স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০৬

0
382

#স্মৃতির_আড়ালে
#Tahmina_Akther

৬.

-একটা মেয়েকে ভালোবেসে কতকাল এভাবে দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়াবি?তুই তো আমাকে তুলির বিয়ের আরও দু’বছর আগে থেকেই বলে এসেছিস, তুই আর কাউকে ভালোবাসিস না।আজ চারবছরে কি তোর মনের অনুভূতি বদলায়নি?

-কাউকে ভালোবাসলে সময় হিসেব করে ভালোবাসা যায়?না-কি আজ বলেছি ওকে কাল মন থেকে মুছে দিব এটা কি কখনো সম্ভব হবে? হ্যা,আমি মানছি তোকে আমি বলেছি আমি তুলিকে আর ভালোবাসি না। কিন্তু, দোস্ত চারটা বছরের প্রতিটি রাত জানে আমি কত চেষ্টা করেছি তুলির জন্য আমার মনে তৈরি হওয়া অনুভূতিকে,ভালোবাসাকে ভুলিয়ে দিতে। কিন্তু, আমি ব্যর্থ।

-আরে কার জন্য তোর এত ভালোবাসা?তুলির জন্য! যে কি-না কিছুদিন আগেও অব্দি তোর নামটা পর্যন্ত কারো কাছ থেকে শুনতে চায়নি।ওর কাছে আলফাজ শেখ শিমুল শুধুই একজন খুনি।তুই কার খুনি ইশফাকের?আরে ইশফাকের যেদিন রক্তের অভাবে ডেথ হয় সেদিন তুই বান্দরবান শহরে ছিলি না। তুই কোথায় ছিলি এটা আমি জানি, মাসুদ জানে, আমাদের কলিগরা জানে। তোকে এতকিছু বলার পরও তুই কিভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলছিস, তুই এখনও তুলিকে ভালোবাসিস!

-দেখ,শাকিল আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। আর রইলো তুলিকে ভালোবাসার কথা এটা আমার মনের সুপ্ত জায়গায় লুকায়িত ভালোবাসা। আমি চাইলে এই ভালোবাসা তুলি দেখবে নয়তো কখনো জানবেও না। আমি যবে থেকে তুলিকে ভালোবাসছি তবে থেকেই নিজের কাছ থেকে, তুলির কাছে নিজের অনুভূতিকে লুকিয়ে রাখছি, মরণের আগ পর্যন্ত লুকিয়ে রাখব। কারণ তুলির চোখের দিকে তাকালে ইশফাকের অস্তিত্ব অনুভব করি আমি।আমি তো কোনোদিন তুলির এতটা কাছের মানুষ ছিলাম না যদি থাকতাম তবে আমার দেয়া এই আংটিটা হলেও ওর কাছে থাকতো।কিন্তু….

হাতের তালুতে রাখা আংটির দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে কথাগুলো বলে চুপ করে আছে শিমুল। শাওন বন্ধুর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে, এই আংটিটা অনেক চেনা তার। কারণ, এই আংটিটা কেনার জন্য তার বন্ধু টিউশনি করিয়ে টাকা জমিয়ে এই আংটিটা কিনেছিল তুলির জন্য।

-থাক সেসব কথা এখন বল তোর কি অবস্থা? তোর মা কেমন আছে?শিমুলের প্রশ্ন শুনে শাওনের ধ্যান ভঙ্গ হলো।

– তোদের ছেড়ে সিলেটে থাকছি এটাই অনেক খারাপ আমার জন্য। কিন্তু, কেউ একজনের জন্য আগের মতো এতটা খারাপ লাগে না বুঝলি।

-কেউ একজন বলতে ভাবি?

-ভাবি না হবু ভাবি। আগামী মাসের তিন তারিখে বিয়ে আমাদের।

-আজ তো মাসের ২০ তারিখ তারমানে হাতে বাকি আছে ১৩ দিন।

-সময় খুবই কম তাই আগে থেকেই তোদের সাথে দেখা করে ওয়েডিং কার্ড দিয়ে যাচ্ছি। কারণ, তোদের মোবাইলে দাওয়াত দিলে পাত্তা পাওয়া যাবে না।প্লিজ দোস্ত চলে আসিস সিলেটে। আমার বিয়েতে এটেন্ড করতে পারবি আবার চা-বাগানের শহরকে নিজ চোখে দেখে আসতে পারবি।

-আচ্ছা, যাব। আজ চলি তুই সময়মতো চলে আসিস আগামীকাল আমাদের বাড়িতে।

-আসব মানে দাওয়াত না দিলেও চলে আসতাম। বিয়ে বাড়ি মানে সুন্দর সুন্দর মেয়ে। বিয়ে হয়ে গেলে আর এমন সুযোগ আসবে না তাই নাতাশার বিয়ের উসিলায় হোক ব্যাচেলার লাইফের শেষ বিয়েতে একটু আনন্দ করা যাবে।

