স্রোতধারা পর্ব-০২

0
433

স্রোতধারা
দ্বিতীয়_পর্ব
~মিহি

“ধারা, আই লাভ ইউ!” চোখ বন্ধ করে দুহাত প্রসারিত করে কথাটা বলতেই পরপর দুটো থাপ্পড় এসে পড়লো স্রোতের গালে। চোখ কচলে সামনে তাকাতেই শাহরীন চৌধুরীকে দেখে চমকে উঠলো স্রোত। কিছু বুঝতে না পেরে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সে নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে আছে। শাহরীন চৌধুরী তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।

“স্বপ্নে কাকে আই লাভ ইউ বলছিলি?”

“কাউকে না তো মা, ভা..ভাইয়াকে বলছিলাম।”

“সৌহার্দ্যকে? আচ্ছা বুঝলাম। পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস কেন দুপুরবেলা? খেতে আয়।”

স্রোত চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে আদতে এতক্ষণ কী হচ্ছিল। সৌহার্দ্যের সাথে কথা বলার জন্য সৌহার্দ্যের ঘরে গিয়েছিল। সৌহার্দ্য শাওয়ার নিচ্ছিল বিধায় কথা হয়নি। স্রোত নিজের ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করতেই কল্পলোকে ধারার আবির্ভাব ঘটে। শুভ্র সাদা সালোয়ার কামিজে মোহনীয় ধারার অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে হাঁটু গেড়ে বসেছিল স্রোত। দুহাত ক্রমশ প্রসারিত করে জমে থাকা অনুভূতি মুক্ত আকাশে উড়িয়ে চিৎকার করে উঠেছিল ভালোবাসি বলে। অদৃষ্টের কী নিদারুণ পরিহাস! সেই চিৎকার কিনা সাক্ষাৎ তার মায়ের কানে পড়েছে। ভাগ্যিস ধারার নামটা শোনেননি। শুনলে নির্ঘাত বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে যেত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৌহার্দ্যের ঘরের দিকে এগোল স্রোত।

সৌহার্দ্য মাত্র ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতেই চোখ পড়ল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্রোতের দিকে। স্রোতের মুখটা দেখাচ্ছে বাংলার পাঁচের মতন।

“কী রে ডাক্তার সাহেব? মুখ এমন কেন?”

“সব বুঝে শুনে খোঁটা দিবা না তো ভাইয়া! মা যা শুরু করছে! ঘুমের মধ্যে ধারাকে আই লাভ ইউ বলছি আর সেটা কিনা মায়ের কানেই পড়ছে।”

“ঘুমের মধ্যে না বলে সামনাসামনি বললেই হয়।”

“আর তারপর? ধারা আমার হাড়গুলো ভেঙে ব্যান্ডেজ করে পার্সেল করে পাঠায়ে দিবে।”

“এত ভয় পেলে কী আর প্রেম করা যায়?”

“তুমি এমনভাবে বলছো যেন ডজনখানেক প্রেম করছো!”

“দেখ, ধারাকে মনের কথাটা বলে দে। তারপর ওকে বোঝা যে হায়াকে সবসময় চোখের সামনে রাখলেই যে হায়া ভালো থাকবে তা তো নয়। আল্লাহ সবার জন্য কাউকে না কাউকে ঠিক করেই রেখেছেন। হায়ার ভাগ্যে যে আছে, সে-ই তো হায়ার জন্য উপযুক্ত, তাই না? হায়াকে জোর করে নিজের কাছে রেখে কি ও হায়াকে ভালো রাখতে পারবে?”

“এটা একদম ঠিক বলছো। এটাই করবো আমি। এখন আপাতত নিচে চলো। মা খেতে ডেকেছে।”

“যা, আসছি।”

স্রোত সায় দিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ির দিকে এগোল। সৌহার্দ্য কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। স্রোত যে তাকে খেতে ডেকেছে তাও ভুলে গেল ক্ষণিকের মাঝে।

___________________________________________

“মুখ কালো করে রেখেছিস কী জন্য? আবার কী অকাজ করে আসলি?”

