স্রোতস্বিনী পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
232

#স্রোতস্বিনী
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পার্ট_শেষ (প্রথমাংশ)

“আপনাকে একটা ছোট্ট রিকুয়েষ্ট করব, স্রোত?”
ধারা অসহায় স্বরে কথাটা বলতেই স্রোত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,
“হ্যাঁ, বলুন।”
ধারা কিছুক্ষণ থামল। শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। স্রোত ধারার বেডের পাশে বসে আছে। ধারা নিজের মুখের অক্সিজেন মাস্কটা খুলে নিতেই, স্রোত ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল,
“কী করছেন? অক্সিজেন মাস্কটা কেন খুলছেন? আপনার কষ্ট হবে তো। আপনি এভাবেই কথা বলুন আমি শুনতে পাচ্ছি। বুঝতেও পাচ্ছি৷”
স্রোতের চিন্তিত মুখশ্রী দেখে ধারার ঠোঁটের কোনে এক টুকরো হাসির ঝলক দেখা দিল। ধারা অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“আমি ঠিক আছি, স্রোত। চিন্তা করবেন না।”
বলে থামল একটু। তারপর একটু জোরে শ্বাস নিয়ে, বলল,
“আমাকে একটু তুলে বসিয়ে দিবেন, স্রোত? আসলে অনেকদিন যাবৎ শুয়ে আছি তো। এখন আর ভালো লাগছে না।”
ধারার কথা শুনে স্রোত একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্ন করল,
“আপনি বসে থাকতে পারবেন?”
ধারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতেই, স্রোত ধারাকে তুলে খুব সাবধানে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। বসানো শেষে ধারার হাত থেকে হাতটা সরিয়ে আনার চেষ্টা করতেই, ধারা আঁকড়ে ধরল। বলল,
“সরিয়ে নিবেন না, প্লিজ। কিছুক্ষণ হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবেন, প্লিজ। ভালো লাগছে এভাবে।”
ধারার কথা শুনে স্রোতের বুকের ভেতরটায় হাহাকার শুরু হলো। এই হাতটাকেই তো আঁকতে ধরতে চাইছিল সারাজীবনের জন্য। কিন্তু উপরওয়ালা সবার জীবনে কিছু একটা শূন্য রাখেই। হয়ত ভালোর জন্য। কিন্তু সেই ভালোটা সবাই বুঝতে পারেনা। ধারা কিছুক্ষণ স্রোতের দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইল। স্রোত তা খেয়াল করেছে ঠিকি কিন্তু ধারার চোখে চোখ রাখার সাহস পাচ্ছে না। ওই চোখে তাকালে যে, নিজেকে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারবে না। ধারা এখন ঢাকা ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি। সেদিনের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ডাক্তাররা সোজা জানিয়ে দিয়েছে তাদের হাতে আর কিছু নেই৷ ধারার হাতে বেশি সময় নেই তা স্রোত খুব ভালো করেই জানে। এতদিন ধরে ধারার বেঁচে থাকার লড়াইয়ে স্রোত প্রতিটা সময় ওর পাশে ছিল। ধারা নিজেও জানে ওর হাতে বেশি সময় নেই। তবুও মেয়েটার মনে বিন্দু মাত্র আপেক্ষ নেই। মেয়েটা এখনো খুব শক্ত। অনেকক্ষণ যাবৎ দুজনের মাঝে নিরবতার ঝড় চলছে। সব নিরবতা ভেঙে স্রোত বলে উঠল,
“স্রোতস্বিনী…”
‘স্রোতস্বিনী’ ডাকটা শুনেই ধারা কেঁপে উঠল। কম্পিত স্বরে শুধাল,
“সারাজীবন আপনার মুখে স্রোতস্বিনী ডাকটা শুনতে না পারার আফসোস নিয়ে আমাকে দুনিয়া ছাড়তে হবে।”
স্রোত সাথে সাথে ধারার মুখ চেপে ধরল। রাগী স্বরে বলল,
“এইসব একদম বলবেন না। একদম না। আপনার কিছু হবে না। আপনি একদম সুস্থ হয়ে যাবেন।”
ধারা হাসল। স্রোতের চোখে চোখ রেখে বলল,
“মিথ্যা আশ্বাস কেন দিচ্ছেন, স্রোত?”
