বাড়িয়ে দাও তোমার হাত পর্ব-০১

0
252

#সূচনা_পর্ব
#বাড়িয়ে_দাও_তোমার_হাত
#হুমাইরা_হাসান

– একে তো অল্পবয়সী তার উপর আ-গুন সুন্দরী। তাকে কী না বিয়ে দিচ্ছে একটা পঙ্গু ছেলের সাথে! তাও আবার দুই বাচ্চার বাপ।বলি তোমার বাপের এতই লোভ যে মেয়ের কথাটা একবার চিন্তা না করে একটা পঙ্গুর সাথে ঝুলিয়ে দিচ্ছে?

এমন তিক্ত ক-টূক্তিসুলভ ম’ন্দবাক্যে কান ঝাঁঝিয়ে উঠলেও দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে অকুণ্ঠচিত্তে দাঁড়িয়ে রইলো মাসনুন। সামনের মহিলা সরে গিয়ে ওর পালা আসতেই হাতের কলস টা রেখে চাপকল চেপে পানি ভরে নিয়ে যত দ্রুততার সহিত সম্ভব এড়িয়ে আসতে চাইলো পারার এমন কূটনৈতিক আচরণধারী মহিলাদের থেকে। মাটি থেকে কলসিটা কোমরের বাঁকে তুলে প্রস্থান করতে নিলে মন্দবাক্য বলা মহিলাটিই ওর হাত চেপে বলল,

– সত্যি করে বলো তো মেয়ে তোমার এ বিয়েতে মত আছে? মনে তো হয়না, শুনেছি ছেলের টাকা পয়সাও আহামরি নেই। যে নিজেকেই সামলে রাখতে পারেনা সে তোমাকে কী করে সামলাবে!

– একুশ বছরের একটা মেয়েকে সামলে রাখতে হবে এমনটা ভাবার চাকরিটা আপনাকে কে দিয়েছে চাচী? আমার হাত-পা চোখ-কান সব ঠিকঠাক আছে। আমাকে আমিই সামলাতে পারি। আর রইলো কথা পঙ্গু ছেলের সাথে বিয়ে হওয়ার আপনার চোখ ট্যারা ভাইয়ের ছেলের সাথে যখন আমার বিয়ের কথা বলেছিলেন এটা তখন মনে হয়নি!

মাসনুনের মুখ থেকে এমন অনমনীয় কঠোরবাক্য শুনে হাত আলগা হয়ে এলো মহিলার। মেদযুক্ত চোয়াল শক্ত করে কেমন খেঁকিয়ে বলল,

– ভারি বেয়াদব মেয়ে তো তুমি! আমার ভাইয়ের ছেলে চোখটা একটু ওমন। তা বলে ট্যারা বলবে তুমি! আমিতো ভালো বুঝে বলেছিলাম তুমি দেখি আমায় হে’নস্তা করছ।

– থাক চাচী। যেখানে আমার বাবা-মা আমার ভালোটা না বুঝেই একটা পঙ্গু ছেলে ধরে বিয়ে দিচ্ছে সেখানে আপনার কী দরকার আমাকে নিয়ে এত ভাবার! আপনার মেয়ে যে এর সাইকেলে ওর বাইকে চড়ে বেড়াচ্ছে সে খোঁজ রাখুন গিয়ে সেটাই ভালো হবে।

বলে প্রত্যুত্তরের কোথায় অপেক্ষা না করে ক্ষিপ্ত গতিতে প্রস্থান করলো। মাসনুনের যাওয়ার পানে চেয়ে আরেকজন মহিলা এসে সুর টেনে বলল,

– বাবারে বাবা! এই মেয়েকে তো খুব ভদ্র, নম্র ভেবেছিলাম। কথাই যেন বলতে যানে না। তার ঝাঁঝ দেখেছ?

