স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-২৪+২৫

0
355

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#২৪তম_পর্ব

জ্যানিফার ও ঠিক এভাবেই সেজেছিলো এই পড়ন্ত বিকেলে। সেদিন অভ্র বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো তাকে। অভ্র চেষ্টা করেও নিজের দৃষ্টি সড়াতে পারলো না। বুকের প্রস্তরে চিনচিন ব্যাথা করছে। মস্তিষ্ক বারংবার বলছে এটা একটা ফাঁদ, মহিলা তোকে ঘোরে ফেলতে এভাবে সেজেছে। কিন্তু দূর্বল চিত্ত অতীতের সম্মুখে নড়েচড়ে উঠছে। জ্যানেট তখন ধীর গলায় বললো,
— “sorry for the late, actually this is the first time I wear saree..” (দেরির জন্য দুঃখিত, আসলে এই প্রথম আমি শাড়ি পরলাম।)
— “Its okay” (ঠিক আছে)

অভ্র কোনোমতে কথাটা বললো। তার কথাগুলো খেই হারিয়ে ফেলছে। তার মনে হচ্ছে, এক বিশাল পাথর তার বুক চেপে বসেছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে কেউ মোটা একখানা শিকল দিয়ে তাকে শক্ত করে বেধে রেখেছে। অতীতের সাথে যুদ্ধ করাটা খুবই কষ্টকর। মূহুর্তের মাঝে অতীতের সকল স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো। একটা সময় ছিলো যখন জ্যানিফার আর চিত্তে বিস্তার করতো। মনমন্দিরে তার ই রাজত্ব ছিলো। তার হাসি, তার কথা সবকিছু লহর তুলছে মস্তিষ্কে। অভ্র দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিলো। চোখ বন্ধ করে নিজের দূর্বল চিত্তকে সামলানোর চেষ্টা করলো অভ্র, শক্ত করে সাজালো নিজেকে,
— “অতীত সর্বদা অতীত ই হয়। অতীতের এক বিন্দু ঝলমলে রঙ দিয়ে কখনোই বর্তমানের সাদা ক্যানভাস সাজানো যায় না। অতীতের ঘোরে নিজের বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে ঝুকিতে ফেলা বোকামি। জ্যানিফার মারা গেছে। আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যত জুড়ে একজন নারীর বিস্তার, সে কেবল ঐন্দ্রিলা। শুধু ঐন্দ্রিলা”

অভ্রের চোখের সামনে ঐন্দ্রিলার মুখটা ভেসে উঠলো, শ্যাম স্নিগ্ধ মুখশ্রী। তাদের চারজনের পরিবারের বাস্তব চিত্র মস্তিষ্ক জুড়ে বিস্তার করলো। অতীতের মেঘের আস্তরণ কেটে স্নিগ্ধ প্রভাত উঁকি দিলো তার ঠোঁটে। এতো সুন্দর পরিবার রেখে অতীত মনে করে কষ্ট পাওয়ার মানে নেই। যদি জ্যানিফার ফিরেও আসতো তবুও ঐন্দ্রিলাকে অস্বীকার করার সাধ্য নেই। সে ঐন্দ্রিলাতে শুধু অভ্যস্ত নয় বরং অভ্রের সমস্তটা জুড়ে শুধু সেই বিস্তৃত। তার আগাগোড়া অগোছালো জীবনটিকে সুন্দর করে সাজানোর কৃতিত্ব সেই নারীর। জ্যানিফারের মৃত্যুর পর তো জীবন্ত লাশের মতো জীবন ব্যতীত করতো, অনুভূতিহীন বেরঙ জীবন। সেই জীবনে একদলা লাল-নীল রঙ নিয়ে আগমন ঘটে, মেয়েটি তার বেরঙ মনের ক্যানভাসকে হাজারো রঙ্গে রাঙ্গিয়েছে। নারীটি তার জীবনে এনেছে পরিপূর্ণতা। সে অভ্রের সন্তানদের মা। এই নারীটির সাথে জীবনের অন্তিম মূহুর্ত কাটাতে চায় অভ্র। তাই ঐন্দ্রিলাকে আত্মবিশ্বাস ভাঙ্গতে পারবে না সে।

