স্রোতস্বিনী পর্ব-০৩

0
173

#স্রোতস্বিনী
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পার্ট_তিন

হসপিটালের বেডে ধারাকে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে স্রোতের পা জোড়া থেমে গেল। শরীররের সমস্ত শক্তি এক নিমিশেই কেমন যেম হাওয়ায় উড়ে গেল। হার্টবিট থেমে গেল বোধহয়! সেদিনের পর আজকে এই অবস্থায় ধারাকে দেখতে পাবে স্রোত কল্পনাও করেনি। স্রোতকে আচমকা দাঁড়িয়ে যেতে দেখে, মাহিদ বিরক্ত হয়ে বলে উঠল,
“তুই এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? অয়ন কোথায় আছে? কি অবস্থায় আছে খুঁজে দেখতে হবে তো?”
স্রোত সেদিকে কান না দিয়ে ছুটে গেল ধারার কেবিনে। স্রোতকে এভাবে অন্যদিকে ছুটে যেতে দেখে মাহিদ অবাক না হয়ে পারল না। স্রোত ধারার কেবিনে ঢুকতেই, নার্স রেগে প্রশ্ন ছুড়ে মা’রল,
“কে আপনি? এভাবে কেবিনে ঢুকলেন কেন?”
স্রোতের সেসবে ধ্যান নেই। ও শুধু ধারার দিকে চেয়ে আছে। মেয়েটার হাতে ক্যানোলা লাগানো। স্যালাইন চলছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। পড়নে হসপিটালের পোষাক। চোখ গুলো কেমন বসে গেছে। স্রোতকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, নার্স একটু এগিয়ে এসে আবার প্রশ্ন করল,
“কি হলো? আপনি উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”
স্রোত হকচকিয়ে উঠল। নার্সের প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে, ধারার সামনে দাঁড়াল। ধারার দিকে একটু ঝুঁকে৷ ধারার ক্যানোলাযুক্ত হাতের উপর হাত রেখে, অসহায় স্বরে বলে উঠল,
“ধারা! এই ধারা! স্রোতস্বিনী..?”
আর কিছু বলতে পারছে না। গলা আটকে আসছে ওর। মাহিদ দরজার সামনে দাঁড়ানো। স্রোতের চোখ, মুখ মাহিদ বুঝতে পারল এই সেই ধারা। যাকে স্রোত এতদিন পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছে। সেদিন প্রোগ্রাম শেষ করে ওদের ঢাকায় ব্যাক করার কথা ছিল। কিন্তু স্রোত এখনো চট্রগ্রাম পড়ে আছে। মাঝে কেটে গেছে প্রায় পনেরো দিন। এই পনেরো দিনের এমনও দিন বাদ যায়নি যে, স্রোত ধারাকে খুঁজেনি। প্রতিদিন খুঁজেছে। রাস্তার অলিতে-গলিতে খুঁজেছে। প্রতিদিন বাসস্ট্যান্ডে এসে খোঁজ নিত। ছেলেটা এই কয়েকদিনে অনেক দূর্বল হয়ে গেছে। একদিনের জন্য কেউ লাইফে এসে, কাউকে এতটা মায়ায় জড়িয়ে নিতে পারে তা স্রোতকে না দেখলে মাহিদের বিশ্বাস হতো না।
“আপনি কে বলুন তো? আপনি কি উনাকে চিনেন?”
নার্সের কথায় মাহিদ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই স্রোত জোরে বলে উঠল,
“হ্যাঁ! আমি চিনি। ও আমার ধারা। আমার স্রোতস্বিনী। যে হুট করে এসে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে, হুট করেই হারিয়ে গিয়েছিল।”
নার্স স্রোতের কথা বুঝতে না পেরে বিরক্তির স্বরে বলল,
“আপনারা কি মজা করছেন আমার সাথে? মেয়েটার অবস্থা ভালো না। আর আপনি হেয়ালী করে উত্তর দিচ্ছেন?”
