স্রোতধারা পর্ব-০৮

0
298

স্রোতধারা
অষ্টম_পর্ব
~মিহি

মায়ের আচরণে স্রোত বিস্মিত। সবকিছু যেন স্বাভাবিক এমনভাবেই তার মা কথাবার্তা বলছেন কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম যেন স্রোত। স্রোতের সাথে কোনো কথাই বলছেন না তিনি। এমনকি স্রোত দুবার ডাকলেও তিনি তা অগ্রাহ্য করে গেলেন। এ মুহূর্তে স্রোতের বেশ রাগ হচ্ছে। কী এমন ভুল করেছে সে যার জন্য এভাবে তাকে অবহেলিত করা হচ্ছে? ভালোবাসাটা তো অপরাধ না, তার চেয়েও বড় কথা স্রোত তো আর সম্পর্কে জড়ায়নি। সে শুধু সম্পর্কটাকে পূর্ণতা দিতে চেয়েছে। এতে এত সমস্যা দাঁড় করানোর কী আছে? মানুষ সুখী থাকার জন্যই তো বিয়ে করতে চায়। হুট করে অপরিচিত কাউকে বিয়ে করার চেয়ে যাকে ভালোবাসি তাকে বিয়ে করলে ক্ষতি কী? প্রশ্নটা মাথায় আসলেও মাকে করার সাহস পেল না সে।

খেতে বসে সবাইকে সার্ভ করলেও স্রোতের প্লেটের দিকে ঘুণাক্ষরেও তাকালেন না শাহরীন চৌধুরী। স্রোত রাগ করে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। স্রোতের চলে যাওয়া দেখে শাহরীন মুখ টিপে হাসলেন। সৌহার্দ্য কিছুটা বিমর্ষ হলো।

“মা, তুমি যে এইভাবে স্রোতকে জ্বালাচ্ছো, ও যখন জানবে তখন কিন্তু বড্ড রেগে যাবে।”

“ওর ব্যবহার আমি ওকেই রিটার্ন দিচ্ছি। ও নিজের ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল আমাকে? যাই হোক, কাল তো শুক্রবার। কালই আমি ধারার বাসায় যাবো।”

“ওনাদের আগে থেকে কল করে জানালে ভালো হত না?”

“সরাসরি কথা বলাটাই ভালো। কল করতে গেলে আমার অকওয়ার্ড লাগবে অনেকটা। ফোনে এসব বলা যায় না।”

সৌহার্দ্য চুপ হয়ে গেল। স্রোত বাদে তারা তিনজন আবারো একবার ধারার বাড়িতে যাবেন। তাহলে নিশ্চয়ই সৌহার্দ্য হায়ার মুখোমুখি হবে আরেকবার। ভেবে খানিকটা বিব্রত অনুভব করলো সে। এ বিব্রত অনুভবের কারণটা ঠিক মাথায় আসলো না তার। আনমনে আরো কিছুক্ষণ খাবার নেড়ে চেড়ে উঠে গেল।