স্রোত হাতটা সরিয়ে নিল ধারার মুখ থেকে। চোখ নামিয়ে নিল। স্রোত চোখ নামিয়ে নিতেই ধারা বলল,
“এখন চোখ কেন নামিয়ে নিলেন, স্রোত? আমি জানি আমার হাতে সময় নেই। হয়ত আপনাদের মাঝে আমি কয়েকদিন, কয়েকঘন্টা অথবা কয়েক মিনিট আছি। আমি যেটুকু সময় আপনাদের মাঝে আছি, সেইটুকু সময় না হয় আমাকে আপনি ভালোবাসবেন। ভরসা দিবেন। আমার ছোট ছোট কিছু ইচ্ছা পূরণ করবেন। আপনি তো আমাকে স্রোতস্বিনী ডাকেন। তাহলে আপনার স্রোতস্বিনীকে শেষ সময় একটু ভালোবাসতে পারবেন না? শেষ নিঃশ্বাস অব্দি পাশে থাকতে পারবেন না, স্রোত?
স্রোতের চোখের কোনে পানি টলমল করছে। যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়বে। কিন্তু না! স্রোত কাঁদবে না। এই মুহূর্তে কিছুতেই কাঁদবে না। স্রোত কাঁদলে যে ধারার মনোবল ভেঙে যাবে। মেয়েটা ছোট থেকে একা লড়াই করে বড় হয়েছে। উপরওয়ালা হয়ত চেয়েছে, মেয়েটার জীবনের শেষ লড়াইয়ে কেউ একজন তার পাশে থাকুক। তাকে আগলে রাখুক। স্রোত মনে মনে বলে উঠল,
” যাই হয়ে যাক না কেন, আমাকে শক্ত থাকতেই হবে। ধারাকে আগলে রাখতেই হবে। ওর সব অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো আমি পূর্ণ করব।”
স্রোতকে চুপ থাকতে দেখে ধারা অসহায় স্বরে বলে উঠল,
“কী হলো স্রোত বলুন আমাকে ভালোবাসতে পারবেন না?”
স্রোত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করল। আলতো হাতে ধারার দুইগালে হাত রাখল। চোখে চোখ রেখে বলতে লাগল,
“আপনাকে আমি সেদিনেই ভালোবেসে ফেলেছি, স্রোতস্বিনী। আমি আপনার সব সত্যি জেনেই ভালোবেসেছি৷ আপনি জানেন, আপনি সেদিন হারিয়ে যাওয়ার পর আমি আপনাকে কত খুঁজেছি? আমি জানিনা আপনি ঠিক কত সময় আমার সাথে, আমার পাশে থাকবেন। কিন্তু আমি আপনার শেষ সময় অব্দি আপনার পাশে থাকব। আপনাকে ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যাব না। আপনার সব অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো পূর্ণ করার চেষ্টা করব। অনেক ভালোবাসব। অনেক বেশি ভালোবাসব, আমার স্রোতস্বিনীকে।”
স্রোতের গলা কাঁপছে। কথা আটকে আসছে। চোখের পানি গুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ধারার চোখেও পানি। দুজনেই কাঁদছে। কান্নার মাঝে ধারা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,
“এই আপনি কাঁদলে আপনাকে একদম পেঁচার মতো লাগে। একদম কাঁদবেন না। পেঁচার দল আপনার খোঁজ পেয়ে আপনাকে তাদের সঙ্গী ভেবে তুলে নিয়ে যাবে।”
ধারার কথা শুনে স্রোত অনিচ্ছা স্বত্তেও হেসে উঠল। তা দেখে ধারা মোলায়েম স্বরে বলল,
“আপনি সবসময় হাসবেন, স্রোত৷ আপনাকে হাসিতেই মানায়। কান্না আপনার চোখে মানায় না।”
স্রোত হাসল অল্প করে। ধারা পুনরায় বলে উঠল,
“এই দেখুন এত বকবক করতে করতে আপনাকে যে একটা কথা বলব, সেটাই ভুলে গেছি।”
স্রোত হেসেই জিজ্ঞেস করল,
“কি যেন একটা রিকুয়েষ্ট করবেন বলছিলেন?”
