স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-২৬+২৭

0
331

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#২৬তম_পর্ব

নীলাদ্রি কথাটা শেষ করতে পারে না তার পুর্বেই সজোড়ে চড় বসিয়ে দেয় পিউ তার গালে। পিউ এর আকস্মিক কাজে থতমত খেয়ে যায় নীলাদ্রি। তার চোখে বিস্ময়। পিউ এর ন্যায় শান্ত মেয়ে অকপটে তাকে থাপ্পড় মারবে এ যেনো কল্পনাতীত। এদিকে পিউ এর চোখে ক্রোধের অগ্নিতে জ্বলছে। তার সারা শরীর ঈষৎ কাঁপছে। শুভ্র মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। নীলাদ্রি কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই পিউ তীব্র প্রতিবাদের স্বরে বলে,
— “চুপ আর একটা কথা বলবা না, কি পাইছো তুমি, হ্যা? যা মুখে আসবে বলবা? আর আমি তো মানুষ না; তোমার আজাইরা কথা শুনবো! এই শোনো আমি যদি তোমার উপর বিশ্বাস না রাখতাম তবে এতোদিন কষ্ট করে সংসার চালাতাম না। সেদিন ই মামুকে বলতাম, যেদিন তুমি চাকরি ছেড়েছো। আর কি বলছিলে আমি মামুর কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছি কি না, হ্যা নিয়েছি। তোমাকে বলি নি কারণ তোমাকে বললে তুমি রাজী হতে না। ভেবেছি ক্যাফের সব কাজ শেষে তোমাকে বলবো। আর আমি খয়রাত নেই নি মামুর থেকে, ধার নিয়েছি। গয়না বিক্রি করে কিছু টাকা শর্ট পড়ছিলো তাই নিয়েছি, তাতে কি কেমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে? একটা কথা শুনে রাখো নীলাদ্রি, আমি এতোটা লোভী কিংবা স্বার্থপর নই। আমি জানি আমার স্বামীর আত্মসম্মানটা কত বেশি! আমি এমন কোনো কাজ করবো না যেখানে তোমার সম্মানহানী হয়। হ্যা, এটা ঠিক আমি পরিবারের অভাবের কথা চিন্তা করে এই ব্যাবসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কেনো নিবো না নীলাদ্রি? দিনের পর দিন তুমি চাকরির জন্য হন্ন হয়ে রাস্তায় ঘুরছো। বাবার চিন্তায় প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। খরচ বাড়ছে। তুমি যখন নির্ঘুম রাত কাটাও ছাইপাশের ধোঁয়া উড়িয়ে তখন আমি তোমার স্ত্রী হয়ে কিভাবে নিশ্চিন্তে দিন কাঁটাবো? এই পরিবারটা তোমার একার নয়, আমারো। যদি তুমি আমার জন্য চাকরি ছাড়তে পারো আমি কেনো আমার গয়না বিক্রি করে এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না? টাকা যার ই হোক, সেটা তো এই পরিবারের জন্য। বলো, আমি কি ভুল করেছি?”