শাওনের থেকে বিদায় নিয়ে চায়ের দোকান থেকে বের হলো শিমুল এরপর বাইকে নিয়ে রওনা হলো বাড়ির পথে।

ড্রইংরুমে বসে আছে নাতাশার বাবা-মা, নাতাশা,দাদী,তুলির মা নিলুফা, ওর ছোট চাচা-চাচী এবং উনাদের দুই ছেলে। আলোচনা চলছে নাতাশার বিয়েতে কার কোন দায়িত্ব। যেহেতু সময় খুব কম তাই কনভেনশন সেন্টার এত কমসময়ে বুকিং দেয়া যাবে না। তাই হলুদের অনুষ্ঠান ছাঁদে, বিয়ে গার্ডেন এরিয়ায়।

-শিমুলকে দেখছি না যে?শিমুলের বাবা প্রশ্ন করলেন শিমুলের মাকে।

-সকালের নাশতা খেয়ে যে বের হয়েছে এখনও বাড়িতে ফিরে আসেনি। ছেলেটা আমার কেমন যেন হয়ে গেছে? চেহারায় কোনো উৎফুল্লতা নেই।যা আছে শুধুই গম্ভীরতা।
মন খারাপের সুরে কথাগুলো বলে উঠলো শিউলি।

মেয়ের মন খারাপ দেখে হালিমা বেগম চট করে নিজের মেয়ের জামাইকে বললেন,

-বাবা,বলছিলাম কি শিমুলের তো বিয়ের বয়স কম হলো না বত্রিশ বছরের তাগড়া যুবক এহন। ভালো একটা মাইয়া দেইখা ওরে শাদী করাইয়া দাও দেখবা এহনকার মতো আর থাকব না।

-আম্মা, আপনার নাতীকে অনেকবার ওর মা বিয়ের কথা বলেছে কিন্তু শিমুলের সামনে বিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করা যায় না। এতবড়ো ছেলে আমাদের, পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করছে। আমাদের কাছে প্রতিদিন ভালো ভালো পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে শিমুলের জন্য কিন্তু যার জন্য আসে সে যদি রাজি না হয় এতে আমাদের কি বা করার আছে।

-দুলাভাই,মেয়ে ঘটিত কোনো ব্যাপার নেই তো?
শিমুলের ছোট মামা দুলালের কথায় উপস্থিত সকলের টনক নড়ে।

-যদি শিমুলের কোনো প্রেম থাকত তবে ও সবার আগে তৃণাকে বলতো।কিন্তু, কই আজ পর্যন্ত তৃণার কাছ থেকে এমন কোনো কথা শুনিনি। আচ্ছা,ভাবি তৃণা কবে আসবে?

ননদের মুখ থেকে বড়ো মেয়ে তৃণার কথা শুনে নিলুফা বললেন,

-ও হলুদের অনুষ্ঠানের দিন আসবে। ওর স্বামী খুব বেশি ছুটি পায়নি তাই হলুদ এবং বিয়ের অনুষ্ঠান এটেন্ড করে চলে যাবে।

-কি নিয়ে এতো আলাপ করছো তোমরা?
প্যান্টের পকেটে দুহাত রেখে ড্রইংরুমের সোফায় গিয়ে বসে পড়লো শিমুল।

-তোকে নিয়ে আলাপ করছিলাম, ভাই। তুই বলে শাদী করতে চাস না তোর আব্বায় কইলো?

হালিমা বেগমের কাছ থেকে বিয়ের কথা শুনে শিমুল ওর বাবার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে আবারও ওর নানীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-বিয়ে করলে কি হবে?চাকরি করছি,খাচ্ছি, ঘুরছি এই তো বেশ চলছে জীবন।

-কিন্তু, তোর মা’র দেখাশোনা করবার লাইগা তো একজন দরকার। তুই বিয়া করলে তোর বৌ তোর মায়েরে খেদমত করত তোর সেবাযত্ন করব। ক্যান শাদী করতে মানা করছ ভাই?

-মা, তুমি কি চাও আমি নাতাশার বিয়েতে এটেন্ড না করি? শান্ত কন্ঠে কথাটি বলে শিমুল ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।

-হ্যা হ্যা চাই। মা প্লিজ বিয়ের কথা বাদ দাও। শিমুলের যেদিন মন চাইবে ও সেদিন বলবে আমাদের। বাবা,তুই কোথাও যাস না তোর বোনটার মন খারাপ হয়ে যাবে।

-ওকে যাব না। আমি এখন ঘুমাবো সো রাতে কেউ গিয়ে আমার ঘরের দরজায় নক করবে না।

কথাটি বলে শিমুল সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে যাচ্ছিল এমন সময় নিলুফা শিমুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-শিমুল, তুলিকে নিতে যাওনি কেন?