“সবসময় সন্দেহ করো কেন মা? চিৎকার করছিলে কেন?”

“ফ্রিজে আইসক্রিম ছিল। কী করেছিস?”

“কী আবার করবো? খেয়ে ফেলেছি।”

“কীহ! তোর ঠাণ্ডা লেগেছে! ডাক্তার বলেছে ফ্রিজের জিনিসে হাত না দিতে আর তুই পুরো বাটি আইসক্রিম শেষ করলি? এখন সর্দিতে মরে গেলেও আমি আর ওষুধ আনাবো না। সর সামনে থাকে।”

শায়লা আহমেদ সরে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল হায়া। যাক! ছেলেটা এখনো কমপ্লেইন করেনি কিন্তু করতে কতক্ষণ? ছেলেটাকে আটকাতে হবে যে করেই হোক। হায়া ঘরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পায়চারি করতে লাগলো।

ধারার ফোনে সৌহার্দ্যের প্রোফাইল অন করা। সৌহার্দ্যকে বিয়ে করা-না করায় বিশেষ আগ্রহ নেই ধারার তবে সৌহার্দ্যের ছোট ভাই আছে। হায়ার জন্য পার্ফেক্ট একজন বর যদি হয় ছেলেটা তবে সৌহার্দ্যকে বিয়ে করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হায়ার রেজাল্ট। মেয়েটা যে আরো কবে পড়াশোনায় একটু মনোযোগ দেবে ভাবতে ভাবতে ধারার এস.এস.সি, এইচ.এস.সি কমপ্লিট হয়ে গেল। সৌহার্দ্যের চিন্তা বাদ দিল ধারা। হায়ার বিয়ের কথা ভাবার চেয়ে ভালো ওকে পড়াশোনার দিকে একটু আগ্রহী করে তোলা। ফোন রাখতে যাবে এমন সময় ধারার ফোনে একটা টেক্সট আসলো। অপরিচিত নম্বর থেকে এসেছে টেক্সটটা।

“আপনার সাথে অতীব প্রয়োজনীয় আলাপ আছে। অনুগ্রহপূর্বক আগামীকাল ক্যান্টিনে এক কাপ কফি অফার করতে পারি কি?”

টেক্সটটা চেক করে রেখে দিল ধারা। এ ধরনের টেক্সট সচরাচর কেউ করে না। যেহেতু ক্যান্টিনের কথা বলেছে অর্থাৎ ক্যাম্পাসের কেউ হয়তো টেক্সট করেছে। ট্রু কলারে নম্বরটা চেক করে দেখলো ‘স্রোত চৌধুরী’ নাম লেখা। কিছুটা বিস্মিত হলো ধারা। সে যতদূর জানে সৌহার্দ্যের ছোট ভাইয়ের নাম স্রোত। স্রোত কেন তাকে দেখা করতে ডেকেছে? প্রশ্নটা মাথায় ঘুরতে লাগলো ধারার।

_______________________

“বলিস কী? তোকে মারলো আবার স্যরিও বলেনি?”

“এতক্ষণ ধরে কী গীত গাচ্ছিলাম? বেশি বকবক না করে আইসপ্যাকটা লাগাতে দে।”

“দেখ ধ্রুব, মেয়েটা কিন্তু যথেষ্ট ডেঞ্জারাস নাহলে সরাসরি টব ছুঁড়ে মারতে পারে কেউ?”

“ভাই, এখন এসব বাদ দে। এক মাসের জন্য তোর এখানে আসছি। একটু শান্তিতে থাকবো তা না উল্টো আসতে না আসতেই কপাল ফাটলো!”