অভ্র চোখ মেললো। অভ্র তার সাথে স্বাভাবিক কন্ঠে ইংরেজীতেই কথোপকথন শুরু করলো, যা বাংলায় অনুবাদ করলে হয়,
— “চলুন হাটি, কাশবনে হাটতে মন্দ লাগে না”
— “যেমন আপনার ইচ্ছে”

জ্যানেট এবং অভ্র পাশাপাশি হাটতে লাগলো। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আভা আছড়ে পড়ছে অভ্রের শ্যাম মুখে। জ্যানেট অপলক চাহনীতে দেখছে বাঙ্গালী ছেলেটিকে। সুঠাম গঠন, বেশ তেজী মূখশ্রী, সবথেকে আকর্ষণীয় তার চোখজোড়া। এক অদ্ভুত মায়ানগরী এই আখিজোড়ায়। পুরুষদের চোখে মায়া থাকে জ্যানেটের জানা ছিলো না। এই আখিজোড়ায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে মন্দ লাগে না জ্যানেটের। যেদিন প্রথম অভ্রকে দেখেছিলো সেদিন থেকে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভূত হয় তার অভ্রের প্রতি। অনেকে বলে জমজদের পছন্দগুলো একই রকম হয়, হয়তো কথাটার যুক্তি রয়েছে। জ্যানিফারের সাথে জ্যানেটের পছন্দের চরম রুপে সাদৃশ্য পাওয়া যায়। অভ্র ই তার জীবন্ত প্রমাণ। ধীরে ধীরে এই আকর্ষণ নেশায় পরিণত হয়েছে, দূর্লভ কিছু পাওয়ার নেশা। তাই তো কানাডিয়ান নারী আর বাঙ্গালী বেশ ধারন করেছে। সে জানে, অভ্রের মতো পারিবারিক পুরুষ তার প্রতি কখনোই আকর্ষিত হবে না। তাই জ্যানিফারের মুখের সুযোগটি সে নিবে। একবার অভ্র তার ফাঁদে পা দিলেই এক ঢিলে দুটো পাখি মারবে সে। অভ্রকে নিজের করে পাওয়া হবে উপরন্তু দিশানের কাস্টেডি পেতে ঝামেলা হবে না। একজন দূর্বল চিত্তের মানুষের সাথে নিশ্চয়ই ঐন্দ্রিলা থাকবে না। আর নিজের বাবার সকল সম্পত্তির উপর জ্যানেটের অধিকার হবে। নিজের উৎফুল্লতা গোপনেই রাখলো সে। বেশ উৎসাহী কন্ঠে বললো,
— “আপনি তো বললেন না, আমাকে কেমন লাগছে? এতো কষ্ট করে শাড়ি পড়লাম”
— “ভালো লাগছে, এতো কষ্ট না করলেই পারতেন”
— “কেনো করলাম, বুঝা কি খুব কঠিন?”

অভ্র উত্তর দিলো না, সম্মুখের দৃষ্টি স্থির রেখে হাটতে লাগলো। একটা সময় একটা ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়ালো সে, প্রশ্ন করে উঠলো,
— “ফুচকা খাবেন?”
— “আমি ঝাল খেতে পারি না
— “একবার খেয়ে দেখুন, ভালো না লাগলে জোর করবো না”
— “বেশ, অর্ডার করুন”

জ্যানেট এবং অভ্র মুখোমুখি বসলো। ফুচকা অর্ডার দেওয়া হয়েছে। জ্যানেট অপেক্ষা করতে লাগলো ফুচকার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অভ্র অনুরোধের কন্ঠে বললো,
— “দেখুন, আমি দিশানকে খুব ভালোবাসি। জ্যানিফারের স্মৃতি সে, আমি ওকে হারাতে চাই না। এই মামলা মোকদ্দমা তার জন্য ভালো ও না, আপনার কাছে অনুরোধ আমার ছেলেকে রেহাই দিন। বিনিময়ে আপনি যা চান আমি করতে রাজী”
— “আমি যা চাইবো তাই?”

অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিঞ্চিত বিব্র্ত কন্ঠে বললো,
— “আমার সাধ্যের বাইরে কিছু চাইবেন না নিশ্চয়ই”
— “ভয় পাচ্ছেন নাকি?”
— “আপনি আমার কাছে টাকা পয়সা চাইবেন না আমি জানি। যদিও টাকা পয়সার ব্যাপার হতো আপনি মামলা করতেন না। তাই, স্বাভাবিক ভয় পাওয়া”

জ্যানেট হাসলো। বিচিত্র এক হাসি, হাজারো রহস্যের ঝলক সেই হাসিতে। জ্যানেট হাসি থামিয়ে বললো,
— “আমি দিশানকে ছাড়তে পারবো না, কারণ আমার বাবার উত্তরাধিকার সে। তবে একটা সাংঘাতিক উপায় দিতে পারি। সেই উপায়ে দিশান আপনার কাছেই থাকবে, উইন উইন ডিল যাকে বলে”
— “কি উপায়?”
— “আমাকে বিয়ে করবেন? মিসেস চৌধুরীকে ডিভোর্স দিতে হবে। আমাকে বিয়ে করতে হবে। তাহলে দিশানের কাস্টেডি আমি লিগালি পেয়ে যাবো অথচ সে আপনার কাছেই থাকবে। কেমন হবে?”

অভ্র সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জ্যানেটের দিকে। জ্যানেটের কুৎসিত মনোবাঞ্চা অভ্রের মনে বিতৃষ্ণার জন্ম দিলো। জ্যানিফারের মুখশ্রীকে কখনো ঘৃণা করবে সেটা কল্পনাতীত ছিলো তার, অথচ আজ এই মুখশ্রীকে ঘৃণা করছে সে। অভ্রকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে জ্যানেট আবারো হাসলো, তারপর বললো,
— “আপনি জোর করবো না, আপনি সময় নিন। পাঁচ বছর একটা মানুষের সাথে থাকছেন তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করা সহজ নয় আমি জানি। কিন্তু ভেবে দেখুন, দিশানকে ছাড়া আপনি থাকতে পারবেন তো?”
— “আমাকে ভাবার সময় দিন”
— “আপনার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করেছিলাম। আফটার অল দিশান আপনার এবং জ্যানির ভালোবাসার প্রতীক। আপনি সময় নিন। মামলার বিচারের পর ও আপনার উত্তরকে আমি গ্রহন করবো”

তখন ফুচকাটা আসলো। জ্যানেট উৎফুল্ল চিত্তে ফুচকা খেতে লাগলো। অভ্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জ্যানেটের দিকে। তখন তার নজর গেলো কাশবনের পাশে। কেউ লুকিয়ে ছবি তুলছে তার এবং জ্যানেটের। অভ্র এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলো। অস্বস্তিতে গা গুলোচ্ছে তার। একটা নারী এতোটা সাংঘাতিক হতে পারে ধারনা ছিলো না তার। একমূহুর্ত ও বসে থাকা দূষ্কর। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো সে। মুখে জোর পূর্বক হাসির প্রলেপ আকঁলো। এই সময়টা দ্রুত কাটলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে সে________

রাত দশটা,
বাচ্চারা খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ঐন্দ্রিলা পাশপাশি দুই সন্তানকে শুইয়ে দিয়েছে। অভ্রকে ফোন দিতে ইচ্ছে করছে তার। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ কি কি হয়েছে! এমন সময়ে কলিংবেলটা বেজে উঠে। সবাই যে যার ঘরে, তাই ঐন্দ্রিলাই দরজা খুললো। দরজা খুলতেই…………..

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#২৫তম_পর্ব

রাত দশটা,
বাচ্চারা খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ঐন্দ্রিলা পাশপাশি দুই সন্তানকে শুইয়ে দিয়েছে। অভ্রকে ফোন দিতে ইচ্ছে করছে তার। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ কি কি হয়েছে! এমন সময়ে কলিংবেলটা বেজে উঠে। সবাই যে যার ঘরে, তাই ঐন্দ্রিলাই দরজা খুললো। দরজা খুলতেই অভ্র হুড়মুড়িয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলো। চুলগুলো এলোমেলো, শার্টের ইন নষ্ট হয়ে আছে। চুলগুলো ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে। অভ্রের রক্তশূন্য মুখশ্রী দেখে অবাক কন্ঠে ঐন্দ্রিলা প্রশ্ন করে উঠে,
— “আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো? কি হয়েছে?”