শিমুল থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। আসলেই তো তুলির কথা ওর স্মরণে এলো না কি করে?

সিঁড়ি থেকে নিচে নেমে শিমুল ওর মামির সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

-তুলি আসেনি?

-না আসেনি। আমি তো ভেবেছি তুমি নিয়ে আসবে। তাই আর কল করিনি, তুলিকে ফিরে আসার কথাও বলিনি। চিন্তিত সুরে কথাগুলো বলে উঠলো নিলুফা।

শিমুল থুতনিতে হাত রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে নাতাশা এবং ওর ছোট চাচার দুই ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-এই তোরা যাবি ওই বাড়িতে?

-ইয়েস। সত্যিই যাবে শিমুল ভাইয়া?

-হ্যা যাব।

-তাহলে তোরা বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর আমি আসছি।

নাতাশা একদৌঁড়ে ওর ঘর গিয়ে বোরকা পড়ে এসে আদিব,রাদিবের সাথে বাইর দাঁড়িয়ে শিমুলের জন্য অপেক্ষা করছে।

-তুলিরে আনতে যাবি ভালো কথা কিন্তু এতজন যাইতাছোস?

শিমুলকে এই প্রশ্নটা করলেন হালিমা বেগম। শিমুল হাসিমুখে তাকিয়ে বললো,

-আজ দুই বছর পর বড়ো মামীদের বাড়িতে যাব। তাই আমরা সব ভাইবোন মিলে সেখানে সারারাত পার্টি করে সকালে ফিরে আসব।মামী আপনার কোনো প্রশ্ন আছে?

-না বাবা। তোমাদের বাড়ি যখন ইচ্ছা হবে তখনই যাবে।কিন্তু, খাবার-দাবার?

-রেষ্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে নিয়ে যাব। মা আমি চলি।

শিমুল বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখলে আদিব আর রাদিব মিলে সিএনজি ঠিক করে ফেলেছে। শিমুল মুচকি হেঁসে সিএনজিতে উঠে বসলো।

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তুলি। ঘুমের ঘোরে তুলির মনে হচ্ছে কেউ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তুলি চোখ বন্ধ রেখে মাথার উপর হাত বুলিয়ে দেয়া সেই মালিকটার হাত স্পর্শ করতে চাইল কিন্তু পারছে না।

চট করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলে অন্ধকার এই রুমটিতে ও ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো প্রাণী নেই। কিছুটা ভয় পাচ্ছে তুলি তবুও মনে সাহস বজায় রেখে বিছানা থেকে নেমে লাইটের সুইচ অন করলো।

পুরো ঘর আলোকিত হয়ে গেলো। তুলি খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখলো, ঘরে আর কেউই নেই এবং জানালা বন্ধ।

হটাৎ করে কলিংবেল বেজে উঠলো। তুলি আতঙ্কে লাফিয়ে উঠলো। এতরাতে কে আসবে ওদের ফ্লাটে? আরও একবার কলিং বেল বাজতেই তুলি দরজা খোলার সিদ্ধান্ত নিলো।

শরীরে খুব ভালো করে ওড়না জরিয়ে ড্রইংরুম পেরিয়ে দরজা খুলে দিলো।

-সারপ্রাইজ

তুলি দেখলো দরজার ওপাড়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে আদিব,রাদিব,নাতাশা। তুলি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নাতাশা এগিয়ে এসে তুলির হাতে চিমটি কেটে বললো,

-এবার বিশ্বাস হয়েছে যে আমরা এসেছি।

নাতাশার কাঁধে থাপ্পড় মেরে বসলো তুলি। এরপর, নিজের হাতের উপর হাত বুলিয়ে বললো,

-এতরাতে তোরা এখানে কি করে এলি?

-কারণ, শিমুল ভাইয়া আমাদের নিয়ে এসেছে।

আদিবের মুখ থেকে শিমুলের নাম শুনে তুলি কিছটা নয় অনেকটাই অবাক হয়ে গেলো। তুলি দেখলো নাতাশা, আদিব রাদিবের পিছনে আরও একটি মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে আর সে হলো শিমুল।

-তোদের বাড়িতে এসেছি বলে আমাদের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি?

-বেশি কথা বলিস না নাতাশা। আয় ভেতরে আয়।

তুলি দরজা ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়াতেই একে একে সবাই ফ্লাটে প্রবেশে করলো।

-আজ সারারাত আমরা গল্প করব পাখি, আ’ম সো এক্সাইটেড।

নাতাশার কথায় তুলি শিমুলের মুখের দিকে একঝলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো।

#চলবে