ধারা একটু সময় নিল। তারপর শান্ত স্বরেই বলল,
“আমার কিছু ইচ্ছে আছে। আছে বলতে আগে ছিল না। হঠাৎ করেই হলো। তার মধ্যে প্রথম ইচ্ছেটা হলো, এখন আপনি আমাকে আপনার পছন্দের একটা গান শুনাবেন। আমি কিন্তু এখন অব্দি আপনার গান শুনিনি। সেদিন খুব ইচ্ছে হয়েছিল আপনার গান শোনার। কিন্তু ইচ্ছাটা পূরণ হয়নি। আজ পূরণ করে দিবেন, স্রোত?”
স্রোত হাসল। বলল
“অবশ্যই! আমার স্রোতস্বিনী একটা আবদার করেছে আর আমি সেটা পূরণ না করে থাকি কিভাবে?”
ধারা মিষ্টি করে হাসল। তা দেখে স্রোত বলে উঠল,
“এভাবে হেসো না, স্রোতস্বিনী। বুকে ব্যাথা করে যে।”
কথাটা শুনে ধারা উচ্চস্বরে হেসে উঠল। মেয়েটাকে দেখে কে বলবে যে, মেয়েটা অসুস্থ। অদ্ভুত এক চঞ্চলতা মেয়েটার চোখে, মুখে ফুটে উঠেছে। স্রোত সেদিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে। খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস? কেউ থাকতে চেয়েও পারছেনা। আর কেউ রাখতে চেয়েও রাখতে পারছেনা। স্রোত যতবার নিজেকে শক্ত করে। ততবার ধারার মুখশ্রী স্রোত’কে দূর্বল করে দেয়। স্রোতকে চুপ থাকতে দেখে ধারা বলল,
“শুরু করুন, জনাব। আপনার গান শোনার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি। আর কত অপেক্ষা করাবেন?”
স্রোত কিছু না বলে উঠে গিয়ে গিটারটা নিয়ে আসল। ধারার সামনে চেয়ার নিয়ে বসল। গিটারে সুর তুলতে লাগল আপনমনে। ধারা গালে হাত দিয়ে চেয়ে আছে স্রোতের দিকে। স্রোত চোখ বন্ধ করে গাইতে শুরু করল,
শ্রাবণ ধারায় এত চেনা কি খুঁজে পাও?
যা আমার মাঝে নেই এক বিন্দু পরিমানও
আমার সরল রেখায় চিন্তাধারায়
আড়া-আড়ি করে দাগ কাট কেন?
নাকি কাঁদিয়ে আমাকে সেই চোখের জলে ভিজো
তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে শুধুই আমি মরিচিকার মতো..

