সে এবং আমরা পর্ব-০৪

0
186

#সে_এবং_আমরা(৪)
*********************
আমি লিমার সঙ্গে লিভিংরুমে বসেছিলাম। পনেরো মিনিট পর করিম এল। আপার বাসা থেকে খাবার পাঠিয়েছে। ভালোই হল, আমি তো দু’টো তরকারি রান্নার মাঝপথে চুলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভাতটাও রাঁধতে পারিনি। এই খাবার দিয়েই রাতটা চালিয়ে নেওয়া যাবে। লিমাকে বললাম, ‘আপনি অল্প করে খেয়ে যান।’

‘না, এখন আর কিছু খাব না। নাপা খেয়ে শুয়ে পড়ব।’

‘নাপা এনে দেবো।’

‘না, না। লাগবে না। আমি নীচে নেমে কিনে নেবো।’

‘সজলকে ডাকব?’

‘না। ওর সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি আসি।’

‘আপনার কিছু প্রয়োজন হলে, আমার আপাকে বলবেন।’

‘ঠিক আছে।’

লিমা ক্লান্ত পায়ে আমাদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল। করিম লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে লিমাকে নিয়ে নীচে নেমে গেল।

এত রাতে রান্না করতে একদম ইচ্ছা করছিল না। কেটে রাখা সবজি আর আধা রান্না হওয়া তরকারিগুলো রিফ্রিজেরেটরে রেখে দিলাম। কাল সকালে বিউটি খালা এসে, ওগুলোর কিছু একটা ব্যবস্থা করবে। আপার বাসার খাবারগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে বেডরুমের সামনে এলাম। প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে আমি বাইরে অথচ সে একবারও উঁকি দিল না! লিমা তাকে কী এমন কথা বলেছে, যাতে সে নিজেকে রুমের ভেতর বন্দি করে ফেলেছে?

রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখি সজল বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে গেছে। মোবাইলটা হাতে ছিল বোধহয়। ঘুমানোর পর হাত থেকে পড়ে গিয়ে হাঁটুর সামনে কাত হয়ে আছে। আহারে বেচারা, আজকে ভোর ছয়টায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। ফ্যাক্টরি আর হেড অফিসে ছুটোছুটি করে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বাইরের কাপড়টা পর্যন্ত পালটাতে পারেনি। কাঁধে হাত রেখে ওকে ডেকে তুললাম। ‘এভাবে ঘুমাচ্ছ কেন? ঘাড় ব্যথা করবে। ওঠো, উঠে কাপড় পালটে ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।’

সজল লিমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করল না। হাতঘড়ি আর ওয়ালেটটা ওয়ারড্রবের ওপর রেখে, কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আমি ডাইনিং রুমে এসে খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে রেখে আপাকে ফোন দিলাম। ‘হ্যালো আপা…’

‘হুম, বল। খাবার পেয়েছিস?’

‘হ্যাঁ। লিমা আপু গিয়েছে?’

‘হুম। মেয়েটার তো জ্বর।’

‘হ্যাঁ, হঠাৎ করেই জ্বর এসেছে। তুই একটু খেয়াল রাখিস, আপা।’

‘সেটা তোর বলতে হবে নাকি?’

‘সে কোথায়?’

‘ফ্যামিলি লিভিংয়ে বসিয়েছি। আম্মা তো সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। মেয়েটা কে, বললি না তো? সজলের আত্মীয়?’

‘এখন জানতে চাস না। যতটা বলেছি, ততটাই জেনে রাখ। আমি তোকে পরে বলব। সজল এসেছে, আমরা এখন খেতে বসব। খাবারের জন্য থ্যাংকস।’

‘তুই আবার কখন থেকে আমার সঙ্গে ফর্মালিটি শুরু করলি!’

