স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০২

0
467

#স্মৃতির_আড়ালে
#Tahmina_Akther

২.

-তুলি,দরজা খোল।এই তুলি দরজা খুলছিস না কেন?

মায়ের ডাক শুনতে পেলাম ; চোখে মুখে পানি দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলাম। দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই মা আর ফুপি ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করছে,

-হটাৎ করে কি হলো তোর? শিমুলকে কিছু না জিজ্ঞেস করে চলে এলি?

-আসলে,ফুপি বাইরের কড়া রোদ দিয়ে এলাম তো হুট করে মাথা ব্যথা করছে। তাই মাথায় পানি দিলাম, দেখছো না চুল ভিজে আছে।

বলেই কপালের ভেজা অংশ দেখিয়ে দিলো তুলি।তুলির ফুপি আরও কিছু জিজ্ঞেস করবে এমন সময় শিমুল ভাইয়া মা মা বলে ডেকে উঠতেই ফুপি ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন। তবে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন তাড়াতাড়ি নিচে ডাইনিংয়ে চলে যেতে দুপুরের খাবার সবাই একসাথে খাবে।

তুলির ফুপি চলে গেলে তুলির মা দরজা লাগিয়ে মেয়ের সামনে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন । তুলি ওর মায়ের নিরবতা দেখে বুঝতে পেরেছে,ওর মা ওর উপর অনেক রেগে আছে।তুলি ওর মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওর মায়ের ডানহাত হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

-মা,রেগে আছো কেন?

-তোর এই জিদ কবে যাবে, তুলি?শিমুল তোর চেয়ে বয়সে গুনে গুনে দশ বছরের বড়ো। সেই ছেলেকে তুই কিছু জিজ্ঞেস না করে চলে এসেছিস!বড়োদের কিভাবে সম্মান করতে সেটা তুই জানিস না! ছেলেটা কি ভাবলো তোর আচরণ দেখে?

-কাকে তুমি কি জিজ্ঞেস করতে বলছো,মা?তোমার ভাইয়ের পুত্রকে কি জিজ্ঞেস করব আমি?আজ চার বছর ধরে সে কি আমার খবর নিয়েছে, আমি মরে আছি না-কি বেঁচে আছি?

-আমি তোর এত প্রশ্নের উত্তর জানি না। শুধু এতটুকু বলব তুই এখনো সেই ছোট্ট তুলি নেই যে শিমুলের কাছে গিয়ে রাগ-অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবি আর শিমুল এসে ছোট্ট তুলির রাগ ভাঙাবে।

কথাটি বলে মেয়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন। তুলি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যিই তো!এখন তো তুলি অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছে। ওর আবার কিসের রাগ-অভিমান?

তুলি নিজেকে স্বাভাবিক করে নিচে ডাইনিংয়ে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো ডাইনিংয়ে একা বসে ভাত খাচ্ছে শিমুল। তুলি এক কদম পিছিয়ে যাবে এমন সময় তুলি দেখতে পায় শিমুল হেঁচকি তুলছে। টেবিলে পানি নেই দেখে তুলি দ্রুত কিচেন থেকে পানির জগ এনে গ্লাসে পানি ঢেলে শিমুলের দিকে এগিয়ে দিলো।

শিমুল চোখের সামনে পানির গ্লাস দেখতে পেয়ে, কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করলো।

শিমুল গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে ধন্যবাদ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে গেলো। কারণ, ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে তুলি।

মূহুর্তের মাঝে শিমুলের কপালের শিরা ফুলে উঠলো।টেবিলের উপর থেকে খাবারের প্লেট ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে জোর গলায় তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আমার সামনে এসে দাড়ানোর সাহস তোকে কে দিয়েছে? এসেছিস ভালো কথা কিন্তু পানি কোন সাহস দিয়েছিস?

শিমুলের চিৎকারের শব্দে তুলি ভয়ে কাঁপছে। শিমুলের হুট করে এই ভাবে রেগে যাওয়ার কারণ বুঝে উঠতে পারছে না তুলি। কিছুটা সাহস নিয়ে তুলি শিমুলকে বলে,

-কি এমন ক্ষতি করেছি তোমার যার জন্য এরকম বিহেভ করছো আমার সাথে?পানিই তো দিয়েছি তোমায়। তোমার কষ্ট হচ্ছিল দেখে দিয়েছি তাছাড়া ফুপি এখানে থাকলে আমি কখনোই তোমার সামনে আসতাম না।

-বাহ্ কথার জবাব দেয়া পর্যন্ত শিখে গেছিস! তাছাড়া, তোদের মতো মেয়েরা এরচেয়ে বেশি কিছু বলতেও জানে করতেও জানে।

কথাটি বলে টেবিল ছেড়ে সদর দরজা পেরিয়ে যাবার আগে তুলির প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো শিমুল।

-আমার মতো বলতে তুমি কি বোঝাতে চাইছো?