তবে তাই যদি হয়, করি না-কো ভয়
জানি আধার রাত ঘনিয়ে হবে,সূর্যোদয়
আমি ভেবে নিলাম, তুমি সেই লালগোলাপ
যারে নিরন্তর পাহারা দেয় এক কাঁটার বাগান…

এতক্ষণ স্রোত চোখ বন্ধ করে গান গাইছিল। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না। গান গাওয়া থামিয়ে দিয়ে রুম থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। ধারার চোখ অশ্রুসিক্ত। স্রোত যে নিজের চোখের পানি লুকাতে এভাবে বেরিয়ে গেল তা ধারা বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে। ধারা ইচ্ছে করেই স্রোতকে আটকালো না। ছেলেটার যদি কান্না করে একটু হালকা হতে চায় তাহলে তাই হোক। ধারা কিছু একটা ভেবে ডুঁকরে কেঁদে উঠল। কান্নারত স্বরে নিজে নিজেই বলে উঠল,
“এত ভালোবাসা পেয়েও আমাকে হারিয়ে যেতে হবে, কেন? এই ক্ষনিকের সুখ যে আমি কখনোই চাইনি। আমি যে, থাকতে চাই স্রোত। আপনার কাছে, আপনার ভালোবাসার ছায়াতলে। কিন্তু প্রকৃতি বড্ড নিষ্ঠুর। আমাকে থাকতে দিবেনা আপনার কাছে। কেড়ে নিবে। আলাদা করে দিবে আমাদের।”

#চলবে

#স্রোতস্বিনী
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পার্ট_শেষ (শেষাংশ)

মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। হসপিটালের ফাঁকা ছাদে হাটু ভেঙে বসে কাঁদছে স্রোত। আকাশটাও স্রোতের সাথে তালে তাল মিলিয়ে কাঁদছে বোধহয়। স্রোত কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল,
“আমাকে কেন সবসময় শুধু হারাতে হয়। আমি যেই জিনিসটা মন থেকে চাই। সেই জিনিসটাই সবার আগে হারিয়ে যায়। কেন? কেন? কেন?”
ছেলেটা আজ কাঁদছে। মন খুলে কাঁদছে। ভেতরে জমে থাকা কষ্ট গুলো চোখের পানিতে বির্সজন দিচ্ছে। প্রায় অনেকক্ষণ যাবৎ স্রোত এখানে বসে আছে। সারা শরীর ভিজে একাকার অবস্থা। তবুও উঠছে না। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। মাত্র কয়েকদিনে কাউকে মনে এতটা জায়গা দিয়ে দিবে তা স্রোত ভাবতেও পারেনি। প্রথম দিন থেকেই তো জানত, যে ধারা ক্যান্সারের রুগী। তার মানে এর শেষটা অনিশ্চিত ছিল। সব জেনেও এখন কেন এত কষ্ট হচ্ছে? স্রোতের হঠাৎ মাথায় এলো। ধারা অনেকক্ষণ যাবৎ একা আছে। তাই উঠে, রওনা হলো সেদিকে।


ধারার বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে। ভেতরের কষ্টগুলো ওকে আরো বেশি দূর্বল করে দিচ্ছে। বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছে জাগছে মনের ভেতর। মনে মনে উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করছে যেন, এই যাত্রায় ও বেঁচে যায়। আরো কয়েকবছর যেন স্রোতের কাছে থাকতে পারে। একসাথে পথ চলতে পারে। কিন্তু সে ইচ্ছা বোধহয় পূরণ হওয়ার নয়। এসব ভাবতে ভাবতে ধারা টের পেল ও নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুকের ভেতরে ব্যাথা করছে। ধারা জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারছে না। হঠাৎ এমন হচ্ছে কেন, বুঝতে পারছে না৷ কোনো রকম অক্সিজেন মাস্কটাকে মুখে চে’পে ধরল। কয়েক সেকেন্ড পর এবার একটু শান্তি লাগছে। ধারা চোখ বন্ধ করে রইল। দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে, ধারার হাতের সময় ফুরিয়ে আসছে। ধারা মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল আর কিছু সময় যেন উপরওয়ালা ওকে দেয়। অনেক কিছু বলা বাকি স্রোতকে। ধারার ভাবনার মাঝেই স্রোত ভেতরে ঢুকল। ধারার চোখে পানি, মুখে অক্সিজেন মাস্কটা দেখে বুকটা কেঁপে উঠল। ছুটে এসে ধারার পাশে বসে হাতটা আকঁড়ে ধরল। কাঁপা-কাঁপি স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“ধারা, কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ করেছে? ডাক্তার ডাকব?”