‘রাখলাম। পরে ফোন করছি।’

‘ঠিক আছে।’

সজল চেয়ারে বসেছে। আমি ওর পাশের চেয়ারে বসে দু’জনার জন্য প্লেটে ভাত বাড়লাম। আপা কয়েক রকম ভর্তা পাঠিয়েছে। সাথে মাংস আর চিংড়ি ভুনা। সজল ভর্তা তুলে নিয়ে ভাত মাখাচ্ছে। লিমাকে থাকতে না দেওয়ায় সে আমার ওপর রাগ করেছে কি না, ঠিক বুঝতে পারছি না। সে কখনোই তার রাগটা কাউকে বুঝতে দেয় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘লিমা আছে না চলে গেছে, কিছুই তো জিজ্ঞেস করলে না?’

‘থাকবে কেন! তুমি তো তাকে চলে যেতে বলেছ।’

‘সে কোথায় গেল না গেল, মানুষ তো একটা কথা জিজ্ঞেসও করে, নাকি?’

সজল কথা না বলে পাতে পটল ভর্তা তুলে নিল।

‘তোমার সঙ্গে তার কী এমন জরুরি কথা ছিল যে বাসায় চলে আসতে হল?’

‘কোনও জরুরি কথা ছিল না।’

‘আচ্ছা জরুরি না হোক, কথা তো ছিল। কথা বলার জন্যই তো তোমার অপেক্ষায় বসেছিল। কী বলল?’

‘তেমন কিছু না।’

‘যেমন কিছুই হোক, কী বলেছে, সেটা বলো। নাকি আমাকে বলতে চাও না?’

‘বলব না কেন?’

‘তাহলে বলো।’

‘আমিও নিজেও ঠিক বুঝলাম না, এতদিন পরে সে কেন এসে হাজির হল? ক্ষমা চাচ্ছিল বারবার।’

‘কিসের জন্য ক্ষমা?’

‘জানি না।’

‘জানো না, না বলতে চাও না?’

‘বারবার কেন একই কথা বলছ, তরী? তোমার কাছে কোনোদিন কিছু লুকিয়েছি?’

‘আমি কীভাবে বলব? লিমাকে নিয়ে কোনোদিন কোনো কথাও তো বলোনি।’

‘বলার প্রয়োজন মনে করিনি, তাই বলিনি। যার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করেছি, তাকে নিয়ে আলোচনা করার কিছু নেই। তাকে নিয়ে কথা বলে, বারবার আমি তার কথা মনে করতে বা তাকে গুরুত্ব দিতে চাইনি কখনও।’

‘তুমি রাগ করছ কেন?’

‘রাগ করছি না। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না। আমি তো বললামই, সে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলেনি। আমার কাছে ক্ষমা চাইল। একটু কান্নাকাটি করল। আমি ক্ষমা না করলে নাকি তার জীবন থেকে শনির দশা কাটবে না।’

‘সেটাই তো জানতে চাইছি, কী এমন ঘটেছিল, যার জন্য এতদিন পর বাড়ি বয়ে এসে ক্ষমা চাচ্ছে সে?’

‘সেটা এককথায় বললে তুমি বুঝবে না। সময় নিয়ে বলতে হবে। তবে এটুকু নিশ্চিত থেকো, আমার তরফ থেকে কোনও কিছু ঘটেনি। অন্যায়টা সে করেছিল। না, ঠিক অন্যায় না, সে ভুল করেছিল। সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছিল।’

‘এতদিন পর!’

‘সেটা আমিও বুঝতে পারলাম না।’

‘যা-ই হোক, বাদ দিই ওসব। ওকে আপার বাসায় পাঠিয়েছি। রাতটা ওখানে থাকুক। সকালে চলে যাবে।’

‘কাকে?’

‘কাকে মানে? কাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল আমাদের?’

‘লিমা, আপার বাসায় গেছে! আপারা কী মনে করবেন? তাছাড়া আম্মা কী ভাববেন, বলো তো?’