পিউ এর কন্ঠ কাঁপছে। তার নয়ন অশ্রুসিক্ত। শরীর রীতিমতো কাঁপছে। নীলাদ্রি এবার দমলো, পিউ এর কথাগুলো অযৌক্তিক নয়। পিউ নিজেকে সামলাতে পারলো না, ছুটে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। আজকাল পিউ এর অনুভূতিগুলো বেসামাল হয়ে গেছে। হুট করে রাগ উঠে, হুট করেই বুকে বিষাদের জলবিন্দু জমাট বাঁধতে থাকে, আবার কারণ ব্যাতীত ই মন উৎফুল্ল হয়ে উঠে। যখন নীলাদ্রি তাকে বারংবার দোষ দিচ্ছিলো, তখন নীলাদ্রির রূঢ় আচারণ পিউ সহ্য করতে পারে নি। উপরন্তু নীলাদ্রির উপর প্রচনড ক্রোধিত হয় সে। তাই নিজেকে সংযত না রাখতে পারায় সে নীলাদ্রিকে চড় মেরে বসে। তারপর কথা বলতে বলতে বুকের মাঝে জমে থাকা বিষাদ অশ্রুর রুপ নেয়। এক মূহুর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টসাধ্য লাগছিলো তার কাছে। তাই ছুটে নিজেকে ঘরবদ্ধ করে পিউ। নীলাদ্রি অপরাধীর ন্যায় তাকিয়ে আছে৷ ঐন্দ্রিলা নির্বাক দর্শকের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। পিউ এর অশ্রুসিক্ত মুখশ্রী নীলাদ্রির হৃদয়ে বিষাক্ত সুই এর ন্যায় ফুটছে। নিজের ভুলটা ভালো করেই অনুধাবণ করতে পারছে সে। আসলে হুট করেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। যা মুখে এসেছে না বুঝেই বলে ফেলেছে। যদিও ব্যাপারটি সামান্য কিন্তু নীলাদ্রির আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছিলো। বদরুল সাহেব তার খালু হলেও এখন সম্পর্কটা অনেক বদলেছে, নিজেকে মামা শ্বশুরের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়াটা ঠিক স্বাভাবিক ভাবে হজম করতে পারে নি সে। কিন্তু এখন নিজের বোকামির উপর রাগ হচ্ছে তার। নীলাদ্রির অসহায়ের ন্যায় ঐন্দ্রিলাকে বললো,
— “পিউ খুব রেগে গেছে রে”
— “বেশ হয়েছে, আরোও পুরুষত্ব দেখাও”
— “তাই বলে মারবে?”
— “এই সময়ে হরমোনের ব্যালেন্স ঠিক থাকে না। অনুভূতিগুলো জট লাগে, স্বাভাবিক”
— “তুই ও এভাবে রুদ্ররুপ ধারণ করতি নাকি?”
— “সেটার দরকার পড়ে নি, কারণ অভ্র তোর মতো ছাগল না, এবার দাঁড়িয়ে না থেকে ওর সাথে কথা বল। যা”

নীলাদ্রি আর দাঁড়ালো না, ছুটে গেলো পিউ এর নিকট। দরজায় ধাক্কা দিয়ে আকুল কন্ঠে বললো,
— “পিউ, দরজাটা খোল প্লিজ। সরি আমি ভুল করে ফেলেছি। আর হবে না এমন। প্লিজ দরজা খোল। তুই তো জানিস আমি একটু মাথা মোটা, হুটহাট রেগে যাই। আজ ও তাই করেছি। প্লিজ ক্ষমা করে দে, পিউ”

পিউ সাঁড়া দিলো না। সে ঠিক দরজার গা ঘেষে বসে রয়েছে। তার কর্ণকুহরে নীলাদ্রির আকুল আবেদন ঝংকার তুলছে কিন্তু কেনো যেনো তার সামনে যেতে ইচ্ছে করছে। তখন রাগের বসে এমন একটা বিশ্রী কাজ করে বসবে নিজেও ভাবতে পারে নি। এখন নীলাদ্রির সামনে যেতেও লজ্জা লাগছে তার। মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড অচেনা লাগে পিউ এর। খুব রাগ উঠে নিজের উপর। নীলাদ্রি বসে রইলো দরজার এপাড়ে, পিউ এর উত্তরের অপেক্ষায়। একটা সময় অসহায়ের ন্যায় বললো,
— “তুই তো আমাকে মারলি, তাহলে কেনো রাগ করে আছিস? খুব ব্যাথা পেয়েছি রে। গালটা জ্বলে গেছে একেবারে। এবার তো দরজা খোল”

নীলাদ্রির কথাটা শেষ হবার পূর্বেই ফোনটা বেজে উঠলো। যদিও ফোন রিসিভ করার ইচ্ছে হচ্ছিলো না, তবুও বাধ্য হলো সে। বেশ কিছুক্ষণ অপাশ থেকে সারা না পেয়ে পিউ দরজাটা খুললো। ঐন্দ্রিলা তখন বসার ঘরে পা তুলে বসে ছিলো। ঐন্দ্রিলাকে দেখে অবাক নয়নে সে জিজ্ঞেস করে,
— “নীলাদ্রি কোথায়?”
— “ফোন এসেছে, কথা বলছে”