বলেই ‘ডাক্তার, ডাক্তার’ বলে ডাকতে শুরু করল। ধারা স্রোতকে হাতের ইশারায় থামতে বলল। মুখের থেকে অক্সিজেন মাস্কটা খুলে নিয়ে বলল,
“এত চিন্তা করার কারণ নেই, জনাব। আমি ঠিক আছি। আপনি শান্ত হোন।”
স্রোত শান্ত হতে পারল না। পুনরায় চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করল,
“সত্যি, ঠিক আছো তুমি? ”
ধারা হাসল। কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানে হেসে বলল,
“আপনি আমার পাশে থাকুক। আমি একদম ঠিক থাকব। আমার থেকে দূরে যাবেন না, স্রোত।”
শেষের কথাটুকু অনেকটা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল ধারা। স্রোত বুঝতে পারল ধারা ভয় পাচ্ছে। ধারাকে আশ্বস্ত করতে বলল,
“আমি আপনার পাশেই আছি, স্রোতস্বিনী। একদম ভয় পাবেন না।”
ধারা বোধহয় শান্ত হলো। কিন্তু মেয়েটার মনে যে মৃ’ত্যুর ভয়৷ এই ভয় স্রোত দূর করবে কীভাবে? এই ক্ষমতা যে, ওর নেই। স্রোতের কেমন যেন, অস্থির লাগছে। বুকের ভেতরটা ভয়ে দুমড়ে মুচড়ে আসছে। সবকিছু হঠাৎ অশান্তিতে ভরে উঠল। কিন্তু হঠাৎ কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছেনা স্রোত। স্রোতের ভাবনার মাঝে ধারা ‘স্রোত’ নামে ডেকে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য স্রোত থমকে গেলো। এই ডাকটার মাঝে অসহায়ত্বের ছোঁয়া পাচ্ছে। এই কয়েকদিনে ধারা কখনো স্রোতকে এতটা অসহায় ভাবে ডাকেনি। স্রোত উত্তর না দিয়ে অপলক চেয়ে রইল।
ধারা বলে উঠল,
“কিছু মনে না করলে, একটা আবদার করব?”
স্রোত সাথে সাথে উত্তর দিল,
“স্রোতস্বিনীকে আবদার করার অধিকার আমি দেইনি। শুধু আদেশ করার অধিকার দিয়েছি।”
স্রোতের কথায় ধারা হেসে উঠল। মৃ’ত্যু পথযাত্রী কোনো মানুষ যে এতটা সুন্দর, প্রানবন্ত, চমৎকার ভাবে হাসতে পারে স্রোতের জানা ছিল না। ধারা হাসি থামিয়ে স্রোতের চোখে চোখ রাখল। মলিন স্বরে বলল,
“আপনাকে জড়িয়ে ধরার তীব্র ইচ্ছা আমার মন, মস্তিষ্কে বাসা বেঁধেছে, স্রোত। এই লোভাতুর ইচ্ছাটাকে দমিয়া রাখার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি কি আপনার বক্ষস্থলে আমাকে একটু জড়িয়ে নিবেন, স্রোত?”
স্রোত যেন থমকে গেলো। না চাইতেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল অজান্তে। নয়ন থেকে অশ্রুকণা গুলো গড়িয়ে পড়া শুরু করল। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না। ধারাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বুকের মাঝে। ধারার কাঁধে মুখ গুঁজে নিরবে অশ্রু বির্সজন দিতে লাগল। ধারাও কাঁদছে। মন খুলে কাঁদছে। মন খুলে কাঁদার জন্যও একটা আশ্রয়স্থল দরকার হয়। এতদিন, এতবছর পর আবার ধারা সেই আশ্রয়স্থল খুঁজে পেয়ে, মন খুলে কেঁদে নিচ্ছে। যদি আর কখনো কাঁদার সুযোগ না পায় তাহলে যে, অনেক অপূর্ণ ইচ্ছা নিয়ে মরে গিয়েও মেয়েটা শান্তি পাবে না। ধারা কাদঁতে বলে উঠল,
“আমি আপনার বুকের মাঝেই থাকতে চাই, স্রোত। সারাজীবন থাকতে চাই। রাখবেন আমাকে?”
