স্রোতধারা পর্ব-০১

0
767

স্রোতধারা
সূচনা_পর্ব
~মিহি

“ডাক্তারি পড়া পাত্রী ছেড়ে তুই কিনা বিয়ে করবি তিনবার মেট্রিক ফেইল করা মেয়েকে? তাও যে কিনা পাত্রীর ছোট বোন? তুই কোন সাহসে এ কথা বললি আমাকে? হয় তুই ধারাকে বিয়ে করবি নাহলে আজীবন অবিবাহিত থাকবি।”

“নিজের ছোট ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষকে কী করে বিয়ে করি বলো তো মা।” কথাটা মনে মনে আওড়ালেও জোরে বলার সাহস পেল না সৌহার্দ্য। মা যদি একবার জানতে পারে স্রোত কাউকে ভালোবাসে তবে এ জনমে আর স্রোতের বিয়ে হবে না।

বড় ছেলের চুপ থাকাটাকে অপমানজনক মনে হচ্ছে শাহরীন চৌধুরীর। কথা না বাড়িয়ে তিনি তটস্থ ভঙ্গিতে ঘরত্যাগ করলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌহার্দ্য। কী এক মুসিবতে পড়েছে সে। মা আর ভাইয়ের মধ্যে বার্গারের লেটুস পাতার মতো অবস্থা এখন তার। সৌহার্দ্য দু’হাতে কপাল চাপড়ে ধরে। অসহ্য লাগছে তার চারপাশ। ধারাকে দেখতে যাওয়াটা উচিত হয়নি তবে সে তো আর জানত না মা তাকে তারই ছোট ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষের সাথে বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। ধারা আর স্রোত মেডিকেলে পড়ছে, একইসাথে। স্রোত ধারাকে পছন্দ করে তাও বছর দুয়েক আগে থেকে কিন্তু কোনোভাবেই সে ধারাকে প্রস্তাব দিতে পারেনি। এর পেছনেও একটা কারণ আছে। কারণটা হলো ধারার বোন, হায়া। হায়া ধারার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট। উশৃঙ্খল স্বভাবের দাপুটে মেয়ে। ধারা চায় দুই বোন যেন একই পরিবারের বউ হয়ে থাকে আর এজন্য অসংখ্য ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব সে নাকচ করেছে।হায়া দেখতে আহামরি সুন্দরী না তবে গুণে গুণান্বিত। হায়ার রান্না খেলে একজন মানুষ তার প্রেমে পড়তে বাধ্য। কিন্তু সবাই তো রূপটাই খোঁজে। সে কারণে হায়াকে বাড়ির বউ করতে রাজি হয়না কেউ। তাছাড়া মেট্রিক ফেইল করা মেয়ে!

সৌহার্দ্য চোখ বন্ধ করে হায়ার মুখটা মনে করার চেষ্টা করে। এক পলক দেখেছিল সে, শ্যামবর্ণের মুখ। চোখজোড়ার মণি বাদামি বর্ণের, ঠোঁট বিবর্ণ যেন কতশত বছর লিপস্টিকের স্পর্শ পড়েনি। গায়ে জড়ানো ছিল পুরুষালি এক শার্ট আর সো কলড ফ্যাশনের ছেঁড়া জিন্স। এত বড় মেয়ের এমন গুণ্ডামার্কা লুক মানা যায়? মেয়ে হবে একদম সাদাসিধে। গায়ে ছড়াবে বাসন্তী কিংবা কলাবতী রঙের শাড়ি, খোঁপায় গুঁজবে বেলীফুলের গাজরা, কাজলকালো আঁখি দেখাবে দেবীর ন্যায়। সৌহার্দ্যের পছন্দ বরাবরই এমন ছিল কিন্তু হায়াকে দেখার পর একমুহূর্তের জন্য হলেও তার মনে হয়েছে হায়ার সৌন্দর্য অমলিন। ঐ ছেলেসুলভ পোশাক আশাকের মেয়েটা সৌন্দর্যে সবাইকে ছাপিয়ে যাবে। সৌহার্দ্য নিজের উপর বিরক্ত হলো। এসব কী ভাবছে সে? বিয়ে নিয়ে এত কিসের মাথাব্যথা তার? মা যাকে পছন্দ করবেন, তাকেই বিয়ে করবে সে। এ বাড়িতে প্রেমের বিয়ে আগে কখনো হয়নি, এখনো হবে না। স্রোতের জন্য ইদানিং মায়া লাগে সৌহার্দ্যের। পারিবারিকভাবে যদি স্রোতের জন্য ধারাকে পছন্দ করে আনা যেত তবে আর কোনো ঝামেলা থাকতো না। সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিয়ে নামক বস্তুটার সাথে সে জড়াতে চায় না, জেনেবুঝে একটা মেয়ের জীবনে অভিশাপ হয়ে আগমন ঘটানোর কোনো মানে হয়?