_____________

ধ্রুব এ নিয়ে পাঁচটা সিগারেট ধরালো। রাহাত তিনবার মানা করতে এসে কাশতে কাশতে ধ্রুবর ঝাড়ি খেয়ে চলে গেছে। ধ্রুবর রক্তিম চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস হয়নি তার। বিকেলবেলা ধ্রুবর বাবা এসেছিলেন এখানে। তিনি এখানকার এড্রেস কী করে পেলেন ধ্রুব জানে না। অবশ্য ক্ষমতার চূড়ায় থাকা মানুষদের জন্য এসব তো স্বাভাবিক ব্যাপার-স্যাপার। তিনি আসাতে ধ্রুব ভ্রুক্ষেপ করেনি তবে তিনি ধ্রুবকে একরকম থ্রেট দিয়ে গেছেন। যদি ধ্রুব সাতদিনের মধ্যে বাড়িতে না ফেরে তবে তিনি ধ্রুবর সমস্ত খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেবেন। ধ্রুব এতে বিন্দুমাত্র রাগ করেনি বরং সে খুশি হয়েছে। সে সবসময় চেয়েছিল স্বনির্ভরশীল হতে কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। তিনি ধ্রুবকে তার মায়ের সাথে দেখা করতে দেবেন না। এ কাজটা তিনি সবসময় করেন। ধ্রুব কোনো কাজে না বললেও তিনি নিজের স্ত্রীকে ধ্রুবর থেকে আড়াল করেন। মাকে ফিরে পাওয়ার জন্য ধ্রুব বাধ্য হয় বাবার কথা শুনতে। ধ্রুবর বাবা জয়নাল আবেদীনের দীর্ঘদিনের একটা স্মাগলিংয়ের ব্যবসা আছে যা তিনি চালান লোকচক্ষুর আড়ালে। এখন তিনি চান ধ্রুবকে সে ব্যবসার দায়িত্ব অর্পণ করতে। ধ্রুব তা নিতে নারাজ। এ বিরোধ থেকেই ধ্রুব ঘর ছেড়ে বন্ধুর কাছে এসেছিল। এতকিছু রাহাত জানতো না এতদিন কিন্তু আজ জানলো সবটা। জেনেও অবশ্য ধ্রুবর বাবার বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস তার নেই, সুতরাং তার জানা কিংবা না জানা একই ব্যাপার।

পাঁচ নম্বর সিগারেটটা শেষ করল ধ্রুব। জীবনে অনেকটা এগিয়ে এসেছে সে। এখন আবার এক পা পিছিয়ে যাওয়া মানে নিজের সাথে সাথে সমাজের কতগুলো মানুষের জীবনও নষ্ট করা। বাড়তি ভাবনাগুলোকে বাক্সে ভরলো সে। টিউশনির বিষয়টা মাথায় আসতেই সামান্য চিন্তামুক্ত দেখালো তাকে। মনের ভার হালকা কমেছে এখন ধ্রুবর। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই মায়ের মুখশ্রীটা মানসপটে জ্বলজ্বল করে উঠলো। ধ্রুবর চোখের কোণা ভরে উঠলো নোনাজলে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে সে জলটুকু মুছে চোখ বুঁজল সে।

______________

“আপা, ঘুমিয়েছো?”

“না, পড়ছিলাম। কিছু বলবি?”

“তুমি সবসময় বলতে আমার জন্য নাকি রাজপুত্র আসবে। সে রাজপুত্রের কি ডানা থাকবে আপু?”

“পাগলী! ডানা থাকবে না তবে সে রাজপুত্র হবে। রাজপুত্রের মতো দ্যুতি ছড়াবে তার মুখখানি, তোকে রাজরানির মতো করে রাখবে সে, কোনো দুঃখ তোকে স্পর্শ করতে পারবে না এতটা ভালোবাসবে সে তোকে।”

“এমন মানুষ কি আদৌ আমার ভাগ্যে আছে আপা?”

“আছে আছে। তোকে খুব বেশি ভালোবাসার একজন মানুষ তোর জীবনে ঠিকই আসবে।”

“আমার এমন মনে হয়না আপু। ভালোবাসা হয়তো আমি পাবো না।”

“উফ! আজগুবি কথা শুরু করেছিস কেন বল তো।”

“জানিনা। সন্ধ্যায় স্বপ্নে দেখলাম একজন সুন্দর ভদ্রলোক আমায় এসে বললেন আমি নাকি নকল রাজকন্যা। নকল রাজকন্যারা তো রাজপুত্র পায় না। তাই আমিও রাজপুত্রকে পাবো না।”