স্রোত উত্তর দিলো না। কি-ই-বা উত্তর দিবে৷ উত্তর দেওয়ার মতো কোনো ভাষা নেই স্রোতের কাছে। ধারা পুনরায় বলে উঠল,
“ছোটবেলা থেকে হাজারটা কষ্ট, অপূর্ণ ইচ্ছা, অবহেলা নিয়ে বড় হয়েছি। যখন আমার খুব খারাপ লাগত৷ কষ্ট হতো তখন কাউকে পাইনি। কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেও পারিনি। ভার্সিটিতে উঠে রাহাতের সাথে বন্ধুত্ব হলো। বন্ধুত্ব থেকে সম্পর্কটা আস্তে আস্তে ভালোবাসায় পরিনত হলো। রাহাত খুব ভালো ছিলো জানেন। আমাকে খুব বেশি ভালোবাসত। আমাদের হাসি,আনন্দে ভালোবাসায় কেটে গেছিল তিনটি বছর। এই তিনটি বছরে একবারের জন্যও মনে হয়নি, রাহাত আমাকে ভালোবাসেনা। ওর চোখে আমি আমার জন্য সত্যি সত্যি ভালোবাসা, সম্মান, যত্ন দেখেছিলাম। এত আনন্দ, ভালোবাসা, সম্মান পেয়ে ভেবেছিলাম আমার জীবনের সব দুঃখ, কষ্টের অবসান ঘটল বোধহয়। কিন্তু, উপরওয়ালা যে আমার কপালে সুখ না লিখে দুঃখ লিখে রেখে দিয়েছিলেন, তা বুঝতে পারিনি। একদিন হঠাৎ করে নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। রাহাত পাগলের মতো করতে লাগল। ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। বিশ্বাস করুন, তিনবছর পর সেদিন আমার প্রিয় মানুষটার আসল রুপ দেখেছিলাম। সেদিনের পর চোখের সামনে চেনা মানুষটাকে অচেনা হয়ে যেতে দেখলাম। সম্পূর্ণ রুপে বদলে গেলো মানুষটা। আর আমি আবার একা হয়ে গেলাম। তারপর থেকে বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই হারিয়ে গেলো। আস্তে আস্তে নিজেকে বন্দী করে নিলাম একা ঘরে। সবরকম চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়ে নিজের মতো বাঁচতে লাগল। এভাবেই কে’টে গেছে এই এক বছর। এক বছরে আমার শরীরের কন্ডিশন দিনদিন খারাপ হয়েছে। তবুও আমার আফসোস হয়নি। মরার ভয় হয়নি। আমি শুধু দিন গুনেছি কবে আমি চোখ বুজব? কবে আমার সব কষ্টের অবসান ঘটবে? কবে আমি এই জীবন থেকে মুক্তি পাব? আমার যখন বেঁচে থাকার ইচ্ছা ছিল না। তখন আমি বেঁচে ছিলাম। অথচ দেখুন, আজ আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। কী নিষ্ঠুর এই নিয়তি! স্রোত, আমি আপনাকে ছেড়ে যেতে চাইনা। আপনার বুকে মাথা রেখে আরো কয়েক বছর বাঁচতে চাই। আমি বাঁচতে চাই, স্রোত।”
এতক্ষণ স্রোত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। এবার ধারাকে আরো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিলো। কান্নারত স্বরে বলে উঠল,
“তোমার কিছু হবে না, স্রোতস্বিনী। তুমি আমার সাথেই থাকবে। আমার বুকে থাকবে। আমরা একসাথে বাঁচব। ”