তাদের কথোপকথন শেষ না হতেই নীলাদ্রি ছুটে এসে পিউকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। নীলাদ্রির এরুপ কার্যে কেঁপে উঠে পিউ। পিউ কিছু বলার আগেই নীলাদ্রি বলে,
— “চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি পিউ শুনছো, এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না
জমা রাগগুলো এইবার তুমি ভেস্তে নিতে পারো, টেনশন আর তোমাকে নিতে হবে না”

সত্যি ই নীলাদ্রির চাকরি হয়েছে। মাত্র নতুন একটা কোম্পানি থেকে কল এসেছে, আগামী মাসে জয়েনিং। এই ইন্টারভিউ টা গত সপ্তাহে সে দিয়েছিলো। ভেবেছিলো হবে না। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি তার চাকরি হয়ে গেছে। পিউ অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে নীলাদ্রির দিকে। নীলাদ্রি তার কপালে আলতো চুমু একে বললো,
— “সরি”
— “আমিও সরি। রাগ উঠেছিলো”
— “আমি জানি, নয়তো আমার শান্ত পিউ এভাবে সিংহীর মতো আচারণ করে? সব দস্যুগুলোর দোষ আমি জানি তো”

পিউ নীলাদ্রির বুকের মাঝে মাথা ঠেকায়। ঐন্দ্রিলা তখন উঠে বলে,
— “রুমে যাও বৎসরা। এভাবে প্রলোভন দেখালে সে আমার কষ্ট হয়। আমার মানুষটা যে দেশান্তরে। বুকটা জ্বলে খুব”

ঐন্দ্রিলার কথা শূনে না চাইতে হো হো করে হেসে উঠে পিউ। মূহুর্তের উত্তাপিত পরিবেশে খুশির লহর উঠে। হয়তো এটাই পরিবারের বৈশিষ্ট্য______________

রাত দশটা,
বদরুল সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দিশা। তার দৃষ্টি ফ্লোরে। পায়ে পা ঘষসে সে। বাবার এমন জরুরি তলবে আত্না কেঁপে উঠেছে। বেশ কিছুদিন বিয়ে বিয়ে একটা গুঞ্জন উঠেছে এই ঘরে। ঐন্দ্রিলা প্রায় ই বদরুল সাহেবের সাথে কথা বলে। নীলাদ্রি কিছু বলতে চায় কিন্তু বদরুল সাহেবের সাথে তার খুটিখাটি লেগেই আছে। দিশার ভয় হচ্ছে, ভয় হচ্ছে বিয়ের গুঞ্জন যেনো বাস্তবে রুপ না নেয়। বদরুল সাহেব কমলার খোঁসা ছাড়াতে ছাঁড়াতে বললেন,
— “তোমার বয়স এখন কত হবে দিশা?”
— “তেইশ বছর বাবা”
— “বাহ বেশ বড় হয়ে গিয়েছো। তা মা তোমার কি কাউকে পছন্দ?”

বিনা ভূমিকায় এমন একখানা প্রশ্নে হতচকিত হয়ে উঠে দিশা। আমতা আমতা করে বলে,
— ……………

মুশফিকা রহমান মৈথি

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#২৭তম_পর্ব

বদরুল সাহেব কমলার খোঁসা ছাড়াতে ছাঁড়াতে বললেন,
— “তোমার বয়স এখন কত হবে দিশা?”
— “তেইশ বছর বাবা”
— “বাহ বেশ বড় হয়ে গিয়েছো। তা মা তোমার কি কাউকে পছন্দ?”