– ছাড়ো তো ছাবিলা ভাবী। চলো পানি ভরে নেই আমার ছেলের বাপটা এখনই বেরিয়ে যাবে৷ ওর সাথে কথা বলাই ভুল হয়েছে আমার।

ছাড়ো তো বলেও মহিলা গুলো দেদারসে চালিয়ে গেলো মাসনুন আর তার বাবা মায়ের নামে অসংখ্য কটূকথা। যেন নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক করে খুব ভুল কাজ করে ফেলেছে৷ মাসনুন অবশ্যি সেদিকে কান দিলো না৷ ইদানীং পানি নিয়ে খুব বিভ্রাটে পড়তে হয়৷ সকাল দশটার পরেই আর পানি আসে না। সেই জন্যেই বাধ্য হয়ে পাড়ার মোড়ে এসেছিলো চাপকল থেকে পানি তুলতে৷ সেখানে আরও কয়েক মাঝবয়সী মহিলারাও ছিলো লাইনে। মাসনুন সচরাচর খুব একটা কথা বলে না নাইবা কারো সাথে তর্কে জড়াই। কিন্তু আজ মহিলাগুলোর কথা শুনে মেজাজের রিখটার বেশ উচ্চ পর্যায়ে চটেছিলো৷
ঘরে এসে পানির কলসটা সশব্দে রাখলো মাসসুন, রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে খালগুলো টেবিলে রেখে মাসুমা বেগম বললেন,

– সিয়াকে ডেকে আন তো, মেয়েটার কী বাজে স্বভাব দশটা বেজে যায় অথচ ঘুম ভাঙে না। কত কাজ এখনো পড়ে আছে আমি কী একা এতসব করতে পারি!

– থাক না। বাচ্চা মেয়ে

কথাটি বলেই শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে টেবিলে এসে বসলেন সুবহান কবির৷ খাওয়া শুরুর আগে এক পলক তাকালেন বড় মেয়ের চেহারায়। মুখটা স্তব্ধ, মলিন দেখে বুকটা কেমন ধক্ করে উঠলো। মেয়ে দুটো যে বড় আদরের তাদের মুখে মলিনতার ছাপ একেবারেই সয়না বাবার। তবে মুখ ফুটে কিছু জিগ্যেস করারা আগে মাসনুন নিজেই বলল,

– আব্বু আম্মু? তোমরা কী আমাকে টাকার জন্য একটা পঙ্গু লোকের সাথে বিয়ে দিচ্ছ!

মেয়ের মুখ থেকে এরূপ কথা শুনে বিস্মিত হয়ে তাকালেন দুজনেই। খাবারের লোকমা টা হাত থেকে মুখে আর উঠলো না সুবহান কবিরের, তা নামিয়ে রেখে একবার স্ত্রীর পানে চেয়ে আবারও মেয়ের দিকে চাইলেন অবিন্যস্ত নজরে, ক্ষীণ স্বরে বললেন,

– এমন কথা কেনো বলছিস মা?

– আমি না আব্বু, পাড়ার অনেকেই বলছে। তোমরা নিজ পছন্দ মতো আমার বিয়ে ঠিক করেছ তোমাদের পছন্দের ওপর কোনো সন্দেহ পোষণ না করে আমি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সবটা মেনে নিয়েছি। আজ বাদে কালই আমার বিয়ে অথচ আমি লোকটার ব্যাপারে কোনো খোঁজ খবর ই জানি না। এত ছেড়ে ওই লোকটার সাথেই আমার বিয়ে কেনো ঠিক করলে তোমরা তা কী বলতে পারবে আমায়?

মেয়ের মুখ থেকে আসা প্রশ্নের তোপে স্থবির হয় বাবার চোখ-মুখ। খাবার আর মুখ অব্দি পৌঁছায় না। মাসুমা বেগম শুরু থেকেই খুব একটা মতে ছিলেন না এ সম্পর্কে, তবে স্বামীর মুখের ওপর না বলার চেষ্টাও করেননি। কিন্তু মেয়ের মুখে এরূপ প্রশ্ন শুনে মনে হলো বড্ড ভুল করছেন তারা, এভাবে কী তাদের মেয়ে সুখে থাকবে!

– আমার মেয়ে ফুলের মতন সুন্দর। কত ভালো ভালো জায়গা থেকে সমন্ধ এলো। সত্যিই একটা পঙ্গু ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছ তুমি?

স্ত্রীর মুখের এহেন কথায় বেশ আহত হলেন সুবহান, তার জবাব দেওয়ার আগেই মাসনুন বলে ওঠে,

– কেনো মা যারা পঙ্গু তারা কী মানুষ না? তাদের কী বিয়ে করাও জায়েজ না! আমায় যতদূর জানানো হয়েছে মিহির নামের লোকটার একটা হাত অচল। বাকি সব তো ঠিকঠাকই আছে। পঙ্গু মানে কী সেটা বোঝো তোমরা? শরীরের যেকোনো একটা অঙ্গ অচল হলেই কী পঙ্গু হয়ে যায়? এমন কেন সমাজের মানসিকতা! দূর্ঘটনা যখন তখন যার তার সাথে ঘটতে পারে, পঙ্গুত্ব নিয়ে যে বাঁচে সে জানে সুস্থ জীবন কতটা দূর্লভ। তোমরা এত সহজেই একটা মানুষকে হেয় করে ফেলো কেনো? আজ যদি তার জাগায় আমি থাকতাম পারতে আমায় পঙ্গু বলতে?