ধারা খেয়াল করল, ওর নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে। স্রোতের শার্টটা রক্তে মেখে যাচ্ছে। ধারার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাসটা বুঝি এই বন্ধ হয়ে গেল। তাও শব্দ করল না। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,
“আমাকে একবার ‘ভালোবাসি’ বলবেন, স্রোত।”
স্রোত শব্দ করে কান্না উঠল। এর মধ্যেই কেবিনে মাহিদ, মালিহা আর অয়ন হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করল। স্রোত ধারাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ওদের তিনজনের মুখেও হাসি নেই৷ মালিহার চোখের কোনে পানি টলমল করছে৷ ওরা ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে আসল। ধারা পুনরায় বলে উঠল,
” আপনার মুখের ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শুনলেও যে আমি শান্তি পাব। অন্তত নিজেকে বুঝাতে পারব যে, কেউ একজন আমাকে অন্তত সত্যিকারের ভালোবেসেছিল। আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত জেনেও আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। আমার পাশে বসে, আমাকে ভরসা দিয়েছিল। আমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদার সুযোগ করে দিয়েছিল। প্লিজ বলুন না একবার, ভালোবাসেন৷ প্লিজ স্রোত একবার বলুন , ভালোবাসি।”
স্রোত কাঁদার জন্য কথা বলতে পারছে না। মাহিদ, অয়ন, মালিহা এবার একসাথে বলে উঠল,
“স্রোত, বলে দে।”
অয়ন বলে উঠল,
“স্রোত দেরি করিস না৷ বলে দে। নিজের মনকে শান্ত কর। নিজেকে শান্ত কর।”
মাহিদ এবার বলে উঠল,
“ভালোবাসাটা মন ভরে প্রকাশ করে ফেল, স্রোত। নয়ত এই কষ্ট নিয়ে তুই বাঁচতে পারবি না। মনের ভেতরে জমানো কথাগুলো মুখ ফুটে বলে ফেল। দেরি করিস না।”
হঠাৎ ধারা কাশতে শুরু করল। তা দেখে স্রোত ধারাকে বুকের থেকে সরিয়ে নিতে চাইলে ধারা বাধা দিল। আরো জোরে স্রোতকে জড়িয়ে ধরল। অস্পষ্ট স্বরে আওড়াতে লাগল,
“ভা.ভা. ভালোবাসি, স্রোত।”
এবার স্রোত আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। জোরে বলতে শুরু করল,
“ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি আমার স্রোতস্বিনী। আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। আমাকে একা করে চলে যেওনা প্লিজ। আমার জীবনটা তাহলে এখানেই থেমে যাবে। প্লিজ ছেড়ে যেওনা, স্রোতস্বিনী। আ…।”
স্রোতের কথা বন্ধ হয়ে গেলো। টের পেলো ধারার হাত দুটো স্রোতের পিঠের থেকে সরে গেলো। এর মধ্যেই মালিহা ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার করে বলে উঠল,
“রক্ত! রক্ত! ধারা! ধারা!”