স্রোতের হাত পা কাঁপছে। ধারাকে দেখতে গিয়েছিল তার বড় ভাই? এত নিষ্ঠুর কেন নিয়তি? গেল তো গেল, স্রোত যে এত করে সৌহার্দ্যকে বোঝালো হায়ার সাথে নিজের বিয়ের ব্যবস্থা করতে। তাও হলো না। দুনিয়াতে যদি চরম জেদী মহিলার তালিকা করা হয়, লিস্টে এক নম্বরে থাকবেন তার মা শাহরীন চৌধুরী আর নিরীহদের তালিকায় থাকবেন তার বাবা সায়ান চৌধুরী। এখন সৌহার্দ্য কিংবা মা কারো সামনেই যেতে ইচ্ছে করছে না স্রোতের কিন্তু দেরি হয়ে গেলে ধারাকে হারিয়ে ফেলবে সে। যে করেই হোক, ধারাকে নিজের মনের কথাটা জানাতে হবে। উন্মুক্ত গায়ে টি-শার্টটা জড়িয়ে স্রোত এগোলো এডভাইস স্পেশালিস্ট বড় ভাইটার কাছে।

___________________

চা’টুকু মুখে নিয়েই ফেলে দিল ধারা। তিতকুটে স্বাদ হয়েছে। কবে যে একটু রান্নাবান্নাটা শিখতে পারবে সে আল্লাহ মাবুদ জানেন। হায়াটাও আশেপাশে নেই। টই টই করে কোন বনে বাদাড়ে যে ঘুরছে। চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতেই শায়লা আহমেদের তীক্ষ্ম গলার আওয়াজ পেল ধারা।

” আবার তুই নিশীথের মাথা কামিয়ে দিয়েছিস? সমস্যা কী তোর? গুণ্ডা পুষছি বাড়িতে।”

” আহা মা! সবসময় ঐ লাফাঙ্গার সাইড নিবা না তো। ও কী করেছে জানো? ও আমার চুলে চুইংগাম লাগাতে এসেছিল..”

” লাগায়নি তো কিন্তু তুই তো ওর চুলে শ্যাম্পু লাগানোর মতো অবস্থাও রাখিস নাই!”

হায়া কিছু বলার আগেই ধারা বেরিয়ে এলো। হাতের বইটা টেবিলে রেখেই মা-মেয়ের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো।

” ধারা, তুই সর তো! তোর আহ্লাদে এটা বাঁদর হচ্ছে দিনকে দিন।”

” আমার লক্ষ্মী বোনটাকে এভাবে বলো না মা। পিচ্চি একটা মেয়ে! এ বয়সে একটু আধটু দুষ্টুমি তো করবেই।’

” এ বয়স? তিনবার মেট্রিক ফেইল করা মেয়ের আবার বয়স। এবার যদি ও পাশ না করে, তাহলে একটা রিকশাওয়ালা দেখে ওর বিয়ে দিয়ে দেব আমি।”

” মা, বাদ দাও তো এসব। কী যে শুরু করলে তোমরা!”

” দেখ ধারা, ওর নামে যদি আর একটা কমপ্লেইন আসে, আমি ওকে ওর দাদীর কাছে গ্রামে রেখে আসবো। একমাত্র আম্মার শাসনেই এ বাঁদর থেকে মানুষ হবে।”

হায়া মলিন মুখে ছাদের দিকে দৌড় দিল। সবসময় পড়াশোনা নিয়ে শর্ত না দিলে বুঝি হয় না মায়ের? ঐ একটামাত্র বিষয়েই তো হায়া অষ্টরম্ভা। এত গুণ রেখে ঐ পড়াশোনাই সব? বিয়ে যখন দিতেই চায়, দিক না, রিকশাওয়ালার সাথেই দিক কিন্তু তার জন্য আবার একবার পরীক্ষার হলে বসতে হবে কেন? তার উপর দাদীর কাছে পাঠাবে বললো। সে তো আরেক ঝামেলা। হায়ার দাদী হলেন আরেক চিজ। সারাক্ষণ হাতে তিন হাত লম্বা একটা লাঠি নিয়ে ঘোরেন। মুখভর্তি পানের রসে লালরঙা ঠোঁটটা দেখলেই গা ঘিনঘিন করে হায়ার। তার উপর যখন রেগে রক্তচক্ষু মেলে তাকান তখন তো যেন পুরো বাড়ি ধ্বসে পড়ার উপক্রম হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুকে তিনবার ফুঁ দিল হায়া।