কথাগুলো উচ্চরবে বললেই উত্তরের প্রতীক্ষা না করে ছুটে নিজের ঘরে এসে বসলো মাসনুন। মেয়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে আহত চোখমুখে মাসুমা বেগম বললেন,

– আমিতো কাওকে ছোট করতে চাইনি মাসনুনের বাবা। নিজের মেয়ের সুখের ব্যাপারে ভাবাও কী আমার ভুল?

– ভুল নয় মাসুমা। তবে সবসময় বাহ্যিক পূর্ণাঙ্গতা দেখেই তাকে সুখ ভেবে নেওয়া ভুল। টাকা বাড়ি গাড়ি বা চেহারাই তো সব না, একজন সচ্চরিত্র, দিনদার, স্বচ্ছ মনের মানুষ নিজেই একটা অমূল্য সম্পদ। তার সাথে জীবন কাটানো কখনো অসুখের হতে পারেনা। আমার মেয়েকে আমি চিনি। আর বাবা হয়ে ওর জন্য যথার্থ জিনিসটাই আমি নির্বাচন করেছি। ওর প্রশ্নের অর্থ তুমি না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝেছি।

বলে আর কোন বাক্য বিনিময় ছাড়াই খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন কাজের উদ্দেশ্যে। মেয়ের প্রশ্নে যে দ্বিধাবোধে জন্ম হয়েছিলো মনে তার জবাব মেয়েই দিয়ে গেছে। তাই আর কোনো সন্দেহ নেই নিজের সিদ্ধান্তে।

•••

দিন গড়ালো, বেলা ফুরোলো। সময়ের কাটা পেরিয়ে আনলো বিবাহ নামক মাহেন্দ্রক্ষণের পাল্লায়। মাঝের দিনটা কোনো সমস্যা ছাড়াই পেরিয়েছে। নিতান্তই ঘরোয়া আয়োজনের আমেজ, নিজেরা নিজেরাই ছাড়া আর কারো উপস্থিতি লক্ষ্যনীয় নয়। বাহ্যিক কোনো চাকচিক্য বা আয়োজন, অনুষ্ঠান ছাড়াই বিবাহ সম্পন্ন হবে মাসনুন আর মিহির নামের দুটো মানুষের। যাদের সামনাসামনি সাক্ষাৎ এর আগে না কখনো হয়েছে নাইবা নিজেদের চিনেছে। অল্প কয়েক লোকজনের সমাগমে সকলের মুখেই কেমন শোভনীয় হাসি। অবিন্যস্ত চাহনিতে মাসনুন লক্ষ্য করলো আশপাশটা৷ মা নেই, কাজের তোড়ে এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। বারো বছরের ছোট বোনটা ওর গা ঘেঁষে বসে খালা বসে আছে ও বাড়ি থেকে আসা দুটো মহিলার সাথে। খুব বেশি হলে আট থেকে দশজন হবে। বরযাত্রীর সংখ্যা এত কম দেখলেও সে ব্যাপার আমলে নিলো না৷ নিষ্প্রভ মুখাবয়বে বসে রইলো মাসনুন। দরজার বাইরে থেকে সকলের একসাথে আলহামদুলিল্লাহ বলার কলধ্বনি কানে আসতেই মেরুদণ্ড দিয়ে শিথিল স্রোত বয়ে গেলো, তৎপর হয়ে ওঠা মনটা সর্বোচ্চ চেষ্টায় শান্ত করে নতশিরে দৃষ্টি বন্ধ হলো। কাজী নামক মৌলবির পদক্ষেপ এ ঘরে পড়ার কিঞ্চিৎ ব্যবধানেই কবুল বলে মুহুর্তের মাঝেই মাসনুন এক পুরুষের নামে লিপিবদ্ধ হলো। হয়ে উঠলো মিহির আবসার নামক ব্যক্তিটার সহধর্মিণী।