আর কিছু বলতে পারছেনা মালিহা। মেয়েটার রক্তে ফোবিয়া আছে। মালিহা কাঁপছে। মাহিদ এক হাতে মালিহাকে জড়িয়ে নিতে নিতে বলে উঠল,
“স্রোত ধারা…।”
আর কিছু বলতে পারল না। অয়ন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছে ধারা আর নেই। চোখের পলকে হঠাৎ কি হয়ে গেল বুঝতে পারল না। স্রোত চুপ করে আছে। না কাঁদছে না। কথাও বলছে না। ধারাকে ডাকছে না। বুকের থেকেও সরিয়ে নিচ্ছে না। মালিহা মাহিদের বুকে কাঁদতে কাঁদতে হামলে পড়ল। মাহিদ অয়নকে চিৎকার করে বলে উঠল,
“অয়ন ডাক্তার নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি যা।”
অয়ন দাঁড়াল না। এলো-মেলো পায়ে দৌড়ে গেল ডাক্তার ডাকতে। স্রোত এখনো আগের ন্যায় বসেই আছে। ধারা নিস্তেজ হয়ে আছে স্রোতের বুকে। মিনিটের মাথায় ডাক্তার নার্স একসাথে দৌড়ে আসল। ধারার পার্লস চেক করে বলল,
“সি ইজ নো মোর, অয়ন।”
স্রোত তাও রিয়েক্ট করল না। অয়ন অশ্রুসিক্ত চোখে স্রোতের কাঁধে হাত রাখতেই স্রোত কেঁপে উঠল। এইবার বুঝি ওর ধ্যান ফিরে আসল। নার্সিটা স্রোতের থেকে ধারাকে সরিয়ে নিতে আসতেই, স্রোত চিৎকার করে বলে মনে,
“ছোঁবেন না। একদম ছোঁবেন না আমার স্রোতস্বিনীকে। ওর কিছু হয়নি। ও একদম ঠিক আছে। দেখছেন না, ও আমার বুকে চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে। একদম ছোঁবেন না। দূরে সরুন।”
মালিহা কেঁদেই যাচ্ছে। মাহিদ মালিহাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখেও পানি। অয়ন কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তবুও সাহস করে বলে উঠল,
“স্রোত, ধারা আর নেই।”
কথাটা বলার সাথে সাথে স্রোত চিৎকার করল…
“চুপ! একদম চুপ! সর তো তুই। একদম বাজে কথা বলবি না।”
বলে ধারাকে বুকের থেকে সরিয়ে, বেডে সুইয়ে দিল। ধারার দুই হাতে হাত রেখে বলতে লাগল,
“আমার ধারা। এই ধারা। চোখ খোলো। আমার দিকে তাকাও৷ একবার চোখ খুলে তাকাও। এই তুমি না এক্ষুনি বললে, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে চাও না। তাহলে এখন কেন চলে যাচ্ছো? ধারা চোখ খোলো না, প্লিজ।”
স্রোত মুহূর্তেই পাগলের মতো করতে লাগল। কতক্ষণ ধারাকে বুকে নিচ্ছে তো, কতক্ষণ সুইয়ে দিয়ে পাগলের মতো ডাকছে। অয়ন আর মাহিদ সহ্য করতে পারল না এই দৃশ্যটা। তাই স্রোতকে ধারার বেড থেকে টেনে দূরে নিয়ে আসল। নার্সটা সাদা কাপড়ে ধারার মুখটা ঢেকে দিতেই, স্রোত চিৎকার করে বলে উঠল,
“এই! এই! এই একদম ঢাকবেন না। একদম না। ওর কিছু হয়নি।”
মাহিদ আর অয়ন কিছুতেই স্রোতকে শান্ত করতে পারছে না। ডাক্তার নার্সকে আদেশ দিল, ডেড বডিটাকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য। অয়ন আর মাহিদ মিলে স্রোতকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। স্রোত পাগলের মতো করেই যাচ্ছে।


বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। স্রোতের বাড়ির পাশের মসজিদের কবরস্থানে ধারাকে দাফন করা হয়েছে। ধারাকে হসপিটাল থেকে যখন নিয়ে আসা হলো তখন থেকে স্রোত একদম শান্ত। কাঁদেনি আর। একদম শান্ত হয়ে গেছে ছেলেটা। দাফন শেষে অয়ন, মাহিদ আর স্রোত দাঁড়িয়ে আছে ধারার কবরের পাশে। অয়ন স্রোতের কাঁধে হাত রেখে কিছু বলতে যাবে, তখনি স্রোত শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“আমাকে একটু একা থাকতে দে, প্লিজ।”
অয়ন আর মাহিদ কিছু না বলে চলে গেল। ওরা চলে যেতেই স্রোত বসে পড়ল। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। এক মুঠ মাটি নিয়ে বলতে লাগল,
“মনের কোঠরে ভালোবাসার স্রোত তুলে, হারিয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী। ভালো থেকো।”

#সমাপ্ত