‘আমার কাছে এটাকেই ভদ্র গোছের সমাধান মনে হয়েছে। অসুস্থ একজন মানুষ রাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে, এটা তো সম্ভব না, তাই না? টেনশন করো না, আপাকে আমি কিছু বলিনি। লিমাকেও নিষেধ করে দিয়েছি, সে যেন তার আগের পরিচয় না দেয়।’

‘সে আপার বাসা চিনে যেতে পেরেছে?’

‘করিম এসে নিয়ে গেছে।’

এরপর এই বিষয়ে কথা এগোলো না। অন্যদিন ডাইনিং টেবিলে অনেক গল্প হয়; কিন্তু আজ আমরা কেউ কোনও কথা বললাম না। সজল খাবারের প্রশংসা করে খাওয়া শেষ করল।

রাতে শুতে আসার পরও অন্য সবদিনের মতো গল্প হল না আমাদের। সজল ল্যাপটপে মাউন্ট এভারেস্টের ওপর ডকুমেন্টারি দেখছে। আমিও কিছুক্ষণ দেখে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। সজল কী আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? ও কী কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে? আশ্চর্য তো, সজল তো একটু আগেই আমাকে বলেছে, সে কিছুই লুকাচ্ছে না। তারপরও আমার কেন এমন মনে হচ্ছে? তাছাড়া সে তো নিয়মিতই রাতে শোয়ার আগে খেলা বা অন্য কোনও ডকুমেন্টারি দেখে। আজকে তো প্রথম এমন হচ্ছে না। সজল হয়ত পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে, আমিই ভুল ভাবছি।

এসি চলার কারণে, বাইরের টুকটাক আওয়াজ কানে আসছে। সজল ইয়ারফোন ইউজ করায়, ডকুমেন্টারির শব্দ এখন আর শুনতে পাচ্ছি না। রুমের ভেতর নিরবতা বিরাজ করছে। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। মাথা থেকে লিমার চিন্তা দূর করতে চেষ্টা করছি; কিন্তু পারছি না। আমার মনের ভেতর অযথা কুটকুট করেই যাচ্ছে। এই কুটকুটানি আমাকে ঠিকমতো ঘুমাতে দিল না বহুক্ষণ।

————————-

প্রতিদিনকার মতোই আজকের সকাল হল। বিউটি খালা সাতটায় এল। সকালের রুটি-সবজি তৈরি করে রেখে অন্য কাজ করতে লাগল। সজল অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে ডাইনিং রুমে আসলে, আমরা একসঙ্গে নাস্তা করলাম। এই পর্যন্ত লিমার কথা একবারও মনে পড়ল না; কিন্তু মনের মধ্যে কিসের যেন একটা চড়াই-উতরাই হচ্ছে! আমার অস্বস্তিটা বোধহয় চেহারায় ফুটে উঠেছিল। সজল বলল, ‘শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’

‘না তো।’

‘তাহলে চেহারাটা এমন লাগছে কেন?’

‘গরমে অস্থির লাগছে।’

‘ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ডেট কবে?’

‘আগামী সপ্তাহে।’

‘আপার বাসায় কখন যাবে?’

‘বিউটি খালা কাজ শেষ করুক। তারপর যাব। তুমি অফিস থেকে ওখানে চলে এসো।’

‘আসব।’

আপার কথা উঠতেই, লিমার কথা মনে পড়ল। কী অদ্ভুত ব্যাপার, আমি তার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। সজল বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপাকে ফোন করলাম। ‘হ্যালো, আপা…..’

‘গুড মর্নিং।’

‘গুড মর্নিং। কী করিস?’

‘আম্মাকে নিয়ে নাস্তা করতে বসব। তুই কখন আসবি?’

‘দশটার পর আসব। লিমা আপু কোথায় রে?’

