স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০১

0
813

#স্মৃতির_আড়ালে
#Tahmina_Akther

১.

-তোর স্বামী আজ দুপুরে আমার বুকে হাত দেয়ার চেষ্টা করেছে,আপু।বাড়িতে কেউ না থাকলে তোর স্বামী আমার সাথে অশালীন আচরণ করতে দ্বিধা বোধ করে না।

কথাটি শেষ করা মাত্র সপাটে আমার গালে থাপ্পড় মেরে বসলো আমার বড়ো আপু।

আমার চোখ দিয়ে টপটপ পানি গড়িয়ে পড়ছে।আমি জানতাম আমার আপু আজও এরকম একটা ভুল করবে কারণ ও আমার থেকেও ওর স্বামীকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে।

-আমার স্বামী অনেক ভালো মানুষ তুই খারাপ। স্বামীকে তো কবে খেয়ে বসে আছিস এখন নিজের চাহিদা মিটানোর খায়েশ আমার স্বামীকে দিয়ে পূরণ করতে চাইছিস।নিজের দোষ ঢাকতে আমার স্বামীর উপর এরকম একটা অপবাদ চাপিয়ে দিতে তোর কন্ঠস্বর কাঁপলো না?

মাথা উঁচু করে আমার আপুর দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বললাম,

-আমার চাহিদার কথা বললে না, সেই চাহিদা মিটাতে তোমার স্বামীর প্রয়োজন আমার নেই। বরং,তুমি হয়তো তোমার স্বামীর চাহিদা মেটাতে পারো না বলে তোমার বিধবা বোনের দিকে আজ তোমার স্বামী হাত বাড়িয়েছে। আজ হয়তো আমার দিকে হাত বাড়িয়েছে অন্যদিন দেখবে অন্য মেয়ে নিয়ে তোমার সামনে ফূর্তি করবে। তুমি তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না।

-কি ভাবছিস,তুলি?

কারো ডাকে আমার পুরোনো স্মৃতিচারণে ব্যাঘাত ঘটলো। পিছনে ঘুরে দেখি আমার ঘরে মা এসেছে।মা এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। আমার মুখের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে বললেন,

-আজও কাঁদছিস!

মাকে দেখে যেন আমার মন মূহুর্তে কিশোরীসুলভ হয়ে গেলো। মা’কে জড়িয়ে ধরে কান্নারত অবস্থায় বলি,

-মা, আমার কি অপরাধ আছে বলতে পারবে?কোন অপরাধে আজ আমি এই সমাজে বিধবার ট্যাগ পেলাম? বড়ো বোনের কাছে হয়ে গেলাম ওর স্বামীর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়া চরিত্রহীনা। একটিবারের জন্য আপু জানার চেষ্টা অব্দি করেনি আমি কি বলতে চেয়েছি?

মেয়ের কথার বিপরীতে কি বলবেন সেই ভাষা নেই নাজমা বেগমের। মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে মৃদু আওয়াজে বলেন,

-হায়াত-মউতের ব্যাপারে আমাদের কারোর হাত নেই। ইসফাক আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, এটা আমাদের জন্য যতই কষ্টদায়ক হোক না কেন এরচেয়ে কঠিন সত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সমাজের মানুষ, তোর বোন তোকে কি বলছে এইসব ব্যাপারে কান দেবার দরকার নেই। আমি তোর মা এখনো জীবিত আছি, আমি তোর পাশে সবসময় আছি।

তুলি ওর মায়ের বুকে চুপটি করে আছে,থেকে থেকে হিচকি তুলে কাঁদছে। নাজমা বেগমের যেন মেয়ের কান্না দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কারণ, আজ চারটি বছর ধরে উনার এই হাসিখুশি থাকা মেয়েটি পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মেয়ে।

-একটু পর আমরা তোর ফুপির বাসায় যাব। নাতাশাকে আজ দেখতে আসবে আর তোর ফুপি বলেছে তুই নাতাশাকে আজ সাজিয়ে দিবি।

মায়ের বুক থেকে মাথা উঁচিয়ে তুলি বললো,

-কিন্তু, মা আমি যে অপয়া। নাতাশার জীবনের এমন খুশির একটা দিনে ওর কোনো জিনিসে হাত দেয়া মানে কুনজর দেয়া হবে,মা?

-তুই এসবে বিশ্বাস করিস! আই কান্ট বিলিভ দিস! আমার কথা বাদ দিলাম তোর ফুপি যদি শুনে তুই এই কথা বলেছিস তবে তোকে উল্টা লটকিয়ে তোর পিঠের ছাল তুলে নিবে।এখন কথা না বাড়িয়ে বোরকা পরে তৈরি হয়ে নে আমি তৈরি হয়ে নেই।

নাজমা বেগম মেয়েকে রেখে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাবেন এমন সময় তুলির কথা শুনে উনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

-শিমুল ভাইয়া আছে ওই বাড়িতে?