বিনা ভূমিকায় এমন একখানা প্রশ্নে হতচকিত হয়ে উঠে দিশা। আমতা আমতা করে বলে,
— “হুট করে এই প্রশ্ন?”
— “তুমি বড় হয়েছো মা, তোমার ভালোলাগা মন্দলাগা উভয়ই আছে। বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে পছন্দ করাটা অতি স্বাভাবিক। আমি তোমার পছন্দকে কখনোই অসম্মান করবো না। আবার তোমার পছন্দ যে একেবারে সঠিক হবে তাও না। মানুষের যে সঠিক মানুষকেই সর্বদা পছন্দ হবে এমন কোনো রীতি নেই। আল্লাহ তা’আলা তাকে বিবেক দিয়েছেন, বুদ্ধি দিয়েছেন। মাঝে মাঝে সেই বুদ্ধিটা ভ্রমের ধোয়ায় অন্ধ হয়ে যায়। পিতা হিসেবে সেই ভ্রমটা কাটাবার দায়িত্ব আমার। আবার তুমি যদি সুপাত্রকে পছন্দ করো তবে আমি হাসি মুখে তোমার সাথে তার বিয়ের ব্যাবস্থা করবো। তাই বলছি তোমার কি কাউকে পছন্দ?”

দিশা ওড়নার কোনায় দু হাতের মুঠোয় নিয়ে টানাটানি করছে। ঠিক কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। তবে এটা সত্যি সে কাউকে পছন্দ করে। দেরি হলেও এই সত্যিটা সে বুঝতে পেরেছে। আহাশ নামক চরম অসহ্য মানুষটার কাছে হৃদয় হেরে বসে আছে সে। এক মূহুর্তে একটু সাহস নিয়ে বলতে চেয়েছিলো দিশা, “হ্যা, বাবা আমি আহাশ নামক খুব অপছন্দনীয় মানুষটিকে ভালোবাসি” কিন্তু বলতে পারলো না, কারণ বাবার কাছে সেটা ভ্রমের ধোঁয়া মনে হবে। উপরন্তু সেই মানুষটি তো অন্যের নেশায় মত্ত। এখন আর আহাশ তার ভালোবাসা প্রকাশ করে না, এখন সে ইভা ম্যামের সাথে ব্যস্ত। দিশা প্রায় ই মানুষটাকে ইভা ম্যাডামের সাথে দেখতে পায়, মাঝে মাঝে মনে হয় আহাশের সারাটা ভুবন একজনকেই কেন্দ্র করেই ঘুরছে। এই সেমিস্টারে দুটো সাবজেক্টের ক্লাস নিলেও একটি বারো আহাশ কারণব্যতীত দিশার সাথে কথা বলে না। বরং তার দিকে তাকায় ও না। তাই সেই মানুষটিকে ভালোবাসার কথা বলাটা বোকামি ব্যাতীত আর কিছুই না। দিশা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে নিলো। এক রাশ আক্ষেপের প্রতীক ছিলো সেই নিঃশ্বাস। তারপর বললো,
— “না বাবা, আমার কোনো পছন্দ নেই”

বদরুল সাহেব কমলার কোয়া মুখে তুলে মৃদু হাসি হাসলেন। তারপর বললেন,
— “আগামী সপ্তাহে তোমাকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসতে চাচ্ছে। তোমার আপত্তি না থাকলে আমি তাদের সম্মতি জানাতে পারি। তুমি চিন্তা করো, যদি কোনো অসুবিধা থাকে আমাকে জানিও। ছেলে্টি ভালো, ভালো চাকরি করে। আমার খারাপ লাগে নি। সেকারণেই তোমাকে এখানে ডাকা। ছেলেটার ছবি আমার কাছে যদিও নেই। তবে ঐন্দ্রিলার কাছে আছে। আসলে এই বিয়ের ঘটক তো সে। তাই তুমি যদি তার ছবি দেখতে চাও ওকে বলো, দেখিয়ে দিবে”

