স্রোতস্বিনী পর্ব-০২

0
146

#স্রোতস্বিনী
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পার্ট_দুই

বাসস্ট্যান্ডে এসে গাড়ি থামতেই স্রোত এলোমেলোহীন ভাবে দৌড়াতে লাগল। কাঁধে ঝুলানো গিটারটা বার বার পড়ে যাচ্ছে। তবুও স্রোতের সেদিকে খেয়াল নেই। ও চারদিকে কিছু একটা পাগলের মতো খুঁজে চলেছে। কিন্তু পাচ্ছে না। দৌড়ানোর এক পর্যায় কারোর সাথে ধাক্কা লেগে স্রোত মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। হাটুসহ বেশ কয়েকটা জায়গায় ব্যাথা পেলেও মুখ দিয়ে আর্তনাদের পরিবর্তে “ধারা” নামটা বের হয়ে আসল। স্রোতের বন্ধুরা স্রোতের সাথে দৌড়ে আসছিল এতক্ষণ। স্রোত পড়ে যেতেই ওরা সবাই তাড়াতাড়ি এসে স্রোতকে টেনে তুলল। মাহিদ আর অয়ন মিলে স্রোতের গায়ে লেগে থাকা ময়লা গুলো ঝেড়ে দিতে লাগল। মাহিদ ধমকের স্বরে বলে উঠল,
“তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? কি করছিলি তুই? এমন পাগলের মতো ছুটছিলি কেন?”
মাহিদের কথা শেষ হতেই অয়ন চিন্তিত স্বরে বলতে লাগল,
“স্রোত, তুই কাকে খোঁজার জন্য এমন করে ছুটছিলি? চোখে মুখে এমন বিষন্নতা কেন তোর? কি হয়েছে আমাদের বল? বাসার সবাই ঠিক আছে?”
অয়নের কথা শেষ হতে না হতেই মালিহা স্রোতের হাতটা টেনে নিয়ে কান্নারত স্বরে বলে উঠল,
“স্রোত তোর হাতটা কতখানি কে’টে গেছে। কি করছিস তুই?”
ওরা তিনজন যে এত কথা বলছে স্রোতের সেদিকে খেয়াল নেই। ও অসহায় হয়ে চারদিকে কিছু খুঁজে চলেছে। মাহিদ স্রোতকে অন্যমনস্ক দেখে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠল,
“কিরে, তোর কি কথা কানে যায়না?”
এবার স্রোতের হুঁশ ফিরে আসল। আমতা আমতা করে বলল,
“হ্যাঁ, কি বলছিস? বল। শুনছি।”
মালিহা এবার খুব রেগে গেল। কড়া স্বরে বলল,
“একটা থাপ্পড় মা’রব তোকে এবার। কি হয়েছে তোর? কি শুরু করছিস এসব? তোর হাতটা যে কে’টে গেছে সেদিকে তোর কোনো খেয়াল আছে? কাকে খুঁজে চলেছিস তুই?”
স্রোতের বুকের ভেতরটা কেমন চুরমার হয়ে যাচ্ছে। অজানা কষ্টে বুকটা কেঁপে উঠছে। হাহাকার করছে ভেতরটা। শারীরিক যন্ত্রণার চাইতে মানসিক যন্ত্রণা বেশি হচ্ছে। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। বার বার চোখের সামনে ধারার মুখটা ভেসে উঠছে। স্রোতকে এমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অয়ন জোরে বলে উঠল,
“স্রোত, তুই কি শুনছিস? কি হয়েছে তোর?”
স্রোত ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠে বলল,
“কিছুনা। চল।”
বলেই হাঁটা ধরতেই মাহিদ স্রোতের শার্টের হাতা টেনে ধরে বলল,
“চল মানে? তোকে যে আমরা এতক্ষণ এতগুলো প্রশ্ন করলাম, সেগুলোর উত্তর না দেওয়া অব্দি এখান থেকে এক পা নড়ব না আমরা।”