” কী রে ফেলটুস? ছাদে দাঁড়িয়ে কি নিজের রিকশাওয়ালা জামাইয়ের কথা ভাবতেছিস?” অপরপাশের ছাদ থেকে নিশীথের গলার আওয়াজ শোনামাত্র জমে থাকা রাগটা উপচে উঠলো হায়ার মনে।

” মাথার চুল হারিয়ে আফসোস হচ্ছে না? এখন কি মাথাটাও ধর থেকে আলাদা হোক সেটা চাচ্ছিস?”

” কিচ্ছু করতে পারবা না জানপাখি। তুমি যদি আমার গায়ে ফুলের টোকাও মারো তবে তোমার আদরের আম্মাজান তোমায় তোমার দজ্জাল দাদীর কাছে রেখে আসবে। কথাটা তিনি আমার আব্বার সামনে শপথ করে গেছেন।”

” ওহ! তুই তাইলে নাটের গুরু। শালা ইতর!”

নিশীথ ক্রমশ হাসতে লাগল। নিশীথের বত্রিশ পাঁটি দাঁতের হাসি দেখে হায়ার রাগ আরো বেড়ে গেল। ছাদের এককোণে ধারার লাগানো লাল গোলাপের টবের দিকে নজর গেল হায়ার। নিশীথের ন্যাড়া মাথায় টব ফাটানোর দুর্দান্ত দৃশ্য মিস করতে চাইল না সে। একমুহূর্তের জন্য দাদীর কাছে পাঠানোর জন্য মায়ের আলটিমেটাম সে ভুলেই গেল। টবটা তুলে ক্ষীপ্র গতিতে নিশীথের দিকে ছুঁড়ে মারলো। নিশীথ চটজলদি মাথা নিচু করলো। টবটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে যাচ্ছে ভেবে চোখ বন্ধ করে অস্ফুট স্বরে ‘ধ্যাত!’ বলে উঠলো হায়া। আচমকা কানের কাছে কোনো এক পুরুষের আত্মচিৎকার ভেসে উঠলো হায়ার কানে। এ কণ্ঠ নিশীথের নয়। চোখ খুলল হায়া। রসগোল্লার মতো বড় বড় দৃষ্টিতে সামনের ছাদে মাথা চেপে ধরা সুদর্শন পুরুষটিকে অপলক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো হায়া। ফর্সা কপালে টবের আঘাতে কপালের এককোণ থেকে রক্ত ঝরছে অবিরত। নিশীথ এ দৃশ্য দেখে ভীত হয়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। হায়া দ্রুত ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ালো।

” এই যে শুনছেন, আমি ইচ্ছে করে মারিনি। আমি তো…”

” আপনার মতো বেদ্দপ মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি। একে তো মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছেন তার উপর স্যরি না বলে সাফাই গাইছেন? আপনার নামে কমপ্লেইন করবো আমি। জাস্ট ওয়েট এণ্ড ওয়াচ।”

কথাটা বলেই ছেলেটা কপালে এক হাত চেপে ছাদ থেকে নেমে গেল। হায়া ছাদে ধপ করে বসে পড়লো। হায়ার মনে এখন একটাই গান বাজছে, “আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া, করিতে পারি না চিৎকার।” পরক্ষণেই নিশীথকে একটা গালি দিয়ে বসলো হায়া, “নিশীথ ন্যাড়া! তোর ঐ ন্যাড়া মাথায় ঘোল না ঢাললে আমিও হায়া আহমেদ না!” নিশীথের চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই চোখে ভেসে উঠলো একজোড়া রক্তিম চোখের ফর্সা সুদর্শন মুখখানি। প্রথমবারের মতো যেন লজ্জা অনুভব হলো তার। আচমকা নিচ থেকে মায়ের চিৎকার শুনতে পেল হায়া।

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।]