ঐন্দ্রিলার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই অতর্কিতে জড়িয়ে ধরলো তাকে অভ্র। অভ্রের এরুপ আচারণে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় ঐন্দ্রিলা। অজানা ভয়ে নিবৃত্ত চিত্ত অশান্ত হয়ে উঠে। ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
— “অভ্র কি হয়েছে? এমন কেনো করছেন?”

অভ্র উত্তর দেয় না। নিবিড়ভাবে ঐন্দ্রিলাকে জড়িয়ে ধরে থাকে সে। ঐন্দ্রিলাও দ্বিতীয়বার কোনো প্রশ্ন করে না। সময় গড়াচ্ছে, অভ্রের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার কাঁধে আছড়ে পরছে। নিস্তব্দ রাত, বসার ঘরটায় নীরবতা ছেয়ে গেছে। সিড়ি ঘরে পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, হয়তো কেউ উঠছে। দরজাটা হাট করে খোলা, কেউ উপরে উঠলে বেশ লজ্জায় পড়তে হবে ঐন্দ্রিলাকে। তাই আলতো করে অভ্রের পিঠে হাত বুলিয়ে সে ধীর কন্ঠে বলে,
— “কেউ উঠছে মনে হয়, আপনি বরং ঘরে যান। আমি আসছি”

অভ্র এবার নিজেকে সামলে নিলো। বাধ্য ছেলের মতো মাথা কাত করে ঐন্দ্রিলার ঘরে গেলো। ঘরে ঢুকতেই চোখ পড়লো বাচ্চাদুটোর দিকে। অদ্রি এবং দিশান কি সুন্দর ঘুমিয়ে আছে, প্রশান্তির ঘুম। সন্তানের কোমল মুখখানা দেখেই অভ্রের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। খুব অশান্তি লাগছিলো তার। জ্যনেটের সাথে তিন ঘন্টা থেকেছিলো সে। ওই তিনটে ঘন্টা তার জীবনের সবথেকে বিরক্তি এবং অস্বস্তির তিনটে ঘন্টা ছিলো। এক এক সেকেন্ড দম আটকে আসছিলো। বুকের অশান্তির লহর বারবার ঝড় তুলছিলো। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো অভ্রের। রাগে মাথা খারাপের যোগাঢ় হচ্ছিলো। ইচ্ছে করছিলো জ্যানেটকে ওখানেই খুন করে ফেলতে। অতিকষ্টে নিজেকে সামলেছে সে। এই অশান্তি নিয়ে সেই শূন্য ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছিলো না অভ্রের। তাই ছুটে এসছে স্ত্রীর কাছে। ঐন্দ্রিলার মুখখানা দেখেই নিজেকে আটকে রাখতে পারে নি, হুড়মুড়িয়ে তাকে নিজের বেষ্টনীতে আবদ্ধ করে সে। অশান্তির জমাট বাধা মেদুর মেঘ ধীরে ধীরে সরে গেলো ঐন্দ্রিলার স্পর্শে। তাই সব ভূলে ঐন্দ্রিলাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে থাকে সে।

দরজা দিয়ে, সব লাইট বন্ধ করে নিজ ঘরে আসে ঐন্দ্রিলা। অভ্র তখন বারান্দায় হাটু গেড়ে বসে ছিলো। শুণ্য দৃষ্টিতে কৃষ্ণ অম্বরের পানে তাকিয়ে ছিলো সে। ঐন্দ্রিলা একটা কম্বল নিয়ে উপস্থিত হলো বারান্দায়। আস্তে করে অভ্রের পাশে বসে সে। মাথাটা অভ্রের কাঁধে এলিয়ে ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করে,
— “কালো আকাশে কি খুঁজছেন?”
— “হারানো অতীতের সাথে যুদ্ধ করার শক্তি”
— “সেটা কি আকাশে লুকিয়ে আছে?”
— “না, লুকিয়ে আছে আমার প্রেয়সীর আলিঙ্গনে”
— “কেমন কাটলো দিন?”
— “বিভীষিকাময়”
— “জ্যানেটের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন?”
— “ছবি পাঠিয়েছে?”