নিকষিত আধার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে রাত ঢলে পড়লো সমস্ত পরিবেশ জুড়ে। সন্ধ্যা পরেই বিদায়কার্য সম্পন্ন করে বেরিয়ে এলো নিজ বাড়ি নিজ ঘর থেকে। পুরোটা সময় স্থির, নিশ্চল থাকলেও বিদায়বেলায় অন্যান্য পাঁচটা মেয়ের মতো মাসনুন ও কান্নায় আছড়ে পড়লো। বাবা মা, চিরচেনা বাড়ি-ঘর, ছোট বোনের খুশিয়াল একটা পরিবার পেছনে ফেলে এগোলো নতুন জীবনের দিকে, নতুনত্বের মোড়ে। একখান লাল জামদানী শাড়ি পরে গাড়ি থেকে নামলো মাসনুন। নাজুক নজর মেলে দেখলো দোতালা একটা বাড়ি। দেখতে আহামরি না, আবার একেবারে কম ও না। স্বাভাবিক নিয়ম রীতি মেনে বরণ করে ঘরে এনে খাওয়া সহ সকল পর্ব চুকাতে বেশ রাত হলে দুজন মেয়ে ওকে নিয়ে এলো কাঙ্ক্ষিত ঘরটায়। অদ্ভুত ভাবে এটা বাসরঘর হলেও স্বাভাবিক বাসরঘরের মতো ফুলে সাজানো নয়। নাইবা কোনো চাকচিক্যের ছোঁয়া আছে। নিতান্তই সাজানো গোছানো ছিমছাম একটা রুম। মাসনুনকে খাটে বসিয়ে একটা মেয়ে বলল,

-, ভাইয়া একটু পরেই চলে আসবে তুমি থাকো আমরা তাহলে আসি। আর কিছু দরকার হলে জানাবে কিন্তু।

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো মাসনুন। না চাইতেও বুকের মাঝে হাজারো আশঙ্কা, বিব্রতবোধ, ভয়ের বাসা বাঁধছে। একইভাবে ক্ষোভ, রাগ ও হচ্ছে মিহির নামক ব্যক্তিটার ওপর। বিয়ে তো আর কোনো ছেলেখেলা নয়! অথচ লোকটার চাঁদমুখখানার দর্শন ই পাওয়া গেলো না এখন অব্দি। যাকে বিয়ে করবে তাকে দেখা বা তার সম্পর্কে জানবার ইচ্ছে বা দরকার তো আছে না কি! চিনলো না জানলো না কীভাবে পার করবে সারাটা জীবন! ভাবনার মাঝেই খট করে শব্দ হলো। তৎপর হয়ে নড়েচড়ে বসলো মাসনুন। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দের তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিছানার চাদর খামচে স্থির জমে রইলো। কিয়ৎক্ষণ কোনো শব্দের নড়চড় না পেতে ঘাড় কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই খট করে লাইট টা বন্ধ হয়ে গেলো। জানালা দিয়ে আসা আবছা আলোয় স্পষ্ট একটা পুরুষালি অবয়ব দেখা গেলো সুইচবোর্ডের পাশে। এক হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে সটান হয়ে। কেমন একটা ভয় জেঁকে ধরলো মাসনুনের মনে, এই লোকটা আবার কে! কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,

– কে?

ওপাশ থেকে জবাব এলো না। ছায়ামূর্তিটা এগিয়ে আসতে থাকলো ক্ষীণ পায়ে, মাসনুন এবার বেশ উচ্চস্বরে বলল,

– কে? এই ঘরে কেনো এসেছেন!

– আমি মিহির

মাসনুনের মেজাজ চটে গেলো। এভাবে হুট করেই লাইট বন্ধ করার কী মানে আছে! ঘর অন্ধকার করার কী মানে। মাসনুন রাগচটা গলায় বলল,

– এভাবে লাইট বন্ধ করলেন কেনো আপনি?

মিহির উত্তর দেয়না। খানিক নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে পা চালিয়ে এগোতে থাকে। ক্ষীণ পায়ে মাসনুনের কাছে এগোতে থাকলে মাসনুন হাতে ভর করে কিছুটা পিছিয়ে আসে। এবার ওর আসলেই ভয় করছে, এ কোথায় এলো ও! লোকটার হাবভাব এমন অদ্ভুতুড়ে কেনো?
.
.
.
চলমাম