‘সে তো ঘুমাচ্ছে এখনও।’

‘ওহ, আচ্ছা।’

‘আমি একটু আগে দেখে আসলাম। কপালে হাত দিয়ে দেখেছি। এখনও জ্বর আছে, তবে কম মনে হল।’

‘ঠিক আছে, তোমরা নাস্তা করো। আমি একটু পরে আসছি।’

আপার সঙ্গে কথা শেষ করে বাকি কাজগুলো শেষ করলাম। মনের ভেতরের অস্থিরতাটা আবার শুরু হয়ে গেছে। আপার ওখানে যাওয়ার পর ওদের সবার কাছে লিমাকে নিয়ে কী বলব? আমি গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারি না। ধরা পড়ে যাই। তা-ও হয়ত হালকা-পাতলা মিথ্যা বলতে পারতাম, যদি লিমা ওখানে না থাকত; কিন্তু তাকে সামনে রেখে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলা, আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে যাবে।

উত্তেজনা কমাতে ব্ল্যাক কফি বানিয়ে বেডরুমে এসে বসলাম। কফিতে চুমুক দিয়ে উত্তেজনা সত্যিই কমে গেল। এমন ভয়াবহ তিতকুটে স্বাদে উত্তেজনা পালাতে বাধ্য তো হবেই। কফি শেষ করে, সময় নিয়ে তৈরি হলাম। আপার বাসায় যাওয়ার সময় আমি তেমন সাজগোজ করি না। প্রায় প্রতিদিনই তো যাই। এত সাজগোজের কী আছে? কিন্তু আজকে সাজলাম। বিউটি খালা আমাকে দেখে বলল, ‘আজকা এত সাজগুজ করেছেন যে? কই যাইবেন?’

‘আপার বাসায়ই যাব।’

‘সুন্দর লাগতাছে আপনেরে। এমনেই সাজলেন নাকি কিছু আছে ঐখানে?”

আমি হাসলাম খালার কথায়। ‘কিছু নাই। এমনিই সাজলাম।’ খালার কাছে অস্বীকার করলেও আমি তো জানি আমি কেন সেজেছি।

বিউটি খালার কাজ শেষ হলে দুইজন একসঙ্গেই বাসা থেকে বের হলাম। খালা বলল, ‘আমিও যামু আপনের লগে। খালাম্মারে কয়দিন দেহি না।’

‘চলেন তাহলে।’

আপার বাসায় নীচে আসার পর থেকে বুক ঢিপঢিপ করছে। ফ্ল্যাটে ঢুকতেই আপা বলল, ‘তোদের গেস্ট তো এইমাত্র চলে গেল। দেখা হয়েছে তোর সঙ্গে?’

‘না তো। কখন গেল?’

‘আরে এখনই চলে গেল। শরীরে জ্বর নিয়েই বেরিয়ে গেল। নাস্তা খাওয়ার জন্য এত করে সাধাসাধি করলাম, কথাই শুনল না। বললাম, তুই আসছিস, তাও অপেক্ষা করল না।’

‘কিছু বলে গেছে?’

‘না বলেনি। শুধু বলল, তার নাকি খুব জরুরি কী কাজ আছে। এখনই শাহজাহানপুর পৌঁছাতে হবে।’

আমি হাত-পা ছড়িয়ে সোফায় বসে পড়লাম। চলে গেছে, একদিক থেকে ভালো হয়েছে। আমাকে এখন আর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলতে হবে না।

‘বললি না তো, মেয়েটা কে?’

আমি বিউটি খালাকে বললাম, ‘খালা আপনি আম্মার রুমে যান।’

খালা চলে গেলে বললাম, ‘লিমা, সজলের আগের ওয়াইফ।’

‘মানে কী? কী বলিস তুই? সে এখানে কেন এসেছে? কী চায় সে?’

আপা অনেকগুলো প্রশ্ন করলেও, আমি একটারও উত্তর দিতে পারলাম না। উত্তর তো আমি নিজেও জানি না।………………………

চলবে