে বাধ্য হয়ে বলেই ফেলল, ‘এতই যখন অবিশ্বাস, তাহলে আমার সঙ্গে আছ কেন?’

এই একটা বাক্যই আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছিল। আমি চিৎকার করে বলেছিলাম, ‘আমি চলে গেলেই তো নিধিকে নিয়ে মৌজমাস্তি করা সহজ হয়, তাই না? আমাকে সরাসরি বললেই পার, লিমা তুমি চলে যাও। দুশ্চরিত্র কোথাকার?’

সজল ঠান্ডা গলায় একটাই কথা বলেছিল, ‘আমি দুশ্চরিত্র না চরিত্রবান, সেটার প্রমান দেবো না। কারণ আমি কোনও অন্যায় করিনি। তবে এটুকু বুঝে গেছি, তুমি মানসিক সমস্যায় ভুগছ।’

এই কথা শুনে আমি সজলের মাথায় পানির মগ ছুঁড়ে মেরেছিলাম। তারপর ওকে বলেছিলাম, আজকেই যদি বাসা ছেড়ে না যায়, তাহলে আমি ভয়াবহ কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলব।

তরী, তুমি বুঝতে পারছ, আমি কীভাবে নিজের সর্বনাশ করেছিলাম? দুইজন নির্দোষ মানুষকে আমি অহেতুক সন্দেহ করে কতটা অপমান করেছিলাম?

সজল সেদিনই চলে গিয়েছিল। আর ফেরেনি। নিধি এসেছিল। সে আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল সজলকে স্যরি বলার জন্য; কিন্তু তখন আমি অন্য জগতে ছিলাম। নিধিকেও অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। নিছক সন্দেহের বশে আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের দুইজন মানুষকে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।

নিধি দুইমাস পরই বিয়ে করল। ওর বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দেয়নি। শুনেছি সজল বিয়েতে গিয়েছিল।

সজল বেশ কিছুদিন আগে আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা রাখতে দিয়েছিল। সে আমার সঙ্গে আর কখনও কথা বলেনি৷ আমার শাশুড়ি ফোন করে টাকাগুলো চেয়েছিলেন। ওনার হাতের এই চুড়িদুটো উনি বিয়ের রাতে আমাকে দিয়েছিলেন। উনি ঐ চুড়ি দুটোও ফেরত দিতে বলেছিলেন। বাকি সব গয়না আমাকেই রাখতে বললেন।

আমি টাকার কথা একদম অস্বীকার করলাম। বললাম, সজল আমাকে কোনও টাকা রাখতে দেয়নি। চুড়িগুলো ফেরত পাঠিয়ে দেবো বলেছিলাম; কিন্তু দিইনি। টাকার কথা অস্বীকার করায় সজল আর টাকা ফেরত চায়নি।

ওর আম্মা চার-পাঁচবার চুড়ি চেয়ে চেয়ে শেষে ক্ষান্ত দিয়েছিলেন। উনি হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন, ওগুলো আমি ফেরত দেবো না।

একসময় আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেল। নিধি ওর বরের সঙ্গে দেশের বাইরে চলে গেল। তারও কিছুদিন পর সজল বিয়ে করল। আমি একা হয়ে গেলাম, ভীষণ একা। আমার ভাইবোনও আমাকে এড়িয়ে চলত। শুধু মাকেই সবসময়, সব কাজে সাথে পেতাম।

সজলের টাকাটা আমি নিয়েছিলাম ঠিকই; কিন্তু হজম করতে পারিনি। ঐ টাকায় তার দীর্ঘশ্বাস মিশে ছিল যে। আম্মার চোখের ছানির অপারেশন হল। ঐ টাকা থেকে টাকা নিয়ে হসপিটালের বিল মেটালাম। বাসার আসার দুউদিন পর আম্মা মারা গেলেন। ছানির অপারেশন হলে কেউ মারা যায়, বলো?

বিষয়টা আমি তখনও বুঝিনি। প্রয়োজন পড়লে ওখান থেকে টাকা নিয়ে খরচ করি। একবার জুয়েলারি দোকানে গিয়ে খুব সুন্দর একজোড়া ঝুমকা পছন্দ হল। প্রায় লাখ টাকার মতো দাম। ঐ টাকা থেকেই কিনে ফেললাম। কিছুদিন পর এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ঐ ঝুমকাগুলো পরে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে একটা মোটরসাইকেল এসে আমার রিকশা ঘেঁষে দাঁড়াল আর আমি কিছু বোঝার আগেই একটানে ঝুমকাগুলো নিয়ে চলে গেল। প্যাচানো পুশ থাকার কারণে কানের লতি ছিঁড়ে দুইভাগ হয়ে গেছিল!

সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত, আমিও চাইলাম নতুন করে শুরু করতে। সেইসময় আমার পরিচয় হল ফাহিমের সঙ্গে। খুব দ্রুতই আমাদের অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠল। ফাহিম ব্যবসা করতে চাচ্ছিল। আমার সমস্ত গয়না বিক্রি করে ওকে টাকা দিলাম। শুধু এই চুড়ি দু’টো রেখে দিয়েছিলাম।

ফাহিম ব্যবসার কথা বলে থাইল্যান্ড গেল। এরপর সে আমার সঙ্গে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। তখনই আমার মনে হল, এগুলো সবই সজলের আর ওর আম্মার অভিশাপের ফল।