তুলির প্রশ্ন শুনে বিদ্রুপের হাসি দিয়ে শিমুল বলে,

-উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। তাছাড়া, তোর সাথে আমার প্রশ্ন-উত্তরের সম্পর্ক কবে শেষ হয়ে গিয়েছে।

কথাটি বলে আর অপেক্ষা করেনি শিমুল বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। শিমুলের কাছ থেকে কোনোদিন এমন কথা শুনতে হবে এই কথা কখনো মাথায় আসেনি তুলির।

তুলি শিমুলের কথা শোনার পর একমিনিটের জন্য সেখানে দাঁড়ায়নি তুলি। দৌড়ে চলে গেলো নাতাশার রুমে। এরপর দুই হাটুতে মাথা গুজে দুচোখের অঝরে অশ্রু ঝড়াচ্ছে ।

ক্লাস এইটে পড়ার সময় স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তুলি। “যাও পাখি বলো তারে” গানটি তুলির জন্য সিলেক্ট করে দেয় তুলির স্কুলের গণিত টিচার।

তুলি যে গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে এই ব্যাপারে ওর পরিবারের কেউ জানে না কারণ তুলির বাবা নাচ-গান পছন্দ করে না।নাতাশা এবং গণিত টিচারের অনেক বোঝানোর পর তুলি ওর পরিবারের আড়ালে প্রতিযোগিতায় পার্টিসিপেট করার সাহস জোগাড় করে।

স্কুলের টিফিনের সময় গানের প্র্যাক্টিস করতে থাকে কারণ বাড়িতে তো আর প্র্যাক্টিস করতে পারবে না।দেখতে দেখতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন ঘনিয়ে এলো।

সেদিন তুলি সোনালী পাড়ের সাদা শাড়ি পরে,চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চুল খোপা করে গুজে দেয় লাল গোলাপ। কানে-গলায় রোজকারের মতো খালি।

প্রতিদিন নাতাশা আর তুলি একসাথে স্কুলে না গেলেও আজ একসাথে যাবে। কারণ, দুজন মিলে একই রঙের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিবে।

রিকশার টুংটাং বেল বাজতেই তুলি বুঝে নেয় নাতাশা চলে এসেছে। ঘর থেকে বের হয়ে ওর মা এবং বড়ো বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দেখে রিকশায় বসে আছে স্কুল ড্রেস পরিহিত নাতাশা। তুলি একহাতে শাড়ির কুঁচি ধরে ভ্রু-কুচকে এগিয়ে যায় রিকশার দিকে। রিকশায় বসে থাকা নাতাশার কাছে গিয়ে তুলি প্রশ্ন করে,

-কি রে তুই স্কুল ড্রেসে? আমাদের দু’জনে তো শাড়ি পড়ার কথা ছিল!

-শাড়ির কথা আর বলিস না পাখি, দেখ তোর পেছনে কে দাঁড়িয়ে আছে? মিনমিনিয়ে কথাগুলো বলে সুবোধ বালিকার ন্যায় চুপচাপ বসে রইলো নাতাশা।

তুলি বিরক্তির চাহনি নিয়ে পেছনে তাকালো,আর যাকে দেখলো এতে তুলির সকল সাহস আর বিরক্তি মুহূর্তে বিলিন হয়ে গেলো। কারণ, বাইকের উপরে বসে আছে শিমুল।তুলি তৎক্ষনাৎ নাতাশার দিকে ফিরে নীচু কন্ঠে বললো,

-শিমুল ভাইয়া কি আমাদের সাথে স্কুল পর্যন্ত যাবে?

নাতাশা রিকশায় বসা থাকা অবস্থায় নিচু হয়ে তুলির কানে কানে ফিসফিস করে বলে,

-স্কুলে যাবে এবং তোর গানও শুনবে এরপর আমাদের বাড়িতে তোকে নিয়ে যাবে আমাদের সঙ্গে করে।

এমন কথা শুনে তুলির অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। যেখানে বাবা-মাকে না জানিয়ে গান গাইবে স্কুলে সেখানে কি না শিমুল ভাইয়া উপস্থিত থাকবে! তাহলে,তো বাবা-মা জেনে যাবে আমি স্কুলে গান গেয়েছি আর সবকিছু শিমুল ভাইয়ার কাছ থেকে জানার পর বাবা আমাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবে।

-কি রে পাখি আজ কি উড়ে উড়ে স্কুলে যাবি?শাড়ি পড়ে আছিস চাইলেও উড়ে যেতে পারবি না। একটা কাজ কর কষ্ট করে রিকশায় চড়ে স্কুলে চলে যা। আজ সারাদিন তোদের বডিগার্ড হিসেবে আমি আলফাজ শেখ শিমুল আমি দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।

আমি মাথা নিচু করে রেখেছি লজ্জায় কারণ আমি শাড়ি পরেছি আর শিমুল ভাই দেখে ফেলছে!