স্রোত কিছু না বলে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। শান্ত স্বরে বলল,
“আয় বলছি।”
বলে হাঁটা শুরু করল। ক্ষত জায়গা দিয়ে হয়ত রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সেদিকে খেয়াল নেই ওর। হাটুতেও জ্বলছে খুব। ছিলে গেছে বোধহয়? বুকের ভেতর যে ক্ষতের ঝড় বইছে, তার চেয়ে বড় ক্ষত এই মুহূর্তে স্রোতের কাছে আর কিছু নেই। মাহিদ, অয়ন আর মালিহা স্রোতের পাশে হাঁটতে শুরু করল। স্রোত কিছুক্ষণ থেমে বাসে ধারার সাথে পরিচয় হওয়ার ঘটনা সম্পূর্ণ বলতে শুরু করল। পুরো ঘটনা শুনে মাহিদ অবাক স্বরে প্রশ্ন করল,
“এক দেখায়, অচেনা একটা মেয়েকে তুই ভালোবেসে ফেললি? আবার মেয়েটাকে সোজা বিয়ের প্রোপোজাল দিয়ে দিলি? আরে বাহ! কি দারুন বুদ্ধি তোর! আসলেই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।”
মাহিদের কথা শুনে মালিহা মাহিদের পিঠে একটা দুম করে কিল বসিয়ে দিল। বলল,
“তোর এই পরিস্থিতিতে মজা করার ইচ্ছা জাগছে? আর একবার এই বিষয়টা নিয়ে মজা করে দেখ, তোর কপালে শনি আছে।”
মালিহার কথা শুনে মাহিদ একদম চুপ হয়ে গেল। কারণ “রাগী ম্যাডাম” একবার রেগে গেলে ও শেষ। মালিহা একটু থেমে স্রোতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“সব বুঝলাম। কিন্তু মেয়েটা কোথায়, স্রোত? তোর পাশের সিট তো খালি দেখলাম নামার সময়।”
এবার স্রোত থেমে গেল। অসহায় স্বরে জবাব দিল,
“জানিনা।”
স্রোতের অসহায় স্বরে “জানিনা” শব্দটার গভীরতা মালিহা ঠিক বুঝল। অয়ন সব শুনে ভাবুক স্বরে প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা, মেয়েটা দেখতে কেমন স্রোত? ”
স্রোতের হঠাৎ কি হলো কে জানে? ফুটপাতে বসে পড়ল। সন্ধ্যা নেমে আসছে চারদিকে। ল্যাম্পপোস্টের নিচে ওরা চারজন বসে আছে। স্রোতকে চুপ থাকতে দেখে অয়ন আবার প্রশ্ন করল,
“স্রোত, ধারা দেখতে কেমন। আর কি ড্রেস পড়ে ছিল?”
স্রোত ধারার বর্ণনা শেষ করেই, আনমনে বলে উঠল,
“আমার স্রোতস্বিনী। স্রোতের জীবনে ভালোবাসার জোয়ার নিয়ে এসে, ভাটায় হারিয়ে গেল।”
স্রোতের কথা শুনে “ওরা” তিনজন একসাথে বলে উঠল,
” আমার স্রোতস্বিনী। বাহ! বাহ!”
ওদের চ্যাঁচানো শুনে স্রোত গিটারটাকে সুন্দর করে কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল,
“এখানেই থাক তোরা? আমি গেলাম।”
বলেই হাঁটা শুরু করল স্রোত। স্রোত পেশায় একজন সিঙ্গার। স্রোতের একটা ছোটখাটো ব্যান্ড আছে। নাম “স্রোতস্বিনী”। ওরা চারজন মিলে আজ একটা গানের প্রোগ্রামের জন্য চট্রগ্রাম এসেছে। বাসে ধারা আর স্রোতের সিট পাশাপাশি পড়েছিল। ধারা ক্যান্সারে আক্রান্ত। এটা লাস্ট স্টেজ। ধারা বড়জোর এই পৃথিবীতে আর ৬মাস আছে। বাকিটা আল্লাহর হাতে। ধারার সাথে পুরোটা রাস্তা