-আমি জানি না শিমুল বাড়িতে আছে কি নেই। অতীত ভুলে যা তুলি। এতে তোর যেমন ভালো হবে সাথে তোর আশপাশের মানুষেরও ভালো হবে। কথা না বাড়িয়ে তৈরি হ।

নাজমা বেগম চলে গেলেন, তুলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাট থেকে নেমে আলমারি খুলে বোরকা বের করে তৈরি হয়ে গেলো।
হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে ওর মায়ের ঘরের দরজা সামনে যেতেই দেখলো ওর মা বের হয়ে আসছে।

এরপর, একসাথে বের হয়ে রিকশায় চড়ে রওনা হলো ওর ফুপির বাড়ির উদ্দেশ্য।

দুবোন মিলে পরিবারের সকল সদস্যের ছবি দেখছিলাম। হুট করে আমার চোখে পড়লো,একটা ছেলে বাবুর ছবি। ন্যাপি পড়া মুখে আঙুল দিয়ে রেখেছে।
চেহারার গঠন বলে দিচ্ছে এই ছবির বাবুটা আমাদের শিমুল ভাইয়া। আমি নাতাশাকে দেখাতেই নাতাশ হু হা করে আমার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো।

এমন সময় কারো পায়ের শব্দ পেলাম আমি আর নাতাশা। আমি আর নাতাশা মাথা উঁচু করে দেখি শিমুল ভাইয়া আমাদের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে।

-আমার ঘরে কি করছিস তোরা? কি হলো জবাব দিচ্ছিস না কেন?

জোরে ধমক দিতেই নাতাশ আর আমি কেঁপে উঠলাম।

-বাড়ির সবার ছবি দেখছিলাম আর এই এ্যালবামটা তোমার ঘরে ছিল। তাই এখানে বসে আমরা দেখছিলাম।

তুলি মাথা নিচু রেখে উত্তর দেয় শিমুলকে।কথার ফাঁকে নাতাশ এক দৌঁড়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছে।তুলি একা একা শিমুলের সামনে দাঁড়িয়ে ভয় পাচ্ছিল।

-এই তুই আমার দিকে তাকা মাথা নিচু করে রেখেছিস কেন?তাকা আমার দিকে।

শিমুলের ফের ধমকে তুলি এবার কেঁদে ফেললো।
শিমুল তুলিকে কাঁদতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। তুলিকে আদর মাখা সুরে বললো,

-কি হয়েছে পাখিটা, কাঁদিস কেন?আমি তোকে বলেছি আমার দিকে তাকাতে। এতে কান্না করার কি আছে?

-তুমি জানো আমি জোর গলায় কথা বললে ভয় পাই। আর সেখানে তুমি বারবার আমার সামনে চিৎকার করে কথা বলছো?

-যাহ্,সরি বললাম তোকে। আর কখনো তোর সামনে জোর গলায় কথা বলব না।

শিমুলকে কান ধরতে দেখো কিশোরী তুলি সেদিন চোখে পানি খিলখিলিয়ে হাসছিল।

মায়ের ডাকে স্মৃতির জগত থেকে বের হয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়লাম। মা রিকশা ভাড়া মিটিয়ে আমার পিছনে পিছনে আসছে।

এই বাড়ির প্রতিটা কোণা আমার খুব পরিচিত। কারণ, এই বাড়িতে থেকে শৈশব থেকে কৈশোর পা রেখেছিলাম আমি। অথচ, আজ কয়েকবছর ধরে এই বাড়িতে ঠিক আগের মতো আসা হয় না।

কলিং বেল বেজে উঠতেই হাসিমুখে দরজা খুলে বের হয়ে এলো তুলির ফুপি। এতদিন পর ভাইঝিকে দেখে আনন্দে বুকে টেনে নিলেন। তুলি মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে বললো,

-কেমন আছো, ফুপি?

-ভালো আছি, তুই এত শুকিয়ে গেছিস কেন পাখি?

-আর বলিস না শিউলি, তোর ভাইঝি না খেয়ে খেয়ে শরীরের এই হাল করে ফেলেছে।নাতাশা কই?

-পার্লারে গিয়েছে। তোরা উপরের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নে। নাতাশা এলে তোদের সাথে দেখা করবে।

আমি আর মা সিঁড়ি বেয়ে যাচ্ছিলাম এমন সময় আমাদের সাইড কাটিয়ে নিচের দিকে নেমে যায় শিমুল ভাইয়া। প্রথমে নিজের মনের ভুল মনে করলেও মা’কে যখন ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো, তখন সত্যি সত্যি মেনে নিলাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নির্দয়,পাষান,নিষ্ঠুর আলফাজ শেখ শিমুল।

-কি রে তুলি শিমুলকে জিজ্ঞেস করবি না ও কেমন আছে?

ফুপির কথা শুনে আমি শিমুল ভাইয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের ঘরে চলে এলাম।

যদি একটিবারের জন্য তাকাতাম তাহলে দেখতে পেতাম কেউ আমার দিকে অবাক-ঘৃনা মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে?

ঘরে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা চোখের পানি গুলো আপনাআপনি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

-কেন আজ আপনার সাথে আমার দেখা হলো?এতবছর বেশ ছিলাম আপনাকে না দেখে। কেন আমি যেটা চাই না সেটা আমার সাথে হয়? কেন? কেন?কেন?

তুলির এই চিৎকার বুকের ভেতের চাপা পড়ে যাচ্ছে কারণ এই কান্না বা দুঃখ কাউকে প্রকাশ করে দেখানো যায় না।

#চলবে