হায়ার কথায় ধারার মুখটা বিবর্ণ হয়ে এলো। হায়া নিজেও জানে না সে কত বড় একটা কথা বলে ফেলেছে। ধারা হায়াকে চুপ করিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। হায়া ভাবলো তার বোন বোধহয় বিরক্ত হয়েছে। সে নিজেও পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। ধারা চোখ বন্ধ করে হায়ার বলা বাক্যটা আওড়াচ্ছে। ‘নকল রাজকন্যা’ শব্দটা বারবার ধারার কানের কাছে সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে।

আজকের সকালটা অন্যদিনের তুলনায় অন্যরকম। শায়লা আহমেদ উঠেছেন বেশ বেলা করে। আটটার পর তিনি নাস্তা বানিয়েছেন। ধারা আর হায়াও উঠেছে দেরিতে। ধারার বাবা নওফেল আহমেদ বেশ ভালো মেজাজে আছেন। নয়টায় খাওয়া দাওয়া শেষ করে পরিবারের সবাই একত্র হয়েছে। এমন সময় দরজায় বেল বেজে উঠলো। হায়া বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলেই একটা বড়সড় ধাক্কাও খেল।দরজায় বাইরে ধ্রুব দাঁড়িয়ে। ধ্রুবর গায়ে ইন করা শার্ট, ফর্মাল লুক। হায়াকে দেখে ধ্রুবও কিছুটা অবাক হয়েছে। হায়াকে পড়াতে আসতে হবে তা কোনভাবেই মাথায় আনেনি সে।

“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

“আঙ্কেল ডেকেছে।”

“খবরদার মিথ্যা বলবেন….”

“কে এসেছে হায়া?” ঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন নওফেল সাহেব। ধ্রুব বেশ উচ্চস্বরেই সালাম দিল। নওফেল সাহেব সালামের জবাব নিয়ে বললেন, “ছেলেটাকে এভাবে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন? ভেতরে আসতে দে।” ধ্রুব ভেতরে ঢুকল। হায়ার মুখে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ বাসা বেঁধেছে। সে ধরেই নিয়েছে ধ্রুব এখানে তার কমপ্লেইন করার জন্যই এসেছে। বাবা ধ্রুবর সাথে ভেতরের ঘরে কথা বলছেন দেখে হায়াও সেদিকে উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করল। লাভ হলো না। তারা কী নিয়ে কথা বলছেন তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলো না হায়া। উল্টো টেনশন আর ওভারথিংকিং করে করে গা ঘামিয়ে ফেলল। আধঘন্টার আলাপচারিতা শেষ করে নওফেল আহমেদ হায়াকে ডাক দিলেন। বাবার রুক্ষ স্বরেদ ডাক শুনে হায়ার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কোনরকম বাবার সামনে দাঁড়ালো সে। নওফেল আহমেদ বলতে শুরু করলেন,

“সামনেই তোমার পরীক্ষা হায়া। মান সম্মান যেটুকু আছে, রক্ষা করার চেষ্টা করো। ধ্রুব কাল থেকে তোমায় রেগুলার কেমিস্ট্রি পড়াবে। যা যা সমস্যা, ওর থেকে বুঝে নিবা। আর যাই হোক, পাশ মার্কসটা যেন ওঠে।”

হায়া একবার নিজের বাবার দিকে তাকাচ্ছে, একবার ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর বিভ্রান্ত চেহারা বদলে এখন ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি স্পন্দন গতির দোলকের ন্যায় দুলছে। হায়ার ইচ্ছে হচ্ছে এক ঘুষি দিয়ে ধ্রুবর নাক ফাটিয়ে ফেলতে, দু-চারটে সামনের পাটির দাঁত ফেলে দিতে পারলে আরো ভালো হত। তখন আর হাসার সাহস পেত না বদটা। বাবার দিকে তাকাচ্ছে হায়া বারবার। পরিস্থিতি বিচারে এ মুহূর্তে তার মনে একটাই গান বেজে চলেছে, “বাচ্চে কী জান লোগে কিয়া?”

চলবে….