নার্সের কথা শেষ হতে না হতেই মাহিদ শান্ত স্বরে বলল,
“আপনার কাছে কেন মনে হচ্ছে স্রোত মজা করছে? আপনি ওর কথা বুঝতে পারছেন না ঠিক আছে। আমি বুঝিয়ে বলছি। এইযে বেডে যেই মেয়েটা সুয়ে আছে, ওর নাম ধারা। ধারাকে আমরা কেউ ব্যক্তিগত ভাবে চিনিনা। ঢাকা থেকে বাসে আসার টাইমে ওর সাথে স্রোতের পরিচয় হয়৷ তারপর হুট করেই ধারা গায়েব হয়ে গিয়েছিল। আর সেদিনের পর থেকে স্রোত ধারাকে পাগলের মতো খুঁজে চলেছে। হঠাৎ আজ এখানে এমন অবস্থায় দেখতে পেয়ে স্রোত ইমোশনাল হয়ে গিয়েছে। তাই এভাবে কথা বলছে। আর আপনি বলছেন ও মজা করছে।”
মাহিদের কথা শেষ হতেই নার্স বলে উঠল,
“দেখুন, মেয়েটার অবস্থা ভালো না। আজ প্রায় ১৫দিন হলো মেয়েটা এখানে এই অবস্থায় পড়ে আছে। এই পনেরো দিনে আমরাও মেয়েটার পরিচয় জানার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। মেয়েটার ফোন থেকে শুধু মাত্র একটা নাম্বার পাওয়া গেছে। আমরা সেখানেও যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু ফোনের অপর পাশে থাকা ব্যক্তি জানিয়েছে, সে এই মেয়েটাকে চিনেনা । অথচ মেয়েটার কল লিস্ট জুড়ে সেই একটা নাম্বার। এবার আপনারা বলুন, আমরা কি করব?”
স্রোত এতক্ষণ সব কথা চুপচাপ শুনল। এবার শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“আমি বলছি সব।”
বলেই একটু থামল। নার্সের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“ধারা ক্যান্সারের লাস্ট স্ট্রেজের পেসেন্ট সেটা আমি জানি। আর আপনি যেই ব্যক্তির কথা বলছেন সে ধারার প্রাক্তন। তিন বছরের সম্পর্ক ছিল ওদের। ধারার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর ছেলেটা বিচ্ছেদ বেছে নেয়। আমার জানামতে ধারার কেউ নেই খোঁজ নেওয়ার মতো৷ ছোটবেলায় একটা এক্সিডেন্টে ধারার বাবা-মা সহ পরিবারের সবাই মারা যায়। ওর অন্যান্য আত্মীয়জনরাও ওর দায়িত্ব নিতে চায়নি। ছোট বেলা থেকেই ধারা এতিমখানায় বড় হয়েছে। খোঁজ নেওয়ার মতো ওই একজনেই ছিল ধারার জীবনে। সেও হারিয়ে গেছে। এখন মেয়েটাও হারিয়ে যেতে বসেছে। ”
কথাগুলো বলতে বলতে স্রোতের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। নার্সের চোখেও পানি টলমল করছে। আর মাহিদ অবাক পানে স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে। স্রোত এত কিছু জানে ধারার ব্যাপারে, অথচ সেদিন তো এইসব বলল না। মাহিদ অবাক স্বরে বলল,
“এতকিছু তুই কিভাবে জানিস?”
স্রোত উত্তর দিল,
“ধারার মুখ থেকেই শুনেছি৷”
নার্স এবার বলে উঠল,
“তাহলে কী মেয়েটা এভাবে বিনা চিকিৎসায় মর’বে?”
সাথে সাথে স্রোত বলে উঠল,
“না! আমি থাকতে এটা কখনোই হবে। জন্ম, মৃত্যু সব তো উপরওয়ালার হাতে। তাহলে আপনি এত শিওর হয়ে কিভাবে বলছেন যে, ধারা ম’রে যাবে?”