ঐন্দ্রিলা রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে ছোট করে “হু” বলে। অভ্র তার কোমল হাতটা নিজের শক্ত হাতের ফঁকে নেয়। তারপর ঠোঁট ছুয়ে বলে,
— “সরি”
— “হঠাৎ”
— “আমি জানি আমাকে অন্য নারীর সাথে দেখতে তোমার ভালো লাগে নি। তোমার কষ্ট হয়েছে, কিন্তু তবুও সহ্য করেছো শুধু আমার জন্য। দিশানের জন্য। অথচ আমি কয়েক মূহুর্তের জন্য অতীতের গোলকধাঁধায় ভ্রমিত হয়ে পড়েছিলাম। যদি স্বম্বিত না ফিরতো, ভুল করে বসতাম হয়তো। তোমার বিশ্বাস ভেঙ্গে ফেলতাম। এক মূহুর্তের জন্য অতীতকে খুব কাছ থেকে জীবিত হতে দেখেছিলাম”

ঐন্দ্রিলা মাথা তুলে কোমল দৃষ্টিতে চাইলো অভ্রের দিকে। মৃদু হাসি হাসলো। তার চোখ চিকচিক করছে। পরমূহুর্তে এগিয়ে ললাটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আবেগঘন কন্ঠে বললো,
— “আমাদের সম্পর্ক এতোটা ঠুঙ্কো নয় অভ্র; জ্যানেটের নোংরামি এবং কপোটতার কাছে হার মানবে। অতীতকে সহ্য করা অনেক কঠিন, আমি জানি আপনার কতটা কষ্ট হচ্ছিলো”

অভ্র ঐন্দ্রিলার কোলে মাথা রাখলো। নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো তার কোমড়। ঐন্দ্রিলার অলস বা হাতটা বিলি কাটতে লাগলো অভ্রের ঘন চুলে। অভ্রের নিঃশ্বাস ভারী হলো, ঐন্দ্রির বুঝতে বাকি রইলো না অভ্র ঘুমিয়ে গেছে। অভ্রের ক্লান্ত মুখশ্রীতে চোখ বুলালো সে। তারপর পুনরায় ললাটে চুমু আঁকলো। তারপর কম্বলটা টেনে দিলো অভ্রের গায়ে। আগামী পরশু অভ্র কানাডাতে যাবে। কেসের আগে ফিরে আসবে। কতদিন এই মুখটা দেখতে পাবে না সে। তাই একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে দেখতে লাগলো সে অভ্রকে। পাঁচ বছরে এমন অনেক সময় ছিলো যখন ঐন্দ্রিলার মনে হয়েছে সময়ের সাথে তার এবং অভ্রের ভালোবাসা ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে ভুল ছিলো। ভালোবাসা সময়ের সাথে হারায় না বরং গাঢ় হয়। তার রঙ বেরঙ্গ হয় না, বরং আরো রঙ্গিন হয়।

১২.
ছাঁদে কারিগর এসেছে। মাপ নিচ্ছে। নীলাদ্রি ভ্রু কুচকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝে পাচ্ছে না ঠিক কি হচ্ছে! বদরুল সাহেব আরোও দেখিয়ে দেখিয়ে কাজ করাচ্ছেন। নীলাদ্রি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই চরম ঝাড়ি খাচ্ছে। নীলাদ্রি বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক কি হয়েছে যে তার সাথে এমন খেঁকিয়ে উঠছেন বদরুল সাহেব। কারিগররা সব মাপ নিয়ে বললো,
— “স্যার, দুই সপ্তাহ লাগবে”
— “না না, আমি দশ দিন দিবো। মাত্র তো কিছু ক্যাবিনেট আর ছাতি। দশ দিন ই যথেষ্ট”
— “আরে স্যার ইন্টেরিয়ার বলে কথা। রেস্টুরেন্ট কি মগের মুল্লুক?”
— “ফাজলামি করো তুমি? শোন ইকবাল শীতের মধ্যে মাথা খারাপ করবে না। আমি তোমার কাজ ভালো করে জানি। ওই তো খুটি খাটি। এতে আমার সময় কিসের! আজাইরা বকবা না”