টাকার বেশিরভাগই খরচ করে ফেলেছিলাম। তাই চাইলেও তখনই ফেরত দিতে পারিনি। কিছু কিছু করে টাকা জমাতে শুরু করলাম। এতদিনে এসে পাঁচ লাখ পুরো করতে পারলাম। চুড়িগুলো এই আপার কাছে রাখা ছিল। সেদিনই দিতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আপা বাইরে চলে যাওয়ায় আর দেওয়া হয়নি।

অনেক কথা লিখে ফেললাম। আমি আসাতে তুমি বোধহয় বিরক্ত হয়েছ। বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক। আমি হলে তো তোমাকে বাসায়ই ঢুকতে দিতাম না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো তরী, আমি আর কখনোই তোমাদের সামনে এসে দাঁড়াব না। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে গেলাম, তবে জানি না ক্ষমা পাব কি না। ভালো থেকো তরী। সজলকে ভালো রেখো।

লিমা।”

চিঠিটা ভাঁজ করে চুপচাপ বসে রইলাম অনেকক্ষণ। সজল আমাকে এসবের কিছুই বলেনি৷ চিঠিটা পড়ার পর কেমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। কোনোমতে নামাজটা পড়ে মোবাইলের সাউন্ড অফ করে শুয়ে পড়লাম। খেতেও ইচ্ছা করছে না, কারও সঙ্গে কথাও বলতে ইচ্ছা করছে না।

—————————–

রাতে সজল ফিরলে ওকে স্বাভাবিক মনে হল। এখন সে ঠিকঠাকভাবে কথা বলছে। আমরা খাওয়াদাওয়া শেষ করে, বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে রুমে আসলাম। সে ল্যাপটপ নিয়ে বসার পর, কেবিনেট থেকে জিনিসপত্রগুলো এনে ওর সামনে রাখলাম। সজল বলল, ‘কী এটা?’

‘এটা পড়ো।’

‘এটা কী?’

‘পড়ে দেখো।’

সজল চিঠিটা এক লাইন পড়ে বলল, ‘লিমা এসেছিল?’

‘হুম।’

‘কখন?’

‘দুপুরে।’

‘বলোনি যে?’

‘তুমি চিঠিটা পড়ো।’

সজল এক নিঃশ্বাসে চিঠি শেষ করল। ব্যাগের ভেতর থেকে টাকা আর চুড়ি দুটো বের করে আনল। চুড়িগুলো আমাকে দিয়ে বলল, ‘এটা আম্মার চুড়ি। তুমি পরতে পার।’

‘আম্মা আসুক। ওনার জিনিস ওনাকে ফেরত দিতে হবে। তারপর উনি যদি দেন, তখন পরব।’

‘ঠিক আছে। টাকাগুলো তুলে রাখো। কালকে ব্যাংকে জমা দিয়ে দেবো।’

‘তুমি কিছু বললে না?’

‘কী বলব?’

‘এই যে লিমা আসল, এগুলো ফেরত দিয়ে গেল, তোমার কী মনে হচ্ছে? সে কেন এগুলো করল?’

সজল উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘লিমার কথা বলতে বা শুনতে ইচ্ছা করছে না। আমি তাকে আমার জীবন থেকে একেবারেই মুছে ফেলেছি। তুমি আর কখনও এসব নিয়ে কথা বলবে না, প্লিজ।’

—————————-

পরদিন রাতে আমরা বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। দুলাভাই আমাদের সবাইকে আজ রাতে বাইরে খাওয়াবে। সেইসময় ফোনটা এল। সজলের কোনও বন্ধু ফোন করেছে। সজল কয়েকটা প্রশ্ন করে ফোন রেখে দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে ফোন করল?’

‘তৌসিফ।’

‘তৌসিফ ভাই? কী বলে? আসবে নাকি?’

‘না।’

‘এত তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিল যে। উনি ফোন করলে তো আধঘন্টার আগে কথাই শেষ হয় না।’

‘একটা খবর জানানোর জন্য ফোন করেছে। তৌসিফ এখন ঝিকরগাছায়।’

‘কী খবর? বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো?’

‘হুম।’

‘বলছ না কেন, কী খবর?’

‘লিমার কথা বলল।’

আবারও লিমা! জিজ্ঞেস করলাম, ‘লিমার কী কথা?’

‘আজ সকালে কপোতক্ষের ওদিকে রোড অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। লিমা ঢাকা থেকে ফিরছিল। দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এগারোজন মরেছে। লিমাও আছে ওখানে।’

আমি গলায় মালা পরছিলাম। হঠাৎ হাতটা থেমে গেল। আমি সজলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘চলো যাই, সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’

আমি চেষ্টা করেও মালাটা পরতে পারছি না। মুখটা আটকানো যাচ্ছে না। সজল এসে মালাটা পরিয়ে দিল। ঘরের বাতি নিভিয়ে, এসি অফ করে বাইরে এলাম। সজল মেইন ডোর খুলে বাইরে বের হয়েছে। আমি লিভিংরুমে ঢুকে সোফার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। লিমা যেখানে দুইবার বসেছিল, সেখানটায় হাত ছোঁয়ালাম। আমার চোখটা অসম্ভব জ্বালা করছে। সজল বাইরে থেকে তাড়া দিচ্ছে, ‘তরী, তোমার হল?’

আমি উত্তর দিতে পারছি না। আমার গলা বুজে আসছে। লিভিংরুমের আলো নিভিয়ে বাইরে এসে দরজা বন্ধ করলাম। দরজা আসলে লিমা বন্ধ করে দিয়ে গেল। তার ফিরে আসার যে ভয়টা আমি পেয়েছিলাম, সেই ভয়টা সে চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে গেল।

সমাপ্ত।