স্রোতের কথায় নার্স নরম সুরে বলল,
“দেখুন, মেয়েটার অবস্থা ভালো না। আপনারা যদি চান তাহলে উনাকে ভালো কোনো হসপিটালে নিয়ে যেতে পারেন। তাহলে হয়ত মেয়েটা আরো কয়েক মাস বেঁচে থাকবে। আর কিছু বলার মতো ভাষা নেই আমার।”
বলে নার্স বেড়িয়ে গেলেন৷ মাহিদ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে অয়নের একটা ছোটখাটো এক্সিডেন্ট হয়৷ সেই খবর পেয়েই ওরা দুজন হসপিটালে ছুটে এসেছিল। আর এসে যে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়বে মাহিদ ভাবতে পারিনি। স্রোত নিস্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহিদ এগিয়ে গিয়ে স্রোতের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল,
“ঠিক আছিস তুই?”
স্রোত মাথা নাড়াল। অর্থাৎ ‘হ্যা’। মাহিদ এবার নরম সুরে বলল,
“চিন্তা করিস না, ভাই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আছি তো। তোর সব পরিস্থিতিতে আমি তোর পাশে যেমনে আগেও ছিলাম, এখনো আছি, আর ভবিষ্যতেও থাকব৷ তুই ভেঙে পড়িস না, প্লিজ। আমরা চেষ্টা করব। ধারাকে এত সহজে আর হারিয়ে যেতে দিব না। শেষ দিন অব্দি চেষ্টা করব। তুই চিন্তা করিস না, ভাই আমার।”
স্রোত মনোযোগ দিয়ে মাহিদের কথাগুলো শুনল। নিজেকে এই মুহূর্তে ভাগ্যবান মনে হলো। বিপদের সময় কাঁধে হাত রেখে ভরসা দেওয়ার মতো বন্ধু খুব কম মানুষের জীবনের আছে৷ স্রোত সেদিক দিয়ে খুব ভাগ্য করে, ওদের মতো বন্ধু পেয়েছে। স্রোত কিছু না বলে মাহিদকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,
“তোরা আছিস বলেই আমি শক্তি পাই। তোদের জন্যই আমি আজ এত দূর।”
মাহিদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। স্রোত ভালো ফ্যামিলির ছেলে। স্রোতের বাবা একজন ডাক্তার। স্রোত নিজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। স্রোতের ফ্যামিলির কেউ স্রোতের এই গান গেয়ে বেড়ানোটাকে ভালো চোখে দেখে না৷ তাই এক বছর যাবৎ স্রোত হোস্টেলে উঠেছে। এই এক বছর স্রোতের পাশে ছায়ার মতো ছিল মাহিদ, অয়ন। স্রোত মাহিদকে ছেড়ে বলে উঠল,
“তুই এক কাজ কর। তুই অয়নের কাছে যা। অয়ন কি অবস্থায় আছে আমাকে দ্রুত জানাবি। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে ধারার ব্যাপারটা সামলে নিচ্ছি। তুই কিন্তু গিয়েই আগে আমাকে অয়নের অবস্থা জানাবি। দ্রুত যা।”
স্রোত মাহিদকে সব বুঝিয়ে অয়নের কাছে পাঠাল। আর স্রোত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধারার কাছে গিয়ে বসল। ধারার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠল,
“উপরওয়ালা না চাইলে তো গাছের পাতাও নড়ে না। তাহলে কি ধরে নিব, তোমার আমার এই অল্পসময়ের পরিচয়টাও, তার ইচ্ছায়? তোমাকে যখন আমার জীবনে পাঠানোই ছিল, তাহলে আরো কেন পাঠালো না স্রোতস্বিনী। আমি যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমার চোখের সামনে তুমি তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাবে, এটা আমি মানব কি করে? কেন এলে তুমি এই অল্পসময়ের জন্য আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিতে?”

#চলবে