কথা বলতে বলতে কখন যে, স্রোত ঘুমিয়ে গেছে নিজেও জানেনা। আর যখন চোখ খুলল তখন ধারাকে হারিয়ে ফেলেছে। ধারাকে হারিয়ে ফেলেছে কথাটা মনে পড়তেই স্রোতের শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে আসছে। ওরা চারজন আগে থেকেই হোটেল বুকিং করে রেখেছিল। বাসস্ট্যান্ড থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। সারাদিন জার্নি করে সবাই ক্লান্ত হয়ে গেছে। হোটেলে ফিরে সবাই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিয়ে যে যার মতো রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত। একমাত্র স্রোত সেই যে রুমে ঢুকেছে। এখনো বের হয়নি। রাতের খাবারটাও খেতে যায়নি। ওরা তিনজন মিলে অনেক ডাকাডাকি করে গেছে। কিন্তু, স্রোত ওদের বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। বেলকনিতে বসে বসে গিটারে সুর তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজ কেন যেন গিটারটাও ওর সাথে বেঈমানী করছে। কিছুতেই সুর উঠাতে পারছেনা। অথচ কালকের প্রোগ্রামটা ওদের জন্য খুব দামী। স্রোত বার কয়েক বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। তারপর গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করল,
“তবে তাই যদি হয়,
করি না-কো ভয়
জানি আধার রাত, ঘনিয়ে হবে সূর্যোদয়।
আমি ভেবে নিলাম
তুমি সেই লাল গোলাপ
যারে নিরন্তর পাহারা দেয় এক কাটার বাগান।”
এইটুক গেয়েই থেমে গেলো। কেন যেন গলা আটকে আসছে। ধারার কথা বলার ধরণ, হাসি সবটা চোখে চোখে ভাসছে। স্রোতের বুকে অসহ্যকর ব্যাথা শুরু হয়েছে। গিটারটাকে সাইডে রেখে উঠে দাঁড়াল। বেলকনির গ্রীল গুলো দুই হাতে আকঁড়ে ধরে, নিজে নিজেই বলে উঠল,
“স্রোতস্বিনী। তুমি আমার স্রোতস্বিনী। স্রোতের ধারা। তোমাকে আমি এত সহজে হারিয়ে যেতে দেই কি করে বলো? তুমি যদি পৃথিবীতে একদিন ও থাকো, তবুও ওই একদিন তোমাকে স্রোতের সাথে থাকতে হবে। স্রোতস্বিনী হয়ে ভালোবাসার স্রোতে হারাতে হবে। আমাকে একদিনের জন্য হলেও তোমাকে ভালোবাসতে হবে। ভালোবাসতেই হবে। তোমাকে আমি ঠিক খুঁজে বের করব। আমার বুকে ক্ষত করে তুমি হারিয়ে যাবে ভাবছো? নো ওয়ে।”


” মেয়েটার নাম কি? আপনারা কি উনার বাড়ির লোক?”
নার্সের কথায় একজন ভদ্রলোক বলে উঠল,
“এই মেয়েটাকে আমরা চিনিনা। মেয়েটার হঠাৎ রাস্তায় ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও আমরা জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে পারিনি। তাই হসপিটালে নিয়ে এসেছি।”
ভদ্রলোকের কথা শুনে নার্সটি চিন্তিত স্বরে বলল,
“মেয়েটা ক্যান্সারের রুগী। উনার অবস্থা ভালো না। উনার দ্রুত ভালো চিকিৎসা প্রয়োজন। আপনারা কেউ কি উনাকে চিনেন না?”

#চলবে