দিশা চুপ করে রইলো। কথাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে তার। এক বিশাল পাথর যেনো বুকের উপর চাপা পড়েছে। অনুভূতিগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনের ঘরে যাকে একবার ঠায় দেওয়া হয়েছে তাকে ভুলে যাওয়া কি খুব সহজ? এতো দ্রুত নতুন ভাবে অন্য একটি মানুষকে নিয়ে ভাবা কিংবা নিজের চিত্তের কেন্দ্র তাকে বানিয়ে ফেলা কি সম্ভব? নাকি আমরা নিজ সত্তাকে মিথ্যে বলি; আমাদের কিছুই যায় আসে না, আমারা ঠিক আছি। দিশা ধরা গলায় বললো,
— “বাবা, আমি যেতে পারি?”
— “হ্যা, যাও”

দিশা নিজের রুমে চলে গেলো। এক অস্বস্তির পাহাড় যেনো তাকে ভর করলো। ছেলেপক্ষের কথা চিন্তা করতেই যেনো নিঃশ্বাস আটকে আসতে লাগলো না। বুকের কোনায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো। নিজের টেবিলের কোনায় রাখা ভাঙ্গা শোপিচটার দিকে চোখ বুলালো সে। তার জন্মদিনে এই শোপিচটা দিয়েছিলো আহাশ। একটা ক্রিস্টাল বল যার ভেতর একটি ছেলে এবং মেয়ের পুতুল। রাগের বসে যখন সে ছুড়ে মেরেছিলো বক্সটি, তখন শোপিচতা ভেঙ্গে গিয়েছিলো। দিশা খুব কষ্ট করে সুপার গ্রু দিয়ে জোড়া লাগিয়েছিলো। কেনো যেনো খুব আগলে রেখেছিলো সে জিনিসটি। এখন যখন ই সে শোপিচটির দিকে তাকাচ্ছে আহাশের সেদিনের প্রেম নিবেদনের চিত্রটি বারংবার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠছিলো। রুমের ভেতর দম বন্ধ লাগছিলো তার। তাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো দিশা। শীতল হাওয়ার মুখ ছুয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো চুলগুলো উড়ছে। কেনো যেনো অস্বাভাবিক কষ্ট হচ্ছে। বারংবার মনে হচ্ছে, “প্রেম এতো বিষাক্ত কেনো?”

১৩.
আজ দিশানের কেসের ডেট, অভ্র এখনো কানাডাতেই আছে। ঐন্দ্রিলার সাথে তার শেষ কথা হয়েছিলো দু দিন পূর্বে। অনেকবার চেষ্টা করার পর ও কিছুতেই লোকটির সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি। এই দুটো দিন পাগলের মতো তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু ব্যার্থ হয়েছে। তাই আজ একা একাই কোর্টে আসতে হয়েছে তাকে। কিছুক্ষণ পর মামলার কার্যক্রম শুরু হবে। বিচারক আসার অপেক্ষায় কাঠের বেঞ্চিতে একা একা বসে রয়েছে সে। বুকের ভেতর আনচান হচ্ছে। চিন্তার কুয়াশা ঘন হচ্ছে। কুচিন্তারা মাথায় জেকে বসেছে। তার ঠিক বিপরীতে জ্যানেট বসা। তার চোখে মুখে উল্লাসের ছাপ। যেনো ফলাফল তার জানা।

বিচারক আসলে কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়। জ্যানেটের উকিল মহোদয় বিনম্র গলায় নিজের পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন করে,
— “মাননীয় আদালত, আমি গতদিন যা বলেছিলাম আজ ও তাই বলবো। দিশানের জন্য মিস্টার এবং মিসেস চৌধুরী মোটেও ভালো পিতামাতা নন। একজন বাচ্চার জন্য একটা স্বাভাবিক পরিবেশ খুব ই জরুরি, তার মানসিক বৃদ্ধির জন্য কলোহ, বিবাদ খুব ক্ষতিকর। কিন্তু হয়তো মিসেস ঐন্দ্রিলা এবং অভ্র সেই কথা জানেন না। তাদের মধ্যে স্বাভাবিক কিছুই নেই। ঝগড়া, কলোহ, বিবাদ যেনো লেগেই থাকে। এবং সেটা দিশান সংক্রান্ত। আমি একজন স্বাক্ষী পেশ করতে চাই। যদি অনুমতি থাকে তবে আমি মাহফুজা খানমকে কাঠগড়ায় ডাকতে চাই”
— “অনুমতি দেওয়া হলো”