“আরে, আমিও তো মাত্রই শিফট করেছি এখানে। মেয়েটাকে চিনলে কমপ্লেইন করে আসতাম।”

“বাদ দে। দরকার নেই।”

আইসপ্যাকটা লাগাতে লাগাতে ধ্রুব মেয়েটার মুখ মনে করার চেষ্টা করলো। বাচ্চা একটা মেয়ে তবে পোশাক ছেলেদের মতো পড়ে। চেহারা শ্যামবর্ণের, এর বেশি আর কিছু মনে নেই ধ্রুবর। কপালের ক্ষত ফুলে লাল হয়ে এসেছে। যদিও রাহাত মলম লাগিয়েছে কিন্তু ব্যথা এখনো কমেনি। বাবার সাথে ঝগড়া করে একমাসের জন্য বন্ধু রাহাতের ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে ধ্রুব যেন বাবা কিছু জানতে না পারে। ধ্রুবর বাবা স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ। বেশ প্রভাবশালী হওয়ায় সারাক্ষণ ধ্রুবকে নজরবন্দি রাখতে চান। মূলত এই বন্দিত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে রাহাতের ফ্ল্যাটে লুকিয়েছে সে।

“ধ্রুব, আমার তো নতুন নম্বর। আমার এখন একটু বাইরে কাজ আছে। আমার নম্বরটা সেভ করে রাখ।”

“হুম বল।”

রাহাত একে একে এগারোটা ডিজিট বললো। সবশেষে বললো ‘নয়’, ধ্রুব কীপ্যাডে নয় না তুলে ভুল করে ছয় তুলে সেভ করলো। রাহাত ধ্রুবকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল। ধ্রুব ভুলেও বুঝলো না নম্বরটা ভুল তুলে সে কতবড় বিপদ ঘটিয়ে ফেলেছে।

সন্ধ্যা থেকে হায়ার সর্দি মারাত্মক বেড়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিনবার হাঁচি দিয়ে ফেলেছে সে। ধারা ওষুধ খাইয়ে হায়ার মাথার কাছে বসে পড়ছে। ফোনের শব্দে ধ্যান কাটলো ধারার। স্রোতের নম্বরটা থেকে আবারো টেক্সট এসেছে।

“প্রত্যুত্তর করাটা এত কঠিন না মহাশয়া, আপনি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দিতে পারেন আমায়।”

স্রোতের কথাবার্তা সুবিধার ঠেকছে না ধারার কাছে। সৌহার্দ্যের পরিবার থেকে কি আদৌ কোন ফিডব্যাক জানিয়েছে। মাকে ডাকলো সে।

“মা, সৌহার্দ্যের পরিবার কি বিয়ে সম্পর্কে কিছু বলেছে?”

“হুম। সৌহার্দ্যের মা ফোন করেছিল। সৌহার্দ্য নাকি এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত না। কেন কী হয়েছে?”

“কিছু না।”

শায়লা আহমেদ চলে যেতেই খটকাটা বাড়ল ধারার। স্রোত কি কোনভাবে তার প্রতি ইন্টারেস্টেড? স্রোত তো তার সমবয়সী, একসাথে পড়ছে প্রায় দু’বছর যাবৎ। ইন্টারেস্টেড হলে তো আগেই বলে দিত। অবশ্য আগে কখনো স্রোতকে সেভাবে লক্ষ করেনি সে। মেডিকেল লাইফে পড়াশোনার বাইরে অতকিছু দেখার-চেনার সময় আছে নাকি? “ওভারথিংক করছি অযথা! নরমালি হয়তো কোন কথা বলবে।” ভেবে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিল সে।

রাতে হায়ার অসুস্থতা বাড়লো। ক্রমাগত শ্বাস ওঠা-নামা করতে লাগলো। ধারা একমুহূর্তের জন্য সরলো না হায়ার পাশে থেকে। রাতটুকু জেগে বসে রইল হায়ার পাশে। শায়লা আহমেদ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলেন সবটা। চোখের কোণের অশ্রুকণা মুছে ভাবলেন, “আল্লাহ না করুক হায়া কখনো নিজের সত্যিটা জানুক। দু’বোনের মাঝে যেন কোনরকম বিপদ না আসে। যে সত্যি আমার দু’মেয়ের জীবনে দুঃখ বয়ে আনতে পারে, সে সত্যি যেন আজীবন বালির নিচে চাপা পড়ে থাকে।”

চলবে…