কারিগর তর্কে গেলো না, বদরুল সাহেবের স্বভাব তার ভালো করেই জানা। এদিকে নীলাদ্রি অবাক রেস্টুরেন্টের কথা শুনে। কার রেস্টুরেন্ট? কিসের রেস্টুরেন্ট? অবাক কন্ঠে সে শুধালো,
— “খালু কার রেস্টুরেন্টের কাজ হচ্ছে?”
— “আমার পিউ মার”
— “পিউ এর রেস্টুরেন্ট? কই আমাকে তো বললো না? আর টাকা কোথায় পেলো?”
— “সব তোমাকে বলবে কেন? আর এই রেস্টুরেন্টের ইনভেস্টর আমি সমস্যা? আমার ভাগ্নিকে আমি উপহার দিবো তোমাকে জানিয়ে দিবো, অদ্ভুত লোক তো তুমি।”

বদরুল সাহেব আবার খেঁকিয়ে উঠলেন। নীলাদ্রি কথা বাড়ালো না। কিন্তু পিউ তাকে এতো জরুরী ব্যাপার জানালো না ভেবেই সে হতবাক। সে দাঁড়ালো না এক মূহুর্ত। দ্রুতপায়ে নেমে গেলো নিচে। পিউ তখন ঐন্দ্রিলার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। নীলাদ্রি হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো, তার শ্যামমুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। কোনো ভূমিকা বিহীন প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
— “পিউ তুমি খালুর কাছে সাহায্য চেয়েছো?”

নীলাদ্রির এমন প্রশ্নে মূহুর্তের জন্য খেই হারিয়ে ফেললো পিউ। আমতা আমতা করে বললো,
— “কিসের সাহায্য?”

নীলাদ্রি তীব্র আক্রোশ নিয়ে বললো,
— “আমি তো বলেছি আমি ব্যাবস্থা করে নিবো। তবুও তুমি খালুর কাছে অর্থের সাহায্য কেনো চেয়েছো? আমার উপর কি একটুও ভরসা নেই তোমার? আমি কি এতোটাই অপদার্থ? আরে চাকরি গেছে পেয়ে যাবো।তাই বলে মামা-শ্বশুরের কাছে সাহায্য নিতে হবে?”

পিউ হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নীলাদ্রির দিকে। হ্যা, সে রেস্টুরেন্টের কথাটা নীলাদ্রিকে জানায় নি। ভেবেছে সব ঠিক করে সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু সব কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো। নীলাদ্রির আক্রোশের মুখোমুখি হতে হবে সেটা ভাবে নি সে। ঐন্দ্রিলা না পেরে বলে উঠলো,
— “তুই চিৎকার করছিস কেনো ভাই? পিউ নিজের কিছু করতে চায় সেটায় দোষ কোথায়?”
— “সমস্যাটা সেটা নয় ঐন্দ্রি, সমস্যা খালুর কাছে সাহায্য চাওয়া। আমি মানছি, আমার সামর্থ্য নেই এখন পিউকে হেল্প করার। কিন্তু একটু তো ভরসা রাখতে পারতো ও। আর এখন কেনো ও রেস্টুরেন্ট করছে আমি জানি না? কারন আমি অপারগ নাই, সংসার চালানোর ক্ষমতা নেই আমার তাই। আসল কথা ওর হাসবেন্ড তো অপদার্থ তাই…”

নীলাদ্রি কথাটা শেষ করতে পারে না তার পুর্বেই সজোড়ে চড় বসিয়ে দেয় পিউ তার গালে। পিউ এর আকস্মিক কাজে…………

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷]

মুশফিকা রহমান মৈথি