আমার ডানহাতে কারো স্পর্শ পেতে মাথা উচু করে দেখি, শিমুল ভাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কখন এলেন উনি? মাত্র না বাইকে বসে ছিলেন!

-হাতে কাজলের দাগ লেগে আছে তাই টিস্যু দিয়ে মুছে দিলাম।রিকশায় উঠে বস।যদি তোর স্কুলের অনুষ্ঠানের জন্য দেরি হয়ে যায়?

আমি রিকশায় উঠে বসতেই আমার শাড়ির আঁচল তুলে আমার কোলে রেখে দিলেন শিমুল ভাইয়া।

রিকশা চলতে শুরু করলো ;আমাদের পেছনে পেছনে শিমুল ভাইয়া বাইকে আসছে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে আমাকে গান গাওয়ার জন্য স্টেইজে ডাকা হয়। নাতাশা আমাকে গুড লাক উইশ করলো। আশেপাশে কোথাও তাকিয়ে শিমুল ভাইয়াকে দেখতে পেলাম না। নাতাশা আমাকে জানালো শিমুল ভাইয়া জরুরি একটা কাজে উনাদের বাড়িতে চলে গিয়েছে।শিমুল ভাইয়ার চলে যাওয়ার কথা শুনে ভীষন খুশি হয়েছি। কারণ, উনি থাকলে আমার গলা দিয়ে গানের সুর না বেরিয়ে কাকের কা কা বের হবে

আমি কাঁপা শরীরে স্টেইজে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিলাম। অতঃপর, “যাও পাখি বলো তারে” বলে গান শুরু করেছিলাম।

গান শেষ হবার পর সকলের করতালিতে মুখরিত স্কুল মাঠ প্রাঙ্গন। স্টেইজ থেকে নেমে পড়লাম আমার অনেক স্কুল ফ্রেন্ড,সিনিয়র-জুনিয়ার সকলেই আমার গানের গলার প্রশংসা করে।

অবিশ্বাস্যভাবে গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হলাম আমি।প্রধান অতিথির কাছ থেকে পুরষ্কার পেলাম।

অনুষ্ঠান শেষ হবার পর স্কুল থেকে বের হয়ে এলাম আমি আর নাতাশা। রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম এমন সময় আমাদের সামনে একটি বাইক এসে থামলো।শিমুল ভাইয়া বাইক নিয়ে এসেছেন।

-কি রে পাখি তোর কা কা শেষ হয়েছে নাকি কাউকে গান না শুনিয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিস?

-কি যে বলো না ভাইয়া!তুলি আজ গানের প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। সকলেই ওর গানের গলার যে-কি প্রশংসা!আর তুমি কি-না বলছো কা কা?

নাতাশা রাগী কন্ঠে ওর ভাইকে কথাগুলো বললেও পরে যখন বুঝতপ পারলো ও কার সামনে কি বলছে তখন জিহ্বায় কামড় দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

-শোন,আমি জানি পাখির গলা কেমন?সবগুলোর মাথা নষ্ট তাই ওমন কা কা গলার সুর শুনে প্রথম স্থানের পুরস্কার ওর হাতে দিয়েছে।
বেশি কথা বলবি না এখন বল তোদের নিয়ে বাড়িতে যাবো কি করে? বাইকে তো আর তিনজন মানুষের জায়গা হবে না। দাঁড়া আমি সামনের মোড় থেকে একটা রিকশা ডেকে নিয়ে আসি।

শিমুল ভাইয়া চলে গেলেন রিকশা খুঁজতে আর নাতাশা আমাকে ওর ভাইয়ার কথায় রাগ করতে বারণ করছে। আমিও রাগ করিনি কারণ আমি জানি আমাকে শিমুল ভাইয়া যা বলে সবই রাগানোর জন্য।

কিছুসময় পর শিমুল ভাইয়া রিকশা নিয়ে এলে আমি আর নাতাশা রিকশায় বসে পরলাম।শিমুল ভাইয়া রওনা হলেন উনার বাইক নিয়ে আর আমাদের রিকশা রওনা হলো শিমুল ভাইয়াদের বাড়ির উদ্দেশ্য।

-কি রে এমন অবেলায় শুয়ে আছিস কেন,পাখি?

চোখ বুঁজে অতীতের স্মৃতিগুলো যখন মনে করতে ব্যস্ত ঠিক তখনি কারো ডাকে আমি স্মৃতির জগত থেকে বের হয়ে এলাম।

চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি নাতাশা আমার দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে।

-ইশফাক ভাইয়ার কথা ভেবে কাঁন্না করছিস, পাখি?

নাতাশার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে, গালে হাত রাখতেই পানির উপস্থিতি টের পেলাম। তবে কি আমি পুরনো স্মৃতির পাতায় লেখা শব্দ
গুলোকে মনে করে কষ্ট পেয়েছি? যদি নাই বা পেয়ে থাকি তবে আমার চোখে পানি এলো কেন?

#চলবে