মাহফুজা কাঠগড়ায় দাঁড়ালো। জ্যানেটের উকিল তখন তাকে জিজ্ঞেস করলো,
— “মাহফুজা আপনি কত সময় মিস্টার অভ্রের বাসায় কাজ করেন?”
— “জ্বে, সাত মাস”
— “তাহলে আপনি হয়তো ঘরের সকল ঘটনা কম বেশি জানেন?”
— “জ্বে, বেশি না হলেও জানি”
— “তাহলে বলুন, অভ্র এবং ঐন্দ্রিলা ম্যাডামের সম্পর্কটা কেমন?”
— “আসলে”
— “ভয় পেও না মাহফুজা, তুমি নিশ্চিন্তে আদালতকে বলতে পারো”

মাহফুজা শুকনো ঢোক গিললো। কেনো যেনো তার কন্ঠ কাঁপছে। ঐন্দ্রিলা শান্ত দৃষ্টিতে মাহফুজার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা এতোগুলো মাস তার সাথে থেকেছে। এতো মধুর কন্ঠে ভাবী বলা মেয়েটি কি টাকার প্রলোভনে মিথ্যে কথা বলবে! হয়তো বলবে। মাহফুজা কিছুটা রয়ে সয়ে বললো,
— “ভাবী এবং ভাই এর সম্পর্ক ভালা না। ভাবী দিশান বাবার একদম খেয়াল রাখতে পারে না। তিনি শুধু নিজেকে লইয়েই ব্যাস্ত থাকে। দিশান বাবার খানা, স্কুল সব খালায় দেখে। এই কদিন ভাই এর লগে ভাবীর এই নিয়ে কাইয্যা ও লাগছে। ভাবী তখন বাচ্চাদের লয়ে তার বাপের বাড়ি গেছে গা”

মাহফুজা এবার ঐন্দ্রিলার দিকে তাকালো। ঐন্দ্রিলার মুখোভাব বদলালো না। সে জানতো মাহফুজা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবে। তখন জ্যানেটের উকিল বলে উঠে,
— “দিশানকেও নিয়ে গেছে?”
— “বাধ্য হয়ে লয়ে গেছে। আসলে দিশান তো ভাইরে ভয় পায়।“
— “কেনো ভয় পায়?”
— “ভাই এর রাগ অনেক। রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না তার। তাই দিশান ভয় পায় তারে”

— “তুমি যেতে পারো। মাননীয় আদালত, আমি এটাই প্রমান করতে চাইছিলাম, এই দম্পতি শুধু দায়ে পড়ে দিশানকে নিজের কাছে রাখছে। না এরা বাচ্চাটির কোনো খেয়াল রাখে, না তারা দিশানের জন্য আদর্শ পিতামাতা। আমার ক্লাইন্ট একারণেই নিজের ভগ্নিপুত্রকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চান। হয়তো আমার মক্কেল বিবাহিত নন। কিন্তু একজন প্যারেন্ট এর সকল দায়িত্ব পালন করার উপযোগী সে। এবং তিনি দিশানের জন্য বিয়ে করতেও নারাজ। তাই মহামান্য আদালতের কাছে আমার আর্জি, দিশানের কাস্টেডি যেনো আমার মক্কেলকেই দেওয়া হয়”

উকিলের কথা শেষ হবার পর শাফায়াত দাঁড়ায়। মৃদু হেসে বলে,
— “আমার প্রতিপক্ষের উকিল বন্ধু একটু ভুল বললেন, মিস মার্টিন দিশানের ঠিকভাবে যত্ন কিংবা মানুষ করার জন্য তার কাস্টেডি চান না। তার মূল উদ্দেশ্য হলো মিস্টার রবার্ট মার্টিনের সম্পত্তি………

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷]

মুশফিকা রহমান মৈথি